জামাই শ্বশুর পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
920

#জামাই_শ্বশুর (অন্তিম পর্ব)
#সাদিয়া

নাজিম সাহেবের বৈঠক ঘর মানুষে গিজ গিজ করছে। নাজিম সাহেব গালে হাত ঠেকিয়ে সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন। তার সামনের সোফায় বসে আছেন ইফাদের বাবা ইকবাল হাসান। তিনি বারবার ছেলে ইফাদের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। তার মুখ দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে তার এখন ইফাদের গালে সপাটে এক রাম থা’প্প’ড় বসিয়ে দিতে মন চাইছে।
ইফাদ খুব আরাম করে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। বসে আছে বললে অবশ্য ভুল হবে। কারণ সে রীতিমতো ঝিমাচ্ছে। সে যতবার ঝিমিয়ে হেলে পড়েছে ততবার তৃপ্তি তাকে চি’মটি দিয়ে সোজা হয়ে বসতে সাহায্য করছে।
সকল নিরবতা ভাঙে নাজিম সাহেব এবার বললেন,
–তৃপ্তি তুই ইফাদের সাথে কি করেছিস?
বাবার কথায় তৃপ্তি অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
–আমি আবার কি করলাম বাবা? আমি তো কিছুই করিনি।

–তুই কিছু না করলে ইফাদ এভাবে এখানে ছুটে আসলো কেন?

–নিজেকে বাঁচাতে।
ফোঁড়ন কে’টে বললো ইফাদ। ইফাদের কথায় তিন জোড়া চোখ তার দিকে নিবদ্ধ হলো। ইফাদ সেদিকে বিশেষ পাত্তা দিলো না।

–তৃপ্তি তুই কি ইফাদের সাথে কোনো খারাপ আচরণ করেছিস?

–কি আবোলতাবোল বলছো বলো তো বাবা? আমি ওর সাথে খারাপ আচরণ কেন করতে যাবো?
ইফাদ এবার তেঁতে উঠলো তৃপ্তির কথায়।
–তুমি যে কালকে রাত দুইটায় আমাকে রুম থেকে বের করে দিলে এটা কোন আমলের ভালো কাজের আওতাভুক্ত শুনি?

–আমি কি এমনি এমনি তোমাকে বের করে দিয়েছিলাম নাকি? তুমি প্রচন্ড বাজে ভাবে নাক ডাক ঘুমের মধ্যে। তোমার জন্য আমার ঘুমের অসুবিধা হয়। তাইতো তোমাকে বের করে দিয়েছিলাম। আর তুমি এসির পাওয়ার কম করে দিয়ে কম্বল নিয়ে ঘুমাও এটা কেমন কথা হলো? তুমি জানো যে আমি এসিতে ঘুমাতে পারি না। তবুও তুমি এই কাজটা আার বার শত বার হাজার বার প্রতি বার করো।

–আমার বাড়ি আমার ঘর। আমি নাক ডাকবো মনচায় নিজের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ডাকবো। তাতে তোমার কি পা’ষণ্ড মহিলা? আর এসির কথা কি বললে? আরে ঘরের এসি তো তোমার দখলেই থাকে। কালো যা’দু করে তো আমার স্যামসাং এসির রিমোটটাই ঘা’য়েব করে দিয়েছো তুমি।

–বেশ করেছি।

–আমার বাড়িতে থেকে আমার মহামূল্যবান জিনিস ঘা’য়েব করে বলছো বেশ করেছো? তুমি তো বড্ড পা’ষ’ণ্ড।

–এই বাড়িটা তোর কবে থেকে হলো রে বাদ’র? বাড়িটা এখনো আমার নামে আছে ভুলে যাস না।

বাবার কথায় মিইয়ে গেলো ইফাদ। নিচু স্বরে বললো,
–বাড়িটা তোমার হলেও রুমটাতো আমার ছিলো তাই না?

–ঠিক বলেছো। রুমটা তোমার ছিলো। সেটা বিয়ের আগে পর্যন্ত। এখান রুমে ততটা তোমার অধিকার ততটাই অধিকার তৃপ্তির রয়েছে।
মায়ের কথায় মুখ ব্যা’কা’লো ইফাদ।
একে একে সকলে ইফাদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ তুলে ধরেন। নাজিম সাহেব সকলের অভিযোগ শুনে কিয়ৎক্ষণ চুপ রইলেন। যেভাবেই হোক ওদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে ইফাদকে নিজের বাড়ি পাঠাতে হবে। এভাবে তো আর শ্বশুর বাড়িতে পরে থাকা যায় না তাই না?
–দেখুন সবই তো বুঝলাম। কিন্তু ইফাদ তো আপনাদের নিজের ছেলে তাই না? ও নাহয় একটা ভুল করেইছে।

–ভুল? কোনটাকে ভুল বলছেন আপনি? এটাকে ভুল নয় বরং অন্যা’য় করা বলে।

–আচ্ছা ঠিক আছে। মানলাম ইফাদ অন্যায় করেছে। তা ওকে কি একবার ক্ষমা করা যায় না। ক্ষমা করা তো মহৎ গুন। ক্ষমাকারীকে আল্লাহ্ তায়ালা অধিক পছন্দ করেন।

–ক্ষমা করতে বলছেন ওকে?

–হ্যাঁ ভাই। এবারের মতন ওকে ক্ষমা করে দিন। ইফাদের হয়ে আমি আপনার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাইছি। ওকে ক্ষমা করে দিয়ে দয়া করে ওকে আপনাদের সাথে নিয়ে যান।
নাজিম সাহেবের এরুপ কথায় তৃপ্তি ইফাদের দিকে তেড়ে এলো। আর বললো,
–দেখো ইফাদ দেখো। তোমার জন্য আমার বাবাকে কতটা অপমানিত হতে হয়েছে একবার দেখো। শেষ বয়সে এসে কি আমার বাবার এই অপমানটা পাওনা ছিলো ইফাদ? তোমার জন্য শুধু মাত্র তোমার জন্য আমার বাবা কারো কাছে ক্ষমা চাইছে। তোমাকে তো আমি এত সহজে ছাড়বো না ইফাদ হাসান।

–আমি কি উনাকে বলেছি আমার হয়ে কারো কাছে ক্ষমা চাইতে? উনি নিজেই তো আগ বাড়িয়ে ওই হৃদ’য়হীন দম্পতির কাছে ক্ষমা চাইলেন যাদের জীবনে নিজের ছেলের কোনো মূল্য নেই। ওনাকে আমি বলিনি ক্ষমা চাইতে। উনি নিজেই পণ্ডিতি করে নিজের অসম্মান নিজে ডেকে এনেছে।
মুখ বাঁকিয়ে বললো ইফাদ। নাজিম সাহেব ইফাদের কথায় বোকা বনে গেলেন। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে “যার জন্য করলাম চু’রি সে-ই বলে চো’র”। প্রবাদ বাক্যটা যেন নাজিম সাহেবের জন্যই। নাজিম সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস গোপল করে ইফাদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
–বাবা ইফাদ আর কথা বাড়িয়ো না। তোমার বাবা মা এসেছেন তাদের সাথে নিজের বাড়ি ফিরে যাও।
এবার নাজিম সাহেব বেয়াই ইকবাল হাসানকে বললেন,
–ভাই ওকে ক্ষমা করে দিয়ে নিয়ে যান। ও আর কোনো অন্যা’য় করবে না।
নাজিম সাহেবের কথা ইকবাল হাসানের পুরোপুরি বিশ্বাস হলো না। কারণ নিজের ছেলেকে তিনি খুব করে চেনেন। মীর জাফর এসে যদি বলে তাকে বিশ্বাস করতে ইকবাল হাসান করে নেবেন বিশ্বাস। কিন্তু যেখানে বিষয় ইফাদ নাম রাম ছাগ’লকে বিশ্বাস করা যেখানে তিনি বড্ড উদাসীন। এই ছেলের কোনো বিশ্বাস নেই। এমনিতে ভালো হলেও কেমন যেন বা’উণ্ডু’লে টাইপের ছেলে। ইফাদকে সাথে নিয়ে যেতে তিনি শতভাগ রাজি নন। তবুও নাজিম সাহেবের কথায় ইফাদকে বললেন,
–এই বাদর বাড়ি চল আমাদের সাথে।

–আমি যাব না।
ইকাবাল হাসানের কথায় বললো ইফাদ। ইকবাল হাসান ইফাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
–কেন যাবি না?

–কবি বলেছেন, যেখানে মানুষের মূল্য নেই যেখানে না যেতে। ওই বাড়িতে আমার কোনো মূল্য নেই। তাই আমি যাবো না।

ইকবাল হাসানের কিছু বলার আগেই নাজিম সাহেব ইফাদকে বললেন,
–বাবা ইফাদ আপনজনদের সাথে এত অভিমান করতে হয় না বাবা। যত যাই হোক উনারা তো তোমার নিজের বাবা-মা তাই না। তাদের উপর এতটা অভিমান করে থেকো না তুমি।
নাজিম সাহেব ইফাদকে রাজি করানোর শত চেষ্টা চালাতে লাগলেন। কিন্তু ইফাদ নিজের সিদ্ধান্তে বদ্ধ পরিকর। যে ও বাড়িতে যাবে না মানে যাবে না।
–থাক তুই এখানে। তোর যাওয়া লাগবে না আমাদের সাথে। আমরা তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উতলা হচ্ছি না। এমনিতেও তুই আমাদের কোনো কাজের না। অ’কর্মা একটা।

–যাও যাও। আমি লাগে তোমাদের সাথে যাওয়ার জন্য উতলা হচ্ছি।
ইকাবাল হাসান আর ইফাদের কথায় নাজিম সাহেব পড়লেন মহা বি’পদে। যেমন করেই হোক ইফাদকে আজকে বাড়ি পাঠাতে হবে। বাই হুক অর বাই ক্রুক।
–ইফাদ! বাবাজীবন আমার! এমন কেন করছো বলো তো? তুমি কি অন্যের বাড়িতে যাবে নাকি? যাবে তো নিজের বাড়ি। আর এক বাড়িতে এক ঘরে থাকে গেলে এমন একটু আধটু সমস্যা হয়। এক সাথে থাকতে গেলে মানিয়ে নিতে হয়। একটু মানিয়ে নিলে দেখবে সম্পর্কটা মধুর হয়ে গেছে।

–ঠিক বলেছেন বাবা। আই এ্যাগ্রি উইথ ইউ। কিন্তু শুধু এক পক্ষের মানিয়ে নেওয়াতে তো আর সম্পর্ক মধুর হয় না। সবাইকে এগিয়ে আসতে হয়। কিন্তু ওই বাড়িতে এমনটা হয় না। সবসময় সবকিছু আমাকেই মানিয়ে নিতে হয়। যেমন আমি সেনসোডাইন ছাড়া দাঁত ব্রাশ করতে পারি না। কিন্তু আপনার মেয়ের পছন্দ পেপসোডেন্ট। আপনার মেয়ের পেপসোডেন্ট পছন্দ বলে আমাকে নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে ওই পেপসোডেন্ট দিয়েই দাঁত ব্রাশ করতে হয়। আবার আমার লাক্স হাজারো ফুলের সৌরভ দিয়ে গোসল করতে ভালো লাগে। আহা আহা কি এ্যারামা! কিন্তু এখানেও আপনার মেয়ে শনি হয়ে আছে। তার আবার লাক্স হাজারো ফুলের সৌরভ পছন্দ না। তার পছন্দ ডাভ সাবান। অগত্যা আমাকেও ডাভ দিয়ে গোসল করতে হয়। এখানেই শেষ নয় আরো আছে..
ইফাদকে আর কিছু বলতে দিলেন না নাজিম সাহেব। ইতিমধ্যে ইফাদের কথায় তার মাথা চক্কর দিতে শুরু করে দিয়েছে।
–এসব এখন থাক ইফাদ। এগুলো তো কোনো সমস্যা না। মাঝে মাঝে ব্রান্ড বদলাতে হয়। এতে স্কিন ভালো থাকে। জানোই তো মেয়েরা নিজেদের স্কিন নিয়ে কতটা প্রোকেক্টিভ থাকে। আর তুমি কি চাও না তোমার বউয়ের স্কিন সুন্দর থাকুক?
ইফাদ মাথা দুলাল। অর্থাৎ সে চায় তার বউয়ের স্কিন সুন্দর থাকুক। এলিডি বাতির মতন চকচক করুক। ইফাদের মাথা দুলানোতে নাজিম সাহেব গোপনে স্বস্থির নিঃস্বাস ফেললেন।
–এবার যেতে আপত্তি নেই তো তোমার?

–আছে।

–আবার কিসের আপত্তি তোমার?
বেশ অসহায় আর কাতর কণ্ঠে জানতে চাইলেন নাজিম সাহেব।
–ওই বাড়িতে আমি যাবো। কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে।

–কি শর্ত?

–শর্ত নম্বর এক. আমাকে ওই বাড়িতে যথাযথ সম্মান দিতে হবে। দুই. আমাকে কোনো প্রকার মানসিক বা শারীরিক টর্চার করা যাবে না। তিন. কথায় কথায় আমাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া যাবে না। চার. আমাকে নিজের পছন্দ মতন টুট্থপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে দিতে হবে।
এক এক করে এমন আরো কতগুলো উদ্ভট শর্ত ইফাদ নাজিম সাহেবের নিকট পেশ করলেন। নাজিম সাহেব একটু সময় নিলেন নিজেকে সামলানোর। অতঃপর ইফাদকে আস্বস্থ করলেন তার যুক্তিযুক্ত শর্তগুলো পূরণ করা হবে। তার দায়িত্ব নাজিম সাহেবের। অনেক কাঠ খর পুড়িয়ে অনেক কেরোসিন খরচ করে নাজিম সাহেব ইফাদকে বাড়ি যেতে রাজি করালেন।
–যাও নিজের বাক্স-পোটলা নিয়ে এসো ঘর থেকে।
ইফাদ শ্বশুরের বাধ্য জামাইয়ের মতন নিজের বাক্স-পোটলা সমেত চললো নিজের বাড়ি। ইফাদ এবং তার পরিবার চলে যেতেই নাজিম সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তুশিকা বেগমের কাছে এক গ্লাস পানি চেয়ে তিনি সোফায় গা এলিয়ে বসলেন। ওমনি বিকট শব্দে বাসার কলিং বেল বাজতে শুরু করলো। নাজিম সাহেব অনেক কষ্টে নিজের ক্লান্ত শরীরটা সদর দরজা পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেন। দরজা খুলতেই তার সামনে ভেসে উঠলো ইফাদের চাঁদ বদন। নিজের দোরগোড়ায় আবারো ইফাদকে দেখে নাজিম সাহেবের চোখের সামনে আজকে সারাদিনের চিত্রগুলো কেমন যেন ভাসতে লাগলো। আর কিছু ভাবতে পারলো না তার মস্তিষ্ক আর কিছু দেখতে পারলো না আর নয়ন জোড়া। কারণ ততক্ষণে তিনি নিজের জ্ঞান হারিয়ে ইফাদের বুকে ঢলে পড়লেন।
নাজিম সাহেবের এমন আচমকা অজ্ঞান হওয়ার কারণ বুঝতে পারলো না ইফাদ। এদিক সেদিক চোখ ঘুরাতেই ইফাদের নজর পড়লো নিজের পাশে থাকা তার বাক্স-পোটলার দিকে। ইফাদ একবার নাজিম সাহেব আর একবার নিজের বাক্স-পোটলার দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবলো। অতঃপর সমীকরণ সমাধান করতে পেরে ভুবন ভুলানো হাসি দিলো ইফাদ। সাথে মনে মনে আওড়ালো,
–আপনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শ্বশুর বাবা। নোবেল এ্যাসোসিয়েশন যদি শ্রেষ্ঠ শ্বশুরের জন্য পুরষ্কার দিতো তাহলে তার একমাত্র হকদার থাকতেন আপনি। ইউ আর টু মাচ ভালো শ্বশুর আব্বা।
বলেই শব্দ করে নাজিম সাহেবের বাম গালে একখানা পাপ্পি দিয়ে দিলো ইফাদ।
।। সমাপ্ত।।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে