জামাই শ্বশুর পর্ব-০১

0
1221

#জামাই_শ্বশুর [১]
#সাদিয়া

নাজিম সাহেব একজন ষাটোর্ধ প্রৌঢ় ব্যক্তি। তিন মাস আগেই দীর্ঘ চাকরি জীবনের ইতি টানলেন। তার তিন মেয়ে। ছেলে নেই। তিন মেয়েকেই শিক্ষিত করেছেন সাথে ভালো ঘরে বিয়েও দিয়েছেন। তিন মেয়ের জামাই যেন একেকজন একেকটা রত্ন। সকলেই ভালো বেতনের চাকরি করেন। স্বামী আর শ্বশুর বাড়ি নিয়ে মেয়েদের কোনো অভিযোগ নেই। নিঃসন্দেহে তিন মেয়েই নিজের বিবাহিত জীবনে সুখী।
তিনি সকল দিক থেকে এখন চিন্তা মুক্ত। তার জীবনে এখন আর কোনো প্যারা থাকার কথা নয়।
যাইহোক, দিনটা শুক্রবার। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। বাইরে ঝলমলে রোদ উঠেছে। নাজিম সাহেব হাতে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে স্ত্রীকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
–আমি বাজারে যাচ্ছি। কি কি আনতে হবে বলো।

–ঘরে প্রায় সব জিনিসই আছে। একটা মাছ নিয়ে আইসো।

–কি মাছ আনবো?

–তুমি তো রুই মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট খেতে পছন্দ করো। তবে রুই মাছই এনো একটা বড় দেখে।
স্ত্রীর কথায় নাজিম সাহেব প্রফুল্ল মনে বাজারে যাওয়ার জন্য প্রস্থান করলেন। দরজা খুলতেই দেখতে পেলেন এক পরিচিত মুখ। অবাক কণ্ঠে সুধালেন,
–একি তুমি?

–হ্যাঁ বাবা আমি। আপনার ছোট বাবাজীবন।

–তুমি হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে আসলে যে? তৃপ্তি কই? ও আসেনি।

তৃপ্তি নামক মহিলার কথা শ্রবণ হতেই নাকমুখ কুঁচকে ফেললো যুবক। প্রশ্নটি যে তার বিশেষ পছন্দ হয়নি তা তার মুখের ভাব দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।
–ওর থেকে মুক্তি পেতেই তো চলে এসেছি।
যুবকের কথায় ভ্রু কুঁচকালেন নাজিম সাহেব।
–ওর থেকে মুক্তি পেতে চলে এসেছো মানে?

–চলে এসেছি মানে চলে এসেছি। একেবারে বাক্স-পোটলা সমেত চলে এসেছি। আমি এখন থেকে এই বাড়িতেই থাকবো।

যুবকের একের পর এক কথায় নাজিম সাহেব অবাকের উপর অবাক হচ্ছেন।

–এই বাড়িতে থাকবে মানে কি বাবাজীবন?

–এই বাড়িতে থাকবো মানে আমি এই বাড়িতে থাকবো। যাবো না আমি আর ওই বাড়িতে।

–কিন্তু ওইটা তো তোমার নিজের বাড়ি বাবা। নিজের বাড়িতে যাবে না কেন?

নাজিম সাহেবের কথায় তাচ্ছিল্য করে হাসলো যুবক।
–কোনটাকে আপনি নিজের বাড়ি বলছেন বাবা? যে বাড়িতে কেউ আমার কোনো মূল্য দেয় না। যে বাড়িতে আমার কোনো ভ্যালু নেই আর যাই হোক সেই বাড়িটা আমার হতে পারে না। আমি আর ওই বাড়িতে যাবো না এটাই আমার শেষ কথা।

–ওই বাড়ি যাবে না বলছো?

যুবক ফট করে উত্তর দিলো,
–না।

নাজিম সাহেব একবার নিজের হাত ঘড়িতে সময়টা দেখলেন। বাজারে যেতে হবে দ্রুত। এখন না গেলে ভালো মাছ পাওয়া যাবে না। তিনি ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়ে যুবককে উদ্দেশ্য করে বললেন,
–আচ্ছা বাবা ইফাদ তুমি ঘরে এসো। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছো। তুমি ঘরে রেস্ট নাও। আমি বাজার থেকে এসে তোমার সমস্যা শুনবো।

শ্বশুরের কথায় ইফাদ বললো,
–এখানে সমস্যার কিছু নেই। আমি আর ওই বাড়ি যাচ্ছি না এটাই ফাইনাল।
এই বলে ইফাদ নিজের শ্বাশুড়িকে ডাকতে ডাকতে ভেতরে প্রবেশ করলো। নাজিম সাহেব ইফাদের যাওয়ার দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে বড় রুই মাছ কেনার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লেন।

ইফাদ ঘরে ঢুকে শ্বাশুড়িকে সালাম দিলো প্রথমে।
–আপনার শরীর কেমন আছে মা?

–আলহামদুলিল্লাহ ভালো বাবা। তুমি কেমন আছো?

–এতদিন ভালো ছিলাম না। তবে এখন বেশ ভালোই আছি।

–হুট এত সকাল সকাল চলে এলে ও বাসার সবাই ঠিক আছে তো।

ইফাদ যেন আরেক দফা বিরক্ত হলো।
–ওই বাসার কথা বলবেন না তো। জাস্ট সহ্য হয় না ওই বাসার মানুষগুলো কে। মানুষ তো নয় যেন একেকজন র’ক্তচো’ষা। আমার রক্ত চুষতে চুষতে আমাকে ফ্যাকাশে বানিয়ে দিয়েছে। দেখুন( নিজের হাত দুটো শ্বাশুড়ির দিকে এগিয়ে দিয়ে) আমার শরীরে আর রক্ত অবশিষ্ট নেই কোনো। বুঝলেন মা আমার মনে হয় কয়েক ব্যাগ রক্ত নেওয়া লাগবে। তাহলে যদি এনিমিয়াটা যায়।
ইফাদের কথার আগা গোড়া ওর শ্বাশুড়ি কিছুই বুঝলো না। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন,
–তৃপ্তি কেমন আছে বাবা?
শ্বাশুড়ির প্রশ্ন শুনে ইফাদ মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দিলো,
–অন্যকে জ্বালিয়ে মা’রা মানুষগুলো সবসময় ভালোই থাকে।

তুশিকা বেগমের মাথা ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। তিনি কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ইফাদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
–তুমি তো অনেকটা পথ জার্নি করে আসছো এক কাজ করো তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি তোমাকে লেবুর শরবত করে দিচ্ছি।

–আচ্ছা। আর মা লেবুর শরবতে বেশি করে বিট লবণ দিবেন। তাহলে শরবতের টেস্ট ভালো আসে।
তুশিকা বেগম ইফাদের কথায় মাথা দুলিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন। মেয়ের জামাই এসেছে। কত কাজ তার!

অপর দিকে নাজিম সাহেব মাছের বাজার ঘুরে ঘুরে মাছ দেখছেন। একটা মাছও তিনি মিলাতে পারছেন না। দেখা গেলো মাছের সাইজ পছন্দ হলে মাছের মাথা বা দাম পছন্দ হয় না আবার দাম ঠিক থাকে মাছের মাথাটা তার মোটেই পছন্দ হয় না। এইভাবে কি আর মাছ কেনা যায়? যদি মাছের মাথা পছন্দ না হবে। তিনি তো মাছের মাথা দিয়েই মুড়িঘণ্টটা খাবেন। লেজ দিয়ে তো আর না! অনেক চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে তিনি নিজের মনের মতন একখানা রুই মাছ পেলেন। দাম টাও ঠিকঠাক আছে আর মাছের মাথাটাও সুন্দর। মাছটা তাজা বটে। কি সুন্দর নড়ছে। তিনি এই মাছটাই নিলেন। দোকানীকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে তিনি চলে আসতে নিলেই মাথায় এলো বাসায় মেয়ের জামাই এসেছেন। তারও তো খাতির যত্ন করতে হবে হবে। তিনি মাছের মল থেকে বের হয়ে মুরগীর দোকানে ঢুকলেন। দুটো সোনালী মুরগী কিনে নিয়ে প্রফুল্ল চিত্তে বাড়ির দিকে চললেন।

বাড়িতে ঢুকেই নাজিম সাহেবের চোখ গেলো সোফায় বসে থাকা ইফাদের দিকে। সে আয়েশী ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। অন্য কোনো দিকে তার খেয়াল নেই। এই মূহুর্তে চা নামক পানীয় গলাধঃকরণ করাই যেন তার একমাত্র মূখ্য কাজ। এই কাজটা না করলে তার বিরাট লস হয়ে যাবে ভাবটা কিছুটা এমন। নাজিম সাহেব কিছুক্ষণ ইফাদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে স্ত্রীকে ডাকলেন। তুশিকা বেগম স্বামীর ডাকে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। নাজিম সাহেব স্ত্রীর হাতে বাজারের ব্যাগটা তুলে দিতে দিতে বললেন,
–ভালো করে রেঁধো মুড়িঘণ্টটা। নামাজ পড়ে এসে কবজি ডুবিয়ে খাবো।
তুশিকা বেগম কিছু না বলে বাজারের ব্যাগ নিয়ে চলে গেলেন। তার একদণ্ড দাঁড়ানোর সময় নেই। তার হাতে প্রচুর কাজ। নাজিম সাহেব স্ত্রীর কাছে এক চায়ের আবেদন করে ইফাদের বিপরীত সোফায় বসলেন। ইফাদ তখন চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে চায়ের কাপটা টেবিলের উপরে রাখলো।
নাজিম সাহেব ইফাদের দিকে তাকিয়ে টেবিলে থাকা খবরের কাগজটা তুলতে গেলে ইফাদ চট করে খবরের কাগজটা নিজের হাতে তুলে নিলো। নাজিম সাহেব বিরক্ত হলেন। এই সময়টা তার খবরের কাগজ পড়ার সময়। তিনি প্রতিদিন এই সময়ে খবরের কাগজ পড়েন। নাজিম সাহেব নিজের চেহারায় যথেষ্ট পরিমাণ বিরক্তি মিশিয়ে ইফাদের দিকে তাকালেন। ইফাদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ খবরের কাগজে নিবদ্ধ।
নাজিম সাহেব হালকা কাশি দিয়ে স্ত্রীকে চা দিয়ে যেতে তলব করলেন।
স্বামীর হাঁক-ডাকে তুশিকা বেগম চায়ের কাপ নিয়ে তড়িঘড়ি করে বসার ঘরে আসলেন। স্বামীর দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে ইফাদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
–বাবা ইফাদ তোমার কি কিছু লাগবে?

শ্বাশুড়ির কথায় ইফাদ মিষ্টি হেঁসে বললো,
–না মা কিছু লাগবে না। আচ্ছা মা ঘরে কি চানাচুর আছে? থাকলে দিয়ে যাবেন তো। খালি মুখে পেপার পড়ায় মন বসছে না।

–আচ্ছা দিয়ে যাচ্ছি।

নাজিম সাহেব চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছেন আর ইফাদকে পর্যবেক্ষণ করছেন। ইফাদ ছেলেটা একটু হড়বড়ে টাইপের। কেমন যেন খাপছাড়া স্বাভাবের। সে খুব একটা শ্বশরবাড়ি আসে না। তাকে শত বলে বলেও শ্বশুর বাড়ি আনা যায় না। যে ছেলেকে শত অনুরোধ করে শ্বশুর বাড়ি আনা যায় না সেই ছেলে হুট করে কাউকে কিছু না বলে যখন শ্বশুর বাড়ি চলে আসে তখন তা নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। নাজিম সাহেবও গভীর চিন্তায় মত্ত। ইফাদের হুট করে এখানে আসাটা নাজিম সাহেবের কেমন খটকা খটকা লাগছে। তবে তিনি এখনো জানেন না মেয়ের জামাইয়ের এমন হুট করে শ্বশুড় বাড়ি আগমনে তার শান্তির জীবনে কি হতে চলেছে।

#চলবে….ইনশা-আল্লাহ্

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে