জামাই শ্বশুর পর্ব-০৩

0
733

#জামাই_শ্বশুর [৩]
#সাদিয়া
🕊️
দুপুরের খাবার খেয়ে নাজিম সাহেব নিজের ঘরে চলে গেলেন। এখন একটা ভাত ঘুম দিলে মন্দ হয় না। নাজিম সাহেব ফ্যানটা চালু করে বিছানায় টান টান করে শুয়ে পড়লেন। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই তিনি তলিয়ে গেলেন ঘুমের অতল সাগরে।

নাজিম সাহেব তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আচমকাই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করলে লাগলো বিকট বিকট শব্দ। শব্দের তীব্রতায় তিনি ঝপাৎ করে উঠে বসলেন। বুকে হাত দিয়ে তিনি ঘনঘন নিশ্বাস নিতে লাগলেন। বেশ কিছুটা সময় নাজিম সাহেব নিজেকে সামলাতে ব্যয় করলেন। নিজেকে সম্পূর্ণ সামলাতে না পারলেও কোনোরকমে নিজেকে সামলে তিনি শব্দের উৎসের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন।
ভ’য়ং’কর ভয়ং’কর শব্দগুলো ছাদ থেকে আসছে। নাজিম সাহেবের বাড়িটা এক তলা। ছাদটা বেশি বড় নয়। নাজিম সাহেব গুটিগুটি পায়ে ছাঁদের দরজার সামনে এসে দেখলেন ইফাদ তার প্রিয় আরাম কেদারায় বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে আর ফাটা বাঁশের মতন গলায় গান গাইছে। এটাকে গান গাওয়া বললে গান গাইতে পারার দুর্দান্ত এক প্রতিভাকে অপ’মান করা হবে। তাই নাজিম সাহেব ইফাদের কাজকে ঠিক গান গাওয়ার পর্যায়ে ফেললেন না।
নাজিম সাহেব মৃদু স্বরে কয়েকবার ইফাদকে ডাকলেন। কানে হেডফোন থাকায় নাজিম সাহেবের ডাক ইফাদের কর্ণগোচর হলো না। সে নিজের মতন আরাম কেদারায় বসে বাইম মাছের মতন মুচড়া-মুচড়ি করছে। আরাম কেদারার অবস্থা বেজায় নাজুক। নাজিম সাহেবের মনে হচ্ছে আরাম কেদারাটা ওনাকে কাতর স্বরে ডাকছে। ওনার কাছে সাহায্য চাইছে। বাঁচার তীব্র আকুতি প্রকাশ করছে। নিজের আরাম কেদারার এই দুর্দশা যেন নাজিম সাহেবের আর সহ্য হলো না। তিনি ইফাদের কাছে গিয়ে ইফাদের কান থেকে হেডফোনটা খুলে নিলেন। নাজিম সাহেবের এমন কান্ডে ইফাদ চোখ মেলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো নাজিম সাহেব কোমড়ে হাত দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
–কি সমস্যা আপনার বাবা? আমার হেডফোন নিলেন কেন?

–তুমি এখানে বসে কি করছিলে?

–আপনার খুব দ্রুত চোখের ডাক্তার দেখানো উচিত। আমার এক বন্ধু আছে আই স্পেশালিষ্ট। আপনাকে কালকে ওর কাছে নিয়ে যাবো।
কিছুটা রেগেই কথাটা বললো ইফাদ। ইফাদের কথায় নাজিম সাহেবের রাগটাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। তবে তিনি নিজের রাগটা প্রকাশ করলেন না। ঠোঁটের কোণে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে তিনি নিজের রাগটা ধামাচাপা দিলেন। ছাদের অপর পাশ থেকে আরএফএলের একটা চেয়ার এনে তিনি ইফাদের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসলেন। ইফাদ ভ্রু কুঁচকে শ্বশুরের কার্যকলাপ দেখছে। নাজিম সাহেব হাসিমুখে ইফাদকে জিজ্ঞেস করলেন,
–বাবা ইফাদ এবার বলো তো তোমার সমস্যাটা কি?

ইফাদ নিজের কুঁচকে থাকা ভ্রুদ্বয়ে আরো কিছুটা কুঁচকে বললো,
–আমার আবার কি সমস্যা হবে?
তারপর আরাম কেদারায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসে বললো,
–আমার কোনো সমস্যা নেই।

নাজিম সাহেব যেন কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেন। তিনি এবার যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে বললেন,
–যদি কোনো সমস্যা না হয় তবে তুমি কাউকে কিছু না বলে এমন আচমকা শ্বশুর বাড়ি কেন চলে এলে বলো তো?
নাজিম সাহেবের এমন প্রশ্নে ইফাদ নড়েচড়ে বসলো।
–আমার এখানে আসাতে আপনার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে বাবা? বাই এনি চান্স আপনি কি আমাকে নিজের বোঝা মনে করছেন?
নাজিম সাহেব কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ইফাদ ওনাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে পুনরায় বলে উঠলো,
–আপনি জানেন না বাবা ছেলে মেয়ে সমান অধিকার। আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে আমার অধিকার কেড়ে নিতে চাইছেন? বিবেকে বাঁধলো না আপনার বাবা?
শেষ কথাটা ইফাদ কিছুটা হতাশার সুরেই বললো।
নাজিম সাহেব চমকে ইফাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইফাদের এমন গাঁ/জা/খুরি কথার পৃষ্ঠে তার কি জবাব দেওয়া উচিত তিনি তাই ভাবছেন। নাজিম সাহেবের নিরবতায় ইফাদ যেন তাকে পেয়ে বসলেন।
–এখন আপনি চুপ করে আছেন কেন? এখন মুখে রা নেই কেন? নিজের কর্মের জন্য আপনি অনুতপ্ত তাই না?
এই মূহুর্তে নাজিম সাহেবের কাছে ইফাদকে একজন মান’সিক রো’গী বলে মনে হচ্ছে।
–এত আজিরা কথা তুমি কিভাবে বলো ইফাদ? ক্লান্ত হও না তুমি?
ইফাদ কিছু না বলে মুখ ব্যা’কালো। নাজিম সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ইফাদের সাথে এসব বিষয়ে কথা বলতে গেলে কাজের কথা আর বলা হবে না। ওর সাথে টু দ্যা পয়েন্টে কথা বলাই শ্রেয়। নাজিম সাহেব দু’একটা শুকনো কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ইফাদ বলে উঠলো,
–আপনার কি যক্ষা হয়েছে বাবা?
এবার আর নাজিম সাহেব কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।
–তৃপ্তির সাথে কি তোমার কোনো ঝামেলা হয়েছে বাবা? না মানে তুমি এর আগে কখনো এভাবে আমাদের বাড়িতে আসোনি তো তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।
–এটা কি আমার বাড়ি নয় বাবা? আপনি আমাকে এক কথায় পর করে দিলেন বাবা? কই আমি তো আপনাদের কখনো পর ভাবিনি। পর ভাবিনি বলেই তো নিজের বিপ’দের দিনে আমার আরেক বাসায় আশ্রয় নিয়েছি।

–বিপ’দের দিনে মানে? কিসের বি’পদ বাবা? ও বাসার সবাই ঠিক আছে তো?

–ওই বাসার করো কথা জিজ্ঞেস করবেন না তো বাবা। একেক জন আমার অস্থি-মজ্জা জ্বা’লিয়ে খেয়েছে।

নাজিম সাহেব ইফাদের কথার কিছুই বুঝলেন না।
–আর আপনার মেয়ে তো কোনো মানুষ নয়। যে তো একটা আ’ত্মা। ওর নাম তৃপ্তি না রেখে অ’তৃপ্ত আ’ত্মা রাখা উচিত ছিলো আপনাদের। এমন ভ’য়ং’কর মেয়ে আমি আমার পৌনে উনত্রিশ বছর বয়সে একটাও দেখি নাই। মেয়ে তো নয় যেন জ’ল’ন্ত আ’গ্নে’য়গি’রি। সাথে জং’লী বি’ল্লি।
নাজিম সাহেব যেন ইফাদের কষ্টটা বুঝতে পারলেন।
নাজিম সাহেবের তিন মেয়ের মধ্যে বড় দুজন খুবই শান্তশিষ্ট। কিন্তু ছোটটা হয়েছে আস্ত বা’নরে’র লে’জ বিশিষ্ট। তৃপ্তির বিয়ে আগে এমন একটা দিনও বাদ যায়নি যে তৃপ্তির নামে কোনো নালিশ আসেনি। আজ এর গাছের সব আম শেষ করে বাড়ি ফিরেছে তো অপর দিন ওর জাম লিচু সাবাড় করেছে। এগুলো তো কিছুই না। মাঝেমধ্যে তো ছেলের বাপেরা আসতো তৃপ্তির নামে নালিশ নিয়ে যে তৃপ্তি তাদের ছেলের মাথা ফা’টিয়ে’ছে নয়তো কারো হাত ভে’ঙ্গে দিয়েছে। এলাকায় চিরুনি তল্লাশী চালিয়েও এমন একজন মানুষ পাওয়া যাবে না যে তৃপ্তির অত্যা’চার সহ্য করেনি। তাদের এলাকায় লেডি ত্রা’শ নামে তৃপ্তির বেশ পরিচিতি ছিলো। হঠাৎ করেই নাজিম সাহেব অনুভব করলেন তিনি ইফাদের জন্য কষ্ট পাচ্ছেন। ইফাদ ছেলেটা যেমনই হোক না কেন মনের দিক থেকে সে একশোতে একশো। নাজিম সাহেবের তো মাঝেমধ্যে মনে হয় ইফাদকে একশোতে পাঁচশো দিলেও কম হয়ে যাবে।
নাজিম সাহেব এবার গলার স্বর খাদে নামিয়ে ইফাদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
–তৃপ্তি কি তোমাকে খুব বেশি অত্যাচার করে বাবা?

–আপনার মেয়ের অত্যচারে আমার রাতের ঘুম হারা’ম গিয়েছে। আমাকে জন্ম দেওয়া আমার বাবা-মাও যে এমন পাল্টি খেয়ে যাবে তা কি আর আমি জানতাম বলুন?
নাজিম সাহেব এবার ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
–তারা আবার কি করেছে?

–কি করেছে জিজ্ঞেস করছেন? কি করতে বাদ রেখেছে সেটা বলুন। আমার বাবা-মা আগে এমন ছিলো না। সব আপনার মেয়ের কালো জা’দুর প্রভাব। আপনার মেয়ে কালো জা’দু করেছে তাদের উপর। এখন তারা নিজের ছেলেকে চিনতে পারছে না। ছেলের বউ-ই এখন তাদের সব। সবাই মিলে এক জোট হয়ে তারা আমার বিরুদ্ধে গভীর ষ’ড়’য’ন্ত্র করছে বুঝলেন বাবা?
নাজিম সাহেব বিজ্ঞের মতন মাথা দুলালেন। অর্থাৎ তিনি বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন। ইফাদ আবার বলতে শুরু করলো,
–ওদের মতলব ছিলো আমার ক্রেডিট কার্ড ছি’ন’তা’ই করে সাজেকে একটা ট্যুর দেওয়া। আমি একবারো ওদের ঘুরতে যাওয়া নিয়ে বিরো’ধীতা করি নি। আমি সসম্মানে ওদের যেতে দিতে চেয়েছিলাম। এমনকি নিজেও যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই হৃদয়হীন মানুষগুলো এই অবুঝের কষ্টটা বুঝলো না। সকলে মিলে আমার বিরু’দ্ধে দল গঠন করলো। বৈঠক হলো আমার বিরু’দ্ধে। সেই বৈঠকেই তো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আমার ক্রেডিট কার্ড ছিন’তা’ইয়ের। কিন্তু আমি একটু বেশিই শেয়া’না কি না। ওদের চ’ক্রা’ন্ত আগেই বুঝে গেলাম। আর বাক্স-পোটলা সমেত চলে এলাম এখানে। এবার আমিও দেখবো আমার ক্রেডিট কার্ড ছাড়া কি করে চলে তাদের হুহ। আমার টাকায় খেয়ে আমাকে নি’র্যা’তন করতে আসে।
নাজিম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রস্থান করলেন। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে তিনি পা’গ’ল হয়ে যাবেন নিশ্চিত। তিনি এই বুড়ো বয়সে এসে পা’গ’ল হয়ে চান না। নিজের বিবি সাহেবাকে নিয়ে যে এখনো তার প্যারিস ঘুরতে যাওয়া বাকি রয়ে গেছে!

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে