জামাই শ্বশুর পর্ব-০২

0
716

#জামাই_শ্বশুর [২]
#সাদিয়া

🐰
সময় ১২ বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। শুক্রবার জুম্মার দিন হওয়ায় চারদিকে আজান দিতে শুরু করেছে। নাজিম সাহেব গোসল করবেন বলে নিজের লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চললেন। তাদের বাসায় মোট তিনটা ওয়াশরুম। দুটো ওয়াশরুম দুটো বেডরুমে এটাচ আর একটা সার্বজনীন। নাজিম সাহেব ওয়াশরুমের দরজা ঠেলে দিলেন কিন্তু দরজা খুললো না। তিনি আবারো দরজা ঠেললেন ফলাফল শূন্য। এবার তিনি ওয়াশরুমের দরজায় কড়া নাড়লেন। নড়া নাড়ার শব্দে ভেতর থেকে ইফাদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো।

–কে?

–আমি বাবাজীবন। তোমার শ্বশুর।

–ওহ্ বাবা আপনি। তা আপনি দরজা ঠেলছেন কেন বাবা?

–গোসল করবো আমি তাই দরজা ঠেলছিলাম।

–ঠিক আছে পরে আসুন। এখন আমি গোসল করছি। আমার শেষ হলে আমি আপনাকে ডেকে দিবোক্ষণ।

–তোমাকে যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে সে ঘরে তো ওয়াশরুম ছিলো তাহলে তুমি এই ওয়াশরুমে কি করছো?

–আসলে বাবা ওই ঘরের ওয়াশরুমটা ছোট। আর ছোট বদ্ধ জায়গায় আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। সাফোকেশন হয় আমার। এই ওয়াশরুমটা বড় তাই এটাতে এসেছি।
নাজিম সাহেব কিছু না বলে ওয়াশরুমের দরজার সামনে পায়চারি করতে লাগলো। এরই মধ্যে আধঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেলো। সেই সাথে ঘড়ির কাটা একটা পার করে ফেলেছে। নাজিম সাহেব পুনরায় ওয়াশরুমের দরজায় কড়া নাড়লেন।
–বাবা ইফাদ তোমার হলো?

ইফাদ কোনো কথা না বলে খট করে ওয়াশরুমের দরজা খুলে দিলো। তার পুরো শরীরে সাবানের ফেনা লেগে আছে।
–আপনি বার বার দরজায় কড়া কেন নাড়ছেন বাবা?

–একি ইফাদ তোমার এখনো গোসল করা শেষ হয় নি?

–দেখতেই তো পাচ্ছেন হয় নি। জিজ্ঞেস কেন করছেন আবার?
কণ্ঠে যথেষ্ট বিরক্তি মিশিয়ে কথাটা বললো ইফাদ। এবার যেন নাজিম সাহেবও প্রচন্ড বিরক্ত হলেন।
–পুরুষ মানুষের এতক্ষণ লাগে গোসল করতে।

–কেন? সময় লাগলে কি সমস্যা? আমি পুরুষ বলে কি মানুষ না নাকি? আর আপনি নিজে একজন পুরুষ হয়ে অন্য আরেকজন নির্যা’তিত পুরুষকে এভাবে বলে পারলেন? একবারো কলিজা কাঁপলো না আপনার বাবা?
ইফাদের কণ্ঠে কাতরতা স্পষ্ট। নাজিম সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–নামাজের সময় হয়ে এসেছে। তুমি দয়া করে তারাতাড়ি বের হও। আমাকেও তো গোসল সারতে হবে।

–হ্যাঁ আর পাঁশ মিনিট জাস্ট।

নাজিম সাহেব ওয়াশরুমের সামনে ফ্লোরে বসে রইলেন ইফাদের গোসল শেষ হওয়ার অপেক্ষায়।
আরো মিনিট পাঁচেক বাদে শুভ্র রঙের তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে বেরিয়ে আসলো ইফাদ। নাজিম সাহেব দুই সেকেন্ড তোয়ালেটা দেখলেন। এই তোয়ালেটা তিনি তিন দিন আগেই চারশো তেষট্টি টাকা দিয়ে মদন দাসের দোকান থেকে কিনে এনেছিলেন। ব্যবহার করা হয়নি তার আর। নাজিম সাহেব পুনরায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজায় খিল দিলেন। নামাজের সময় হয়ে আসায় নাজিম সাহেব কোনো রকমে শরীরে পানি ঢেলে গোসল সারলেন। নামজে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে গিয়ে পড়লেন বিপ’দে। তিনি তার পাঞ্জাবির সাথের পায়জামাটা পাচ্ছেন না। অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে তিনি পায়জামাটা পাঞ্জাবির সাথে রেখেছিলেন। তিনি পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে স্ত্রীর কাছে রান্না ঘরের দিকে চললেন।
–একি বাবা আপনি এখনো তৈরি হননি? নামাজের সময় যে হয়ে এসেছে দেখেন নি? তারাতাড়ি করুন। না হলে প্রথম সারিতে জায়গা পাবো না।
ইফাদের কথার জবাব দিতে গিয়ে নাজিম সাহেব ইফাদকে লক্ষ করলেন। ইফাদের পরিহিত পায়জামাটা তার বড্ড চেনা। হ্যাঁ এটা সেই পায়জামা যেটা তিনি এতক্ষণ যাবত খুঁজে হয়রান হচ্ছিলেন।
–এই পায়জামাটা..

–ও এটা? এটা আপনার আলমারি থেকে নিলাম। আসলে আমারটা আনতে মনে নাই। তাই আপনারটা নিতে হলো। চিন্তা করবেন না নামাজ থেকে এসে আপনারটা আপনাকে দিয়ে দেবো।
নাজিম সাহেব অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
–আমার পায়জামা হলো তোমার?

–না হয় নি তো। তবে সমস্যা নেই আমি ম্যানেজ করে নিয়েছি।
নাজিব সাহেব আর কিছু না বলে লুঙ্গি পরেই নামাজের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লেন৷ তার পিছন পিছন ইফাদও ছুটলো নামাজে। দেরি হলে আবার প্রথম সারিতে জায়গা হবে না। তার আবার প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার অভ্যাস!

নামাজ শেষে দুই শ্বশুর-জামাই এক সাথে বাসায় আসলেন। তারা আসতেই তুশিকা বেগম তাদের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন,
–তোমরা দুজনে টেবিলে এসে বসো। আমি তোমাদের খাবার দিচ্ছি।

নাজিম সাহেবের আগে আগে ইফাদ গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলো। নাজিম সাহেব ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে দেখলেন ইফাদ উনার চেয়ারটার দখল নিয়েছে। নাজিম সাহেব ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
–একি তুমি দাঁড়িয়ে কেন আছো? খেতে আসো।

–হ্যাঁ বাবা খেতে আসুন।
নাজিম সাহেব আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। আজ সকাল থেকে এই দীর্ঘশ্বাসটাই তার আপন হয়ে উঠেছে যেন।
নাজিম সাহেব একটা চেয়ার টেনে বসলেন। তুশিকা বেগম ইফাদের পাতে খাবার দিচ্ছেন। প্রথমে ভাত দিয়ে তিনি ইফাদের পাতে তুলে দিলেন সকালে নাজিম সাহেবের আনা রুই মাছের বিশাল মাথাটা। ইফাদ আয়েশ করে মাছের মাথাটা খেতে লাগলো। ইফাদকে মাছের মাথাটা দিয়ে তুশিকা বেগম স্বামীর পাতে তুলে দিলেন মাছের মাঝারি সাইজের একটা টুকরা। নাজিম সাহেব একবার নিজের পাতের দিকে তাকাচ্ছেন আবার ইফাদের পাতে তাকাচ্ছেন।
–তুমি না আজকে মুড়িঘণ্ট রাঁধবে বলেছিলে?

–হ্যাঁ বলেছিলাম। তো?

–তো? তো কই গেলো মুড়িঘণ্ট?

–রান্না করি নাই।

–কেন?

–কেন মানে? দেখছো না জামাই এসেছে।

–জামাই আসার সাথে মুড়িঘণ্ট না রান্না করার কি সম্পর্ক তুশি?

–বাবা আপনি ছোট বাচ্চাদের মত কি শুরু করলেন বলুন তো?

নাজিব সাহেব অবাক হয়ে বললেন,
–আমি আবার কি করলাম?

–কি তখন থেকে মুড়িঘণ্ট মুড়িঘণ্ট করে যাচ্ছেন? দেখুন মা কি ইয়াম্মি করে ফিশ কারি রান্না করেছে। খেয়ে দেখুন কত্তো টেস্টি হয়েছে।
ইফাদ এবার নিজের পাত থেকে মাছের মাথার একটা কা’টা নিয়ে নাজিম সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
–মাছের মাথা খাবেন বাবা?
নাজিব সাহেব মুখ খুলার আগে ইফাদই বলে উঠলো,
–থাক আপনি বয়স্ক মানুষ। আপনার মাছের মাথা খাওয়ার দরকার নাই। দেখা গেলো মাছের মাথা খেতে গিয়ে গলায় কা’টা আটকে যাবে। পরে হবে আরেক ঝামেলা।
ইফাদের কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন নাজিম সাহেব। একে তো তিনি মুড়িঘণ্ট খেতে পারেন নি তার উপর তাকে অনায়েশে বুড়োর উপাধি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সব কিছু এতই সোজা নাকি!

–তুমি আমাকে বুড়ো বললে?

ইফাদ একটা কা’টা চুষতে চুষতে বললো,
–আপনাকে আমি বুড়ো কেন বলতে যাবো বাবা? আপনি তো এমনিতেই বুড়ো।

–বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এবার ইফাদ।

ইফাদ প্রতিত্তোর করার আগেই তুশিকা বেগম মুখ খুললেন,
–আহ্ চুপ করো তো তুমি। ছেলেটাকে খেতে দাও শান্তিতে। আর তুমিও খাও। আর খেতে না মন চাইলে টিভি দেখো গিয়ে।

–ও আমাকে বুড়ো বললো তুমি দেখলে না?

–বাবা এটাকে দেখা না শুনা বলে।

–তুমি চুপ করো। আর তুশি তুমি দেখলে না মানে শুনলে না ও আমাকে বুড়ো বলে অপমান করলো।
তুশিকা বেগম এবার মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
–তোমার মতন বুড়োকে বুড়ো বলবে না কি অমিতাভ বচ্চন বলবে নাকি।
তুশিকা বেগমের কথায় ইফাদ শব্দ করে হেসে উঠলো। অপরদিকে অপমানে নাজিম সাহেবের চেহারা লাল হয়ে উঠলো। তিনি কোনো আর কথা না বলে চুপচাপ মাছের কাটা ছাড়াতে লাগলেন। মুড়িঘণ্ট না খেতে পারার তীব্র আফসোসে মনে হয় না আজকে তার গলা দিয়ে খাবার নামবে বলে। নাজিম সাহেব আড়চোখে একবার ইফাদকে দেখে নিলেন। সে আরাম করে মাছের মাথা গিলছে। এই মাছের মাথাটা মনে হয় অন্যান্য মাছের মাথার তুলনায় একটু বেশি মজাদার ছিলো।

–বাবা আপনি নিজের পাতে না তাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কেন আছেন।

–কিছু না এমনি। তুমি খাও।
নাজিম সাহেব এবার নিজের পাতে মনোনিবেশ করলেন।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে