জানালার ওপারে পর্ব-১৩

0
712

#জানালার_ওপারে
||১৩তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
সারাটা রাত ঘুমাতে পারিনি। বর্তমানে নিশার সাথে বাড়ি ফিরছি। কেমন যেন অদ্ভুৎ রকমের অনুভূতি হচ্ছে। যদিও ঐ বাড়িটি আমার, ঐ বাড়িটিতেই আমার বেড়ে উঠা। আমার খুব করে বিশ্বাস হচ্ছে আবেগের উপর, তবুও কোথায় একটা কিন্তু, মনের খচখচানি।

রিকশা থামলো। অন্যদিকে ধ্যান থাকায় পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলিয়ে নিলাম।

কলিংবেলের সুইচটা চাপ দিতেও যেন আজ বহু খানি সাহস সঞ্চার করা লাগছে। বেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজটা বুকের ঢিপঢিপ শব্দটা আরও বাড়িয়ে দিল। দরজা খুলতেই মায়ের অতিপরিচিত মুখশ্রী দৃশ্যমান হলো। তাতে ভীষণ রকমের ক্লান্তি ও দুঃখের ছাপ।

আমাকে দেখে অনতিবিলম্বেই তার চোখ জোড়ায় অশ্রুর ভর। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। জড়িয়ে ধরলেন মা শক্ত করে।

“হাতির পাঁচ পা দেখেছিলি যে বাড়ি ছাড়ার মতো কলিজা হয়ে গেছে! বিপদ-আপদের হাত-পা আছে? একটা কিছু হয়ে গেলে কোথায় পেতি জীবন?” মায়ের অশ্রুসিক্ত কণ্ঠের বকাগুলো কেমন যেন শান্তি লাগছিল।

কিন্তু এখন এতো যত্ন-আত্তি কেন? যখন এ বাড়িতে ছিলাম তখন তো ভুলেই বসেছিল আমাকে। হারিয়ে যাওয়ার ফলেই বুঝি এমন গুরুত্ব দেওয়া?

বসার ঘরে ছোট্ট বাবুই খেলছে। আমাকে দেখে চিৎকার করে ‘মাম্মা’ ডেকে জড়িয়ে ধরে। ইতিমধ্যে আব্বু সহ সকলেই আমাকে দেখে চমকে উঠেছে।

আব্বু চোখের কিনারায় আসা নোনাজল অতি যত্নে আড়াল করে ফেললেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“কী খাবি আম্মু? তোর পছন্দের কাবাব-লুচি নিয়ে আসি?”

আমি মাথা নাড়িয়ে আলতো হাসলাম। আব্বু খুশিমনে বেড়িয়ে গেলেন। একে একে বাসার সবাই হালকা বকা দিলেন।

আমি ও নিসা নিজের বেডরুমে গেলাম। সাজানো-গোছানো, পরিস্কার। তবে জিনিসপত্র একচুল জায়গা থেকে নড়েনি।

হাসিব ভাই আশেপাশেই কোথাও এসেছেন। তাঁর কল পেয়ে নিসা চলে গেল আমাকে বিদায় জানিয়ে।

একা বসে রইলাম নিজের ঘরে। কেমন এক সুখ, উত্তেজনা বোধ হচ্ছে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। ঘুরে ঘুরে নিজের ঘরটিকে দেখছি, যেন কতো নতুন এ ঘর আমার জন্য।

কিছুক্ষণ পর আম্মু ঘরে আসলো ওড়নায় ঘাম মুছতে মুছতে। আমার হাতটি নিজের হাতে নিলেন।

“কেন চলে গিয়েছিলি? একবার আমাকে সব বলেই দেখতি তুই। মনে হয়নি মা আমাকে ছাড়া কী করবে।”

আমি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে উত্তর দিলাম,
“আমি যাওয়ায় তো তোমাদের ভালোই হয়েছিল। তোমাদের তো বোঝা, বিরক্তি মনে হতো শুরু করেছিল আমাকে। তাই তো আমার সাথে কথা বলা, কেয়ার করা বন্ধ করে দিয়েছিলে। খালি বকাই দিতে। এমন কী কেউ আমাকে কোনো বাজে কথা বললেও কিছু বলতে না। ঐদিন হাফসার মা মেহের আপুকে বলল আমাকে কে বিয়ে করবে, ভাইদের ঘাড়ে বসে খাব। কই? তাকে তো কিছু বললা না। মানে তোমরাও তা-ই মনে করতে, করো।”

মা গম্ভীর মুখে তাকিয়ে মাথায় আলতো হাতে বারি দিল।
“সারাজীবন বলদই থেকে গেলি মেয়ে! তোকে বকবো না তো কী করবো? কী একটা কথা বলা বন্ধ হলো, তাই বলে সব ছেড়ে-ছুড়ে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী হয়ে গেলি। পড়াশোনা, হাসি, আনন্দ, সখ-আহ্লাদ, সবকিছু গোল্লায় দিয়ে, তাই না? তোকে কতো বোঝাতাম বাহিরে চল, ভার্সিটিতে যা, ছাদে যেয়ে একটু হাঁটাহাটি কর। শুনতি? এমন কী ডাক্তার যে থ্যারাপি নিতে বলেছিল তাও নিতিস না।

জোর করলে হতাশ হয়ে বলতি, টাকা নষ্ট হবে শুধু, আমি আর ঠিক হবো না। আরে মেয়ে, আশায় বাঁচে চাষা। কাকে কোন উসিলায় সুস্থ করে আল্লাহ কে জানে! এই দুঃখে, রাগেই কথা বলা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর মানুষের বাঁকা কথার উত্তর দেইনি, আগে দিতাম কেউ তোকে কিছু বললে? না, কারণ তুই-ই নিজের জন্য যথেষ্ট। আমরা চাচ্ছিলাম তুই-ই নিজের হয়ে প্রতিবাদ কর, নিজের নীরবতাকে দুর্বলতা না হতে দিয়ে। আর তুই তো দরজা আটকে বসে পড়েছিলি। কিন্তু বল তো, হাফসার মাকে আর দেখেছিলি এই বাড়িতে? তোর বাপ-ভাই তাকে ঘর বিদায় দিয়েছিল তোর আড়ালে।”

মায়ের বুকে মাথাটা এড়িয়ে দিলাম। একদিকে আনন্দ অনুভূতিরা রংধনু এঁকে দিচ্ছে মনের আকাশে, অপরদিকে কেমন একটা জমাট দুঃখও অনুভব হচ্ছে।

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শুধালো,
“আল্লাহ তোর থেকে তোর কণ্ঠ নিয়ে নিলেও বেশ দামী উপহার দিয়েছে। তা হলো আবেগ। আমরা যতোটা কেঁদে মরেছি তোর চিন্তায়। ততোটা ঐ পরের ছেলেটাও। পাহাড়ের মতো ছেলেটা কেমন মুর্ছে গেছিলো। ভবঘুরে হয়ে ঘুরতো তোর খোঁজে। ওর মাও এসে কাঁদতেন আমাদের এখানে। এই যে এই সময়টা পাড় করছিস মা এতো বড়ো প্রতিবন্ধকতা নিয়ে এটাও একটা পরীক্ষা। ভালো সময় যেমন শেষ হয়ে যায়, খারাপ সময়টাও শেষ হয়ে যায়, যাবে। দিনের পর রাত আসবেই, আর রাতের পর দিনও আসবেই। মনে রাখবি এ কথা, কখনও মনে ঐ বাজে ভাবনা আনবি না আর।”

মা দুপুরের খাবার বসাতে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আকদের দিনের সম্পূর্ণ ঘটনাও খুলে বললেন।

আকদের দিন না কি আবেগ ভাই বাসায় এসেছিলেন কাবিনের লগ্নের দেড়-দু ঘণ্টা আগে৷ তাড়াতাড়ি শেরওয়ানি পরে তৈরি হয়ে কাজির সামনে যাওয়ার জন্য বের হলেই বেলি ডায়েরিটি ধরিয়ে দেয়।

বলে,
“সামু আপু দিয়েছে। আর এটা পড়েই বিয়ের পিঁঢ়িতে বসার অনুরোধ করে গেছে।”

আবেগ ভাই অবাক হন। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বিয়েতে বিলম্ব করে বেডরুমে পুনরায় ঢুকেন ডায়েরি নিয়ে।

পনেরো-বিশ মিনিট পরেই জোরালো আঘাতে দরজা খুলেন তিনি। বসার ঘরে যেয়ে বধূ বেশে বসে থাকা হাফসার হাত ধরে উঠে দাঁড় করান। একটানে মাথার ওড়না ফেলে দেন।

মুখের উপর ভারি ডায়েরিটা ছুঁড়ে মেরে হুংকার দিয়ে উঠেন,
“এই মেয়ে, তোমার সাথে কোন কালে আমার প্রেম ছিল? Bloody jerk! তুমি কী বলছি, তোর সাহস কীভাবে হয় মায়াবালিকাকে এসব বলার?”

হাফসা উত্তর কী দিবে, থরথর কাঁপছিল ভীতিতে। হাটে এসে এভাবে হাড়ি ভাঙবে বিষয়টা ধারণাতীত ছিল। উপস্থিত মানুষগুলোর বিস্ময়ে হা করে দাঁড়িয়ে। তাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। শুধু একজনের মাথা নত, সে হলো আবেগের বড়ো বোন আয়েশা।

আবেগ ভাই উত্তর না পেয়ে ক্রোধে এক ধাক্কায় মেঝেতে ফেলে দেয় তাকে। এবার তাঁর ক্রোধানল উপচে পড়ে তাঁর বড়ো বোনের উপর।

“বড়োপা তোমাকে তো আমি স্পষ্ট বলেছিলাম সামুর জন্য প্রস্তাব পাঠাবে। ব্যাপারটা হাফসা অবধি গেল কীভাবে?”

আয়েশা ঘাবড়ে গেলেও হার মানে না। বরং, কপট কঠোরতা আনে গলায়।

“দেখ, তুই এখনও ছোটো। আমি তোর বড়ো। তোর জন্য ভালো কোনটা, মন্দ কোনটা, তা তুই না বুঝলেও আমি বুঝি। হাফসা অনেক ভালো মেয়ে। সামু বাজে…”

“Just shut up! মুখের কথা মুখেই রাখো, বাহিরে বের হলো পরিণাম ভাবনার বাহিরে হবে। বড়ো বোন দেখে বেঁচে গেলে, নাহলে… আর তোমার অর্থ তো একটাই দাঁড়াচ্ছে। তুমি ইচ্ছে করে এসব প্যাঁচ লাগিয়েছো, আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে। How could you do this! Bloody betrayer! Backstabber!”

“আবেগ তুই বুঝতে পারছিস না। মেয়েটা ভালো নয়। একে তো বোবা। আবার কী কোর্ট-কাচারির ঝামেলা তার পিছনে! বল, ভালো মেয়ে হলে কী আর কোনো আধবুড়া ব্যাটা ওর পিছে লাগতো! এতো মেয়ে থাকতে ওর ক্ষতিই কেন করলো মতি মিয়া, ওকেই কেন চোখে পড়লো উত্তর দে একটা বার?”

“Oh really! তাহলে তো সবার আগে তোমার গর্ভের মেয়ে মানে তোমার ভাষায় বাজে মেয়ে আর্শিকে এই প্রশ্ন করা উচিত!”

“আবেগ! পরের জন্য নিজের মেয়ে সমান বোনঝিকে এভাবে বললি!”

“চিৎকার কোরো না আপু। আমি যা বলছি ঠিকই বলছি। সেদিন পনেরো তারিখ বুধবার দুপুরবেলা আর কেউ নয় তোমার মেয়ে আর্শিকেই বাসায় যাওয়ার পথে আটকায় মতি মিয়া। যেসব ঝামেলা কথা বলে মেয়েটাকে বদনাম করছো সেসবের ভয় করলে এখন তোমার মেয়ে ঐ আধবুড়োর কামনার বলি হয়ে মর্গে পড়ে থাকতো।” মোবাইল সুইচ অন করে সেদিনের ভিডিওটি চালু করে সবাইকে দেখায়।

ভিডিওটি শেষ হওয়ার পূর্বেই ধপ করে বসে পড়ে আয়েশা। তখনই কল আসে ফোনে, হাসিব ভাইয়ের কল। তিনি নিসার কাছে আমার বলা কথা তথা হাফসার সাথে বিয়ে শুনে সকাল হতেই কল করছিলেন। কিন্তু আবেগে ভাইয়ের ফোন বন্ধ থাকায় তা পৌঁছায়নি।

আবেগ ভাই চিন্তিত ভঙ্গিমায় তাক র সাথে কথা বলতে বলতে বের হয়ে গিয়েছিলেন। মা জানালো তাঁর অবস্থা না কি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল আমার খোঁজে। নাওয়া-খাওয়া একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলেন, বাসায়ও আসতেন না। ভার্সিটিতে পড়ে থাকতেন বা হলে, যদি দেখা পান আমার এই আশায়।

মা মিথ্যে বলবে না এটুকু ভরসা আছে। সেই ভরসাতেই আবেগ ভাইয়ের উপরও পুরোপুরি ভরসা করতে যতোটুকু দ্বিধা ছিল তাও কেটে গেল। তবে তাঁর সামনে যেতে বড্ড দ্বিধা বোধ হচ্ছে। তাঁর সামনে যাব বা যেতে হবে ভাবতেই হার্ট বিট বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ হারে।

প্রিয় অসভ্য পুরুষটির পছন্দের শুভ্র রংয়ের এক সেট থ্রিপিস নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম। বের হলে কেমন একটা জোর গলায় কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পেলাম।

দরজার সামনে যেয়ে দাঁড়ালে শুনতে পাই আবেগ ভাইয়ের স্পষ্ট উক্তি,
“আমার বউকে আমি এখনই নিজের বাড়ি নিয়ে যাব। এখনই মানে এখনই!”

আমি আঁতকে উঠলাম। এতোকিছুর পর আমি এখনও প্রস্তুত নই তাঁর সামনে যেতে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে