ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০৮

0
1718

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
শব্দসংখ্যা: ২২০৮
পর্ব-০৮

আজকের প্রেজেন্টেশন শেষ করতেই সমস্ত ক্লান্তি যেন পেয়ে বসেছে ছোঁয়াকে। তাই সে শপেও যায়নি। অফিস শেষে সোজা বাসায় চলে এসেছে। এসেই লং শাওয়ার নিল। শাওয়ার নেওয়ার পরেই বেশ রিল্যাক্সড ফিল করছে সে। কিচেনে গিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে এসে বসল বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে। কফির মগে চুমুক দিতে দিতেই আজকের দিনের সমস্ত ঘটনা তার মস্তিষ্ক ভিজ্যুয়ালাইজ করছে। ছোঁয়া চাইছে তার চিন্তার গাড়িটা থামাতে। কিন্তু সে ছুটে চলেছে নিজ গতিতে। থামবার নাম নেই। মোবাইলের তারস্বরে বাজার শব্দে সে সম্বিৎ ফিরে পেল। সাইফ কল করছে। ছোঁয়া নিজের মাথায় চাটি মারল। সে ভুলেই গিয়েছিল সাইফকে কল করার কথা। কলটা রিসিভ করতেই সাইফ তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘কই তুই? আমাকে তো এখন একেবারে তোর এমপ্লয়ি বানিয়ে ফেলেছিস।’

‘স্যরি দোস্ত! আমি ভুলে গিয়েছিলাম। খুব ক্লান্ত ছিলাম রে।’ ছোঁয়া অপরাধীর সুরে বলল।

‘কী এমন রাজকার্য সাধন করেছিস? বল তো। যার কারণে এত ক্লান্ত তুই।’ চেঁচিয়ে বলল, সাইফ।

‘দোস্ত বলছিলাম না আজ একটা প্রেজেন্টেশন ছিল তার উপর নতুন বস। সব মিলিয়ে একদম রুদ্ধশ্বাস অবস্থা ছিল।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এমনিতেই তো আমি উদার মানসিকতার তাই এবারের মতো মাফ করলাম।’ সাইফ শার্টের কলার উঁচিয়ে বলল ফোনের ওপাশে যদিও ছোঁয়া তা দেখতেই পেল না।

‘দোস্ত দিস ওয়াজ দ্যা লাস্ট টাইম।’ মিনমিনে কণ্ঠে বলল, ছোঁয়া।

‘এরকম কত লাস্ট টাইম ছিল মনে আছে তোর?’

‘ওই একটু হয় আরকি। তুই তো আছিস আমার জিগরি দোস্ত। আমার বডি গার্ড।’

‘শেষমেশ বডি গার্ডের উপাধিটাও দিয়ে দিলি!’ সাইফ প্রাণবন্ত হেসে বলল।

‘না দিয়ে উপায় নেই রে। মা তো তোকে এমনিতেও সত্যিকারের বডিগার্ড বানিয়ে রেখেছে আমার জন্য।’ ছোঁয়া প্রশান্ত কণ্ঠে বলল।

‘খালামণি আসলে তোকে নিয়ে খুব চিন্তা করে। তাই আমাকে বডিগার্ড বানিয়ে দিয়েছে। তবে আমার কিন্তু এই দায়িত্ব পালন করতে বেশ লাগে। সুন্দরী রাজকন্যার বডিগার্ড হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার কিন্তু।’ সাইফ অবিচলিত কণ্ঠে বলল।

‘আবার শুরু করলি?’ ছোঁয়া বলল, অভিযোগের সুরে।

‘শুরু করার কি আছে? আমি তো সত্যি কথাই বলছি।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। এবার ক্ষান্ত হও জনৈক সত্যবাদী মহাপুরুষ।’ ছোঁয়া বলল, দুষ্টুমির স্বরে।

‘কী ব্যাপার! আমাকে রেখেই দুই বন্ধুতে জম্পেশ আড্ডা চলছে? কী স্বার্থপর রে তোরা!’ মায়া বলল, কপট তিরস্কার করে।

মায়াকে দেখে ছোঁয়া সাইফকে বলল, ‘দোস্ত রাখছি। মায়ারানী বাসায় এসে গেছে। কাজ শেষে তুইও চলে আসিস।’ এটুকু বলেই ছোঁয়া কল কেটে দিল।

‘আচ্ছা, এবার বল। কী হয়েছে?’ মায়া ছোঁয়ার পাশে বসে জানতে চাইল।

‘আর বলিস না। আজ আমার শ্বাসরুদ্ধ হবার জোগাড় হয়েছিল।’ ছোঁয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল।

‘কেন ? কী হয়েছে? জলদি বল। আমার শান্তি ভ্রষ্ট করিস না।’ মায়া বলল, ব্যস্ত ভঙ্গিতে ।

‘শোন, তোকে বলেছিলাম না আমার নতুন বসের কথা?’

‘হ্যাঁ বলেছিলি। কী করেছে সে? উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে তোকে?’ মায়া এক নিঃশ্বাসে প্রশ্ন করে বসল।

‘আরে থাম তো। এত প্রশ্ন একসাথে! আমি কি পালিয়ে যাব না-কি? ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলেই তো পারিস।’

‘আচ্ছা, কী করেছে সেটা তো বল।’

‘কী করেছে না । কে সে সেটা জানিস?’

‘না বললে জানব কী করে?’

ছোঁয়া দম আটকে চোখ বন্ধ করে বলল, ‘হি ইজ নান আদার দ্যান শিহরণ।’

‘হোয়াট?’ মায়া চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘তুই সত্যি বলছিস।’

‘হুম। মিথ্যে বলব কেন? আমি তো তাকে দেখেই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছি। আমার চারপাশটা থমকে গিয়েছিল। বহু কষ্টে প্রেজেন্টেশন কমপ্লিট করেছি।’

‘ওয়েট। তুই কি এখনো পছন্দ করিস শিহরণকে?’

‘পছন্দ? শিহরণকে?’ ছোঁয়াকে বিভ্রান্ত দেখাল।

‘পছন্দ করিস কি না বল।’ মায়ার একরোখা প্রশ্ন।

‘জানি না রে দোস্ত।’ ছোঁয়া হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘আমি একদম বুঝতে পারছি না।’

‘তাহলে তুই অমন ফিল করছিলি কেন?’ মায়া ছোঁয়ার এক হাত চেপে ধরে জানতে চাইল।

‘হয়তো অনেকদিন পরে হঠাৎ দেখা হয়েছিল বলে।’ ছোঁয়া প্রসঙ্গ এড়াতে বলল।

‘যাইহোক তোর ব্যাপারটা বাদ দে। শিহরণের অভিব্যক্তি কেমন ছিল?’ মায়ার চোখে মুখে রাজ্যের কৌতূহল খেলল নিমিষেই।

‘এই ছেলেটাকে আমি একদম বুঝতে পারি না। আমাকে দেখার পর তার আলাদা কোনো অভিব্যক্তি আমার চোখে পড়েনি। তাছাড়া তার ভাবখানা এমন ছিল যে আমাকে দেখা তার জন্য এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।’

‘উঁহু! ব্যাপারটা হয়তো এমন যে, সে তোকে চিনতে পারেনি বা হয়তো তুই ওর জন্য বিশেষ কেউ না।’

‘হতে পারে। বাদ দে। সেও আমার জন্য বিশেষ কেউ না। হি ইজ জাস্ট মাই বস। দ্যাটস ইট।’

‘মায়া আপু! নাশতা খেয়ে তারপর গল্প করো। তোমাদের গল্পের তো শেষ নেই।’ হিয়া নাশতা নিয়ে এসে ডাকল মায়াকে।

হিয়ার ডাক শুনেই ছোঁয়া আর মায়া ব্যালকনি থেকে বেরিয়ে রুমে এসে দেখল হিয়া টোস্ট, স্যান্ডউইচ আর চা নিয়ে এসেছে।

মায়া বলল, ‘তুমি আবার এসব করতে গেলে কেন আপু? আমি তো নাশতা সেরেই এসেছি।’

‘এই হালকা নাশতা খেলে তেমন কিছুই হবে না।’ হিয়া সহাস্যে বলল।

ছোঁয়া হিয়ার সাথে তার মিলিয়ে বলল, ‘একদম ঠিক বলেছে হিয়া। এই হালকা নাশতা খেলে তোর স্লিম ফিগারের কোনো ক্ষতি হবে না।’

‘মায়া আপু! বিয়ে নিয়ে তো বেশ পরিকল্পনা করে ফেলেছ। কিন্তু তোমার উনার সাথে কবে পরিচয় করাবে?’

‘হিয়া! আমারই এখনো সৌভাগ্য হলো না তাকে দেখার। তোমাকে কীভাবে দেখাই বলো তো? অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হলে যা হয় আরকি!’

ছোঁয়া আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, ‘অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হলেই বেটার। পালিয়ে যাওয়ার ঝামেলা নেই। মান-অভিমান ভাঙানোর ঝামেলা নেই। কাউকে রাজী করানোর ঝামেলা নেই। সারাক্ষণ মোবাইলের পেছনে পড়ে থাকতে হয় না। লাভ ম্যারেজের বহু ঝামেলা । তার চাইতে বরং অ্যারেঞ্জই ঢের ভালো।’

‘ছোঁয়াপু! তুমি কি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করেবে?’

হিয়ার প্রশ্নে ছোঁয়া যেন একটু ভড়কে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘অবশ্যই অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করব। দেখছিস না মা কেমন সার্চ লাইট নিয়ে আমার বর খুঁজতেছে।’

মায়া আর হিয়া হাসতে হাসতে সমস্বরে বলল, ‘তা একদম ঠিক বলেছিস।’

‘একবার পেয়ে গেলেই তোর গলায় ঝুলিয়ে দিবেন।’ মায়া টিপ্পনী কাটল।
___________________________

বৃষ্টিতে ভেজার কারণে রাদিদের জ্বর উঠেছে। নওশীন হক বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ জলপট্টি দিতে দিতে বকলেন। নীরাকে বললেন রাদিদকে জলপট্টি দিতে। তারপর তার জন্য স্যুপ রাঁধতে রান্নাঘরে গেলেন।

নীরা মুখে রাজ্যের বিরক্তি এনে অভিযোগের সুরে বলল ,’আমাদের নবীণবরণ অনুষ্ঠানের আগেই তোমাকে জ্বর বাঁধাতে হলো কেন শুনি?’

রাদিদ ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, ‘আমি কি ইচ্ছে করে জ্বর বাঁধিয়েছি? জ্বর কি আসার আগে আমার পারমিশন নিয়েছিল?’

‘হয়েছে, তোমার জ্ঞানগর্ভ ভাষণ নিজের কাছেই রাখ। এমনিতে তো কঞ্জুসরাজা! কিন্তু জ্ঞান বিতরণের বেলায় একেবারে হাজী মুহাম্মদ মহসীন হয়ে যাও।’ নীরা চোখ মুখ কুঁচকে বলল।

‘হাজী মুহাম্মদ মহসীন হওয়া কি এত সোজা? উনার জীবনী পড়ে দেখিস তাহলে বুঝতে পারবি…।’ রাদিদের ভাঙা গলায় দেয়া পাল্টা জবাব মাঝপথেই থামিয়ে দিল নীরা।

সে প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘আমার এই মহান ব্যক্তির জীবনী পড়ার ইচ্ছে নেই। কারণ তুমি এত উদার একজন মানুষের জীবনে পড়েও কিপ্টেই থেকে গেলে! তাই আমি নিজেকে কিপ্টে বানাতে চাই না। এমনিতেই আমি তোমার চাইতে ঢের বেশি উদার মানসিকতার।’

রাদিদ প্রত্যুত্তরে কিছুই বলল না। চোখ বুজে রইল। নীরা জলপট্টি দিচ্ছে ক্রমাগত। আর
বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘সামান্য ট্রিট চাইলাম। তাতেই হাজী সাহেব আমাকে ধরিয়ে দিলেন শর্তের এক খসড়া!’

‘কিছু বলছিস?’ রাদিদ চোখ বুজেই প্রশ্ন করল।

‘না!’ টেনে টেনে বলল নীরা। তারপর আক্ষেপের সুরে বলল, ‘তোমাকে কিছু বলার সাধ্যি কি আমার আছে?’

‘সাধ্য নেই তারপরেও কতকিছু বিড়বিড় করে বলছিস। সাধ্য থাকলে যে কী হতো কে জানে!’ রাদিদের সোজাসাপ্টা উত্তর।

নওশীন হক স্যুপ নিয়ে আসলেন। কিন্তু রাদিদ খেতে চাইছে না। তিনি ধমকে উঠলেন। বললেন,’তোর এসব ধানাইপানাই আমার কাছে চলবে না। এসবকিছু তোর মায়ের জন্য রেখে দে। ভাবি তো বড়ো খোকা বলতেই অজ্ঞান।’

ফুফুর ধমক শুনে রাদিদ চুপসে গেল। উঠে বসার চেষ্টা করল। নীরা তাকে সাহায্য করল। খাটে হেলান দিয়ে বসতেই নওশীন হক আবার ধমকালেন। বললেন, ‘ছাতা নিয়ে গেলে তো বৃষ্টিতে ভিজতে হতো না। বৃষ্টি যখন এলোই ভিজার কী দরকার ছিল? এমন তো না যে বৃষ্টি আর থামতোই না।’

রাদিদ বৃদ্ধ দাদুর কথাটা চেপে গেল। ছাতাটাও বারান্দায় রেখে দিয়েছে। বললে ফুফু বরং খুশিই হবেন। কিন্তু রাদিদের বলতে ইচ্ছে করল না। মাঝেমধ্যে বকার মধ্যেও গভীর ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। একটু বুঝে নিতে হয়। যদিও রাদিদের ফুফুর ভালোবাসা প্রকাশের ধরনটা প্রচ্ছন্ন নয় বরং প্রকট। তবুও যেসব ক্ষেত্রে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ প্রচ্ছন্ন সেসব ক্ষেত্রে অপরপক্ষের মানুষটিকে বুঝে নিতে হয় ভালোবাসার মানুষটির অব্যক্ত শব্দগুলো। রাদিদ জানে ফুফু তাকে অনেক বেশিই ভালোবাসেন। তাই এসব বকা শুনে তার মধ্যে এক প্রকার ভালোলাগা কাজ করছে।

নীরা তার মাকে বলল, ‘আম্মু! আমি মামিকে কল করে বলি যে রাদিদ ভাইয়ার জ্বর হয়েছে তাই এখানে আরও কয়েকদিন থাকবে।’

নওশীন হক বাধা দিয়ে বললেন, ‘কল করার দরকার নেই। এই জ্বর সেরে যাবে। এত চিন্তার কিছু নেই। খবর দিলে ভাবি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে আবারও অসুখ বাঁধাবে।’

রাদিদকে স্যুপটুকু খাইয়ে দিয়ে তিনি ওষুধ খাইয়ে দিলেন। তারপর আবার কঠিন গলায় বললেন, ‘তোর মাকে কিছু বলিস না। চিন্তা করবে। তারপর নিজেই অসুখ বাঁধাবে। তখন আবার তোরই দৌড়াদৌড়ি করা লাগবে। তোর ছোট ভাই আর বোনটা তো মানুষ হলো না। এদের দিয়ে হালের চাষও করা যাবে না।’

রাদিদ মৃদু স্বরে বলল, ‘ফুফু! মাকে আমি এমনিতেও বলতাম না। মাকে তো আমি চিনি।’

নওশীন হক চলে যাবার আগে রাদিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখন ঘুমিয়ে পড় বাবা।’

নীরা তাই দেখে মুখ ভেংচি কাটল। বিড়বিড় করে বলল, ‘সব আদর ভাইয়ের ছেলেকেই উজাড় করে দেয়। আমি যেন বানের জলে ভেসে আসছি! আমার বেলায় সবাই কিপ্টে!’

রাদিদ তাই দেখে মুচকি হাসল। কিছু বলার জোর নেই। চোখ বুজে রইল। নীরা আদুরে গলায় বলল, ‘ভাইয়া! তুমি আমার সাথে আমাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে যাবে? প্লিজ, ভাইয়া প্লিজ।’ নীরা এই কথা বলে রাদিদের কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করতেই থাকল।

রাদিদ আর সহ্য করতে না পেরে চোখ খুলল। নীরার আকুতিভরা চোখ-মুখ দেখে সে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। যাব।’

নীরা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘তোমাকে তো যেতেই হতো।’ তারপর ধীর পায়ে হেঁটে দরজার কাছে যেতেই মৃদু স্বরে স্বগোতক্তি করল, ‘আই হ্যাভ টু কমপ্লিট মাই মিশন বাই হুক অর বাই ক্রুক।’
________________________

অতল লাইব্রেরিতে আসতেই আয়মান ধরল ওকে। দুদিন ধরে কল করে না পাওয়াতে আজ আর কোনো রিস্ক নিল না সে। লাইব্রেরির গেইটের সামনেই পায়চারি করছিল সে। অতলের উপর রাগ করে আছে। প্রচণ্ড আক্রোশ ভরা কণ্ঠে বলল,’শালার ব্যাটা! তোরে কল করতে করতে মইরা গেলেও তোর কোনো খবর থাকে না।’

‘তুই মরবি আমার কেন খবর হবে? খবর তো হবে তোর।’ অতলের নির্বিকার উত্তর।

‘তোর মতো স্বার্থপর একজন মানুষ আমার বন্ধু!’ আয়মানের কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময়। বিস্ময় ছাপিয়ে দুঃখ ভরা কণ্ঠে সে পুনরায় বলল, ‘ আমার ভাবতেই কষ্ট লাগতেছে যে তুই আমার বন্ধু। তোরে কত ক্যাঁচাল থেকে বাঁচাইলাম আর তুই আমার লগেই ভাব নিতাছস! সব কপাল আমার।’ শেষ কথাটা বলতে বলতে আয়মান কপাল চাপড়াল।

‘তোর কষ্ট লাগলে লাগুক। আমি এমনই। এমনই থাকব। ভালো মানুষির দাম নাই। তাই আমি ভালো মানুষ আর হতে চাই না।’ অতলের কণ্ঠে বিষাদ ঝরে পড়ছিল। কপালে ভাঁজ পড়ে গেল তার। চোখে খেলল এক অদ্ভুত রকমের দ্বন্দ্ব। কিন্তু মুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নিল।

আয়মান নিজের রাগকে সংবরণ করে কোমল সুরে বলল, ‘দোস্ত! তোকে না আমি একদম বুঝতে পারি না। তোর চাইতেও আমার রুবিকিউবের পাজল মেলানো ঢের সহজ মনে হয়।’

‘তোরে নিষেধ করছে কে? যা গিয়ে রুবিকিউব মিলা গিয়ে।’ অতল তেজী গলায় বলতে বলতে লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়ল।

ব্যাগ থেকে এক এক করে সব বই আর খাতা বের করে পড়া শুরু করেছে সে। আয়মান ভ্যাবলাকান্তের মতো খানিকক্ষণ চেয়ে থাকল অতলের দিকে। মনে মনে ভাবল অতল আসলে ঠিক কোন দেশি পাজল! সে কোনোভাবেই মেলাতে পারে না কেন? তার চরিত্রের কোন দিকটা আসল আর কোন দিকটা নকল সেই বিষয়ে সে রীতিমতো দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। আর শুধু সেই বা কেন? বলতে গেলে তার বন্ধুদের মধ্যে কেউ অতলকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এসব ভাবতে ভাবতেই আয়মান বিড়বিড় করে বলল, ‘শালা! মুখোশধারী কোথাকার!’

অতল সেটা শুনে ফেলল। বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলল, ‘আমি মুখোশধারী হলে তোর সমস্যা কোথায়? আমি কি তোর বাপের হোটেলে খাই? আমি আমার বাপের হোটেলে খাই । সো ডোন্ট কল মি দ্যাট এগেইন। গট ইট?’

আয়মান এবার একটু ভড়কে গেল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘দোস্ত, রিয়ানা তোকে খুঁজছিল? পুরো ক্যাম্পাস করেছে ব্যাপারটা।’

অতল প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ল। তার হাতে থাকা মোটাসোটা নতুন বিশ্বের বইটা টেবিলের উপর ধপাস করে রেখে বলল, ‘শালা! এতক্ষণ পরে বলছিস! আগে বলবি না?’

লাইব্রেরিতে এখনো তেমন কেউ আসেনি। কেবল একটা বোরখা পরিহিত মেয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল। এহেন বিকট আওয়াজ হওয়াতে আপাদমস্তক বোরখায় আবৃত মেয়েটা নেকাবের আড়াল থেকে একবার চোখ তুলে তাকাল অতলের দিকে। অতল তার দৃষ্টিকে একেবারেই অগ্রাহ্য করল। মেয়েটা যথেষ্ট বিব্রতবোধ করল এমন বিকট আওয়াজে। পড়াতে ব্যাঘাত ঘটাতে বিরক্ত বোধও করছে বোধহয়। তার চোখে অবশ্য তার দৃশ্যমান প্রকাশ ঘটেছে।

‘বলার জন্যই তো তোকে কল করেছিলাম দুইদিন ধরে। কিন্তু তুই তো চান্দের দেশে ছিলি। তাই বোধহয় রিসিভ করতে পারিস নাই।’ আয়মান এই সুযোগে খোঁচা মারতে ভুলল না।

‘আই নিড টু টক টু ইউ।’ অতল লাইব্রেরিতে রিয়ানাকে দেখে হকচকিয়ে গেল।

থতমত খেয়ে বলল, ‘তুমি এখানে কী করছ?’ পরক্ষণেই কণ্ঠে যথেষ্ট গাম্ভীর্য এনে বলল,’ আই টোল্ড ইউ দ্যাট ইটস্ ওভার।’

‘বাট আই ওয়ান্ট টু নোউ দ্যা রিজন। ইউ ক্যান্ট ডিচ মি উইদাউট এনি সলিড এরর।’

অতল তার বইখাতা গুছিয়ে নিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে পড়ল। একে একে ছাত্র, ছাত্রীরা প্রবেশ করছে লাইব্রেরিতে। তাই এখানে সিনক্রিয়েট হোক তা সে চায় না। আয়মান আর রিয়ানাও তার পেছন পেছন বেরিয়ে এলো। বোরখা পরিহিত মেয়েটা ভ্রু কুঞ্চিত করে একবার তাদের যাওয়ার পানে দেখে আবার পড়াতে মনোনিবেশ করল।

লাইব্রেরি থেকে বেশ দূরত্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অতিকায় বৃক্ষের ছায়ায় দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অতল। সে ভাবতেও পারেনি মেয়েটা এভাবে লাইব্রেরিতে চলে আসবে!

কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। এত সিরিয়াস হওয়ার কী আছে অতল তা ভেবে পায় না! দ্যাট ওয়াজ অনলি টাইম পাস আফটার অল। রিয়ানা ভাঙা গলায় বলল,’ আই ওয়ান্ট ইউ টু…।

অতল তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বাম চোখের ভ্রু উঁচিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে বলল, ‘ইটস্ ওভার বিকজ আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ক্যারি অন দিস রিলেশন। গট ইট?’

রিয়ানার চোখ ছলছল করে উঠল। কাঁদো কাঁদো গলায় সে বলল, ‘অতল! প্লিজ তুমি এমন করো না। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি তো জানো এটা।’

‘প্লিজ, স্টপ রাইট দেয়ার।’ অতল তার ডান হাতটা উপরে তুলে বলল, ‘আমি এসব শুনতে চাই না। আই হ্যাভ মাই নিউ গার্লেফ্রেন্ড । সো ইউ ক্যান চুজ এনাদার ওয়ান। ইউ আর ফ্রি ফর দ্যাট।’

রিয়ানা এবার সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেলল। বলল,’ ইউ হ্যাভ টু পে ফর ইট।’

‘আ’ম কাইন্ড অফ রেডি ফর দ্যাট। সো ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু থিঙ্ক এবাউট ইট।’ রুষ্ট কণ্ঠে অতলের নির্বিকার উত্তর।

রিয়ানা ক্রোধে ফেটে পড়ল। কিন্তু ক্রোধকে সংবরণ করে কিছুই না বলে চোখে জল নিয়ে, বুকে পাহাড়সম কষ্ট নিয়ে চলে গেল। তার বন্ধুদের নিষেধ অমান্য করেই সে অতলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। এবার তার ফলাফল সে নিজের চোখেই দেখছে।

আয়মান থমথমে গলায় বলল, ‘দোস্ত! ডোন্ট ইউ হ্যাভ এনি মার্সি?’

অতল বিষাদ ভরা কণ্ঠে বলল, ‘নো। র্যাদার আই এনজয় ইট। ইট হেল্পস্ মি টু রিডিউস মাই পেইন।’

_________________________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে