চিরেকুটের শব্দ পর্ব-০১

0
1370

#চিরেকুটের শব্দ (পর্ব ১)
#মেহেদী হাসান রিয়াদ

‘এখানে সাইন করে দাও অর্থি।’

ডিবোর্স পেপার টা সামনে এগিয়ে দিয়ে খুব শান্ত ভাবে কথাটা বললো অর্ণব।
বিয়ের প্রথম রাতে স্বামীর হাতে ডিবোর্স পেপার দেখে বুকটা কেঁপে উঠে অর্থির। মাথা তুলে অর্ণবের দিকে তাকালো। করুন চোখে ডেব ডেব করে তাকিয়ে আছে সে। বিয়ের প্রথম রাতে ডিবোর্স পেপারে সাইন করার ভাগ্যটা বোধ হয় তার কপালেই লেখা ছিলো।
অর্ণব আবার চোখের ইশারায় আবার বললো সাইন করতে। কিন্তু অর্থি করুন চোখে তাকিয়ে আছে। তার ধারণা অর্ণব একটু পর হুট করে বলবে, এটা মজা ছিলো।
কিন্তু তার ভাবনা জলে ফেলে অর্ণব তেজস্ব গলায় বলতেই ডিবোর্স পেপার হাতে তুলে নিলো অর্থি। হাতটা কাঁপছে খুব। কাঁপা হাতে সাইন করে দিলো চুপচাপ।
অর্ণব কাগজ টা হাতে তুলে নিলো। তার মুখের কোনে একটা হাসি ফুটে উঠলো। অর্থির দিকে তাকিয়ে বললো,
– তুমি তো সাইন করেই দিলে। এবার আমি সাইন করলেই সব শেষ। আগামি ছয় মাস তোমাকে এই বাড়িতেই কাটাতে হবে। এক কথায় তোমার জীবন টা নির্ভর করবে আমার সিদ্ধান্তের উপর। যেদিন আমি সাইন করে দিবো ওইদিনই তোমাকে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।

কিছু না বলে চুপচাপ বসে আছে অর্থি। খুব করে অশ্রশিক্ত হওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে চোখ দুটু। কিন্তু সে ভাগ্যের কাছে হেরে নিশ্চুপ। তার ভাগ্যটা এতো নিষ্ঠুর কেন তা ছোট থেকেই বার বার নিজেকে প্রশ্ন করে সে। অপুরুপ সুন্দর্যের অধিকারি অর্থি। তার চোখ দুটু যেন স্পষ্ট মায়াজাল। যে কেউ বন্ধি হতে পারে ওই চোখের দৃষ্টিতে। অনেক ছেলেই তাকে একবার দেখে ঘায়েল হয়েছে। একবার দেখেই বিয়ে করার স্বপ্ন দেখেছে অনেক ছেলে। তেমন করে অর্ণবও। মাথায় বুদ্ধিও প্রচুর। সুন্দর্য, বুদ্ধি, মেধা চরিত্রবান ধার্মিক কোনো দিকে কম নয় সে। সব গুনই আছে তার। তবে একটা গুনের অভাব আছে তার। আর তা হলো, সে কথা বলতে পারে না। যার কারণে তাকে একবার দেখে পছন্দ করা মানুষগুলোও এই সত্যটা জানার পর পিছু হেটে দুরে সরে যেত। খুব কষ্ট হতো অর্থির। মাঝে মাঝে আড়ালে বসে কেঁদে কেঁদে মনে মনে আল্লাহ্ কে প্রশ্ন করতো, কেন তাকে এই গুনটা থেকে বঞ্চিত করেছে আল্লায়।
সব সময় স্বপ্ন দেখতো তার লাইফে এমন একজন মানুষ আসবে, যে তাকে বুঝবে। সুদর্শন হতে হবে না। ভালো মনের একটা মানুষ হলেই হবে। তাকে বুঝবে এমন একটা মানুষ। চিরেকুট দিয়ে কথা বলবে তার সাথে। মনের কথা। গোপন কথা। চিরেকুটের শব্দে প্রকাশ করবে তার ভালোবাসার বার্তা গুলো।

অনেক্ষন ধরেই অর্ণবের ফোন টা বেজে চলছে। ফ্রেশ হতে ওয়াশ রুমে ঢুকেছ অর্ণব। অর্থি এখনো ওই রকম করেই বসে আছে। বার বার বেজে উঠা অর্ণবের ফোন নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই তার। কিন্তু কে এমন মানুষ, যে আজ বাসর রাতে একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে? জানার ইচ্ছে হলেও ফোনের দিকে তাকালো না অর্থি। যদি অর্ণব রেগে যায়?

একটু পর টাওয়াল দিয়ে হাত মুখ মুছে বেড়িয়ে আসে অর্ণব। খাটের এক পাশে ফোন টা বাজতে দেখে এগিয়ে গিয়ে ফোন টা তুলে নিলো সে। দেখে তার গার্লফ্রেন্ড ঈষিতার ফোন। কান্নার ইমোজি দিয়ে ভরা মেসেন্জার। ফোন রিসিভ করে বেলকনিতে চলে গেলো অর্ণব। ফোনের ওই পাশ থেকে ভেষে আসছে ঈষিতার কান্নার শব্দ।
– তুমি এমন টা কেন করলে অর্ণব? আমার ভালোবাসায় কি কমতি ছিল? তুমি যখন যা চেয়েছো, যেভাবে চেয়েছো, সেভাবেই পেয়েছো আমার। তোমার ভাবলোবাসা প্রমানের জন্য সব করেছি আমি। তুমিও তো আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলে আমার কখনো ছারবে না, তাহলে কেন এমন করলে অর্ণব? আমি তোমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসি অর্ণব।

ঈষিতাকে কি বলবে তা বুঝতে পারছে না অর্ণব। যে একটা ঘোরের মাঝে অর্থিকে বিয়ে করেছে সে। অর্থির মায়াজালে আটকে গিয়েছিলো সে। তা কিভাবে ঈষিতাকে বুঝাবে?
অর্ণব কে চুপ থাকতে দেখে কাঁন্নার বেগ বাড়িয়ে দেয় ঈষিতা। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– চুপ করে আছো কেন অর্ণব। কিছু বলো, আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। পাগল হয়ে যাবো আমি তোমাকে না পেলে। মরে যাবো আমি।
একটা দির্ঘশ্বাস ছারলো অর্ণব। শান্ত ভাবে বললো,
– তোমাকে আমি সব বলবো ঈষিতা। প্লিজ ভুল বুঝোনা।
– ভুল বুঝার আর কি বাকি রেখেছো তুমি? কিভাবে পারলে আমায় এতো স্বপ্ন দেখিয়ে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করতে?
– প্লিজ ঈষিতা মাথা ঠান্ডা করো। আমি তোমায় সব বুঝিয়ে বলবো। আমি তোমার থেকে হারিয়ে যাই নি, আছি আমি।
আর কিছু না বলে শুধু কাঁদছে ঈষিতা।

ফোন রেখে রুমে আসলো অর্ণব। তার চোখে পরলো অদ্ভুত সুন্দর একটা মায়াবি পরী। বৌ সেজে বসে আছে তার খাটের উপর। ইচ্ছে করছে এই মায়াপরী কে নিয়ে সারা জীবন একজসাথে কাটিয়ে দিতে। সৃষ্টি কর্তা যেন সব সুন্দর্য তার মাঝে ঢেলে দিয়েছে।
কিন্তু তাকে নিয়ে চলবে কিভাবে সে? কিভাবে পরিচিত মানুষদের সামনে দাড়িয়ে পরিচয় করিয়ে দিবে যে, এটা আমার স্ত্রী? পরিচিত মানুষ গুলোই যখন প্রশ্ন করবে তখন তো কোনো উত্তর দিতে পারবে না সে। কারণ তার সেই শক্তি টা নেই।

– সারা রাত কি এভাবেই বসে কাটিয়ে দিবে, নাকি দয়া আমার একটু ঘুমাতে দিবে?
অর্ণবের কথায় খাটের এক পাশে সরে বসলো অর্থি। অর্থির বিপরিত দিকে ঘুরে শুয়ে পরে অর্ণব।
অর্থি চুপচাপ তাকিয়ে আছে তার দিকে। অর্ণব কিভাবে ফট ফট করে কথা শুনিয়ে শুয়ে পরলো। ইশ সেও যদি এভাবে কথা বলতে পারতো? তাহলে হয়তো তার ভাগ্য টা অন্য রমন হলো। তার বাবা মা তাকে নিয়ে এতো ভাবতে হতো না। আশে পাশের মানুষগের মুখে শুনতে হতো না, ‘এই মেয়েকে বিয়ে দিবে কিভাবে’?

এই ঘরে আশার পরও অনেকে হাসি মুখে নতুন বৌ দেখতে এসে গোমড়া মুখে চলে গেছে। কারণ নতুন বৌ তাদের কোনো কথারই উত্তর দেয় নি।
এর পর একে একে সবাই চলে গেলো। কারো মুখে বলতে শুনেছে, অর্ণব ভাই এমন রোবটকে কিভাবে বিয়ে করলো? বৌ নাকি কথা বলতে পারেনা। এটা কোনো কথা?

এসব শুনে একটুও মন খারাপ হয়নি তার। কারণ এসব কথা শুনতে শুনতে সে ছেটবেলা থেকেই অভ্যস্থ। চুপচাপ বসে ছিলো তার বিয়ে করা স্বামির জন্য। তার বিশ্বাস ছিলো, এই মানুষ টা তাকে একটু হলেও বুঝবে। তার জীবনে এই একটাই মানুষ এসেছে যে তার রাগ, ভালোবাসা, অভিমান সব কিছু চোখের দেখাতেই বুঝবে। মুখ ফুটে বলতে হবে না।
কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমান করে, রুমে ঢুকে প্রথমেই ডিবোর্স পেপার এগিয়ে দিলো তার দিকে। এর চেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে তার জন্য?
অর্ণবের উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে আছে অর্থিও। ঘুম আসছে না। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে আজ। নিজের ফ্যামিলিকে ছেরে যেই মানুষটার হাত ধরে সারা জীবনের জন্য চলে এসেছিলো সেই মানুষটাই তাকে বুঝলো না।
চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে বালিশে পরলো। তার জীবনটা এমন কেন হলো?

সকালে রাঙা প্রভাতের মিষ্টি আলোয় চার পাশ ভরে গেছে। অর্ণবের ঘুম ভেঙে গেলো। দেখে তার থেকে অনেকটা দুরে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে মেয়েটা। দেখে মনে হচ্ছে হিংস্র বাঘের খাচায় পরে সে ভয়ে একপাশে গুটিশুটি মেরে আছে।
অর্ণব খাট থেকে নেমে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো। এক চিলতে আলো এসে অর্থির মুখ কে স্পর্শ করতেই অর্ণব অসম্ভব মুগ্ধতা খুজে পেলো সেই মুখে। আচ্ছা ঘুমন্ত মেয়েটাকে তার কাছে এতো মায়াবি লাগছে কেন? ইচ্ছে করছে তার পাশে বসে কোলে মাথা তুলে নিয়ে সারা মুখ জুড়ে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিতে। এটাও কি পূর্বের মতো একটা ঘোর?

অর্থির থেকে চোখ ফিরিয়ে বেলকনিতে গিয়ে দাড়ায় অর্ণব। বাইরে কয়েকজন মানুষ কাজ করছে। আার ঘরেও অনেকের কথা বার্তা শুনা যাচ্ছে। সকলে উঠে গেছে তারাতারি। হটাৎ বাড়ির গেটে চোখ পরতেই দেখে ঈষিতা বাড়ির ভেতরে আসছে। ঈষিতাকে দেখেই যেন অবাকের চরম সীমানায় পৌছে গেলো অর্ণব।
ঈষিতার এমন উপস্থিতি তার শরিরে অদ্ভুত এক শিহরণ তৈরি করে মুহুর্তেই।
বিয়ে বাড়িতে প্রাক্তন প্রেমিকার সিনক্রিয়েট। এমন টা হলে মান ইজ্জতের চিরেফোঁটাও থাকবেনা আজ।

To be continue,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে