চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-১০

0
323

#চিত্রলেখার_কাব্য
দশম_পর্ব
~মিহি

“এসব লেখাকে জানানোর দরকার নেই সাথী। যা হবে আমি সামলে নিব, তুমি ভুলেও ওকে কিছু বলতে যেও না।” সাথী অর্ণবের কথায় মাথা নাড়ায়। এছাড়া উপায় নেই। চিত্রলেখা অপর্ণার বলা কথাগুলো কিংবা ঘটনাটা জানতে পারলে মানসিকভাবে আঘাত পাবে। এমনিতে শক্ত দেখালেও চিত্রলেখা মানসিকভাবে মারাত্মক দুর্বল। পরিস্থিতি অনুযায়ী সামলে চলার সামর্থ্য তার খুব কম। হয়তো অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য কিংবা নিষ্ঠুর শৈশবের বদৌলতে সে নিজেকে খুব দুর্বল ভাবে।

চিত্রলেখা গোসল সেরে বেরিয়ে সোজা শুয়ে পড়লো। বাইরে কী ঘটলো না ঘটলো সে খোঁজ নিতেও আসলো না। রাতের খাবার খেতেও ইচ্ছে করলো না তার। আনমনে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো রঙ্গনের মেসেজ। সেদিকে ধ্যান দেওয়ার রুচিটুকুও হলো না। রঙ্গন নামটা মাথায় আসতেই তার নরপশু মামার দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে চিত্রলেখার। ফোন পাশে রেখে কাঁথা মুড়ি দিল সে।

___________________

-তুই যাস না রঙ্গন, আমি সত্যিই দুঃখিত।

-দেখ রাহাত, আমি তোদের জন্য যাচ্ছি না এটা বিশ্বাস কর। আমার একটা জবের অফার এসেছে। আমার ওদিকে শিফট হওয়াটা দরকার।

-তুই ভুল বুঝিস না আমাকে।

-বন্ধুত্বে ভুল বোঝাবুঝি থাকে না, থাকলে সেটা বন্ধুত্ব থাকে না।

-আমাদের মাঝে কোনটা থাকবে না? ভুল বোঝাবুঝি নাকি বন্ধুত্ব?

রঙ্গন উত্তর দিতে পারলো না। শত চেষ্টা করলেও কিছু ক্ষত মিটানো যায় না। রাহাত এবং অবনী যেভাবে তাকে অবহেলা করেছে তারপর এসব কাণ্ড সে আদতে ভুলতে পারবে? রাহাতকে মিথ্যে আশা দিয়ে লাভ নেই। রঙ্গন চুপ থাকলো। ফোনের দিকে গভীর মনোযোগ দিল। অলকানন্দা অনলাইনে এসেছিল কিন্তু তার টেক্সট সিন করেনি। রঙ্গনের এবার মনে হলো এটা নিশ্চিত ফেইক আইডি তবুও কৌতুহল কিংবা কোনো এক টানে মেয়েটার প্রোফাইল ঘাঁটতে লাগলো। বিশেষ কিছুই নেই। দু-চারটে গানের ভিডিও শেয়ার করা আর কিছু কবিতা। গানগুলো একের পর এক শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ করলো রঙ্গন।

________

-লেখা, চুপচাপ খেতে চল।

-ভাবী, আমার ভালো লাগছে না। খাবো না।

-তুই উঠবি নাকি অর্ণব ভাইয়াকে ডাকবো?

-আসছি।

চিত্রলেখার সম্মতি পেয়ে সাথী বেড়িয়ে গেল। চিত্রলেখা উঠে বসলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুছলো। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লক্ষ করলো চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে। চশমাটা ভালোভাবে পড়ে খাবার টেবিলের দিকে এগোলো সে।

অর্ণব এক চেয়ারে বসেছে। বাকি সবগুলো চেয়ার ফাঁকা। চিত্রলেখা খানিকটা অবাক হলো। রূপসা তো বাবাকে ছাড়া খেতে বসে না আর অপর্ণা ভাবীও বাচ্চাদের ছাড়া খেতে বসেন না। বাড়ির পরিবেশটা অন্যদিনের তুলনায় বেশ থমথমে। বাচ্চাদের হইচইও নেই। চিত্রলেখার মন ভারাক্রান্ত। খাবার গিলতেও অসুবিধে হচ্ছে তার। কোনরকম ভাত নাড়াচাড়া করছে। বাচ্চারা না থাকায় আরো বিষণ্ণ অনুভব করছে।

-ভাইয়া, রূপসা রাদিফ কোথায়?

-আমার শ্বশুর একটু অসুস্থ। অপর্ণা বাচ্চাদের নিয়ে সেখানে গেছে।

-তুমি যাওনি ভাইয়া? সন্ধ্যেবেলা ভাবী একা গেল!

-অপর্ণার চাচা নিতে আসবে রাস্তায়।

চিত্রলেখা আর কিছু বললো না। বিষয়টা খানিকটা গোলমেলে। অপর্ণা ভাবীর বাবা অসুস্থ হলে তার চাচা নিজের ভাইকে রেখে ভাতিজিকে নিতে নিশ্চয়ই রাস্তায় আসবেন না! অর্ণবের মুখ দেখেই মিথ্যে ধরতে পারছে চিত্রলেখা। কিন্তু আজ বাড়তি কথা তার মুখে আসছে না। সবকিছু অসহ্য লাগছে তার। নওশাদ নামক লোকটাকে যথাসময়ে শাস্তি দিতে না পারার যন্ত্রণা ভয়ানক। একটা পুরুষ তাকে বিশ্রিভাবে স্পর্শ করলো আর সে অসহায়ের মতো কাঁদলো? কেন? একটা চড় দেওয়ার সামর্থ্যও তার ছিল না? চোখ অশ্রুজলে ভরে আসে চিত্রলেখার। ভাতের প্লেটে পানি ঢেলে নিজের ঘরের দিকে এগোয়। সাথী কিছু বলতে চেয়েও পারেনা। চিত্রলেখার বিষণ্ণতা তার চোখের আড়াল হয়নি। সাথী ভাবলো অহমের সাথে সখ্যতা জন্মানোয় টিউশনি ছেড়ে চিত্রলেখা কষ্ট পাচ্ছে তাই তাকে আর ঘাটলো না বেশি। অর্ণবের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। অপর্ণার চলে যাওয়াতে তার যেন কিছুই যায় আসছে না। নিজের মতো খাবার খেয়ে ঘরের উদ্দেশ্যে চলে গেল সে।

_________

সকাল হতেই অপর্ণার বাপের বাড়িতে ব্যস্ততা শুরু হয়। প্রত্যেকে ব্যবসায়ী মানুষ, তাই ন’টার মধ্যেও সকালের নাস্তা খাওয়া হয় সচরাচর কিন্তু আজ বাড়ির পরিস্থিতি ভিন্ন। গতকাল রাতে অপর্ণা রাগ করে বাচ্চাদের নিয়ে এ বাড়িতে এসে উঠেছে। অপর্ণার মা নিজের মেয়ের পাশ থেকে সরছেন না। অর্ণব অপর্ণার গায়ে হাত তুলেছে শুনে তিনি ক্ষুব্ধ। তাও কিনা সৎ বোনের জন্য বউয়ের গায়ে হাত! অপর্ণার বাবা একটু বিচক্ষণ মানুষ। তিনি অর্ণবকে সকাল সকাল আসতে বলেছেন বিষয়টা নিয়ে কথা বলার জন্য। অপর্ণা যদিও ও বাড়িতে ফেরা নিয়ে বিরোধ প্রকাশ করছে তবে নিজের বাবার সিদ্ধান্তের উপর কিছু বলার অধিকার তার নেই। অর্ণব যথাসময়ে এসে উপস্থিত হলো। অপর্ণার মা বিশেষ কোনো খাতিরদারির ব্যবস্থা করলেন না। অপর্ণার চাচীরা অর্ণবকে নাস্তা দিল। অর্ণব সেদিকে গুরুত্ব দিল না। সে এসেছে কথা বলতে, নাস্তা করতে নয়।

-আসসালামু আলাইকুম বাবা।

-ওয়ালাইকুম সালাম। কী শুনছি অর্ণব? তুমি অপর্ণার গায়ে হাত তুলেছো?

-ক্ষমা করবেন। অপর্ণা যা করেছে তার প্রেক্ষিতে আমি এটা করতে বাধ্য হয়েছি।

-কী করেছে সে? তোমার বোন কমবয়সী। তার জন্য চিন্তা করা অপর্ণার ভুল?

-অপর্ণা চিন্তা করেনি বাবা, সে আমার বোনের দিকে অপ্রীতিকর মন্তব্য করেছে। আমার বোনের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

-দেখো অর্ণব, এসব টুকটাক সব সংসারেই হয়। তুমি ওকে মাফ করে দাও এবং ঝামেলাটা মিটিয়ে নাও।

গুরুজনদের সামনে অর্ণব দ্বিমত প্রকাশ করলো না। বড়দের সিদ্ধান্ত মেনে নিলো কিন্তু বাঁধ সাধলো অপর্ণা।

-যদি তুমি তোমার বোনকে হোস্টেলে পাঠাও, তবেই আমি তোমার সংসারে ফিরবো। অন্যথায় যাবো না।

-অপর্ণা বাড়াবাড়ি করো না।

-বাড়াবাড়ি তূমি করছো। আর তোমার বোন, ঐ মেয়ে তো আরেক শয়তান। আমার টাকায় ফুর্তি করে বেড়ায়।

-তোমার টাকা? আর এই টাকা তোমাকে কে দেয়? আমিই তো! আমার টাকায় আমার বোন যা ইচ্ছে করবে, তুমি বলার কে?

-থাকো তোমার বোন নিয়ে। বাচ্চাদের আমি আমার কাছে রাখবো, ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবে। এখন তুমি ভাবো সৎ বোন নাকি বউ বাচ্চা!

অর্ণব কখনো ভাবেনি অপর্ণা ডিভোর্সের কথা তুলবে। রাগে তার মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে লাগলো। উপস্থিত সকলকে উপেক্ষা করে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অর্ণব এভাবে বেড়িয়ে যাবে তা অপ্রত্যাশিত ছিল অপর্ণার। সে ভেবেছিল এভাবে ভয় দেখালে কাজ হবে কিন্তু হিতে বিপরীত হলো বুঝতে পেরে সে কাঁদতে শুরু করলো। অপর্ণার মা মেয়ের কান্না সহ্য করতে পারছেন না। অর্ণব কিনা নিজের সৎবোনের জন্য তার মেয়েকে এভাবে ছুঁড়ে ফেলবে! কিসের এত দায়িত্ব ঐ মেয়ের প্রতি? নিজের বউয়ের চেয়ে বোনের প্রতি কেন দায়িত্ব বেশি থাকবে? নিজের বউ বাচ্চা আগে। মোটামুটি ভয়ঙ্কর একটা কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।

গতকালের ঘটনায় জ্বর এসেছে চিত্রলেখার। কলেজ যায়নি আজ আর। বিছানায় শুয়ে মাথা যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছিল সে। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। ফোন একটু দূরে ড্রেসিংটেবিলের উপর। চিত্রলেখা উঠার আগেই সাথী এলো।

-তুই অসুস্থ, তোর উঠতে হবে না। আমি নিয়ে আসছি।

-লাউড স্পিকারে দাও। সুবহা ফোন করেছে হয়তো।

-আচ্ছা।

সাথী ফোন রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিতেই অপর পাশ থেকে কেউ একজন অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে লাগলো। চিত্রলেখা কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।

-আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?

-এই ডাইনী! তোর শরম নাই? সালাম দিচ্ছিস? খুব সতী না তুই? নিজের ভাইয়ের সংসার ভেঙে আজীবন ঘাড়ে বসে খাইতে চাস? বেশরম বেহায়া! বাইরে রঙঢঙ করো ,খাও ভাইয়ের টাকায় আবার তার সংসারেই বিষ ঢালো। চুপচাপ হোস্টেলে চলে যাবি নিজের ভাইকে বুঝিয়ে। তোর জন্য যদি আমার অপর্ণার সংসার ভাঙে তোকে আর তোর ভাইকে আমি কী করবো তুই ভাবতেও পারবি না!

চিত্রলেখা কিছু বলার সুযোগ পেল না। আবারো কেউ একজন তাকে চরম দুর্বল প্রমাণ করে ছাড়লো। সামান্য প্রতিবাদের শব্দটুকু তার মুখ দিয়ে বেরোলো না। সাথী পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো। স্তব্ধ সে। চিত্রলেখার চোখ বেয়ে নোনা জলগুলো গড়িয়ে পড়ছে। আর কত ভাবে অপমানিত হতে বাদ আছে তার? কেউ তার সভ্রমে হাত দেয় তো কেউ চরিত্রে আর সে নগন্য প্রজাতির মতো চুপচাপ শোনে? সে কি আদৌ মানুষ নাকি পাথর?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে