চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙে পর্ব ৬১

0
2017

চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙে পর্ব ৬১
লেখা আশিকা জামান

চারদিকে ঝুম বৃষ্টি! কোথাও কিচ্ছু দেখার জোঁ নেই। যেন সমস্ত অন্ধকার মাথায় করে প্রলয়ঙ্কারী নৃত্যে মেতে উঠেছে দূরের আকাশ। ক্ষণে ক্ষণে আকাশের বুক চিরে আত্ন চিৎকারসম বিদুৎ চমকানোর আওয়াজ হচ্ছে৷
এবার অন্বেষার ভয় করছে। ভীষণ ভয়।
বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছাতা আনার প্রয়োজন হয়নি। কাচরঙা রোদ্দুর হঠাৎ নীকষ কালো আঁধারে ছেয়ে যাবে কে জানতো!

বড় রাস্তাটা পার হয়ে তখন অনন্যাদের বাসার সামনের রাস্তায় সে। রাস্তার মাঝখানে কিঞ্চিৎ গর্ত হয়ে বেশ পানি জমে গেছে। আনমনে হাটতে গিয়ে গর্তটার মুখোমুখি যখন ঠিক তখন-ই একটা গাড়ি হুড়মুড়িয়ে এসে গায়ে কাঁদা ছিটিয়ে দিয়ে যায়।

মুহুর্তেই মেজাজ খিঁচে যায়। গলা চড়িয়ে ডাকে,
” চোখ কী বাড়িতে রেখে এসে ড্রাইভ করছেন? জলজ্যান্ত মানুষের গায়ে কাঁদা ছিটানো কোন ধরনের ভদ্রতা। অসভ্য লোক কোথাকার!”
এলোপাথাড়ি কথার বুলেট দ্রুতগতিতে ছুড়ে দিয়ে সে ডানদিকে বাসার গেটের কাছাকাছি দাঁড়ায়।

আশ্চর্যজনকভাবে গাড়িটাও গেটের কাছাকাছি এসে থামল। মুহুর্তেই দরজা খুলে যে বেরিয়ে এলো তার জন্য অন্বেষা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।

” ওহ্ সরি! এক্সট্রেমলি সরি!” অনিক চশমা ঠিঁক করতে করতে বলে। অন্বেষা তখনও তীর্যকভাবে তাকিয়ে আছে। তা-ই দেখে অনিক মৃদু হাসে।
” আপনার গায়ে কাঁদা ছিটানোর কোন ইনটেনশন আমার নেই। প্লিজ বি পজেটিভ, নেগেটিভ কিছু ভেবে হাইপার হবেন না…
তাতে ক্ষতিটা আপনার-ই। ”

অন্বেষা কথা না বাড়িয়ে হনহন করে গেটের ভেতর ঢুকে গেল। অনিক অতিমাত্রায় বিস্মিত হয়ে পিছু নিল। এমন কাকভেঁজা হয়ে মেয়েটি তার বাসায়-ই বা কেন যাচ্ছে? এতক্ষণ ব্যাপারটা খেয়াল হয়নি। এবার বেশ ঘাবড়ে গেল। কী সাংঘাতিক এরমধ্যে-ই মেয়েটা তার বাসার ঠিকানাও যোগাড় করে ফেলল!

বাড়ির সামনের গার্ডেনের দিকটা শ্যাওলা জমেছে। বেখেয়ালে হাটতে গিয়ে ধপাস করে পড়তে গিয়েও আচঁমকা সে পড়লো না। ডান হাতে আর পিঠে অচেনা কারো স্পর্শে আৎকে উঠা দৃষ্টিতে অন্বেষা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।

” স্যরি! আপনি পড়ে যাচ্ছিলেন।” কথাটা বলেই অনিক হাত সরিয়ে নেয়।
অনিক হয়তো ভেবেছিল মেয়েটা তাকে,থ্যাংকস জানাবে কিন্তু না তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে তেতে উঠে বলল,
” আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন? এখানে কী! ভালোই ভালোই যান বলছি নাহলে খারাপ কিছু হয়ে যাবে!”

অনিক বিস্মিত হয়। কী সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা। চোরের উপর বাটপারি। আমারই বাসায় এসে এখন আমাকে-ই থ্রেট করা হচ্ছে!
” পিছু নিয়েছি আমি! হ্যাভ ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড!”

” নয়তো কী! একদিন আপনার সাথে চালাকি করে ফোন নম্বর নিয়েছিলাম তাই বলে পিছু নিয়ে আমার রিলেটিভের বাসা পর্যন্ত এসে পড়বেন! প্লিজ দয়া করে চলে যান। আমার এমনিতেও আজ মন মানিসিকতা ঠিক নেই। যাচ্ছেতাই কান্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারি।”

অনিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাহ্ যা ভেবেছিল তা নয়। তবে এই মেয়েটিকে সে কস্মিনকালেও দেখেছে বলে মনে পড়লো না। হবে হয়তো কোন আত্নীয় কে জানে! থাক কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। অনিক শান্ত গলায় বলল,
” আচ্ছা, আপনি যান। আমি পিছু নিচ্ছি না কেমন!”

অন্বেষা উত্তর না দিয়ে হনহন করে ভেতরে চলে যায়। অনিক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েটির চলে যাওয়া দেখে। এরপর এক ছুটে সে বাসার ছাদে উঠে। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে! শনশন শব্দে চারপাশ মুখরিত। বৃষ্টির ফোটা গায়ে মাখিয়ে নতুন করে আরোএকবার সে ছেলেবেলায় পৌছে গেল!

অনন্যা ড্রয়িংরুমেই ছিল অন্বেষার হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে৷ চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। অনন্যাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে- নিজেই বলল,
” অনন্যা আপু, ভাইয়াকে একবার ফোন করবে?”

” তুমি তো ভিজে গেছ! আগে চেইঞ্জ করে নাও। তারপর কথা বলছি। ” অন্বেষা কিছুক্ষন গাইগুঁই করেও কিছুই বলতে পারলো না। অনন্যা একরকম টেনে হিঁচড়ে নিজের রুমে নিয়ে যায়।

কিচেন থেকে আয়েশার গলা শোনা যায়।
” কে এসেছে রে অনন্যা? কার সাথে কথা বলছিস। ”

” অন্বেষা! ” নামটা শোনামাত্র আয়েশার মুখটা কালো হয়ে যায়। এখন সে নিজেও অনীলার উপর বিরক্ত।

ভিজে নেয়ে একাকার হয়ে অনিকের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়।
” এতবড় ছেলে বিয়ে করলে এখন দুই বাচ্চার বাপ হতি। বুদ্ধি সুদ্ধি কবে হবে! অকাল বৃষ্টিতে ভিজে আমার ঘর-বাড়ি সব ভিজিয়ে দিয়ে গেলরে!”
মায়ের বকুনির তোয়াক্কা না করে সে
ওয়াশরুমে না ঢুকে সরাসরি অনন্যার ঘরে চলে যায়। আয়েশা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকলেন।
” এখনো ছেলেমানুষী গেল না। অতি শীঘ্রই বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে.. ”

কিছুক্ষণ পর অনন্যার ঘর থেকে চিৎকারের শব্দ শোনা যায়। অনন্যা ধড়ফড়িয়ে উঠে। কিচেনে এসেছিল অন্বেষার জন্য নাস্তা নিয়ে আসতে। এরমধ্যে কী এমন ঘটলো!

” এক্সট্রেমলি সরি! বিশ্বাস করুন আমি আসলে…” অনিক কথাটা শেষ করতে পারে না অন্বেষা এক ঝটকায় অনিকরে সরিয়ে দেয়। চোখমুখ লাল করে তীক্ষ্ণ মেজাজে বলল,
” আমি কল্পনাও করিনাই আপনি এতোটাই ছ্যাঁচড়া! ছিঃ, অপরিচিত একটা মেয়েকে ভিজা শরীরে পেছন থেকে জাপটে ধরে এখন আবার বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে? এখানে আপনি আসলেন কী করে? ছিঃ! আপনাদের মতো পুরুষদের জন্যই মেয়েদের যেখানে সেখানে হ্যারাস হতে হয়।”
অনিক নির্বিকারভাবে অন্বেষার দিকে তাকায় চোখ মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কান্নারা এই উথলে পড়লো বলে! অপমানে ঘৃণায় তার পায়ের নীচটা শূন্য থেকে শূন্যতর লাগছে। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে যেন শত্রুও না পরে।

এরমধ্যেই অনন্যা হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে। ওঁকে দেখে অন্বেষা বলল,
” আপু এই অসভ্য লোকটা…! ” অন্বেষা কথাটা শেষ করতে পারে না কেঁদে ফেলে।

অনিক চোখমুখ ছোট করে লজ্জিত ভঙ্গিতে তাকায়। অনিকের সদ্য বৃষ্টিস্নাত দেহখানি দেখে অনন্যা বুঝে যায় আজও সেই পূর্বের মতোই অনিকের মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চেপেছিলো। কিন্তু ভাগ্য সহায় না হওয়ায় অনন্যার যায়গায় অন্বেষাকে জাপটে ধরেছে। অন্বেষার গায়ে অনন্যার জামা থাকায় ভুলটা যেন আরও প্রবলভাবে টেনেছে তাকে। কিন্তু এই বোকা মেয়েটাকে কী করে সামলানো যায়!
” ভাইয়া, তুই এখন যা! আমি দেখছি ব্যাপারটা।”

অন্বেষা ভ্রুকুটি করে তাকায়। অনন্যাকে ছেড়ে দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। কী সাংঘাতিক! ইনি অনন্যাপুর ভাইয়া! নাহ্ এবার আর ব্যাপারটা হজম হচ্ছেনা।

অনিক নিঃশব্দে স্থানত্যাগ করে তবে যাবার আগে অন্বেষার দিকে আড়চোখে তাকায়। লজ্জায় অন্বেষা তখন ফ্লোরে নখ খুটছিল। এবার যদি তার কুকীর্তির কথাও ফাঁস করে দেয়! অন্বেষা ঘামতে লাগল।

” অন্বেষা আর ইউ ওঁকে! ভাইয়া আসলে তোমাকে আমি ভেবেছিল। প্লিজ কিছু মনে করোনা। আমি ওর হয়ে স্যরি বলছি।”

অন্বেষা মাথা নাড়ায়। ব্যাপারটা এবার তার মাথাতেও ঢুকেছে। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে সে বলল, ” ভাইয়া আমার ফোন তুলছেনা। বাবা বাসায় নেই আমি একা! মা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে! কোথায় খুঁজব একা একা তাই তোমার কাছে এসেছিলাম!”

অন্বেষার গলাটা ধরে আসছে আর কিছু বলতে পারছেনা। অনন্যা তাকে থামিয়ে দেয়। তবে বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হয়না এইসব কিছু তার জন্যই হচ্ছে!
” অন্বেষা, তুমি খাওয়া দাওয়া করোনি দেখেই বুঝা যাচ্ছে। প্লিইজ কিছু মুখে দাও তারপর আমি দেখছি ব্যাপারটা!”

অন্বেষা খেতে না চাইলেও জোরাজোরিতে আর না করতে পারে না। অনন্যা উঠে গিয়ে অঙ্কনের নম্বর ডায়াল করে ফোনটা সুইচড অফ! না পেরে জিহাদের নম্বর ডায়াল করে।
” অঙ্কন কোথায়?”
” জ্বি ম্যাম ঘুমায়!”
” ওহ্ আচ্ছা! ঘুমাতে গেলে কী ফোন সুইচড অফ করা লাগে! জানা ছিলো না। বাই দ্যা ওয়ে অন্বেষা ফোন করেছিল ধরো নাই কেন!”
” না মানে ম্যাম হয়েছে কী স্যার ধরতে বারণ করেছিলো!”
অনন্যা সীমাহিন রাগে ফোন কেটে দেয়। এরপর অন্বেষার দিকে তাকিয়ে বলল,
” চলো৷ সম্রাট নিরোর ঘুম ভাঙ্গিয়ে আসি।”
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে