চন্দ্ররঙা প্রেম ২ পর্ব-২০

0
1009

#চন্দ্ররঙা_প্রেম_২
#পর্বঃ২০
#আর্শিয়া_সেহের

দেখতে দেখতে রুশানের বিয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। তিহান আর অ্যামিলিয়াকে শান রেখে দিয়েছে। বিয়ে শেষ হলে ওরা আবার দেশ ছাড়বে। আগামীকাল রুশানের গায়ে হলুদ। রুমঝুমের বাবা রেজাউল সাহেবকে দুদিন আগে গিয়ে নিয়ে এসেছে শান। রুমেল -মেঘা তাদের ছেলে তাহমিদকে নিয়ে রওনা হয়ে গেছে। যশোর থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব বেশি হওয়ায় বিয়ে শানদের বাড়িতেই হবে। তবে বিয়ের আয়োজনের জন্য যা প্রয়োজন তার সিংহভাগ দিচ্ছে রুমেল।

বিথীকে স্থায়ীভাবে নিজের বাড়িতে রেখে দিয়েছে ইমতিয়াজ মাহমুদ। তিনি আপাতত বিথীকে আপনজনের কাছে পাঠাতে চাননা। মেয়েটা আরেকটু শক্ত হলে সবার সাথে দেখা করিয়ে আবার নিজের কাছেই নিয়ে আসবেন । শিরীনটা তো শ্বশুরবাড়িতে থাকে। ওর শূন্যস্থান নাহয় বিথীই পূরন করে রাখুক।

রুমঝুম অ্যামিলিয়াকে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। পুনম আর রুশানের জন্য শপিং করতে যাবে আজ। তাছাড়া নিজেদের জন্যও তো কেনাকাটা করতে হবে। রুমঝুম,শান,বিথী, তিহান আর অ্যামিলিয়া যাবে মার্কেটে। শান আর তিহান রেডি হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
সাঁঝ আর বিন্দু সারাবাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তিহান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিন্দুর দিকে। মেয়েটাকে দেখলেই ওর ভালো লাগে। এই পাঁচদিনে সাঁঝ আর বিন্দুর সাথে বেশ ভাব জমিয়েছে তিহান। সারাক্ষণ মেয়েদুটো তার আশেপাশে ঘোরে আর চাচ্চু,তাত্তু ডাকে মুখরিত করে রাখে চারপাশ।

তিহান এগিয়ে এলো সাঁঝ আর বিন্দুর দিকে। বিন্দু তিহানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসলো। তিহান সাঁঝ-বিন্দু দু’জনের দিকে তাকিয়েই বললো,
-“আমার প্রিন্সেস দু’জনের কি লাগবে? কি আনবো বলে দাও ঝটপট।”
সাঁঝ লাফিয়ে এসে বললো,
-“চকোলেট লাগবে।”
সাঁঝের তালে তাল দিয়ে বিন্দু বললো,
-“তকতেত কাবো।”

-“হ্যাঁ তোমাদেরকে চকোলেট খাওয়াবো তো আমি।”
রুমঝুম সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বললো।
তিহান সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে হালকা ঝটকা খেলো। এই প্রথম নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে শাড়ি পড়তে দেখলো তিহান। কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। রুমঝুম তিহানের সামনে এসে দাঁড়ালো। চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
-“এখন চলুন ভাইয়া। দেখার অনেক সময় আছে।”

তিহান চোখ সরিয়ে মাথা চুলকে হেঁসে দিলো। আর একপলক অ্যামিলিয়ার দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো। উপর থেকে বিথী সবটাই দেখলো। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার। চাইলেও সামলাতে পারছে না নিজেকে। আল্লাহ চাইলে আজ তিহানের ওই মুগ্ধ দৃষ্টিটা হয়তো তার উপর থাকতো। আচ্ছা,কেন হলো না এমন? সৃষ্টির নিয়ম এতো আলাদা কেন?

..

তনিম আর রুশান একটা দরকারি কাজে ঢাকা গিয়েছিলো গতকাল। আজকে ফিরেই সরাসরি শপিং মলে চলে গেছে। রুমঝুম বলেছে পুনমের ড্রেস-জুয়েলারি পুরোটাই রুশানের পছন্দে কেনা হবে। রুশানও আর না করেনি। সেও সানন্দে প্রেয়সীর জন্য শপিং করতে চলে এসেছে।

পুরো মার্কেট খুঁজে খুঁজে পুনমের জন্য মেরুন রঙের লেহেঙ্গা পছন্দ করলো রুশান। রুমঝুমেরও ভালো লাগলো সেটা। লেহেঙ্গা আর নিজের জন্য ম্যাচিং শেরোয়ানি রুশান নিজেই কিনলো। পুনমের জন্য এবং বাদবাকি সব মেয়েদের জন্য কেনাকাটা রুমঝুম ,বিথী আর অ্যামিলিয়া করছে। ছেলেদের কেনাকাটা তিহান আর শান করছে।

রুশান আর তনিম বেরিয়ে এসেছে মল থেকে। তারা এমনিতেই বেশ টায়ার্ড। এখন গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিতে হবে। দু’জন পার্কিং এরিয়াতে এসেই দেখলো একটা পরিচিত ধরনের মুখ। কোথাও যেন দেখেছে। তনিম ফিসফিস করে বললো,
-“এটা রায়হানের চাচাতো ভাই না?”
ফট করেই রুশান সবটা ধরতে পারলো। শান্তর কথাই ঠিক। এই ছেলেটাকে দিয়ে হয়তো রাশেদ-রায়হান তাদের উপর নজর রাখাচ্ছে বা প্ল্যান আরো গভীর হতে পারে। রিস্ক নেওয়া যাবে না। রুশান তনিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“হুম হতে পারে। কোনো দরকারে এসেছে হয়তো। তুমি এখন বাড়ি চলে যাও। আমি কিছুক্ষণ পর যাচ্ছি।”

তনিমও মাথা ঘামালো না এ ব্যাপারে। রুশানের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
রুশান আরাম করে বাইকের উপর বসলো। সানগ্লাস চোখে দিয়ে তাকিয়ে রইলো সেই ছেলেকার দিকে। ছেলেটার দৃষ্টি শপিং মলের ভেতরে। রুশান আর তনিমকে বোধহয় দেখেনি ছেলেটা।

পাক্কা দেড়ঘন্টা পরে শানবাহিনী বের হলো। রুশান সেই থেকে তৎপরতার সাথে পাহারা দিচ্ছে নিজের লোকজনগুলোকে। ওদের বের হতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রুশান। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে রুমঝুমদের দিকেই চেয়ে আছে। ফানটা পেটের কাছ থেকে অ্যাঙ্গেল করে ধরে ফটাফট ছবি তুলে নিলো তাদের যা রুশানের দৃষ্টি এড়ালো না। রুশান সোজা হয়ে বসলো বাইকে। কোনো খারাপ সময় আসতে চলেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু আন্দাজ করতে পারছে না।
রাশেদ-রায়হান জেলে কড়া পাহারায় বন্দি। ওদের ছাড়া এই পুঁচকে একা কি করবে? পিছু নিয়েছে কেন এই ছেলেটা তাও বুঝতে পারছে না রুশান।

-“তুই বাড়ি যাসনি, রুশান? এখনো বসে আছিস এখানে?”
রুমঝুমের ডাকে রুশান নড়ে উঠলো।‌ ছেলেটার থেকে চোখ সরিয়ে নিলো।‌ রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“না আপু,একটু কাজ ছিলো। তোমাদের হয়ে গেছে?”
-“হুহ তোদের শুধু কাজ আর কাজ। এতো কাজ যে কোত্থেকে আসে তোদের।”
শান ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“সিরিয়াসলি ঝুম? এতো‌ কাজ কোত্থেকে আসে তুমি বুঝো না?”
রুমঝুম আড়চোখে চেয়ে বললো,
-“আপনি চুপ করুন। আপনাকে উত্তর দিতে বলেছে কে?”

শান আরে কিছু বলতে গেলে রুশান থামিয়ে দিলো। ওই ছেলেটাও চলে গেছে ইতোমধ্যে। রুশান সবাইকে গাড়িতে বসতে বললো। নিজেও বাইক স্টার্ট দিয়ে বাড়ির পথ ধরলো।
মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো দুশ্চিন্তা। পরিবারকে রক্ষা করতে হবে সব বিপদ থেকে।

পিহু খাটের উপর সমস্ত শাড়ি মেলে রেখে নিজে চেয়ারে বসে আছে। গায়ে হলুদ, বিয়ে,রিসিপশনে কোন শাড়ি পড়বে তা নিয়ে কনফিউজড সে।
তনিম রুমে ঢুকে এমন অবস্থা দেখে একটু শক খেলো। হঠাৎ এমন এলোমেলো অবস্থা করে রেখেছে কেন মেয়েটা তা বুঝতে সময় লাগলো তার। চুপচাপ হেঁটে হাতে থাকা প্যাকেটটা ড্রয়ারে রাখলো। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বললো,
-“ঘরের বেহাল দশা করেছো কেন,পিহুরানী?”
পিহু গাল ফুলিয়ে বললো,
-“আমার একটাও শাড়ি নেই। আমি কি পড়বো পুনমের বিয়েতে?”

সবে পানিটা মুখে দিয়েছিলো তনিম। পিহুর এমন কথায় বিষম খেয়ে গেলো সে। কাশতে কাশতে নাক দিয়ে পানি বেরিয়ে গেছে তার। পিহু দৌড়ে এলো তনিমের কাছে। মাথার উপর আস্তে দু ঘা দিয়ে বললো,
-“বিষম খেলেন কিভাবে? আরে একটু দেখে পানি খাবেন না? ”
তনিম খাটের এক সাইড থেকে শাড়ি সরিয়ে বসে পড়লো সেখানে। পিহুর পরনের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে বললো,
-“ওখানে কয়টা শাড়ি আছে?”
পিহু উঁকি মেরে শাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বেশি নেই, ষোলোটা শাড়ি ওখানে।”

তনিম হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। অসহায় চোখে পিহুর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তোমাকে একটা শাড়ির গোডাউন গিফট করবো আমি।”
পিহু খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
-“তাই? সত্যি?”
তনিম কপাল চাপড়ে উঠে পড়লো।‌ ওয়াশ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-“এই শাড়িগুলো গুছিয়ে রাখো আগে। তারপর ড্রয়ার চেক করো। ”
বলেই দরজা আটকে দিলো।

পিহু খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে শাড়িগুলো গোছাতে শুরু করলো।‌ অর্ধেক গুছিয়ে আর হাত চলছে না। বারবার ড্রয়ার চেক করতে ইচ্ছে করছে। অগোছালো শাড়িগুলো এক সাইডে রেখে পিহু ড্রয়ার চেক করতে গেলো। বড়সড় একটা প্যাকেট ভেতরে। প্যাকেট খুলতেই বেরিয়ে এলো দুইটা শাড়ি। একটা হলুদ, অন্যটা গোল্ডেন আর গোলাপি কালার মিক্সড। মুচকি হেঁসে শাড়ি দুইটা বুকে জড়িয়ে ধরলো পিহু। নতুন শাড়ির ভাঁজে সে প্রিয় মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছে।
হুট করেই মনে পড়লো তার আরো একটা শাড়ি লাগবে। দু’টো হলো, এখন অন্যটা খুঁজতে হবে ভেবে আবারও বিছানায় ষোলোটা শাড়ি মেলে রাখলো।

..

আজকের সকালটা সুন্দর। শুধু সুন্দর না, ভীষণ সুন্দর । এমনটাই মনে হচ্ছে পুনমের। আটদিন আগেও তার গায়ে হলুদ হয়েছিলো। সেই সকালটা দেখে পুনম আল্লাহর কাছে বলেছিলো তার জীবনে যেন সেই সকালই শেষ সকাল হয়। অথচ আজ? আজকের সকালটা দেখার পর মনে হচ্ছে এমন সকাল হাজারটা আসুক তার জীবনে।

পুনম জানালার বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে ফোন হাতে নিলো। কল করলো রুশানের নাম্বারে। রুশান তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। শান্ত রুশানের পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তার মনটা সারাক্ষণ “বিয়ে করবো,বিয়ে করবো, উর্বিকে বিয়ে করবো, উর্বিকে চাই ” এসবই বলতে থাকে তা কেউ বোঝে না। আর কত বড় হতে হবে বিয়ে করার জন্য তা বুঝতে পারছে না শান্ত। তার বাপের এতো টাকা,চাইলেই আরো দশটা ছেলেপেলে পালতে পারে সেখানে আর একটা বৌমাকে পালতে পারবে না? ধেত।

শান্ত বিরক্তিসূচক শব্দ করে বিছানার দিকে তাকাতেই দেখলো রুশানের ফোনের স্ক্রিনে পুনমের নাম ভেসে উঠেছে। ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। শান্ত খপ করে ফোন তুলে নিয়ে রিসিভ করলো। পুনমের কিছু বলার আগেই নিজে বললো,
-“আমার কবে বিয়ে হবে পুনম আপু? আমারও তো বিয়ে করতে ইচ্ছে হয়। কেউ বোঝে না ।”

পুনম ঠোঁট টিপে হাসলো। ধীর কন্ঠে বললো,
-“রুশানের ভাইয়ার কাছে ফোন দে পাজি। তোর কষ্ট পরে বুঝবো।”
শান্ত হতাশ হয়ে বললো,
-“সে ঘুমাচ্ছে। হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে।”
-“আচ্ছা তাহলে ডাকিস না। নিজেও ওখানে বসে জ্বালাস না ওকে। বাঁদর।”
বলেই পুনম কল কেটে দিলো। শান্ত ফোনের দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কেটে বললো,
-“এহহহ কত্ত প্রেম দেখো? তাহলে ডাকিস ন্যাহহহ। বিয়ের পর নিজেই তো দুমদাম করে মেরে উঠাবে। এখন ঢং যত্তসব।”

শান্ত ফোনটা বিছানায় মেরে দিয়ে আবারও আগের মতো দেবদাস রুপে বসে রইলো। আজ উর্বিন্তা আসবে। ওকে দেখলেই শান্তর শুধু বিয়ে বিয়ে পায়। এসব ভাবতে ভাবতে শান্তর চোখে পানি এসে পড়লো। মাথা নিচু করে চোখের পানি মুছে নিলো শান্ত। পরীক্ষার রেজাল্ট কবে দিবে? সে কবে কলেজে ভর্তি হবে? কবে মেডিকেলে পড়বে? কবে ডাক্তার হবে? কবে বিয়ে করবে? কবে কবে কবে?
শান্ত ধপ করে রুশানের পাশে শুয়ে পড়লো । এতো কষ্ট সহ্য করা যায় নাকি?

রুশান ঘুমের মাঝেই কপাল কুঁচকে বললো,
-“নড়িস না শান্ত ,ঘুমাতে দে।”
শান্ত এবার মুখ চেপে কেঁদে দিলো। কেউ বোঝে না তাকে। কেউ না।
কেঁদেকেটে চোখমুখ ফুলিয়ে শান্ত ওয়াশরুমে ঢুকলো। ব্রাশ করতে করতেও কাদলো। মুখে পানি দেওয়ার সময়ও কাদলো। কিন্তু কেউ দেখলো না। চোখের পানিটা ট্যাপের পানির সাথে মিশে বেসিনে পড়লো। নিজেকে সামলে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো শান্ত। মুখ মুছে বিছানার পাশে দাড়িয়ে রুশানকে ডেকে বললো,
-“রুশান ভাই, উঠো রুশান ভাই। সাড়ে আটটা বাজে ,উঠো।”

রুশান নড়েচড়ে আবার ঘুমালো। শান্ত গলার স্বর বাড়িয়ে বললো,
-“এই রুশান ভাই উঠো না কেন? আজকে তোমার গায়ে হলুদ না? মনে নেই নাকি? উঠোওও।”
রুশান ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,
-“এই তুই যা তো। তুই গিয়ে হলুদ মাখ।”
শান্ত মুখ ভেঙচি দিলো। মুখটা চুপসে ছোট হয়ে গেলো তার। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
-“হলুদ আমি মাখলেও বিয়ে তো তুমিই করবা। বউটাতো আর আমাকে দিবা না।”

চলবে…….

(রি-চেক দেইনি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে