গল্প – শাস্তি

0
1921
গল্প – শাস্তি ~ Maria Kabir আমি যখন নাহিদকে ডিভোর্স দিলাম তখন বাপের বাড়ি থেকে আমাকে বের করে দেয়া হলো। আমিও কোনো অভিযোগ, অনুযোগ না করেই নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুলো নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। বাসার সবাই এক হয়ে আমাকে বলেছিল – ডিভোর্স দিলে এই বাসায় তোমার থাকার জায়গা নেই। ওরকম জামাই মইরা গেলেও পাবা না। নাহিদ তো সবার সামনে পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলছিল – আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি খুব ভালোবাসি তোমাকে। আমি পা ঝাড়া দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে সাইন করেছিলাম।
বাসা থেকে বের হয়ে যেতেই হবে। তাই ভেবেচিন্তে কাজ করবা৷ আমি হেসেছিলাম সেদিন। কারণ আমার ভাবা ততদিনে হয়েই গেছিলো। গলাধাক্কা খেয়ে বের হবার চেয়ে নিজে দপদপিয়ে বের হয়ে আসার মধ্যে আলাদা আত্মসম্মান লুকিয়ে থাকে। আত্মসম্মান নিয়ে তো বের হয়ে আসলাম কিন্তু পেটের কথা তো ভুলে গেলে চলেনা তার উপর ২৩ বছরের মেয়ের জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা চাই। কলেজের কাছাকাছি একটা মহিলা হোস্টেলে উঠলাম। টুকটাক টিউশনি করি বেতন খুবই কম। মফস্বলের দিকে টিউশনির বেতন এমনিতেই কম থাকে আর মেয়ে টিচার হলে তো সেটা আরো নিচের দিকে যায়। আমি ডিভোর্সি জেনে একজনের মা তো আমাকে সরাসরি না করে দিলেন। তখন পড়লাম মহাবিপদে। সামনে অনার্স চতুর্থ বর্ষের ফ্রম ফিলাপ, হোস্টেল ভাড়া, খাওয়ার খরচ সবমিলিয়ে আমার অবস্থা পাগল প্রায়। বেশিরভাগ সময়ই আমি রাতের মিল দিতাম না। ডায়েট করছি বলেই কাটিয়ে দিতাম। রুমমেটরা আমাকে সান্ত্বনা দিতো। অনেকেই বলতো, কিছুই করলা না তারপরও তোমার সাথে এমন হলো! অনেকে আবেগে আপ্লূত হয়ে নাহিদকে অভিশাপ দিয়ে বসতো। আমি মুচকি হাসতাম কারণ ওরা জানেনা আমারই কর্মফল ভোগাচ্ছে আমাকে। পিচঢালা রাস্তার ডান পাশে আমাদের বাড়ি আর বামপাশে নীলা আপার। খুব হাশিখুশি ছিলেন আপা। এক মেয়ে আর স্বামী নিয়ে তার সুখের সংসার থাকার কথা। নীলা আপার স্বামী ঢাকায় বেশ ভালো জব করতেন। প্রতি মাসে ছুটিতে দুই থেকে তিন দিন থেকে যেতেন। সারা মাস নীলা আপা খুব হাসিখুশি, সাজুগুজু করে কাটালেও ভাইয়া আসলে তার মুখের হাসি উবে যেতো আর সাজুগুজু দশ হাত দূরে থাকুক। তার বাসায় আমাদের বেশ যাওয়া হতো। কারণ পুরো এলাকায় ওনার বাড়ি ছাড়া কারো বাড়িতেই ডিশের লাইন ছিলোনা। ভাইয়া আসলেই বাড়িতে নীলা আপার অগ্নিকণ্ঠ শোনা যেতো। ভাইয়ার কোনো কণ্ঠ আমরা শুনতে পেতাম না। আপা অন্য পুরুষের সাথে হেসে কথা বললেও ভাইয়ার সাথে কথা বলে এমনভাবে যেন এ আপদ বিদেয় হলেই বাঁচেন যেন! আমরা প্রায়ই গোল টেবিল বৈঠক করতাম নীলা আপাকে নিয়ে। ওনার কার সাথে ইটিশ পিটিশ চলে, কার সাথে ওনাকে ঘুরতে দেখা গেছে, ভাইয়ার সাথে কেনো খারাপ ব্যবহার করে। মিটিং শেষে আমরা সিদ্ধান্তে আসতাম উনি বারো ভাতারী মহিলা! ভাইয়া আমাদের সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করতেন। আমরা গেলেই উনি হাস্যোজ্বল মুখে নীলা আপাকে বলতেন – হ্যাগো মুনিয়ারা আসছে চা নাস্তা বানাও। নীলা আপা মুখ খিচে বলতেন – ওরা অমন প্রায়ই আসে। এভাবে ওনাদের মধ্যে ঝামেলা চলতে চলতে একদিন থেমে গেলো। ভাইয়াকে নীলা আপা ডিভোর্স দিলেন। তখন পুরো এলাকায় ওনাকে নিয়ে যখন তখন মিটিং চলে। ওসব মিটিংয়ে আমি সক্রিয় ভাবে আপাকে নিয়ে পিওর কথা বলি। সামনা-সামনি তাকে আমি অনেক শ্রদ্ধা করতাম আর পেছনে তাকে নিষিদ্ধ পল্লীর মহিলা বলে গালিও দিতাম। নাহিদের সাথে আমার বিয়েটা হলো পারিবারিক ভাবেই। নাহিদ দেখতে যথেষ্ট সুপুরুষ বিধায় আমি না করলাম না। বিয়ের প্রথম দিককার সময় বেশ স্বপ্নের মতো করে কাটলো। একটা ব্যাপার মনের মধ্যে খচখচ করতো। শারীরিকভাবে মিলনের ব্যাপারটা। প্রতিদিনই সে আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতো। মাঝেমধ্যে মনে হতো অত্যাচার! যে বিষয়টাকে আমার উপভোগ করার কথা ছিলো সেটাকেই আমার অত্যাচার মনে হতো। বড় ভাবীকে বললাম, ভাবী বললেন – বিয়ের প্রথম দিকে ছেলেরা ওমনই করে। আস্তে আস্তে কমে যাবে। আমিও আশাবাদী হলাম। আস্তে আস্তে কমলো না বাড়তে লাগলো। আমার কোনো অসুস্থতাই তাকে হার মানাতে পারতোনা৷ মাসিকের সময় গুলোতেও মানতে চায়না। প্রথমদিকে আমি চুপ থাকলেও একটা সময় আমার শরীর, মন বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। না করাতে সেও প্রথম দিকে কিছু বলতো না। কিন্তু কয়েকদিন যাবার পরে সে অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিতে শুরু করল। গালাগালি একসময় গায়ে হাত দেয়াতে রূপ নিলো। আমি এতোটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম যে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। ভাবলাম সে এবার হয়তোবা শুধরে যাবে কিন্তু না সে শুধরায়নি। অনেক ধৈর্য্য ধরে ছিলাম। সারাদিন সংসারের কাজ আর রাতে তার চাহিদা পূরণ। আর না করলে, আমার লাইন আছে অন্য কারো সাথে। আমি তাদের সাথেও শুয়ে বেড়াই….. তাই স্বামীকে পছন্দ হয়না। নাহিদ উচ্চস্বরে এসব বলতো না। নিচু স্বরে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো। বাসায় জানালাম নাহিদ এমন করে। কেউই বিশ্বাস করতে চায়না। সবার একটাই কথা – নাহিদের মতো ভালো ছেলে হয়ইনা। নাহিদ এই, নাহিদ সেই। আমার জন্মদাত্রী মাও বিশ্বাস করলেন না আমার কথা। শ্বাশুড়ি ভক্ত নাহিদের কথাই মা বিশ্বাস করলেন৷ ডিভোর্স টা দিলাম তখনই যখন নাহিদ আমার ৩ মাসের বাচ্চাকে নষ্ট করতে বললো। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় কন্সিভ করেছিলাম। আমাকে অ্যাবরশন করাতে বাধ্য করলো। কারণ তার রাতের চাহিদা আমি পূরণ করতে পারছিনা। নাহিদের এই রূপ আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। সেখানে আমার ফ্যামিলির লোকজনের কথা বাদই দিলাম। আসলেই ও শুধু আমার সাথেই এমন করতো। অন্য কারো সাথে খারাপ ব্যবহার তো দূরে থাক, রেগেও কথা বলতো না। নীলা আপার সাথে আমার একবার দেখা হলো মার্কেটে। এখনো সেই হাসিখুশিই আছেন। মেয়েকে সাথে নিয়ে মার্কেটে এসেছেন। বাসায় এসে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলালাম। নীলা আপার স্বামী আর আমার স্বামীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তারপরও শিওর ছিলাম না। বাপের বাড়ি গিয়ে নীলা আপাকে ধরলাম। সে মুচকি হেসে বললেন – অতীত নিয়ে আলোচনা না করলে হয়না? – আপা আপনি আমাকে অল্প একটু বললেই হবে। বলেছিলেন আপা সবকিছুই। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিলো। এরকম একটা মানুষকে আমি বেশ্যা বলেও গালি দিয়েছিলাম! নীলা আপা আর আমার মধ্যে পার্থক্য এইটুকুই ছিলো যে, ভাইয়া দূরে থাকতেন আর আমার সে কাছে। তবে সে ডিভোর্স দিয়ে বেশ ভালোই আছেন। মেয়েটাকে নিয়ে ছোটো খাটো একটা সংসার পেতে বসেছেন। আর আমি? আমি প্রকৃতির দেয়া শাস্তি ভোগ করছি। এলাকা এখন আমাকে নিয়ে কথা বলে। আমি এর ওর মুখ থেকে শুনেছি আমাকে কী বলে তারা! ওই একই কথা যেটা কয়েক বছর আগে আমি বলতাম নীলা আপাকে নিয়ে। ” লেখিকা মারিয়া কবির এর সকল লেখা দ্রুত পেতে অবশ্যই এ্যাড হোন তার ফেসবুক পেইজ ‘Maria Kabir -মারিয়া কবির’(এখানে পেইজ লিংক) এর সাথে। ২০২০ বই মেলায় প্রকাশ পেতে যাচ্ছে মারিয়া কবির এর প্রথম উপন্যাস ‘যেখানে সীমান্ত তোমার আমার’। মারিয়া কবির এর নতুন সব গল্প উপন্যাস পেতে আমাদের।সাথেই থাকুন। ধন্যবাদ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে