গল্পটা তুমিময় পর্ব-০৩

0
1133

#গল্পটা_তুমিময়💕
#পর্বসংখ্যা_৩
#মৌরিন_আহমেদ

বর্তমানে সূর্য ভাইয়ের সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি আমি। অবস্থান তার ঘরে। সে তখন থেকেই আমাকে ঝেড়ে যাচ্ছে! চলছে রিমান্ড! আমি মাথা নিচু করে তার ঝাড়ি শুনছি। ইচ্ছে করছে কানে তুলা দিয়ে বসে থাকি। কিন্তু আশেপাশে তুলা নেই। আচ্ছা, সূর্য ভাইকে বলবো না কি, “একটু তুলা বা টিস্যু দেন? কানে গুঁজতাম আর কি…”

না, থাক! আবার এটা বলতে গিয়ে কী কান্ড করবে কে জানে! এমনিতেই একটু আগে দাবাং একটা থাপ্পড় দিয়ে আমার গালটার জিওগ্রাফি বদলে ফেলেছে! ভয়ঙ্কর জ্বালা করলেও মুখ দিয়ে টু শব্দ করার পারমিশন নেই! সে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে,

— “তোর এত সাহস হয় কী করে? বিয়ে করতে চাস না ভালো কথা, পালাতে গিয়েছিলি কোন সাহসে? একবার ভেবেছিলি তুই পালিয়ে গেলে আন্টি-আংকেলের কী হতো? তোর বাপ যে হাইপার টেনশনে রোগী সেটা তো আমার থেকে তুইই ভালো জানিস! তারপরও.. তারপরও কেমন করে.. তোর যে কমন সেন্স কম জানতাম, কিন্তু একেবারেই নেই সেটা জানতাম না।.. আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না তুই এমন কিছু করতে যাচ্ছিলি! ধারণা করেছিলাম এমনটা করতে পারিস কিন্তু তাই বলে সত্যি সত্যিই!… তুই মানুষ হইলি না! উফ্!

— “আমি তো মানুষই সূর্য ভাই! না তে কী গ’রু-ছা’গ’ল?”

মিনমিন করে বললাম। যেন তা তার কান অবধি না পৌঁছায়। সে থামছে না। তার মতো করে ঝাড়ির পসরা সাজিয়ে বসেছে! মেইল ট্রেনের গতিতে ছুটছে তার বকা-ঝকা। বলছে,

— “তুই কি ভেবেছিস পালিয়ে গেলেই সব মিটে গেল? তুই আমার হাত থেকে বেঁচে গেলি? জ্বি না! এত্ত সোজা না! বিয়েটা তোকে আমাকেই করতে হবে। হবে মানে হবেই! আর পালিয়ে গিয়েছিলি সেই শাস্তিও তুই পাবি। সময় মতোই দিবো। যাই হোক, এখন আর কথা বাড়াতে চাইছি না। বাসায় যা। আমি আন্টি-আঙ্কেলকে এখনো বলি নি তুই পালিয়ে যাচ্ছিলি। এটা জানলে তারা কষ্ট পাবেন। তাই বলছি ভদ্র মেয়ের মতো বাড়ি যাবি। এই হিয়া!..”

দরজার ওপাশে দাড়িয়ে ছিল হিয়া। সূর্য ভাইয়ের ডাক শুনে ভেতরে ঢুকে নম্র হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

— “জ্বি, ভাইয়া বলেন।”

— “তোমার এই পাবনা ফেরৎ পাগলী বান্ধবীকে বাসায় নিয়ে যাও। ও যে পালিয়ে গিয়েছিল সেটা কাউকে বলো না। পরে আমি জানাবো সবাইকে। আপাদত শুধু দেখ, নতুন করে কোনো আকাম যেন না করতে পারে! তেনার মাথার আবার অনেক বুদ্ধি তো!.. অবশ্য মাথায় না, বুদ্ধি সব হাঁটুর নিচে!..”

শেষ কথাটা তাচ্ছিল্য করেই বললো। আমি মনে মনে ক্ষেপে গেলেও কিছু বললাম না। এখন কিছু বলা মানেই আমার অপর গালেরও হাড্ডি চ্যাপটা করে ফেলা! দরকার নাই আর চ’ড়-থা’প্প’ড় খাওয়ার! আপাদত বাড়ি যাই। গিয়ে হিয়ার ক্লাস যদি না নিয়েছি তো!..

তারপর আর কোনো কথা না বলেই বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করলাম।

আসলে তখন গলির মোড়ে হিয়ার সাথেই দেখা হয়েছিল আমার। তখন এতবার করে কল দিলাম ফোন বন্ধ অথচ ও কি না আমার বাসাতেই আসছিল। কেন আসছিল? সূর্য মারফৎ সেও খবর পেয়েছে আমার বিয়ে! তাই খুশির ঠেলায় নাচতে নাচতে বান্ধবীর বিয়ে খেতে আসছিল।

আমি যখন ওকে দেখেও না দেখার ভান ধরে রিকশায় উঠছি তখন হঠাৎ দৌড়ে এলো ও। হন্তদন্ত হয়ে বললো,

— “মৌরি, কোথায় যাচ্ছিস তুই? আজ না তোর বিয়ে?”

আমি মোটামুটি অবাক হয়েছিলাম। কারণ যে বোরকা টা পরেছি সেটা বর্তমান হাল ফ্যাশনের নয়। বলা চলে আদিম কালের আদিম ট্রেন্ডের। এমন পুরোনো আমলের বোরকা সাধারণত থুত্থুড়ি বুড়িরাই পরে! যাই হোক, এমন বোরকা পরনে, নাক-মুখ-চোখ ঢাকা। তবুও ও আমাকে চিনলো ক্যামনে? তারপর আবার বিয়ের বুলিও আওড়াচ্ছে! চিন্তায় পড়ে গেলেও কথা ঘুরিয়ে বললাম,

— “ইয়ে.. আপনার বোধ হয় কোথাও ভুল হচ্ছে…”

— “মিথ্যা বলছিস কেন? তুই কি ভাবছিস তোর কণ্ঠ আমি চিনি না? নাক দিয়ে কথা বললেই কি তোর কণ্ঠ চেঞ্জ হয়ে যাবে?”

ভ্রু কুঁচকালো হিয়া। আমি পাত্তা না দিয়ে রিকশায় চড়ে মামাকে বললাম,

— “মামা, চলেন।”

কিন্তু মামা প্যাডেল ঘুরানোর আগেই হিয়া হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে আমাকে রিকশা থেকে নামালো। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

— “তুই বাসা থেকে পালিয়ে যাচ্ছিস! ছি মৌরি, ছি! বিয়ের দিন কেউ বাসা থেকে পালায়? তুই চলে গেলে কি হবে ভেবে দেখেছিস? ছিঃ ছিঃ! তুই এমন কাজ করবি আমি চিন্তাও করি নি। আমার সাথে চল্ এক্ষুণি!”

এবার আর ভনিতা করলাম না। হিয়ার সাথে চালবাজি করে লাভ নেই। এই মেয়ের শরীরের গিঁটে গিঁটে বুদ্ধি! ঠিক ঠিক, আমাকে দেখার সাথে সাথেই আসল কাহিনী বুঝে ফেলেছে! তাই নরম গলায় বললাম,

— “তুই আমার সিচুয়েশনটা জানিস না, হিয়া! আমি এই বিয়েটায় রাজী নই। এই বিয়ে করলে আমার লাইফটা হেল হয়ে যাবে। প্লীজ আমাকে যেতে দে! দেখ, আমি কিন্তু পালিয়ে যাচ্ছি না। শুধু দু’ তিন দিনের জন্য মামার বাড়ি যাচ্ছি। বাসার সবার মাথা থেকে বিয়ের ভুত নামলেই আমি কাম ব্যাক করবো!”

কিন্তু হিয়া আমার কথা শুনলো না। সে শুনলো ভুট্টো সাহেবের আই মিন সূর্য ভাইয়ের কথা। সূর্য ভাই তাকে বলেছিল আমার উপর নজর রাখতে। তাই সে তাড়াতাড়ি করে আমার বাসায় আসছিল। পথেই দেখেছে আমি পালানোর পাঁয়তারা করছি অমনই ‘কপ’ করে ধরে ফেলেছে! তারপর বহুত ঝাড়ি-ঝুড়ি মেরে, জ্ঞানের পসরা সাজিয়ে, কোরবানির গরুর মত করে টেনে হিঁচড়ে হাজির করেছে সূর্য ভাইয়ের সামনে!

আমার বন্ধু মহলে হিয়া হলো সবচেয়ে বুদ্ধিমতী মেয়ে। নিজের সম্পর্কে তার ধারনা হলো সে খুব লয়াল! তার উপর কেউ কোনো দায়িত্ত্ব দিলে সে সেটা জান দিয়ে পালন করার ট্রাই করে। আর আজ ওর লয়ালিটির জন্য ধরা খেয়ে গেলাম আমি! এই মুহূর্তে কান ধরে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘বান্ধবী বানাইলে হাঁদা টাইপের বানাবো, গাধা, হ্যাবলা দেখে, কিন্তু তোর মতো লয়াল ফ্রেন্ড আমার লাগবো না! তোর লয়ালিটির চক্করে আমার জীবনডা শ্যাষ!”– যাই হোক, এগুলো পাগলের প্রলাপ। আমি এখনো পাগল হই নি আর বিয়েও এখনো হয় নি। সো সময় আছে। এর মধ্যে কিছু একটা করতে হবে!

বাসায় ঢোকার পর আমাকে দেখে মা অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো কোথায় গিয়েছিলাম কিন্তু মনের দুঃখে সে কথার জবাব দিলাম না। রাগে গজগজ করতে করতে রুমের দিকে ছুটলাম। হিয়া মাকে কি বলেছে আমি জানি না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হিয়ার বাবা-মা, নিরা আর ওর ফ্যামিলিও চলে আসলো। নিরা আসতেই হিয়া রসিয়ে রসিয়ে বলতে শুরু করলো আমার পালিয়ে যাওয়ার কাহিনী। ক্যামনে পালালাম, ক্যামনে সে আমাকে ধরলো! লাইক– আমি একটা কোরবানির গরু। হাঁট থেকে কিনে নিয়ে যাওয়ার সময় পালাচ্ছিলাম, আর অমনই হিয়া এসে বীর পালোয়ান হয়ে ধরে ফেলেছে!

সেইসব গল্প শুনে নিরা তো হেসেই খুন। দুজনে মিলে কানের কাছে বসে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে। তাদের হাসি তাদের প্রেমিকের দৃষ্টিতে খুবই সুন্দর। খিলখিল করে হাসে তারা। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের অসম্ভব সুন্দর হাসিও আমার কাছে হাঁসের প্যাক প্যাক মনে হচ্ছে। এরা এভাবে হাসছে কেন? আজব!

হাসি থামিয়ে নিরা বললো,

— “আহারে আমাদের মৌরি বেচারি! বিয়ের দিনে বরের হাতে দাবাং চড় খেয়ে গাল আর কপালে বারি লাগিয়ে কপাল ফাটিয়ে ফেলেছে! বিয়ের পিঁড়িতে বসে ফাটা কপাল নিয়ে সে বলবে, ‘কবুল!’ আহারে! কী দুঃখ!”

— “ঠিক বলেছিস। দেখ না, কপালটা ফেটে দু’ ভাগ হয়ে গেছে! বেচারি!”

— “আহা গো, সোনা গো আমার!”

দুজনে আবারো সেই খ্যাঁক খ্যাঁক মার্কা হাসিতে মেতে উঠলো। রাগে দুঃখে আমার তখন সাধ জাগছে আমার প্রাণ প্রিয় দুই বান্ধবীর গ:লা টি:পে দেই! হা:রা:মী কোথাকার!

রাগে ফেটে যখন হনহন করে নিজের ঘরে ঢুকতে এসেছি তখন অসাবধানতা বশত দরজার সাথে তুমুল একটা বারি খেয়ে কপালটা ফেটে গেছে! কপাল থেকে রক্ত ঝরছে! মুহুর্তেই ফুলে একাকার! ভয়ঙ্কর রাগে তখন আমার মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। পেছন থেকে সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে হিয়ার হাসি আর কে দেখে! পাগলির মতো হা হা, হো হো, হি হি করেই যাচ্ছে। তারপরই এলো নিরা। আর শুরু হলো এদের বকবকানি!

কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে আছি আর হিয়া কপালে ব্যান্ডেজ করছে। নিরা শাড়ী গবেষণায় ব্যস্ত। তখনই ঘরে অনুপ্রবেশ ঘটলো আমার জেঠাতো বোনের, ফিহাপু। পেছন পেছন তার প্রেমিক, আমার মামাতো ভাই রুদ্র। এরা দুজনেই সূর্য ভাইয়ের ব্যাচ মেট। আমাকে বসে থাকতে রুদ্র ভাইয়া দেখেই বললো,

— “কি রে, বিয়ের কনে! কী অবস্থা! কপাল ফাঁটলো কীভাবে?”

— “বাথরুমে উষ্ঠা খেয়েছিলাম।”

নির্বিকার হয়ে মিথ্যেটা বলে দিলাম। ফিহাপু হেসে বললো,

— “দুনিয়াতে আর জায়গা পেলি না? বাথরুমে গিয়ে হোঁচট খেলি? হা হা হা!”

এই যে আরেকটা ভুল করে বসলাম। মিথ্যে বলতে গিয়ে এমন মিথ্যে বললাম যে এখন হাসির পাত্র হয়ে উঠতে হচ্ছে! আহা রে! এই দুঃখ আমি কই রাখি!

তারপর চললো ওদের হাসি-ঠাট্টা। আমি লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখলাম। একটা কথাও বলতে পারলাম না। এরা আমাকে এমন ভাবে ঘিরে ধরে রাখলো আমি আর পালানোর কোনো রাস্তাই খুঁজে পেলাম না! বিশেষ করে নিরা আর হিয়া তো চিপকু গামের মতো করে চিপকে রইলো সারাটা সময়! বিয়ের ভারী বেনারসি আর গয়না পরে ওয়াসরুমে যাচ্ছি তখনও হিয়া সন্দেহের চোখে বললো,

— “ওয়াশরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে আবার পালাবি না তো?”

মানে কি ভাই? আমারে কি তোদের এতোই ব;ল:দ মনে হয়? অবশেষে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলাম। কাজী এসে যখন কবুল বলতে বললো, তখন ভাবছিলাম বলবো কি বলবো না। একদিকে বাবা-মায়ের সম্মান, অন্য দিকে আমার সারাটা জীবন! ঠিক ওইসময়ে নিরা কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

— “সূর্য ভাই বলেছেন, তুই কবুল না বললে উনি বরের আসর থেকে উঠে এসে তোকে একটা চড় মারবে!”

সূর্যের চামচা! সূর্যের শা:লী! রাগে দুঃখে গড়গড় করে বললাম,

— “কবুল, কবুল, কবুল!”

ব্যস! বিয়েটা হয়েই গেল!
_____________________

বাড়ির ছাদে সূর্যের একটা চিলেকোঠার ঘর আছে। সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসছি এই ঘরটায় সে থাকে। বাসার ভেতরে একটা রুম থাকলেও সে এই ঘরটায় অধিকাংশ সময় কাটায়। কিন্তু কোনদিন এই ঘরটায় সে আমাকে ঢুকতে দেয় নি। ইগোষ্টিক পাবলিক কী না তাই!

কিন্তু আজকে এই ঘরেই সাজিয়েছে সে বাসর! বা:স:র? আজকে এই বাসর রাতে তোর অবস্থা আমি এমন করবো না তুই টের টা পাবি, মৌরি কী চিজ! মনে মনে শ:য়:তা:নি হাসি দিয়ে দুধের গ্লাসটা বেড সাইড টেবিলের উপর রাখলাম। আজকে হবে মজা! হা হা হা।

সূর্য ঘরে ঢুকলেন। হাতে একটা বাঁশের বেত। সেটা দেখেই আমি আঁতকে উঠলাম! সর্বনাশ! এই ছেলের হাতে এই জিনিস কেন? মারবে না কী? শেষ পর্যন্ত বাসর রাতে বরের হাতে মা:ই:র? সারাজীবনে কী কম পিটানো পিটাইছে? আজকেও মারবে? সকালেও তো থা:প্প:ড় দিলো! মা গো মা! এই জন্যই বলছিলাম ‘আমি বিয়া করতাম না।’ কিন্তু কেউ আমার কথা শুনলো না।

আতঙ্কে শিউরে উঠলাম যেন। ভ্যাবলা কান্ত হাসি দিয়ে বললাম,

— “সূর্য ভাই, হাতে বেত নিয়েছেন কেন? নৈশ বিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়েছিলেন না কি?”

— “যাই নি তবে যাবো এখন। তোর ক্লাস নিবো।”

— “বাসর রাতে কী স্বামী স্ত্রীর ক্লাস নেয়, ভাই? এইটা কোনো কথা?” মেকি হাসি দিলাম।

— “বা:স:র রাত? বাহ্! ভুতের মুখে রাম নাম। ওপস! সরি, পেত্নীর মুখে রাম নাম? ঘটনা কি রে?”

বলেই হঠাৎ কাছে এগিয়ে এলো আমার। আমি ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে বুকে থুথু ছিটালাম। ঢোক গিলে বললাম,

— “এমন করে আগাচ্ছেন কেন, হ্যাঁ? সমস্যা কী আপনার?”

— “তেমন কিছু না। সমস্যা শুধু আমার বৌকে নিয়ে। সে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল কী না..”

‘খাইছে আমারে! এই পোলায় দেখি সেই কথা এখনো মনে রাখছে! এখন তাহলে কি উপায়?’ ভীত মুখে তার দিকে তাকাতেই দেখলাম মুচকি মুচকি হাসছে। এই হাসির মানে আমি জানি। মানে হলো আমার কপালে দুঃখ আছে! বহুত দুঃখ!

একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বললাম,

— “ইয়ে.. সূর্য ভাই.. আসলে হয়েছিল কী.. তখন না আমি..”

— “আগে ভাই ডাকা বন্ধ কর!”

বাঘের মতো গলা। যদিও আমি বাঘের গলায় কোনোদিন হুংকার ছেড়ে কথা বলতে শুনি নি। তবুও এই গলাকে বাঘের কণ্ঠই বলা যায়! বুকে সাহস যুগিয়ে বললাম,

— “ভাই ডাকবো না তো কি জান ডাকবো? ঠিক আছে, আপনি মা:ই:র না দিলে তাই ডাকবো।.. আসলে তখন না আমি.. ইয়ে মানে.. তখন শ্যাম্পু কিনতে গিয়েছিলাম। বুঝেনই তো, জীবনে একবার বিয়ে করবো। চুলে শ্যাম্পু না দিলে হয়? তাই আর কি.. তখন ভয়ে বলতে পারি নাই। হে হে হে..”

— “তা শ্যাম্পু কিনতে রিকশায় চড়ে কই যাচ্ছিলি তুই? কোন রেয়ার শ্যাম্পু ইউজ করিস তুই যে মোড়ের দোকানে সেটা পাওয়া যায় না?..”

সূর্য ভাই ঠিকই বলে। আই অ্যাম আ ডাফার! একটা মানানসই মিথ্যেও যদি বলতে পারতাম। উফ্! দুঃখের ঠেলায় ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলাম,

— “আপনি আমাকে মারবেন, সূর্য ভাই? বাসর রাতে বৌ পিটাবেন?.. ”

তারপর হঠাৎ কি যেন মনে হতেই বললাম,

–“ঠিক আছে, মারেন। সমস্যা নাই। বিয়ে তো হয়ে গেছে। তো.. কাল সকালেই আমি কোতোয়ালি থানায় মামলা দিবো। বলবো আপনি নারী নি:র্যা:তন করেন। বৌ পি:টা:ন। তখন যদি পুলিশ আপনার কোমড়ে দড়ি বেঁধে থানায় না নিয়ে যায় তো..”

— “আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস?”

— “ভয় না। যা সত্যি তাই বলছি। মে:রেই দেখেন না কেন? এতোদিন মা’র কাছে বিচার দিয়েছি, লাভ হয় নি। এখন সরকারের কাছে বিচার দিবো। দেখে নিয়েন!”

— “হাঁসের মতো এত প্যাক প্যাক করিস না তো, পাঁচফোড়ন! যা বলছি তাই কর। কান ধরে একশো বার উঠবস কর। নে ফটাফট শুরু কর!”

— “সূর্য ভাই!” করুন সুরে ডাকলাম।

— “ভাই ডাকা বন্ধ করতে বলেছি!”

কি করি, কি করি, করতে করতে হঠাৎ দুধের গ্লাসটার কথা মনে হলো। সুর বদলে, রোম্যান্টিক রোম্যান্টিক মুড নিয়ে এক পা দু পা এগোলাম। সে ততক্ষণে বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে বসে ফোন স্ক্রোল করতে ব্যস্ত হয়ে গেছে! আমি এগিয়ে যেতেই বললো,

— “কি রে, শুরু কর?”

আমি পাত্তা দিলাম না। রোম্যান্টিক ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ালাম। সে ফোন রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আমি কিছু না বলে পাঞ্জাবির কলারে আঁকিবুঁকি শুরু করলাম। দুষ্টু হেসে বললাম,

— “আজকের রাতে কি কান ধরাটা মানায়? বলেন তো? আজ রাতে তো…”

— “আজ রাতে কী করে?..”

— “কি করে, সেটা পরে বলছি। আগে এটা খান তো!”

বলেই টেবিল থেকে গ্লাসটা তুলে হাতে ধরিয়ে দিলাম। সে সন্দিহান চোখে চেয়ে বললো,

— “এত্তো সোহাগ?”

— “এখানে সোহাগের কি দেখলেন আপনি? আমাকে এটা দিতে বলেছে দেখেই তো দিলাম। তাছাড়াও আপনি খুব ক্লান্ত। এই সময় এই দুধটা খেলে আপনার ভালো লাগবে। বিয়ের জন্য কতো পরিশ্রম গেছে না?.. নিন, ধরুন।”

— “এটা কে দিয়েছে?”

— “আমার শাশুড়ি আম্মা!”

— “আম্মু দিয়েছে? তাহলে ঠিক আছে। খাওয়া যায়। কিন্তু তোর হাত দিয়ে? তাহলে অসম্ভব!”

গ্লাসটায় ঠোঁট ছুঁইয়েও শেষ পর্যন্ত খেল না। হুট করে আমাকে টেনে ধরে বললো,

— “আমি তো ক্লান্ত নই পাঁচফোড়ন! ক্লান্ত তো তুই। আফটার অল বিয়ের দিনে পালিয়েছিলি, আবার জোর করে ধরে এনেছি। সাজগোজ করেছিস। যত ধকল সব তো তোর উপর দিয়ে গেছে! এই নে এটা তুই খা!”

বলেই আমার মুখ টিপে ধরে খাইয়ে দেয়ার প্রয়াস চালালো। আমি ছিটকে সরে গিয়ে বললাম,

— “নাহ্! আমি খাবো না। আপনি জানেন না, আমি ওইসব খাই না।..”

সে সন্দিহান চোখে তাকাতেই বললাম,
— ” না মানে আমার বমি পায়। হি হি.. আপনিই খান না?”

— “আরে খা তো! একদিন খেলে কিছু হয় না। এদিকে আয়, কোলে বসিয়ে খাইয়ে দিচ্ছি। আয়, আয়!..”

— “এই না!”

আমি দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলেই আমাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ধরে ফেললো সে। হাত দুটো পেছনে মুড়ে ধরে বললো,

— “আমি তো তোকে খাওয়াবোই পাঁচফোড়ন! হা কর.. তাড়াতাড়ি!”

খুব জোড়ে ধমকে উঠল। আমি ভয়ে কেঁপে উঠলেও মুখ খুললাম না। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,

— “বল্, কি মুশিয়েছিস এখানে? একদম কথা ঘুরাবি না.. তাহলে..”

— “জ.. জামাল গোটা।”

— “কিহ্?”

আমি চুপ করে রইলাম। সেও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ ডেভিল স্মাইল দিয়ে বললো,

— “আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। তুই যে ঠিক কেমন সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? হা হা হা। এখন এই দুধ তুই খাবি, তোকেই খাওয়াবো আমি!”

বলেই আমাকে চেপে ধরলেই আমি আঁতকে উঠলাম। পড়েছি এখন মাইনকার চিপায়! বের তো হইতেই পারছি না উল্টো প্যাঁচ লাগাচ্ছি বেশি বেশি করে! অসহায় গলায় বললাম,

— “প্লিজ, এবারের মতো ছেড়ে দিন। ওই জিনিস খেলে আজকে আর আমার ঘুম হবে না। বাথরুম দৌড়াতে দৌড়াতে আমার ঘুম হারাম হয়ে যাবে। প্লিজ! এইবার মাফ করেন!..”

— “আমি তো সেইটাই চাই। নে, হা কর!”

— “আমি সত্যিই খুব ক্লান্ত, সূর্য ভাই! একটু ঘুমাতে চাচ্ছি। আজকের মতো ছেড়ে দিন, প্লিজ?”

আমার স্বকরুণ চেহারা দেখে হয় তো মায়া হলো ব:দ:টা:র! গ্লাসটা রেখে দিয়ে বললো,

— “ঠিক আছে, ঘুমা।”

আমি কোনো কথা না বলেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
_____________________

পরদিন সকালে খুব বেলা করে ঘুম থেকে উঠলাম। উঠেই দেখি ঘরে সূর্য ভাই নেই। কী রকম খারাপের খারাপ! বিয়ে-টিয়ে করে পরের দিন সকালে বৌকে রেখে চলে গেছে? শা’লা বিয়ে করেছিস কোন দুঃখে? যদি বৌকে সাথে করে বাড়ির সবার সামনে না যেতে পারিস? মনে মনে ফুঁসতে ফুঁসতে আগের শাড়িটা বদলে নতুন আরেকটা শাড়ী পরে নিলাম। মাথায় একহাত লম্বা ঘোমটা টেনে নববধূ স্টাইলে লজ্জা লজ্জা ভাব করে নিচে গেলাম।

এমন নয় যে আমি এ বাড়ি চিনি না। চিনি খুব ভালো করেই চিনি, বাড়ির প্রতিটা কোণা আমার চেনা। তবুও নতুন বৌ বলে একটা কথা আছে না? তাই লাজুক লাজুক ভাব করে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে অন্তুআন্টির গা ঘেঁষে দাড়ালাম। আশেপাশে সবাই আমার পরিচিত। তাও একেবারই অপরিচিতদের মতো আড়ষ্ট হয়ে থাকলাম। অন্তুআন্টি মানে সূর্য ভাইয়ের মা আমাকে আসতে দেখে বললেন,

— “কি রে! তুই এখন রান্নাঘরে কী করছিস?”

— “না মানে এমনই..”

— “মায়ের বাড়ি থাকতে তো কোনোদিন রান্নাঘরের ধারে কাছেও যাস নি। বিয়ে হতে না হতেই শ্বশুর বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকছিস যে?.. শোন, আমার সাথে পাকামো করবি না। আগেও তুই এবাড়ির মেয়ে ছিলি, এখনও থাকবি। তাই চুপচাপ দাড়িয়ে না থেকে রুৎবার কাছে যা। গল্প কর গে!”

আমি ভদ্র মেয়ের মতো রূতবার কাছে গিয়ে থাকলাম। সেদিন সারাদিন রুতবার কাছে থাকলাম। খা’টা’স’টা’র সাথে দেখা হয় নি। রাতের বেলা ঘুমনোর জন্য যখন ঘরে ঢুকলাম তখন সেখানে কেউ নেই। সূর্য বাড়িতেই আছে। নিশ্চয় চিলেকোঠায়! কিন্তু আমি কি সেখানে যাবো?

ধীর পায়ে হেঁটে ছাদে উঠে দেখি সে ছাদের এক কোণায় দাড়িয়ে আছে। চুপচাপ নিশ্চুপ। আমি চুপি চুপি গিয়ে পেছনে দাড়ালাম। মজা করে বললাম,

— “আপনার গার্লফ্রেন্ডের কথা মনে পড়ছে, সূর্য ভাই? এখন বুঝি এই বিয়েটা করার জন্য আফসোস হচ্ছে?”

সে আমার দিকে করুন চোখে তাকালো। হুট করেই আমার হাত টেনে ধরে বললো,

— “ভালোবাসি মৌপাখি! তোকে আমি খুব ভালোবাসি! কিন্তু তুই বুঝিস না। কেন আমি তোকে বিরক্ত করি, কেন এতো জ্বালাই, কেন এতো রাগারাগি করি, সেসব কিচ্ছুটি তুই জানিস না। কারণ তুই আমাকে বুঝিস না। বোঝার চেষ্টা করিস না। কিন্তু আজ থেকে তুই আমাকে বুঝবি, আর আমাকে আমার মতই ভালোবাসবি!”

শেষ কথাগুলো কেমন যেন জোর দিয়ে বললো। শুনেই হঠাৎ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। খিটমিট করে বললাম,

— “যদি তা না হয়?”

রাগে গজগজ করতে করতে প্রশ্ন ছুঁড়লাম আমি। এহ! ভালোবাসা দেখাচ্ছে! ঢং! যেন আমি কিচ্ছুটি বুঝি না! ওই বদ’টা যে চালাকি করে বিয়েটা করেছে ঠিকই আমি বুঝেছি। এই বিয়েটা করেছে সে আমাকে অত্যাচারের জন্য। সারাজীবন জ্বালিয়েছে, আর বাকী জীবনটাও যেন জ্বালাতে পারে সেজন্যই এই বন্দোবস্ত! নয় তো, অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেলে ব্যাটার অত্যাচার থেকে বেঁচে যাবো না আমি? আর আমাকে না জ্বালালে এর পেটের ভাত হজম হবে? কক্ষণো না। এসব হচ্ছে ষড়যন্ত্র! গভীর ষড়যন্ত্র! বুঝি আমি, সব বুঝি! হুহ!

— “হবে তো অবশ্যই। আর না হয়েই বা যাবে কোথায়? বিয়ে যেহেতু করেছিস ভালো তুই আমাকেই বাসবি!”

— “থাকুন আপনি আপনার দিবাস্বপ্ন নিয়ে! আমি গেলাম ঘুমোতে। হুহ!”

বলেই দেমাগ দেখিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলাম। যাই হোক, এর ঘরটা বেশ চমৎকার! গতকাল ঘরটা ভালো করে দেখা হয়ে ওঠে নি। বর পছন্দ না হোক, ঘর আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ব্যা’টা’র রুচিবোধ আছে। পুরো রুমটাই বেশ পরিপাটি। আর সবচেয়ে অবাককর বিষয় হলো রুমের বেড সাইড টেবিলের উপর আমার একটা সিঙ্গেল ছবি লাগানো। আমার কিশোরী বয়সের ছবি। বুঝলাম না, ছবিটা কি আজই লাগিয়েছে? না আগে? আগে কখনো এই ঘরে আমাকে ঢুকতে দেয় নি সূর্য। তাই জানি না। কিন্তু এটাতে কি প্রমাণ করতে চায় সে? সত্যি সত্যিই আবার ভালোবাসে না কি আমাকে? ধুর, কিসব ভাবছি! এই ছেলে আর ভালোবাসা? তাই কি সম্ভব? এর মতো ইগোস্টিক, অ্যারোগেন্ট ছেলেরা ভালোবাসতে জানে না কি? এরা জানে মানুষকে অত্যাচার করতে! ব্যাটা ব্রিটিশ!
_____________________

এরপরের দিন গুলো ঠিক আগের মতোই কেটে গেল। আগের মতো ঝগড়া-মা’রা’মা’রি করে। নিত্য নতুন বিষয় নিয়ে শুরু হলো ঝামেলা। এই তো সেদিন আমি ঘরের ভেতর চুপ করে বসে আছি। হঠাৎ কোত্থেকে যেন উদয় হলো সূর্যের। পেছন থেকে এসে আমার মাথায় গাট্টা মেরে বললো,

— “ঢেঁপসি মেয়ে! সারাদিন ঘরে বসে পোল্ট্রি মুরগির মতো ঝিমাস! কাজ কর্ম করতে পারিস না?”

— “কি বললেন আপনি? আমি পোল্ট্রি মুরগি? আমি ঢেঁপসি?..”

— “ভুল কিছু বলেছি না কি? সারাদিন ঘরে বসে থাকিস। ওদিকে আমার মা সারাদিন রান্নাঘরে কাজ করতে ব্যস্ত। রাঁধতে না পারিস, হেল্প তো করতে পারিস?”

— “আপনি কি আমাকে দিয়ে কাজ করানোর জন্য বিয়ে করেছেন?”

— “না তে কী তোকে বসিয়ে রাখার জন্য?”

ওও! এইবার বুঝছি। সব বুঝছি। শা:লা খা:টা:সে:র খা:টা:স এই ছিল তোর মনে? মন খারাপ করে বললাম,

— “অন্তু আন্টি নিজেই আমাকে নিষেধ করেছে। তাই যাই নি..”

— “সে তো নিষেধ করবেই। কিন্তু তোর কমনসেন্স নেই? নিজে থেকে কিছু করতে পারিস না?”

রাগে খিটমিট করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে এলাম।

বিয়ের পর অভিমান করে আর আমাদের বাসায় যাই নি। যদিও তারা এসেছিল কিন্তু আমি সাথে যাই নি। দু’ একটা কথা বললেও মন খুলে কথা বলা আর হয় নি। এখন ছাদ থেকে প্রায়ই মায়ের সাথে দেখা হয়। বাড়ির উঠানে বাবা আর মা দুজনকেই প্রায় দেখি। কিন্তু কথা বলি না। তারা আমার সাথে এমনটা না করলেও তো পারতো! ভাবতেই মন খারাপ হয়।

কিন্তু সে মন খারাপও বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না। সূর্য দি গ্রেট খা:টা:স হুটহাট এসে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়। বিয়ের পর ঝগড়াটা বেড়ে গেছে চক্রবৃদ্ধি হারে! সেদিন যে গা:ঞ্জা খেয়ে ভালোবাসার কথা বলেছিল সেটা আমি ড্যাম সিউর! নয় তো এরপর তার মুখে আর প্রেমের বুলি আওড়াতে দেখি নি। যখনই দেখা হয়, তখনই শুধু ঝগড়া! তাও আবার খুব ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আর বেশি কিছু বললে ধুমধাম মা:রা:মা:রি শুরু করে। আমিও যে ছাড় দেই তা নয়। আমাকে একটা মারলে আমি তিনটা মারি! হুহ!

#চলবে——-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে