ক্লিওপেট্রা পর্ব-০১

0
2212

ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ০১
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি বিছানায় আমার পাশে শুয়ে এক নগ্ন নারীমূর্তি! আমার গা ঘেঁষে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটির গায়ে একটা সুতো পর্যন্ত নেই। সবুজ ডিম লাইটের আবছা আলোয় দেখতে পেলাম তাকে। শরীরটা যতটা না কামনাদায়ক, তার চাইতে কয়েকগুণ বেশি মায়াবী তার মুখটা। কিছু একটা আছে ওই মুখটায়। যার কারণে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছি না।
এখন শীতকাল। বছরের বারো মাস চব্বিশ ঘণ্টাই শোবার ঘরের জানালা খুলে রাখার অভ্যাস আমার। জানালাটা বিছানা বরাবর। হু হু করে বাতাস আসছে সেদিক থেকে। লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকার পরেও গায়ে হিম ধরে গেল আমার।
এমন ঠান্ডায় মেয়েটা কি করে নগ্ন দেহে শুয়ে আছে!
আসল ভাবনা বাদ দিয়ে কখন ইতি-উতি ভাবতে শুরু করেছি খেয়ালই করিনি। খেয়াল করতেই গা থেকে লেপ ফেলে দিয়ে একপ্রকার লাফিয়ে বিছানার অপরপ্রান্তে চলে এলাম। সাথে সাথেই মেয়েটা জেগে গেল। আমার ফেলে দেয়া লেপ টেনে সে নিজের গায়ে লেপ্টে নিল। তারপর আমার দিকে সরে আসতে আসতে বলল, ‘কী হয়েছে আহান? দূরে চিলে গেলে কেন?’
কথাটা বলেই সে একদম আমার কাছে চলে এল। তারপর আমার হাতটা তার মাথায় রেখে আহ্লাদী স্বরে বলল, ‘আদর করে দাও!’
আমি ঘোরগ্রস্তের মতো তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি!
সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো দেখলাম বিছানায় আমি একা শুয়ে। মেয়েটা নেই! সারা ঘর, সারা বাড়ি জুড়ে তাকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না তাকে। কোত্থাও নেই সে! তাহলে কি আমি স্বপ্ন দেখেছি? আমার ভ্রম ছিল মেয়েটা?
নাহ! এটা কি করে হতে পারে! স্বপ্ন কখনো এত রঙ্গিন এত জীবন্ত হয়!
মা টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিল। আমাকে এ ঘর ছেড়ে ও ঘরে ছোটাছুটি করতে দেখে বলল, ‘মিথিকে খুঁজছিস? ও তো আমার ঘরে।’

মিথি আমার পোষা বিড়াল। ছ’মাস আগে ওকে আমি রাস্তায় কুড়িয়ে পাই। নর্দমার পাশে শুয়ে ছিল। ওমন ময়লার স্তূপের মধ্যে সাদা ধবধবে বিড়ালটা নজর কেড়েছিল আমার। তাই ওকে কাছে ডাকি। ডাকতেই দৌড়ে চলে আসে। কেন যেন হঠাৎ অচেনা প্রাণীটির জন্যে আমার মায়া লেগে যায়। কোলে করে বাসায় নিয়ে আসি। বাসায় আনার এক সপ্তাহের মধ্যেই ও বাড়ির সকলের মন জয় করে নেয়। অবশ্য বাড়িতে আমরা তিনজন মাত্র মানুষ৷ মা, আমি আর আমার ছোটো বোন অহনা।
হঠাৎই ঘড়ির দিকে চোখ পরল আমার। সর্বনাশ! সাড়ে আটটা বাজে! নয়টায় অফিস আমার। যেতে সময় লাগে চল্লিশ মিনিট। ফ্রেশ হব কখন! খাব কখন! আর যাব কখন! আর জ্যাম থাকলে তো কথাই নেই। এই ঢাকার রাস্তায় জ্যাম থাকবে না তা কি হয় কখনো?
একপ্রকার দৌড়ে বাথরুমে চলে গেলাম। হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে শার্ট-প্যান্ট পরে টাইটা বাঁধতে বাঁধতে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। মা খেতে ডাকল। আমি মায়ের ডাক অগ্রাহ্য করে দরজা খুলে বেরোতে নিতেই মা পেছন থেকে আমার শার্ট টেনে ধরলো। বলল, ‘না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস? অল্প কিছু মুখে দিয়ে যা।’

আমি মায়ের হাত ধরে বললাম, ‘মা প্লিজ! আজকের মতো ছাড় দাও! অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।’

মা আমার কথার কোনোরকম পাত্তা না দিয়ে জোর করে টেবিলে নিয়ে বসাল। স্যান্ডউইচের বাটিটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি এক পিস স্যান্ডউইচ হাতে নিয়ে ‘মা আসি’ বলে বেরিয়ে এলাম। গন্তব্য বাস-স্টেশন।

সারাদিন অফিসে কাজের চাপে গত রাতের ঘটনাটা বেমালুম ভুলে গেলাম। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে একবার কলিংবেল চাপতেই মা দরজা খুলে দিল। ঘরে ঢুকতেই দেখি মিহি সোফায় শুয়ে। আমার দিকে চোখ পরতেই দৌড়ে আমার কাছে চলে এল। আমার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে মিউ মিউ করতে লাগলো। যার মানে হচ্ছে ‘আমাকে কোলে নাও।’
ওকে কোলে তুলে নিলাম। মা চেঁচিয়ে উঠল। ‘যা ফ্রেশ হয়ে খেতে বস। পরে আহ্লাদীকে কোলে নিয়ে বসে থাকিস।’
মায়ের কথায় আমি মিথিকে নামিয়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু মিথি নামতে চাইল না। উলটে আমাকে খামচে ধরে রইল। আমি পুনরায় ওকে কোলে তুলে নিলাম। ও নিশ্চিন্তমনে আমার কোলে শুয়ে মৃদু মিউ ধ্বনি তুলল। আমার বুকে মাথা ঘষতে লাগল। যার মানে ‘সকালে আমাকে আদর না করে কোথায় চলে গিয়েছিলে? এখন আদর করে দাও।’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে ‘স্যরি’ বললাম। ও প্রতুত্যরে বলল, ‘মিউ!’
মা ঠিকই বলে। আহ্লাদী একটা!

রাত এগারোটা। বিছানায় এসে শুয়েছি আধ ঘন্টা হলো। ঘুম আসছে না। কেন জানিনা আজ একা শুতে মন সায় দিচ্ছে না। তাই ভাবলাম মিথিকে নিয়ে আসি। ও নিশ্চয়ই মায়ের ঘরে। ওর ঘুমোনোর স্থানের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কখনো আমার সঙ্গে, কখনো মায়ের সঙ্গে তো কখনো অহনার সঙ্গে ঘুমোয়।

মিথিকে নিয়ে এসে শুতেই আমার ঘুমে চোখ ভার হয়ে এল। ঘুমিয়ে পরলাম তখুনি।

গতকালকের মতোই ঠিক মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমার মনে হল বুকের কাছটায় কেউ জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। মিথিই হবে। রাতে তো মায়ের কাছ থেকে আমিই ওকে নিয়ে এসেছিলাম। আমার গায়ের ওপর থেকে আলতো করে লেপ সরিয়ে নিতেই আমি শিউরে উঠলাম। মিথি নয়! গতকাল রাতের সেই মেয়েটি! আমার বুকের ওপর মাথা রেখে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। সেদিনের মতোই নগ্ন দেহে!
আমি এক ধাক্কায় আমার বুকের ওপর থেকে ওর মাথাটা সরিয়ে দিলাম। শরীর ঢাকার জন্য লেপ ছুড়ে মারলাম ওর ওপর।
মেয়েটি আমার আচরণে কোনো ভ্রুক্ষেপ করল না। গলা পর্যন্ত লেপ টেনে নিয়ে শুয়ে পরল। কিন্তু ঘুমোলো না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
আমি হন্তদন্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে নামলাম। সুইচ চেপে আলো জ্বালালাম। অকস্মাৎ কড়া আলো চোখে পরতেই মেয়েটি চোখ বন্ধ করে ফেলল। পরক্ষণেই আবার খুলে ফেলল। আমার দিকে তাকিয়ে সেই আদুরে স্বরে বলল, ‘ঘুমোবো আহান। আলো নেভাও!’

ওর কথা আমার কান পর্যন্ত পৌছালেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌছাতে পারল না। কারণ আমার মস্তিষ্ক জুড়ে ছিল অন্যকিছু। আমি একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম মেয়েটির মুখায়বে। এত রূপ, এত সৌন্দর্য, এত মায়া কারো চেহারায় থাকতে পারে! আমি ক্রমশ মোহগ্রস্ত হয়ে পরতে লাগলাম। এ মেয়ে কিছুতেই সাধারণ নারী হতে পারে না! কিছুতেই নাহ!!

তারপরের দিন সকাল বেলা মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গলো। ঘুম ভাঙ্গতেই দেখলাম আমি মেঝেতে শুয়ে আছি। মা বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগল এই ঠান্ডায় আমি মেঝেতে কেন? মাথা-টাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম না কি!
মায়ের মাথা থেকে দুঃশ্চিন্তা দূর করার জন্য মিথ্যে বললাম। ‘রাতে এত ঘুম পেয়েছিল না মা। মেঝেতে বসে মোবাইলে গেমস খেলছিলাম। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। ‘

মা রেগে গেল। বলল, ‘ তুই কি বাচ্চা ছেলে আহান?তোর কি কোনো কান্ড জ্ঞান নেই? এই ঠান্ডার মধ্যে তুই মেঝেতে বসে গেমস খেলবি কেন? ঘরে কি বসার জিনিসের অভাব পরেছে?’

‘উফফ মা। ভুল হয়ে গেছে। চেঁচামেচি করো না তো!’

মা আমাকে সাবধান করার ভঙ্গিতে বলল, ‘আর কখনো যেন মেঝেতে শুতে, বসতে না দেখি!’
তারপর আবার বলল, ‘ আটটা বেজে গেছে। যা জলদি হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়। নাহয় পরে দেখব দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে না খেয়েই বেরিয়ে পড়েছিস।’

মা চলে যাবার পর আমি গতকাল রাতের ঘটনাটা স্মরণ করতে লাগলাম। গতরাতের ঘটনাটাও কি স্বপ্ন ছিল? একই স্বপ্ন দু’দিন দেখা। এটা কি সম্ভব!
যদি স্বপ্নই হয় তাহলে আমি মেঝেতে এলাম কি করে! নাহ! গতরাতে এবং তার আগের রাতে যা ঘটেছিল সব বাস্তবই ছিল। স্বপ্ন স্মৃতিতে এত স্পষ্ট হয়ে কিছুতেই থাকতে পারে না। স্বীদ্ধান্ত নিলাম। আজকের রাতে কি ঘটবে সেটা আমি ডিসাইড করব। ওই মেয়েটা নয়। মনে মনে ওকে হাতেনাতে ধরার সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেললাম। তাতে যদি আমার ইজ্জতের ফালুদা হয় তো হোক।

আজকে অফিসের কাজ ঠিকমতোন করতে পারলাম না। সেজন্য দু’বার বসের ঝাড়িও খেলাম। তবুও কোনো কাজেই মন বসছে না। একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে মনের ভেতর। আচ্ছা আমি কি আমার পরিকল্পনায় সফল হবো? মন বলল, হবি। মস্তিষ্ক বলল, আজ তোর ইজ্জতের ফালুদা না আইসক্রিম হবে।
দেখি কোনটা সঠিক হয়। মন না কি মস্তিষ্ক!

অবশেষে রাত এল। শোবার আগে মা’কে, অহনাকে বলে এলাম দরজা খুলে ঘুমাতে। মোবাইলে ঠিক রাত দুটো বাজে এলার্ম সেট করে নিলাম। তারপর ঘুমিয়ে পরলাম।

রাত দুটোয় এলার্মের শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানার অপর পাশে তাকাতেই আমার মুখে হাসির রেখা ফুটল। এইতো! মেয়েটা আজো আমার পাশে শুয়ে। আমার ঘুম হারাম করে নিজে কেমন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছে দেখো! দাড়াও রহস্যময়ী। আজ তোমার রহস্য উদঘাটন করবোই!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে