ক্যালেন্ডার! পর্ব: ০৭!

0
819

গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ০৭!
লেখক: তানভীর তুহিন!

মিছিল গোসল সেরে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। খুব অস্থির লাগছিলো তার, কেমন যেনো ভ্যাপসা গরম অনুভব করছিলো দেহে। গোসল করার পর এখন বেশ স্বস্তি অনুভব হচ্ছে তার। মুবিনও মাত্রই গোসল করেছে, এসেই সোজা বাথরুমে ঢুকেছিলো। বাথরুম থেকে বের হয়েই মিছিলকে ফোন করে মুবিন। ফোনটা কানে লাগিয়ে মাথা দিয়ে ঘাড়ে চেপে ধরে আলমারির দিকে এগোয়। ফোন রিং হয়ে যাচ্ছে কিন্তু মিছিল ধরছে না। অদ্ভুত নজরে ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে মিছিল। দেখে মনে হবে জীবনে এই প্রথমবার ফোন নামক বিস্ময়কর যন্ত্রটি দেখেছে সে। ফোনটা বেজেই চলছে, কিন্তু মিছিল ধরছে না। মিছিল ফোন না ধরায় মুবিন মিছিলকে টেক্সট করলো, ” টেক্সট টা পড়ার সাথে সাথে ফোন দেবে আমায়! ”

মুবিনের কল কেটে যাবার পরপরই টেক্সট আসায় মিছিল উৎসাহ নিয়ে ফোন হাতে নেয়। টেক্সট টা দেখার পর নাকটা খানিক উচিয়ে চোখ ডান-বাম, উপর-নিচ ঘুরিয়ে ভাবতে থাকে মুবিনকে ফোন দেবে কিনা। ভাবনার অবসান ঘটিয়ে মিছিল ফোন দিয়েই দেয়। মুবিন ফোন রিসিভ করেই বলে, ” কোথায় ছিলে মিছিল মনি? ফোন দিতে দিতে হার্টফেল হয়ে গেলো আমার! ”
মিছিলের ঝটপট জবাব, ” কই হার্টফেল হইছে? একবারই তো ফোন দিলা! ”
– ” তারমানে তুমি ফোনের কাছে থেকেও ফোন ধরো নাই? ”
ধরা পড়ে গিয়ে জিহ্বায় একটা ছোট কামড় বসায় মিছিল। পরমুহুর্তেই, সে একটা প্রযুক্তিগত যুক্তি খুজে পায়। একটু চড়াভাব নিয়ে চড়াগলায় বলে, ” গর্দভ! কম্পিউটার নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করছো কেনো? যখন জানোই না যে ফোনে মিসডকল কাউন্ট করার প্রোগ্রাম আছে! ”
মুবিনের প্রানবন্ত হাসি বেড়িয়ে আসে মিছিলের কথায়। মিছিল অপমান করে, শাসন করে নাকি খুনসুটি’র ছলে কথাটা বলেছে তা সে জানে না। তবে কথাটায় বেশ প্রেম প্রেম প্রলেপ পেয়েছে সে। যে প্রলেপ হৃদয়ের ঠিক চারপাশটায় শিহরন জাগিয়ে দিতে পারে প্রখরভাবে।

মুবিন মুখে হাসি লেপে বলে, ” কী করতেছো? ”
– ” গোসল করে, চুল মুছছিলাম। তুমি? ”
– ” এই তো তোয়ালে খুলে শর্টপ্যান্ট পড়ছি। ”
– ” ছি! ” বলেই নাক কোচকালো মিছিল।
– ” কীহ? ”
মিছিল মুখটাকে খানিক বাকিয়ে ভেংচি কেটে বলে, ” কিছুনা! ”
মুবিনের মুখে ফেলুদা ধরনের গোয়েন্দা ছাপ। সে চোখটাকে খানিক ছোট করে বলে, ” কিছুনা হতে যাবে কেনো? তুমি এই মাত্রই ছি! বললে। ”
– ” হ্যা বলেছি! ”
– ” কেনো বলেছো? ছি! এর মতো কী হয়েছে? ”
– ” অনেক কিছু হয়েছে। তুমি তোয়ালে ছেড়ে শর্টপ্যান্ট পড়ছো এটাও বলা লাগে নাকি? যখন বলছিলে কথাটা উইয়ার্ড লাগেনি তোমার কাছে? ”
– ” এখানে উইয়ার্ড এর কী আছে? উইয়ার্ড তো তখন হতো আমি বলতাম যে আমি ল্যাং….. ”
– ” হইছে! হইছে! আমি বুঝছি। অসভ্য কোথাকার! ” বলেই একটু হাসে মিছিল।
মুবিনও হাসছিলো। মুবিন বলে, ” আচ্ছা শোনো কাল স্কুটার নিয়ে ভার্সিটি যাওয়া লাগবে না। আমি যাবার সময় তোমায় পিক করে নেবো আর বাসায় ড্রপ’ও করে দেবো! ”
মিছিল ভনিতামাখা শক্ত গলায় বলে, ” কোন দুঃখে এই আকামটা করতে যাবো আমি? ”
মুবিন হো হো শব্দে চারপাশ কাপিয়ে হেসে ওঠে। কন্ঠে হাসির আভা মিশিয়ে মুবিন বলে, ” তুমি জানো বরিশাল, যশোর ওসব অঞ্চলে আকাম এর মানে কী? ”
লজ্বায় মিছিলের কপাল কুচকে চোখদুটো বুজে যায়। দাতদুটো খিটে খানিক লজ্বামিশ্রিত স্বরে মিছিল বলে, ” আমি মোটেই ওভাবে মানে বের করে বলিনি! ”
– ” হ্যা বুজেছি। এখন শোনো, কাল স্কুটার নেবার প্রয়োজন নেই। আমি তোমায় ভার্সিটি নিয়ে যাবো আর বাসায় ছেড়েও যাবো! ”
– ” কোন দুঃখে এই আজাইরা কাজটা করবা শুনি? আর বাসা থেকে স্কুটার না নিয়ে বের হলে আব্বুর কাছে জবাবদিহি করতে হবে! ”
– ” দুঃখে হতে যাবে কেনো? প্রেমে! প্রচুর প্রেমে! ” বলেই মুচকি হেসে চুপ করে যায় মুবিন। কেমন যেনো অন্যরকম লাগছে। মিছিল ও মিটিমিটি হাসছে। মুবিন আবার বলে,
– ” একদিনের’ই তো ব্যাপার। যেকোনো একটা অজুহাত বানিয়ে নিও। আমার একটা সারপ্রাইজ দেবার আছে তাই বলছিলাম! ”
– ” সারপ্রাইজ? তা চান্দু তোমার কেনই বা মনে হলো তোমার সারপ্রাইজ দেওয়াটাকে আমি এপ্রিশিয়েট করবো? আমরা জাস্ট ফ্রেন্ড! এখনো সারপ্রাইজ দেবার মতো কোনো সম্পর্ক তৈরী হয়নি আমাদের মধ্যে। ”
– ” জাস্টফ্রেন্ড!? তুমি কী এই মাত্র আমায় জাস্টফ্রেন্ড বললে মিছিল? আসলেই আমি তোমার জাস্টফ্রেন্ড? ” মোক্ষম সময়ে মোক্ষম যুক্তিটা যে কীভাবে মুবিনের মাথায় চলে এসেছে সেটা ভেবেই হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে মুবিন। মিছিলকে জব্দ করে যেনো সে রাজ্য জয়ের সুখ ভোগ করছে।
মুবিনের ডাবলমিনিং কথাটায় আহাম্মক বনে গেছে মিছিল। সে অন্যকোনো মিনিং ছাড়া এমনিতেই ক্যাজুয়াল ভাবে বলেছিলো কথাটা। কিন্তু মুবিন সেটার কী বাজে একটা মানে বের করলো। মুবিন সামনে থাকলে মিছিল ঠিকই ওর নাক টেনে উঠিয়ে, চুল টেনে ছিড়ে ন্যাড়া করে দিতো ওকে। মিছিল দাতখিটে বলে, ” ওরে অসভ্যর ছাও ওটা কথার কথা ছিলো। তুই যা ভেবে এরকম লাফালাফি করছিস আমি ওই মিনিং’এ বলি নাই! ”
মুবিন হেসে হেসে বলে, ” আচ্ছা ঠিক আছে। এখন তুমি কাল স্কুটার নিয়ে বের হচ্ছো না। এটা ফাইনাল! আমি তোমায় ভার্সিটি নিয়ে যাবো! ”
– ” কোনোমতেই না। আমি স্কুটার নিয়েই যাবো, আব্বুর কাছে অজুহাত সাজিয়ে বলতে পারবো না! ”
– ” আমি মেইনরোডের কাছে অপেক্ষা করবো। আসা না আসাটা তোমার ব্যাপার। তোমার ব্যাক্তি স্বাধিনতা। আর আমি স্বাধিনতায় হস্তক্ষেপ করতে পছন্দও করি না। তাই তুমি এলে আসবে, আর না এলেও সমস্যা নেই। আমি এই ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মাইন্ড করবো না। সো ডোন্ট ওরি! ”
মুবিনের কথায় মুখ ভেংচায় মিছিল। আসছে স্বাধিনতা রক্ষার সৈনিক। অধিকার ফলাতে আসে, দু-তিন দিন প্রোপোজের পরেই নিজের প্রোপার্টি মনে করতেছে। যেই দেখলো কনভেইন্সড হচ্ছি না ওমনি বীরপুরুষ লজিক দিয়ে কনভেইন্স করার ধান্ধা। আমি মোটেও কাল সারপ্রাইজ ডিসকভার করার জন্য তোর সাথে যাবো না।

সকাল সাড়ে নয়টা মতো বাজে। মিছিল মেইনরোডের কাছে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় পাচ মিনিট। কোনো ইচ্ছেই ছিলো না তার মুবিনের কথায় ড্যাংড্যাং করে নাচার। কিন্তু সে না চাইলেও তার মন চায় যে সে মুবিনের কথায় ড্যাংড্যাং করে নাচুক। নেচে নেচে একদম পা ভেঙে লুলা হয়ে যাক, তারপর মুবিনের কোলে উঠে বসে থাকুক। মিছিলের গলায় পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাটা ঘামে ভিজে গেছে প্রায়। বাইরে আজ প্রখর রোদ। আজ যেনো রোদ সূর্যের সাথে তার বিবাহবার্ষিকী পালন করছে এমন অবস্থা। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে মিছিল। সে কী এই অসহ্য গরম থেকে রেহাই পাবার জন্য স্কুটার নিয়ে ভার্সিটি চলে যাবে নাকি এখানে মুবিনের জন্য অপেক্ষা করে করে মানুষরুপি আমসত্ত্ব হয়ে যাবে। না এখন স্কুটার নিয়ে যাবার কোনো মানেই হয় না। এতোক্ষন দাঁড়িয়ে যখন আছে আরো কিছুক্ষন নাহয় দাঁড়িয়েই থাকুক। মিছিল গরমে অতিষ্ট। হাত নাড়িয়ে বাতাস করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে, ঠোট সরু করে মুখ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বের করছে মিছিল। হঠাৎ করেই একটা বাইক এসে কষে ব্রেক করে মিছিলের সামনে। একদম নাকের ডগার পাশ ঘেষা ব্রেক। মিছিল গর্জে ওঠে। হুংকার দিয়ে বলে, ” এ্যাই! এটা কোন ধরনের বেয়াদবি? বাইক কী ফুটপাত দিয়ে চালাবেন নাকি? ”
মিছিল চেহারায় আগুন মেখে তাকিয়ে আছে সামনের হেলমেটটার দিকে। উদ্দেশ্য হেলমেটের পেছনের বেয়াদবটাকে দেখবে সে। মুখ না দেখলে ঠিক ভালোভাবে শিক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। সামনে থাকা মানুষটা হেলমেট খুলতেই পরিচিত একটা মুখ আবিষ্কার করে মিছিল। আরে এটা তো মুবিন!
মুহুর্তেই মিছিলের রাগ পড়ে যায়। এটুকু মজা মুবিন মিছিলের সাথে করতেই পারে, সেটুকু অধিকার অবশ্যই মুবিন অর্জন করেছে। কিন্তু পরমুহুর্তেই মিছিলের রাগ মাথায় উঠে যায়। না মানে ওয়েট করানোর তো একটা লিমিট আছে, হারামজাদা কালকে সারপ্রাইজের ভাষন মারিয়ে আজ এভাবে হ্যাপা দেওয়া? পাইছস টা কী? মিছিল মুবিনকে কড়াকথা শোনাতে যাবে তার আগেই মুবিন মিছিলের দিকে তাকিয়ে হেসে ভ্রু-নাচিয়ে বলে, ” গাড়ির ভেতরে কেমন যেনো দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। তাই ওই স্কুটারটায় যাতায়াত করি, একদম ফুরফুরে বাতাস পাই চালানোর সময়। বেশ ভালো লাগে! এটাই বলেছিলে না কাল? নাও এখন থেকে চারচাকা বাদ, দুচাকা নিয়ে তোমার সাথে ফুরফুরে বাতাসের সঙ্গে ভাববিলাস করবো। এখন চটজলদি উঠে পড়, বাইকের ব্যাকসিট তোমার জন্য ওয়েট করে আছে! ”

মিছিল হতবাক দৃষ্টিতে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে মুবিনের দিকে। বাইকটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এখনই শো-রুম থেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। সব স্টিকার-ফিস্টিকার যায়গারটা যায়গাই আছে। মানে কী এসবের? একটা কথার জন্য সোজা বাইক কিনে ফেলবে? এসব কোনধরনের পাগলামি? এভাবে টাকা অপচয়ের কোনো মানে হয়?
মিছিল শীতল কন্ঠে বলে, ” এসব কী মুবিন? তুমি বাইক কেনো কিনেছো? ”
– ” যাতে তোমার আমার সাথে গাড়িতে যেতে দমবন্ধ না লাগে। এখন থেকে বাইকের মধ্যে পিওর অক্সিজেন পাবা, সাথে আমি ফ্রিতে তোমার জড়িয়ে ধরাও পাবো! ” বলেই খিটখিট করে দুষ্টু হাসে মুবিন। মুবিনের হাসিতে গা জ্বলে মিছিলের। তার মোটেই অপচয় পছন্দের না। টাকার মুল্য ঠিক কতটা তা সে তার বাবার কাছ থেকে শিখেছে। তাই সে একদমই অযথা টাকা অপচয় পছন্দ করে না। মিছিল এবার মুখে বিরক্তি এনে বলে, ” একদম এরকম ফালতু কাজ করবা না। এসব কোনধরনের ফালতুগিরি? আমার বাতাস ভালোলাগে বলেই বাইক কিনে ফেলবা? তাও আবার হুট করেই। আমার ছোট একটা ইচ্ছের জন্য সোজা লাখটাকার অপচয়? এসব আমার একদমই পছন্দ না মুবিন! ”
মুবিন মিছিলের বিরক্তির কারনটা বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হ্যা এটা একধরনের অপচয় সেটা সে জানে। তবে সে আশা করেছিলো তার এই কাজে মিছিল ইম্প্রেস হবে, ইম্প্রেস না হলেও খুশি অন্তত হবে। অথচ মিছিলের মুখে একরাশ বিরক্তির ছাপ দেখতে পাচ্ছে সে। মুবিন চুপ করে আছে। হাত দিয়ে হেলমেটের উপরের অংশে ঢোল বাজাচ্ছে। মিছিল সামনে হাত বেধে তাকিয়ে আছে মুবিনের দিকে। মিছিল মুবিনের মুখে অপরাধবোধ এবং মন খারাপের আলমারি আবিষ্কার করেছে। তাই আর দাঁড়িয়ে না থেকে বাইকের পেছনের হেলমেটটা পড়ে নিয়ে বাইকে উঠে বসে!

চলবে!
#thetanvirtuhin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে