কোনো একদিন পর্ব-০৬

0
1711

#কোনো_একদিন
#পর্ব_৬
#কলমে_অপরাজিতা_ইসলাম

“মেহেক,আমার মধ্যে এমন কিসের কমতি ছিল যার জন্য তুমি আমাকে রিজেক্ট করে মাসফিকে হ্যা বললে?আমিও তো ওর মতোই একই পরিবারের ছেলে।দেখতেও ওর চেয়ে কম না আমি।কোনোকিছুরই কমতি নেই আমার মধ্যে।তবুও কেন তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারলে না?কেন আমার পবিত্র ভালোবাসাকে অপমান করলে তুমি?বলো।জবাব দাও।প্লিজ মেহেক চুপ করে না থেকে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”

হঠাৎই তাহার কথায় কল্পনা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসলাম আমি।এতক্ষণ ধরে আমি সিয়ামের কথা ভাবছিলাম।প্রতিনিয়ত ওকে কষ্ট দেওয়ার যন্ত্রণা আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না।ওর শুকনো মুখ,লাল লাল চোখ,নিজের যত্ন না নেওয়া আমি আর মানতে পারছি না।ভালো তো আমি সিয়ামকে ও বাসি।কিন্তু সেটা বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে।আমি এতোক্ষণ ধরে ভাবছিলাম হয়তো সিয়াম আমাকে একা পেলে এই কথাগুলোই বলবে।কিন্তু না,ওও আমার সমস্ত ভুল ধারণা ভেঙ্গে দিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে বললো,

“কংগ্রাচুলেশনস।”

আমি শুধু অবাক হয়ে ওকে দেখছি আর ভাবছি,

“একটা ছেলে কতটা ভালো হলে নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হতে দেখেও এমন হাসি মুখে থাকতে পারে।আর সেই ছেলেটা তো অন্য কেউ না বরং ওরই আপন চাচাতো ভাই।”

সিয়াম আমাকে আর মাসফিকে উইস করেই বাগানের অন্য একটা দিকে চলে গেল।আমিও সবার মাঝে থেকে উঠে একটা কল করার বাহানা নিয়ে সিয়ামের কাছে চলে এলাম।ওও উদাসীন দৃষ্টিতে আকাশ পানে চেয়ে আছে।আমি পর কাছে গিয়ে দাড়ালাম।

“সিয়াম”

ওও একবার আমার দিকে তাকিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,

“হুম বলো।”

“আমাকে কি মাফ করা যায় না?”

“মাফ?তোমাকে আমি কেন মাফ করবো?তুমি তো কোনো ভুল করোনি।”

“হুম তুমি ঠিকই বলেছো।আমি কোনো ভুল করিনি।বরং অন্যায় করেছি।”

“না মেহেক।তুমি কিচ্ছু করোনি।আর যেটা করেছো সেটা হয়তো ঠিকই করেছো।”

“তুমি এতো স্বাভাবিক কিভাবে আছো?”

“অস্বাভাবিক-ই বা থাকবো কেন?”

“সিয়াম তুমি আমাকে ভালোবাসো।অথচ আজ আমি তোমারই ভাইয়ের বউ।তোমার কি একটু ও কষ্ট হচ্ছে না?খারাপ লাগছে না?”

হঠাৎই সিয়াম আমার কাছে এসে চোখের দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করলো,

“ভালোবাসা কাকে বলে জানো?ভালোবাসা তাকেই বলে যেটা নিঃস্বার্থ হয়।যেখানে কোনো লাভ-ক্ষতির হিসেব করা যায় না।ভালাবাসা সেটা নয় যেখানে কোনো না কোনো স্বার্থ জড়িয়ে থাকে।ভালোবাসার সজ্ঞাটা আমার কাছে এমন-ই যেখানে স্বার্থহীন ভাবে কাউকে ভালোবেসে তার ভালো থাকাটা নিশ্চিত করা যায়।আমি তোমাকে ভালোবাসি।তার মানে এটা নয় যে তোমাকে আমার কাছে পেতে হবে।দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে একসাথে থাকতে পারলেই সেই ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে।আর ভালোবেসে বিচ্ছেদ হয়ে গেলে সেই ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে না এমনটা কিন্তু নয়।ভালোবাসা প্রিয় মানুষটিকে আগলে রাখতে শেখায়।প্রিয় মানুষের মুখের হাসি,তার আনন্দ,ভালো থাকা এসব নিশ্চিত করতে শেখায়।আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই যে তোমাকে আমার পেতে হবে এমনটা না।বিধির বিধানে যদি তুমি আমার ভাগ্যেই না থাকো তাহলে নিজেকে কষ্ট দিয়ে তিলে তিলে শেষ করেও কিচ্ছু হবে না।বরং যেটা হবে তা হলো,আমরা কেউ ভালো থাকবো না।আমার শেষ হয়ে যাওয়ার পেছনের গল্পটা কেউ জানলে তোমার দিকেই আঙ্গুল তুলবে।তুমিও প্রতিনিয়ত অপরাধবোধে শেষ হয়ে যাবে।এটা তো ভালোবাসা নয়।ভালোবাসা তো আমাদেরকে ভালো থাকতে শেখায়।হয়তো তুমি আমার সাথে ভালো থাকবে না সেই জন্যই মাসফিকে বেছে নিয়েছো।এতে তোমার কোনো দোষ নেই।কারণ জোর করে ভালোবাসা যায় না।সর্বোপরি,নিজের ভালোবাসার মানুষটা ভালো থাকলেই আমার ভালোবাসা স্বার্থক হবে।আর তাই আমিও ভালো আছি।”

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য চোখে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে আছি।

“তোমার ভালোবাসার ব্যাখ্যার কাছে আমার কথাগুলো নিতান্তই তুচ্ছ।সত্যি সিয়াম তোমাকে যে নিজের করে পাবে সে আসলেই অনেক বেশি ভাগ্যবতী।হয়তো সেই ভাগ্যবতী আমি নিজেই হতে পারতাম।কিন্তু আমার কাছেও যে ভালোবাসার একটা ব্যাখ্যা আছে।আর সেই ব্যাখ্যার কাছে হেরে গিয়েই আজ আমি মাসফির স্ত্রী।”

“তোমার ব্যাখ্যাটা শুনতে চাই আমি।বলবে কি আমায়?”

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম,

“অবশ্যই জানতে পারবে।তবে সেটা এখন না।সঠিক সময়ে সবটা জানতে পারবে।আজ নাহয় সেসব কথা তোলা থাক মনের সিন্দুকে।সঠিক সময়ে সেই সিন্দুকের চাবি দিয়ে সিন্দুক খুলে আমার ভালোবাসার ব্যাখ্যা সবাইকে জানাবো।”

আমার কথায় সিয়াম হাসলো।তারপর বলল,

“তোমার কথার প্রেমে আগেও পরেছি।আজ আবার নতুন করে নতুন ভাবে প্রেমে পরলাম।”

আমি কিছু না বলে শুধু হাসলাম।এই ছেলেটাকে ভালো রাখতে হবে।আর আমি জানি সেটা একমাত্র তুলিই পারবে।আমাকে এদের দু’জনকে যেভাবেই হোক এক করতেই হবে।একটু পর তুলি এসে আমাদের দু’জনকে একসাথে দেখে আলতো হেসে কাছে এসে বললো,

“কিরে তোরা এখানে কি করছিস?চল ঐদিকে চল।সেই সকালে এসেছি আমরা।এখন কিছু খেয়ে নিই।তারপর মেয়েরা মিলে রান্না করবো।আর ছেলেরা ডেকোরেশন করবে।আজ একটা পিকনিক হয়ে যাক।”

আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম,

“হ্যা চল চল।খুব মজা হবে আজকে।”

এটা বলেই আমি তুলি আর সিয়ামের হাত ধরে সামনপর দিকে এগোতে লাগলাম।সবার কাছে গিয়ে আমি হঠাৎই খেয়াল করলাম সিয়াম আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আমি ওর হাত ধরে আছি এটা বুঝতে পেরেই চট করে হাত ছেড়ে দিলাম।সিয়াম মুচকি হেসে অন্যদিকে গিয়ে বসে পড়লো।আমিও আর কিছু না বলে তুলির সাথে বসে পড়লাম।

“মেহেক,তোমার মুখের হাসি টাই আমার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যথেষ্ট।ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে না পেলেও প্রতিদিন একবার হলেও দেখতে তো পারবো।একদিক থেকে ভালোই হয়েছে তুমি মাসফির বউ হওয়াতে।কারণ তুমি আজ অন্যকারো হলে তো সবসময় আমার চোখের সামতে থাকতে না।তার থেকে তুমি আমার ভাইয়ের বউ হওয়াতে আমি অনেক খুশি হয়েছি।তুমি ভালো থাকলেই তো আমি ভালো থাকবো।তোমার বর হতে নাই বা পারলাম।বেস্ট ফ্রেন্ড তো হয়েছি।কোনো না কোনো দিক থেকে তো তোমার মনে জায়গা করতে পেরেছি।তোমার ভালোবাসা পেয়েছি।এতেই আমি সন্তুষ্ট।”

আমি সিয়ামের দিকে তাকানোর পর আমাদের দু’জনের চোখাচোখি হয়ে গেলো।আমি তারাতাড়ি করে ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।কারণ ঐ ব্যাথাতুর চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই আমার।একটুপর আমি রাজ,তাহা আর মাসফিকে কোত্থাও দেখতে না পেয়ে মিহিকে জিজ্ঞেস করলাম,

“রাজ আর মাসফি কোথায়?”

“রাজ আর তাহা মার্কেটে গিয়েছে কেনাকাটা করার জন্য।ডেকোরেশন,রান্নার জিনিস এসব কিনতেই গিয়েছে।আর মাসফির কি যেন একটা জরুরি কাজ আছে বলে চলে গেলো।আর বললো এক ঘন্টার মধ্যেই চলে আসবে।”

আমি ‘ওহ’ বলে বাকি সবার সাথে গল্প করতে লাগলাম।আপতত এখানে আমি,তুলি,মিহি,সানভি আর সিয়াম আছে।বাকি তিনজন তো কাজে গিয়েছে।একটু পর আমি আর মিহি মিলে ইটের চুলা বানাতে লাগলাম।সানভি আর সিয়াম মিলে কাঠ,লতাপাতা,ইট এগুলো আনতে লাগলো।তুলি ডেকোরেশনের জায়গাটা পরিষ্কার করতে গেলো।আসলে আমরা প্রতিবার রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এনে ফার্মহাউসের ভেতরে গিয়ে মজা,হৈ-হুল্লোড় করতাম।কিন্তু এইবার আমার কথাতেই এমন আয়োজন।বাগানের দিকেই সবকিছুর যোগাড় করা হচ্ছে।আমি সকাল সকাল এসেই সবাইকে সবটা বুঝিয়ে দিয়েছি।আর সবাই ও আমার কথা মতো হ্যা বললো।

প্রায় বিশ মিনিট পর রাজ আর তাহা সবকিছু নিয়ে এলো।তারপর আর কি?মেয়েরা সবাই রান্নার কাজে লেগে পরলাম।আর ছেলেরা ডেকোরেশন করতে লাগলো।আজ এখানেই আমরা সবাই থাকবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।যেই ভাবা সেই কাজ,পরিবারের সবাইকে কথাটা জানিয়ে দিলাম যেন চিন্তা না করে।কারোর পরিবারই না করেনি।কারণ সবাই জানে,আমাদের বন্ধু মহলের সম্পর্কটা এমনই যেখানে চোখ বন্ধ করে একে-অপরকে বিশ্বাস করা যায়।যেখানে থাকলে আমরা সবাই ভালো থাকবো।কেউ আমাদের দিকে তাকানোর সাহস পাবে না।আমাদের বন্ধু মহলের মেয়েদের জন্য ছেলেরা সবাই অনেক বেশি সচেতন।জানিনা কার মনে কাকে নিয়ে কি রকম ফিলিংস আছে।কিন্তু তুলি আর সিয়ামের ব্যাপারটা তুলির ব্যবহার দেখেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম।আর এখন সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাকে তুলির সাথে একান্তই কথা বলতে হবে খুব দ্রুত!

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে