কোথাও কেউ ভালো নেই পর্ব -০৫

0
1145

#কোথাও কেউ ভালো নেই
জাহান আরা
পর্ব-০৫

সকাল থেকে ভ্যাপসা গরম পড়ছে।সূর্য উঠেছে,তীব্র রোদে সকলের প্রাণ ওষ্ঠাগত। মাথার উপরে ভনভন করে ফ্যান ঘুরছে পূর্ণ গতিতে।তবুও পূরবীর সারা শরীর ঘেমে জবজবে।
বহুদিন পর পূরবী বেলা দশটা পর্যন্ত শান্তিতে ঘুমালো।
একটা হাতপাখা দিয়ে তানভীর পূরবীকে বাতাস করছে আর দেখছে পূরবীর নাকের মুক্তোর মতো ঘাম বিন্দুগুলো।লোকে বলে নাকে ঘাম দেওয়া মেয়েরা স্বামীর খুব ভালোবাসা পায়।সত্য মিথ্যা জানে না তানভীর তবে এটুকু জানে এই মেয়েটাকে সে প্রচুর ভালোবাসবে।

টিস্যু প্যাকেট থেকে টিস্যু নিয়ে পূরবীর নাক মুছে দিলো তানভীর। এই মেয়েটা নিশ্চয় গরম সহ্য করতে পারে না।সাথেসাথে সিদ্ধান্ত নিলো দুটো এসি কিনবে।একটা বাবা মায়ের রুমে লাগাবে আরেকটা নিজেদের রুমে।

টেবিলের ড্রয়ারে পূরবীর জন্য আনা নতুন স্মার্ট ফোন ও এক জোড়া সোনার নুপুর রয়েছে। গতরাতে দিবে ভেবেছে তানভীর কিন্তু দিতে পারে নি নানা ঝামেলায়।
ঠিক করে রাখে ঘুম থেকে উঠলেই দিবে পূরবীকে।

পূরবীর আচমকা ঘুম ভেঙে গেলো। লাফ দিয়ে উঠে বসে পূরবী জিজ্ঞেস করলো,”কয়টা বাজে?সুরভী কই?
আমি কি দেরি করে উঠেছি আজকে?
ছোট মা কি সুরভীকে মেরেছে?”

তানভীরের চোখে জল এলো পূরবীর কথা শুনে।জবাব না দিয়ে পূরবীকে টেনে নিলো।বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,”ভয় পেও না পূরবী।সব ঠিক করে দিবো আমি।আমি আছি তো শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত। ”

পূরবী চুপ করে রইলো। তারপর উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো। হাত মুখ ধুয়ে বের হয়ে বিছানায় বসে রইলো। পূরবী বুঝতে পারছে না আসলে ওর এখন কি করা উচিত বা কার কাছে যাওয়া উচিত।
তানভীর কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলো পূরবীকে।তারপর জিজ্ঞেস করলো,”পূরবী তোমার দাদী,নানী কেউ আছেন বেঁচে?”

পূরবী মাথা নেড়ে বললো,”না,নেই।”

তানভীর বুঝলো এই মেয়েটার সংসার জীবন সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই,এমন কি আশেপাশের ভাবীরা কেউও মেয়েটিকে বুঝিয়ে দেয় নি কিছু।
ড্রয়ার থেকে নুপুর বের করে পূরবী পা দুটো নিজের দিকে টেনে নিলো তানভীর। পূরবী ভয়ে আঁতকে উঠলো।

বক্স থেকে নুপুর বের করে পূরবীর দুই পায়ে পরিয়ে দিলো তানভীর। তারপর হাতে একটা চুমু খেয়ে বললো,”আমাকে তুমি নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড ভাবতে পারো পূরবী। যেকোনো সমস্যায় পড়লে আমাকে বলতে পারো,আমি সমাধান করে দিবো।স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক আগে হচ্ছে বন্ধুত্বের,একে অন্যের কাছে যদি সহজভাবে মনের সব সুখ দুঃখ বলতে না পারে তবে একটা সম্পর্কে থাকে কিভাবে মানুষ? ”

পূরবী তানভীরের মুখের দিকে তাকালো।এই মানুষটিকে প্রথমে যতোটা খারাপ ভেবেছে সে আসলে ততটাও খারাপ না লোকটি।একটু একটু ভরসা করাই যায়।

একটু ভেবে পূরবী জিজ্ঞেস করলো,”আমি এখন কী করবো?”

“তুমি আগে গোসল করবে,তারপর একটা গোলাপি সুতির শাড়ি এনেছি আমি,শাড়িটি পরবে।চুলে এই বেলীফুলের গাজরা দিবে,চোখে মোটা করে কাজল দিবে,তারপর আমার সাথে নাশতা করতে যাবে।সময় মাত্র ৩০ মিনিট,জলদি করো।”
তানভীরের কথামতো পূরবী উঠে গেলো।

রেবেকা পান বানিয়ে তমিজ মিয়া কে দিলেন।তমিজ মিয়া পান খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো,”নতুন বউ কই?”

রেবেকা মুখ ঝামটা মেরে বললো,”খুঁজে তো আনছেন একটা বেলাজ ছেড়ি,বিয়ার পরদিন মানুষ এতোক্ষণ শুইয়া থাকে?
বউ কি আরো দুইটা আনি নাই ঘরে?
এরকম বেলাজ তো অরা আছিলো না।”

তমিজ মিয়া স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,”আমার প্রশ্ন তো এতো প্যাচানো আছিলো না রেবেকা।এতো হিস্টোরি তো তোমারে আমি জিগাই নাই।আমার জহুরির চোখ,খাঁটি সোনা চিনতে আমার ভুল অয় নাই।তুমি যেডি আনছো,সবডি অইলো গিয়া গোল্ড পেলেট,সোনার মতো মনে অয় প্রথমে দেখলে।”

রেবেকা স্বামীর সাথে আর কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখেন তানভীর বসে বসে আম কেটে দিচ্ছে পূরবীকে,পূরবী খাচ্ছে।
রেবেকা তাৎক্ষণিক গিয়ে তারিন কে ডেকে এনে দেখালেন।

তারিন অনেকক্ষণ ভেবে বললো,”মা,আমার মনে লয় অরা তাবিজ করছে তানভীরের লাইগ্যা। আমার ভাইতো এমন না মা।কাইলকা বউ আনতে আনতে আইজকা বউরে এমন যত্ন করে কেউ?
কোনো একটা কাহিনি আছে মা।তুমি জোবেদা খালার বাড়িতে যাও।তারে গিয়া সব খুইল্যা কও।যা করার উনি করবো।”

রেবেকা মেয়ের কথায় সায় দিলেন।কাল পরশুরমধ্যে তিনি যাবেন জোবেদা বুজির বাড়িতে।

খাওয়া শেষ হলে তানভীর পূরবীকে বললো,”যাও এবার মায়ের কাছে যাও।ওনার পাশেপাশে থেকো।উনি একটু রেগে আছেন,একটু রেগে কথা বলবে হয়তো রাগ করো না তুমি। সংসারের সব মানুষ তোমার মনের মতো হবে না।তুমি ও সবার মনের মতো হবে না।জগৎ এরকমই। আমি ও দেখো কারো অপছন্দের তালিকায় আছি।আবার আমার অপছন্দের তালিকায় ও অনেকে আছে।
তুমি নিজের ব্যবহার দিয়ে সবাইকে প্রভাবিত করতে পারো যদি তো ভালো। সবাই যার যার ইগো ছেড়ে তোমায় কাছে টেনে নিবে।
আর না পারলেও ক্ষতি নেই পূরবী।তবে তোমাকে তোমার জায়গায় স্বচ্ছ থাকতে হবে।তোমার দোষ ধরার জন্য মানুষের অভাব হবে না।কিন্তু দেখবে তোমার গুণ কারো চোখে পড়বে না।
প্রতিটি মানুষের বিবেক আছে পূরবী। মন ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে কিন্তু বিবেক নেয় না।নিজের বিবেকের কথা শুনো।এই পরিবার এখন তোমার। আমি বলছি না তুমি সেভাবে চলবে যেভাবে আমার মা,বোন,ভাবী,ভাই সবাই বলবে,ওদের কথামতো উঠবে বসবে।তোমার যেভাবে কমপোর্টেবল লাগবে তুমি সেভাবে চলবে।
তবে এমন করে চলাফেরা করো না,কারো সাথে এমন ব্যবহার করো না যাতে কেউ তোমার দিকে আঙুল তাক করতে পারে।
মনে রেখো,পুরো দুনিয়া তোমার বিরুদ্ধে থাকুক,তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিক,আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবো।তোমার চাইতে বড় সত্য আমার কাছে কিছু নেই।

আমার এই বিশ্বাস তুমি ভেঙে দিও না।আমি খুব আবেগী মানুষ পূরবী।বিশ্বাস ভাঙলে আমি বাঁচবো না।আমি তোমার সাথে, তোমার হাত ধরে হাজার বসন্ত কাটাতে চাই।”

পূরবী কি বুঝলো তানভীর জানে না।তবে দেখতে পেলো পূরবীর দুচোখ জলে টইটম্বুর হয়ে গেছে। চোখ মুছে পূরবী বললো,”আমি কখনো কাউকে অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না।তবুও যদি কেউ অভিযোগ করে থাকে আমাকে বলবেন আপনি,আমার দোষ হলে আমি নিজেকে শুধরে নিবো।”

তানভীর হাসলো।পূরবী উঠে চলে গেলো কিচেন রুমের দিকে।

নতুন বউ দেখার জন্য আশেপাশের অনেক মানুষ এসেছে।যেই দেখছে পূরবীকে সে-ই পূরবীর রূপে মুগ্ধ হচ্ছে।সবাই বলছে,তানভীরের বউ পরীর মতো সুন্দরী।

লোকে বলে জা’য়ের শত্রু জা।পূরবীর এতো প্রশংসা আনিকা,মিমের সহ্য হলো না।বিরক্ত হয়ে সরে গেলো দুজন। সকালের নাশতার কাপ,পিরিচ,প্লেট জমেছে সিংকে অনেকগুলো। রেবেকা রান্নাঘরে এসে দেখেন সিংকে সব জমে আছে,কেউ এগুলো পরিষ্কার করে নি।পূরবী একটা মোড়ায় মাথা নিচু করে বসে আছে।

রেবেকা কড়া গলায় পূরবীকে বললেন,”পূরবী,সিংকের প্লেট বাসন সব পরিষ্কার করে ধুয়ে ফেলো তো।”

এই প্রথম রেবেকা পূরবীর সাথে কথা বললেন সুন্দর করে। পূরবী আনন্দিত হলো শাশুড়ি তার সাথে কথা বলায়।
ভিম দিয়ে ধুতে লাগলো সব।মিম এলো রান্নাঘরে কাপ নিতে,চা খাবে মিমের স্বামী তুহিন। পূরবী কাপ ধুয়ে মিমের দিকে দিলো।মিম কাপটা ধরলো না ইচ্ছে করে। ফলাফল কাপ ফ্লোরে পড়ে ভেঙে গেলো।

কাপ ভাঙার শব্দে রেবেকা রুম থেকে দৌড়ে এলো।এসে দেখে তার নতুন ডিনার সেটের সাথের কাপ সেটের একটা কাপ ভেঙে পড়ে আছে নিচে।
রাগ রেবেকার কান লাল হয়ে গেলো।চিৎকার করে বললো,”কালকে আসতে না আসতে আজকেই আমার ঘরের জিনিস ভাঙতে শুরু করেছো?
দেখে শুনে কি অলক্ষ্মী ঘরে আনছি আমি।আমার এতো সুন্দর সেটের কাপ ভেঙে ফেলেছে।বাপের বাড়িতে কি কাম-কাজ কিছু করো নাই না-কি পাড়ায় পাড়ায় টইটই করে ঘুরছো গায়ে বাতাস লাগিয়ে? ”

ভয়ে লজ্জায় পূরবী মাথা নিচু করে রইলো।তানভীর বাবার রুমে বসে সব শুনলো।মায়ের কথা শেষ হলে কিচেনে আসলো।এসে দেখে পূরবী এক কোণে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হাত পা থরথর করে কাঁপছে।তানভীর এগিয়ে গিয়ে পূরবীকে কাছে টেনে নিলো।
তানভীরকে দেখে পূরবী স্বস্তি পেলো কিছুটা। অভিমানে,লজ্জায় কেঁদে দিলো সবার সামনেই তানভীরের বুকের উপর মাথা রেখে।

তানভীর পূরবীর চুলে বিলি কেটে দিয়ে বললো,”ভয়ের কিছু নেই পূরবী। আমি আছি তো তোমার পাশে।সামান্য একটা কাপ-ই তো ভেঙেছে।এ আর এমন কি ব্যাপার। আমি এনে দিবো এক সেট।ভাঙা কাঁচে যে তোমার হাত পা কাটা যায় নি এই তো আমার জন্য ঢের।
যাও তুমি রুমে যাও।”

পূরবী চলে যেতেই তানভীর জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে এখানে,কেউ দেখেছেন?”

নতুন বউ দেখতে আসা একটা ৯-১০ বছরের মেয়ে বললো,”কাকা আমি দেখেছি।নতুন কাকী মেজো কাকীকে কাপ দিচ্ছিলো। কিন্তু মেজো কাকী ইচ্ছে করেই কাপ ধরেন নি,তাই পড়ে ভেঙে গেছে। ”

মিম ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। তানভীর মিম কে কিছু বললো না। মা’কে বললো,”মা,পূরবীর বয়স কতোই আর বলো?
১৫-১৬ বছর। এই বয়সে তো তুমি আপাকে নিজের হাতে ধরে ভাত খাইয়েছো।আপার জামা কাপড় নিজে ধুয়ে দিয়েছ।আপার শ্বশুর বাড়িতে কাজ করতে হবে বলে আপাকে ওই বাড়িতেও যেতে দাও না।

পূরবী ও তো কারো এরকম আদরের মেয়ে ছিলো।ওর মা বেঁচে থাকলে হয়তো এতো অল্প বয়সে ওকে বিয়ে দিতো না।ওর তো এখনো মায়ের কোলে খেলার বয়স।ভাগ্যের ফেরে ও এখন এই বাড়ির বউ।এই বয়সী মেয়েরা কাঁদা মাটির মতো মা।যেমন খুশি তেমন আকৃতিতে এদের গড়ে নেওয়া যায়।
তুমি ওকে ভালোবেসে যদি আপন করে নাও,ও সেই ভালোবাসা তোমাকে দশগুণ ফেরত দিবে।তুমি ওর জন্য এক হাঁটু জলে নামলে ও তোমার জন্য এক বুক জলে নামবে।আরো ওর মা নেই।তোমাকে ও মায়ের আসনে বসাবে।শুধু যদি একটু ভালোবাসা দাও তুমি।একটা কাপ ভেঙেছে বলে এতো কথা বললে তুমি ওকে।আমি চাইলে ওর সামনে বলতে পারতাম যে এই ঘরের সব জিনিসপত্র তুমি আমার টাকায় গড়েছ।তাই আমার বউ সব ভেঙে ফেললেও কারো কোনো কথা বলার অধিকার নাই।

কিন্তু আমি বলি নি।তোমাকে ছোট করা হবে তাহলে। আজ আমি বললে পরেরবার পূরবী বলবে।আমি চাই না পূরবী তোমার সাথে বেয়াদবি করার সুযোগ পাক।

আমি জানি আমার বউ তোমার পছন্দের না।তাই বলে আজকেই ওকে এভাবে অপমান না করলেও পারতে।এক জীবনে মানুষ কতো অপ্রিয় কাজই তো করে,অপ্রিয় কে প্রিয় করে নেয়।
প্রিয় না কর,অন্তুত পূরবীকে এভাবে অপমান করে কথা বলো না।পূরবী হয়তো তোমাদের ভয়ে সব সহ্য করে যাবে কিন্তু আমি?
আমাকে তুমি ভলো করে জানো মা।
এরপর থেকে পূরবীর কোনো ভুল হলে আমাকে বলবে।কেউ আর কোনোদিন পূরবীকে একটা কথাও বলবে না।

বিনাদোষে পূরবীকে কেউ অপমান অপদস্ত করলে,হেয় করলে,আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না।কে ভাই, কে বোন,কে ভাবী আমি কিছুই মাথায় রাখবো না।”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে