কোথাও কেউ ভালো নেই পর্ব -০২

0
1176

#কোথাও কেউ ভালো নেই
জাহান আরা
পর্ব -০২

সারাপথ রেবেকা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে গেলো।তমিজ মিয়া মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন তানভীরের বউ এই মেয়েটাকেই বানাবেন।তাতে যতো বাঁধাই আসুক।

বাড়ি গিয়ে বোরকা না খুলতেই রেবেকা বোম ফাটালো। রেবেকার চিৎকারে তার মেয়ে তারিন এবং বড় দুই বউ আনিকা ও মিম ছুটে এলো বসার ঘরে।
রেবেকা সোজাসাপটা বললো,”এরকম মা মরা কোনো মাইয়া আমি আমার তানভীরের বউ করমু না।আমার হিরের টুকরো ছেলে।ভালো টাকা কামাই করে,ওর লাইগ্যা কতো ভালো,উচ্চবংশীয় মেয়ে পাওয়া যাইবো।
আমার ছেলের চেহারা ও তো রাজপুত্রের মতো। ”

তারিন বললো,”কি হইছে মা?”
রেবেকা নাকের জল,চোখের জল একসাথ করে বললো,”তোর বাপে একটা এতিম মাইয়া ঠিক করছে তানভীরের লাইগ্যা।এই বাড়িতে আমার পোলার কি কোনো সমাদর হইবো তুই ক তারিন?”

তারিন বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,”আব্বা,এগুলা কি কয় মা?”

তমিজ মিয়া সোজা বললেন,”তারেক,তুহিনের বউ তোর মা পছন্দ কইরা আনছে।আমার মতামত নেওনের দরকার ও মনে করে নাই।আমার ছোট পোলা তৌসিফ,ওর বিয়াও তোর মা ঠিক কইরা রাখছে নিজের ভাইয়ের মেয়ের লগে।আমারে জিগায় ও নাই।

তোর বিয়াও তোর মা নিজে দিছে,আমার কোনো মতামত আছিলো না।আমার এই পোলার বউ আমি পছন্দ করছি তাই।তোগো যদি এতো আপত্তি থাকে তোরা কেউ যাইস না বিয়াতে,আমি তানভীররে নিয়া গিয়া বউ নিয়া আসমু।

কাল তোরা তৈয়ার হইয়া থাকিস,মেয়ে দেখতে যাবি।”

তমিজ মিয়ার কথার উপরে আর কোনো কথা বলার সাহস পেলো না রেবেকা।তমিজ মিয়ার একটা কথাও মিথ্যা না।তাই নিজের পরাজয় মেনে নিলেন তিনি।

————–

সালমা বাড়ির আশেপাশের বাড়ির কয়েকজন মহিলাকে ডেকে আনলেন সকালে।সবাই মিলে পিঠা বানালো,কেউ পায়েস রান্না করলো।
মুরুব্বি দুজন বসে সুপুরি কাটতে লাগলেন।সুরভী প্লেটে আপেল,কমলা,আঙুর সাজিয়ে নিয়ে চা বানাতে গেলো।

সালমা চায় তাড়াতাড়ি পূরবীকে বিদায় করতে,দুই বোনকে বিদায় করে দিয়ে সালমা শান্তিতে থাকতে চায়।
পূরবী বসে আছে জানালার পাশে। দুচোখ বেয়ে নিরবে জল গড়িয়ে পড়ছে। বৈশাখের এই তপ্ত সকালে মা থাকলে হয়তো আজ এরকম হতো না।
পূরবীর মা সবসময় বলতো মেয়েকে তিনি অনেকদূর পড়াবেন,মেয়ের পড়ার লাইন ভালো বলে ভীষণ গর্ব করতেন।পূরবীর ও ভীষণ ইচ্ছে ছিলো পড়ার।দুচোখে নানা স্বপ্ন নিয়ে পূরবী ঘুমুতে যেতো রাতে।
একদিন ডাক্তার হবে,এই স্বপ্ন পূরবীকে কেমন আচ্ছন্ন করে রাখতো।

আজ সব স্বপ্ন কবর দিয়ে পূরবীকে বিয়ে করে নিতে হবে।

সালমা আলমারি থেকে নিজের একটা জাম কালারের টাঙ্গাইল শাড়ি বের করে দিলো পূরবীকে পরার জন্য।
পূরবী কিছুক্ষণ শাড়িটি জড়িয়ে ধরে বসে রইলো।এই শাড়ি তার মায়ের।
পাশের বাড়ির দুজন ভাবী এসে পূরবীকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন।

সুরভী আজ খুব খুশি।আজকে বাসায় অনেক রকম রান্না হচ্ছে,অনেক নাশতা। সুরভী ইতোমধ্যে দুই টুকরো আপেল মুখে পুরেছে,১ কোয়া কমলা মুখে পুরেছে। সুরভীর ধারণা মা তা দেখেছে কিন্তু কিছু বলে নি তবুও।
এতেই সুরভী ভীষণ খুশি।

মেহমান এলো সকাল ১০ টার দিকে। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আনিকা আর মিম একে অপরকে ইশারা করলো।তাদের দুজনের বাবার বাড়িতে বিল্ডিং অথচ এই মেয়েদের ঘর টিনের।দেখেই বুঝা যাচ্ছে এরা তেমন মান্যগণ্য লোক না।আনিকা মিমকে বললো,”বাড়ির নমুনা দেখেছিস মিম?
মেয়েও নিশ্চয় এরকম চেহারার হবে।”

মিম হেসে বললো,”আমাদের রূপের ধারেকাছে যেতে পারবে না ভাবী।”

তারিন ভীষণ বিরক্ত হলো বাবার এরকম কাজে।কিন্তু প্রকাশ করলো না তা।সবাই মিলে ভিতরে ঢুকে সালাম দিয়ে একে অপরের কুশল বিনিময় করলো।

সালমা এগিয়ে এসে সবার সাথে পরিচিত হলো।তারপর সুরভীকে ডাকলো শরবত নিয়ে আসার জন্য।
সুরভী শরবত দিতে এসে অবাক হয়ে তাকালো সবার দিকে।কি সুন্দর শাড়ি,সাজগোজ করে এসেছে এরা।

সুরভীকে তমিজ মিয়া নাম জিজ্ঞেস করলেন,নাম বলেই সুরভী দৌড়ে পালালো।

পূরবীর চোখের জলে কাজল লেপ্টে গেছে,মুখের পাউডার ভেসে উঠেছে।
বসার ঘর থেকে সালমার ডাক পেয়ে পূরবী উঠে দাঁড়ালো। তারপর জগে থাকা পানি দিয়ে ভালো করে মুখ ধুয়ে নাশতার ট্রে হাতে নিয়ে বসার ঘরে গেলো।
সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিতেই সবাই তাকালো পূরবীর দিকে।

নিজেদের রূপ নিয়ে অহংকার করা আনিকা ও মিমের সেই অহংকার যেনো গুড়িয়ে দিলো দাঁড়িয়ে থাকা জাম কালারের শাড়ি পরা মেয়েটি।

পূরবীকে দেখে মিমের মনে হলো,” চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর।”

পূরবীর টানা টানা দুই চোখ,দীর্ঘ আঁখি পল্লব যথেষ্ট কাউকে মায়ায় জড়ানোর জন্য।দুধে আলতা গায়ের রঙ পেয়েছে দুই বোন মায়ের থেকে।আনিকার মনে হলো এ যেনো গ্রীক উপকথার দেবী।
হয়তো পূর্ব জন্মে এই মেয়েই ট্রয়ের সেই হেলেন ছিলো।চেহারায় স্নিগ্ধ কোমল একটা আভা রয়েছে।
এক অজানা হিংসে পেয়ে বসলো আনিকা আর মিম কে।

তারিন পূরবীর কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।

তমিজ মিয়া তারিন কে বললো ফোন থেকে তানভীরের ছবি দেখাতে। তারিন ছবি বের করে সালমার হাতে দিলো।সালমা ছেলের ছবি দেখে মুগ্ধ হলো।
তারপর সুরভীকে ডেকে দিলো দেখতে,সুরভী ফোন নিয়ে ভিতরে চলে গেলো সবাইকে দেখাতে।
ভিতরে সবার হাসাহাসির আওয়াজ পূরবীকে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে যেনো।কেনো কেউ বলছে না পাত্র আমাদের পছন্দ হয় নি।নয়তো পাত্রপক্ষ বলুক,পাত্রী তাদের পছন্দ হয় নি।

তমিজ মিয়া পূরবীকে নিজের পাশে বসালো।তারপর মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,”আমার আম্মাজানের নাম কি?”

এতো মায়া নিয়ে মা মারা যাবার পর কেউ পূরবীকে ডাকে নি।বাবা ও না।কান্নায় পূরবীর গলা বুঁজে এলো।অচেনা অজানা এই লোকটির জন্য পূরবীর মনে জন্ম নিলো এক সাগর ভালোবাসা।

নিচু স্বরে পূরবী বললো,”পূরবী আহমেদ”

তারিন জিজ্ঞেস করলো,”কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?”

পূরবী বললো,”এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি।”

তারিন আবারও জিজ্ঞেস করলো,”রেজাল্ট কবে দিবে?”

পূরবী বললো,”দশ দিন পরে।মে মাসের ৩০ তারিখে। ”

মিম হেসে জিজ্ঞেস করলো,”সুরা ইয়াসিন জানো?
শোনাও তো আমাদের।”

পূরবী অপ্রস্তুত হলো।সূরা ইয়াসিনের ১৫ আয়াতের মতো সে মুখস্থ জানে,কিন্তু হঠাৎ করেই ভুলে গেছে।অতিরিক্ত নার্ভাসনেসের জন্য পূরবীর গলা শুকিয়ে গেলো।

তমিজ মিয়া বুঝতে পেরে মিমকে ধমক দিয়ে বললেন,”এতো বেশি প্রশ্ন করতে কেউ বলছে তোমাদের?
নিজেদের কি মহাজ্ঞানী ভাবো না-কি তোমরা?
কেউ কোনো প্রশ্ন করবা না।আমরা এখানে চাকরির ইন্টারভিউ নিতে আসি নি যে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ”

অপমানে মিমের মুখ কালো হয়ে গেলো। এরকম লজ্জা দিবে শ্বশুর তা সে ভাবে নি।রেবেকা বেগম ও তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।
পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা রিং ও একটা খাম বের করে তমিজ মিয়া পূরবীর হাতে দিলো।রিং পরিয়ে দিয়ে বললো,”যাও আম্মা,ভিতরে যাও তুমি এবার।”

কাঁপাকাঁপা পায়ে পূরবী ভিতরে এলো।এসেই পূরবী টাকার খাম লুকিয়ে ফেললো।পূরবী এখনো জানে না কতো টাকা আছে।কিন্তু পূরবী ভেবে রেখেছে আগে সুরভীকে একটা স্কুল ড্রেস বানিয়ে দিবে।

সবাই পূরবীকে চেপে ধরলো কি দিয়েছে তা দেখার জন্য। হাত বাড়িয়ে পূরবী নিজের হাতের রিং দেখালো।

সুরভী বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো,”তোর বিয়ে হয়ে গেলে দারুণ মজা হবে বুবু।আমি বেড়াতে যেতে পারবো। ”

পূরবী বোনকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বললো,”বিয়ে হয়ে গেলে বুঝবি রে বোন কি কষ্ট হবে তোর তখন।”

সুরভী গিয়ে ফোন দিয়ে আসলো তারিনের। তারিন ভাইকে পূরবীর ছবি পাঠালো।

ছবি দেখে তানভীর মেসেজ দিয়ে বললো,”এই ইন্দ্রাণীকে কোথায় পেলি আপা?
আমার তো বুকের ভেতর প্রেমের ঘন্টা বেজে গেছে রে একে দেখে।”
নগদ চার লক্ষ টাকা দেনমোহর দিয়ে,মে মাসের ৩০ তারিখে পূরবীর বিয়ের তারিখ ঠিক হলো।

চলবে……?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে