কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-০৯

0
1049

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:০৯
জাহান আরা

সকালে ঘুম ভাঙলো দেরীতেই।রাতে সারা রুমে পায়চারী করতে করতে ক্লান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও টের পাই নি।
ঘুম থেকে উঠার পর শরীর কেমন ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছিলো।ঘড়িতে দেখি সাড়ে দশটা বাজে।
বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে এখনো।রাতে রুমে পায়চারী করার সময় ও শুনতে পেয়েছি বাহিরে বৃষ্টির শব্দ।
উঠে গিয়ে ব্রাশ করে গোসল করে নিলাম।সকাল বেলায় গোসল করার অভ্যাস হয়ে গেছে আমার।সকালে গোসল করে রুম থেকে না বের হলে নিজেকে কেমন অশুচি মনে হয়।মনে হয় যেটাতেই হাত দিচ্ছি সেটাই নোংরা হয়ে যাচ্ছে।

আমার যে কিছুটা শুচিবায়ুর মতো আছে তা আমি নিজেও কিছুটা অনুভব করি।কিন্তু চেঞ্জ করার চিন্তা করি না যদিও।কি দরকার চেঞ্জ করার!
গোসল করে রুমে আসার পর টের পেলাম আমার প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে।
মনে হচ্ছে যেনো আমি একাই দশ জনের খাবার খেয়ে ফেলতে পারবো।
নিজের এই অবস্থা দেখে নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়লাম।
জানালার কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে।বাহিরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে।জানালার কাঁচ খুলে দিতেই বৃষ্টির ছিটা এসে আমাকে একদফা ভিজিয়ে দিলো।বরফের মতো ঠাণ্ডা বৃষ্টির পানি।
ইচ্ছে করছে আমার বৃষ্টিতে ভিজি কিছুক্ষণ,তাতে হয়তো ভিতরের জ্বালা কিছুটা কমবে।
কিন্তু ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিলাম না।আমি জানি এই জ্বালা যতোক্ষন থাকবে ততক্ষণ আমার মাথায় প্রতিশোধ নেবার একটা জেদ থাকবে।ভিতরের আগুন নিভে গেলে আমার জেদ ও নিস্তেজ হয়ে যাবে।
আমি তা কিছুতেই হতে দিবো না।

জানালার শিক গলিয়ে হাত বের করলাম।বৃষ্টির পানি হাতে এসে পড়ছে।গুনগুন করে গেয়ে উঠলাম হুমায়ুন আহমেদ স্যারের সেই বিখ্যাত গানটি ,
“যদি মন কাঁদে-
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…
এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমল শ্যামল ছায় ।

যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরি
কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি ।
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আরো
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…

নামিবে আঁধার বেলা ফুরাবার ক্ষণে
মেঘ মাল্লা বৃষ্টিরও মনে মনে ।
কদম গুচ্ছ খোঁপায়ে জড়ায়ে দিয়ে
জল ভরা মাঠে নাচিব তোমায় নিয়ে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…

গাইতে গাইতেই কেমন আনমনা হয়ে গেলাম।চোখের কোণ ভিজে গেলো।এই গান গেয়ে আমি কাকে আহবান করছি?
কে আসবে আমার কাছে,এই বৃষ্টিস্নাত দিনে?
অভ্র…..!
আমার অবচেতন মন কি এই গানের মধ্য দিয়ে অভ্রকে ডাকছে!
অভ্র কি আসবে আর কখনো?
আমার অভ্র ও তো আমাকে কথা দিয়েছিলো,এরকম বৃষ্টির দিনে আমাকে সাথে নিয়ে বৃষ্টি বিলাস করবে।আমি পরবো সাদা শাড়ী,নীল ব্লাউজ,অভ্র পরবে নীল পাঞ্জাবী।
সেদিন আমরা অনেক পথ হাটবো।হাটতে হাটতে কোনো এক টং দোকানে গিয়ে চা খাবো।
বৃষ্টির জল সেই চা’য়ে গিয়ে পড়বে,অভ্রর ভাষায় সেই চা হবে একেবারে পারফেক্ট চা।
কেননা সেই চা’টা আর ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করে খেতে হবে না।

কি অদ্ভুত,তখন কোনো বৃষ্টি হয় নি।অথচ বৃষ্টি শুরু হয়েছে গতকাল।এখন আর অভ্র নেই।

সবচেয়ে অদ্ভুত কথা হচ্ছে,আমার পরনে এখন সাদা শাড়ি ঠিকই আছে কিন্তু নীল পাঞ্জাবী পরার জন্য অভ্র নেই।
অভ্রর মৃত্যুর পর থেকে আমি আর রঙিন শাড়ি পরি নি।
কেনো পরবো?
কার জন্য পরবো?
কে দেখবে সেই সৌন্দর্য?
আমার তো স্বামী নেই।যার জীবনে স্বামী নেই,তার জীবনে আর রঙ চকচকানির কি দরকার।রঙ্গিন জীবন যদি কাটানোর ভাগ্য থাকতো তাহলে আল্লাহ স্বামীকে জীবিত রাখতো।
এ আমার এক নিরব আত্মাভিমান। নিজের উপর নিজের রাগ।এ জীবনের জন্য রঙিন কাপড় আমার জন্য নিষিদ্ধ করে দিলাম আমি নিজে।

বৃষ্টির জল হাতে নিয়ে মনে মনে বললাম,”অভ্র,তুমি ছাড়া এই বৃষ্টি বিলাস আমার কাছে অর্থহীন। ”

ভিতর থেকে কান্না আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বুঝতে পেরে জানালার গ্লাস বন্ধ করে দিলাম।এতোক্ষন ভাবনার জগতে থাকায় ভুলেই গেছিলাম আমার যে প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে।এই বৃষ্টিতে ভুনা খিচুড়ি,ইলিশ মাছ ভাজা,আর ডিম ভাজা খেতে ভীষণ ভালো লাগবে।

দুপুরে আবার ভাবীর বাবার বাড়িতে যেতে হবে।

রুম থেকে বের হয়ে গেলাম খিচুড়ি রান্না করার জন্য।
আমার ভাগ্য হলো না অভ্রকে বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি রেঁধে খাওয়াবার,অনন্ত অভ্রর বাবা মা কে তো খাওয়াতে পারবো।

রুমের দরজা খুলে বের হতেই আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম।ভুনা খিচুড়ির ঘ্রাণ ভেসে আসছে।কড়াইতে ইলিশ মাছ ভাজছে কেউ সেই ঘ্রাণ ও পাচ্ছি।
কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব!
আমি তো কাউকে কিছু বলি নি।

বের হয়ে ডাইনিং রুমে যেতেই দেখি আম্মা বড় একটা ডিশ থেকে প্লেটে খিচুড়ি সার্ভ করছে।আব্বা কিচেন নাইফ হাতে নিয়ে শসা কাটছে গোল গোল করে।
কিচেন থেকে ইলিশ ভাজার শব্দ ভেসে আসছে।
আমাদের বাসায় কোনো হেল্পিং হ্যান্ড নেই,ভাবীরা সবাই ভাইয়াদের চাকরী সূত্রে আরেক জায়গায় থাকে,বাসায় আমরা তিনজন মানুষ। কিন্তু কে ইলিশ ভাজছে কিছুই বুঝতে পারছি না।আম্মা কে জিজ্ঞেস করতেই আম্মা জবাব দিলেন,”আমার আরেকটা ছেলে আছে,সে এসব নিজ হাতে রেঁধেছে,কিচেনে গিয়ে দেখে আসো।”

আম্মার এই হেঁয়ালির কোনো মানে আছে?

আর কিছু জিজ্ঞেস না করে আমি কিচেনে চলে গেলাম।
নেহাল কে দেখে আমি থ হয়ে গেলাম।ও এখানে কেনো?
সে কথা জিজ্ঞেস করতেই নেহাল জবাব দিলো,”তুই ভুলে গেলেও আমার তো মনে আছে বন্ধু,বৃষ্টি হলেই যে তোর খিচুড়ি খাবার ক্রেভিংস হয়।তাই সকাল সকাল মাছ বাজার থেকে পদ্মার তাজা ইলিশ আর গরু মাংস নিয়ে চলে এলাম তোকে সারপ্রাইজ দিতে।”

কিছু না বলে আমি বের হয়ে এলাম কিচেন থেকে।নেহালের এরকম অতিরিক্ত কেয়ার আমার কাছে কেমন সন্দেহজনক লাগছে।নেহালের কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে এসবের পিছনে?
নাকি এসব শুধু মাত্রই বন্ধুত্বর জন্য করছে নেহাল?
এমন তো নয় ও এরকম আগে করে নি।ও আগেও এরকম ছিলো।কিন্তু তবু কেনো জানি আজকে আমার কাছে কেমন সন্দেহজনক লাগছে এসব কিছু।

৫ মিনিটের মাথায় নেহাল চলে এলো ইলিশ মাছ ভাজা নিয়ে,তারপর আবার গিয়ে নিয়ে এলো ডিম ভাজা।
আমি কিছু না বলে চুপচাপ খেতে বসলাম।খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম আমার শ্বশুর শাশুড়ির মুখে উপচে পড়া আনন্দ।কেমন হাসিখুশি দুজনেই আজকে।দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে দেখে তাদের আনন্দের সীমা নেই।অভ্রর মৃত্যুর পর এই দুজন মানুষকে আমি এরকম খুশী দেখি না আর।

নেহাল নিজে আব্বার প্লেটে মাছ,ডিম তুলে দিচ্ছে।বৃদ্ধ মানুষ টি আর খাবো না বলে অনুনয় করলেও নেহাল তা শুনছে না।জোর করে তুলে দিচ্ছে আব্বাকে।
আম্মার মুখ আনন্দে চিকচিক করছে।

তবুও কেনো জানি আমি খুশি হতে পারছি না।খাবারের প্রতি কিছুক্ষণ আগের সেই আগ্রহ আর পেলাম না।কোনোমতে কিছুটা খেয়ে উঠে চলে এলাম।

রুমে এসে বসে বসে ভাবছি অভ্রর কথা।তারপর উঠে গিয়ে আলমারি থেকে অভ্রর হাসপাতালের এপ্রোন টা বের করে নিলাম।এই এপ্রোনে এখনো অভ্রর গায়ের গন্ধ মিশে আছে।
মনে হলেই আমি এই এপ্রোন গায়ে দিই।তখন মনে হয় যেনো অভ্রকে জড়িয়ে ধরে আছি।

ভাবনার ব্যাঘাত ঘটাতে আমার ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভাবীর নামটা ভেসে উঠলো।

রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভাবী বলে উঠলো,”এই লতা,কখন আসবে তুমি?”

“ভাবী,বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি,এই বৃষ্টিতে বের হওয়া অসম্ভব। ”

“আমি তাহলে তোমার ভাইয়ার গাড়ি পাঠিয়ে দিই?”

বুঝতে পারলাম ভাবী জেদ করেছে আমাকে নিবেই।তাই বললাম,”লাগবে না,আমি সিএনজি নিয়ে আসছি।”

“আমার লক্ষ্মী ননদিনী। ”

ভাবীর আদরের কথাটা শুনে একটা তীর্যক হাসি এলো ঠোঁটের কোণে।
লক্ষ্মী!
তাও আমি!

এর চাইতে হাস্যকর আর কি হতে পারে?
এই পৃথিবীতে আমার মতো অলক্ষ্মী কয়জন আছে যার চোখের সামনে তার স্বামীকে খুন করে?
অথবা,যার স্বামীর সামনে দুর্বৃত্তরা তাকে…!

না এটা আমি কিছুতেই ভাবতে চাই না।কিছুতেই ভাববো না আমি।

দরজায় টোকা পড়তেই আমি বুঝতে পারলাম নেহাল এসেছে।কিছু না বলে আমার হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে বের হলাম।নেহাল কে অপ্রস্তুত করে দিয়ে আমি সোজা আব্বা আম্মার রুমে চলে গেলাম।আব্বা আম্মার থেকে অনুমতি নিয়ে বের হতে যাবো তখনই আব্বা ডাক দিলো।

আমি পিছনে ফিরতে আব্বা বললেন,”মা,নেহাল কে সাথে করে নিয়ে যাও।”

আমি কিছু বলে উঠার আগেই শাশুড়ি আম্মা বলে উঠলেন,”আমার অভ্রকে আমি দেখতে পাই এই ছেলেটার মাঝে,না করিস না মা।তোকে একা ছাড়তে ভীষণ ভয় করে।আমরা তো ঘরপোড়া গরু রে মা,তাই আমাদের ভীষণ ভয়,তোর সাথে কেউ থাকলে তবুও একটু ভরসা পাবো।”

আব্বা আম্মার ইচ্ছেকে মেনে নিয়ে নেহাল কে বললাম,”চল আমার সাথে।”

মুহুর্তেই নেহালের মুখ হাসিহাসি হয়ে গেলো আমার কথা শুনে।

চলবে…..???

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে