কেন আমি ডাকি তারে পর্ব-১৫+১৬

0
1756

কেন আমি ডাকি তারে -১৫

নিতু ঘুমাচ্ছিল। রেহান উঠে তৈরি হয়ে অফিসে বের হয়ে গেল। আজ আর অপরাধবোধ লাগছে না৷ দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়ে কাছাকাছি থাকলে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়, এটাই স্বাভাবিক। মনের দিক থেকে ভালোবাসা না থাকলেও হয়৷ আর রেহান তো নিতুকে অপছন্দ করে না। বরং বেশ পছন্দ করে। নিতুও মনে হয় তাকে অপছন্দ করে না৷

রেহান অফিসে চলে যাওয়ার পরে নিতু উঠল ঘুম থেকে৷ গতরাতের বিষয়টা স্পষ্ট মনে আছে। রেহান কাছে আসায় একটুও খারাপ লাগে নি, বিষন্নতা কেটেছে!

ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলো নিতু। বাসায় সবাই নিতুকে খুবই ভালোবাসে। নিতুর প্রতিমুহূর্তে মনে হয়, এরকম সম্পর্কটা যদি সত্যি হতো! কয়েকদিন পরে নিতু চলে যাবে, এটাই সত্য।
সবার সাথে যতই ভালো সম্পর্ক হোক, রেহান যতই সাপোর্ট করুক! ওর গার্লফ্রেন্ড অপেক্ষা করে আছে। রেহান এত কেয়ারিং একটা মানুষ, ওকে নিশ্চয়ই সায়রা হারাতে চাইবে না।

★★★

লাঞ্চের সময় সায়রা ফোন করল রেহানকে।
রেহান, আজ আসো, প্লিজ, একসাথে লাঞ্চ করি।

রেহান বলল, হঠাৎ?

এমনিই, তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।

রেহানের একদম ইচ্ছে করছিল না, তবুও বের হয়ে রেস্টুরেন্টে।

সায়রা অলরেডি টেবিল বুক করে সব অর্ডার করে দিয়েছে।

তোমাকে ফ্রেশ লাগছে রেহান, ভীষণ হ্যান্ডসাম!

তুমি একথা বলছ!

কেন, বলতে পারি না?

তোমার ইদানিং ব্যস্ততা বেড়েছে অনেকটাই।

হুম, একটা সুখবর দেই, আমার জব হয়েছে। বললাম না ট্রেইনিং, ওটাই।

হুম, কি জব? কী কোম্পানি?

সায়রা একটা কার্ড বের করে দিলো।

কি পোস্ট?

এক্সিকিউটিভ। আমার কাজ এম ডি এর সাথে।

দেখো সায়রা, এধরণের প্রাইভেট জবগুলোতে স্মার্ট মেয়ে নেওয়া হয় অনেক কারণ থাকে। অনেকটা শো অফ করার জন্য অথবা আরো অনেক কিছু৷ তোমার তো পড়া শেষ হয় নি। কি দরকার এগুলো করার!

রেহান, তোমার কাছ থেকে আমি এটা আশা করি নি। তুমি এত ছোটো মনের, আমি ভাবতেই পারি না। সবাই তোমার বউয়ের মত বউ সেজে বসে থাকতে পারে না।

রেহান বলল, আমার বউয়ের কথা আসল কেন এখানে?

বাবাহ, তুমি দেখছি খুব পসেসিভ! কি ব্যাপার! সেদিন আমাকে রেখে চলে গেলে, বউয়ের সাথে খুব জমছে, তাই না!

রেহান ওয়েটারকে ডেকে বলল, বিলটা দিয়ে দাও।

সায়রা বলল, আমি পে করব। তোমার দিতে হবে না।

রেহান উঠে বলল, দেন ওকে। আসছি।

সায়রা বলল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করে বসে আছি রেহান। আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা কোরো না।

রেহান বলল, এসব কথার মানে কি!

সায়রা বলল, কোনো মানে নেই!

রেহান চলে গেল। নিতু ফোন করে বলেছে, ও বাপের বাড়ি যাচ্ছে। সেই বিয়ের পরে একবার গিয়েছে, আর যাওয়া হয় নি। যাক। অসুবিধা নাই। ঘুরে আসুক।

কিন্তু অসুবিধা ছিল, রাতে বাসায় ফিরেই রেহান টের পেল।
একটু আগেই ফিরেছিল আজ৷ সমস্ত বাসা খা খা করছে,কোথাও যেন কোনো মানুষ নেই!
রুমটা পরিপাটি করে গোছানো, নিতু নেই। নিতুর কসমেটিকস গুলো ড্রেসিং টেবিলে রাখা। বারান্দায় কোনো জামাকাপড় নেই৷ আলমারির যে পাল্লায় নিতুর পোশাক থাকে, রেহান টেনে খুলে দেখল, সবই গোছানো আছে। অলিভ সফট টাওয়েলটা হাতে নিয়ে রেহান নাকের কাছে নিলো, নিতুর সুবাস নাকে এসে লাগল।
মন কেমন করা মায়া মায়া সুগন্ধ।

রেহান আর দেরী না করে রুম থেকে বের হলো, গাড়ি বের করতে হবে। নিতুকে নিয়ে আসতে হবে।

মা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছিস?

নিতুকে নিয়ে আসি।

আজই তো গেল।

হ্যা, আমরা বান্দরবান যাব, গোছানোর কাজ আছে।

তবুও, একদিন থাকুক। ওর বাবাও অসুস্থ। আর গেলে তুই জামাকাপড় নিয়ে যা, আজ থেকে কাল নিয়ে আয়।

রেহান মনে মনে ভাবল, জামাকাপড় নিয়ে থাকতে চলে যাবে, বিষয়টা কেমন যেন!

তাই কিছু না নিয়েই বের হয়ে গেল।

নিতুর ভাবী নিতুকে জিজ্ঞেস করল, কি খবর নিতু? রেহান কেমন আচরণ করে?

নিতু বলল, ভালো৷ খুবই ভালো মানুষ৷

ভাবী বলল, ভালো হতো যদি সব স্বাভাবিক হতো, আব্বা থাকতে আবার কত ভাঙাচোরা দেখবেন!

নিতু কথা বলল না।

রেহান আসবে আজ?

তেমন কিছু বলে নি।

কিন্তু নিতু একটা কাজ করেছে, রেহানের একসেট জামা কাপড় ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে আসতেও পারে।

ভাবী হাসতে হাসতে বলল, যদি সম্পর্ক তৈরি হতো, তাহলে চলে আসত, থাকতে পারবে না৷ প্রথম দিকে তোমার ভাই, মনে নেই!

নিতু হাসল, খুব মনে আছে। মনে মনে ভাবল, সম্পর্ক তো একটা হয়েছে, হয়তো ভালোবাসা না, প্রেম না৷ কিন্তু শারিরীক তো! সেটাও তো একটা টান। নিতু তো এড়াতে পারে নি! রেহান হয়তো এত গুরুত্বও দেয় না। ন্যাচারাল কারণে কাছে আসে।

ভাবী রাতের খাবার বাড়তে বাড়তে বলল, নিতু রেহানের জন্য খাবার রেখে দিই৷ যদি আসে।

নিতু কিছু বলল না, একবার ফোন ও করে নি আসবে না। কিন্তু ডিনারে বসার সাথে সাথেই কলিংবেল বেজে উড়ল।
নিতু আগ্রহ নিয়ে দরজায় তাকালো।

ভাবী নিতুকে বলল, যাও দরজা খুলে দাও।

নিতু বলল, ভাবী কি যে বলো না!

দেখো! ঠিক হয় কিনা!

নিতু দরজা খুলতেই রেহানকে দেখে মিষ্টি করে হাসল। রেহানের ক্লান্ত লাগছিল, নিতুর হাসিটা দেখে ক্লান্তি হাওয়ায় উবে গেল!

কি হচ্ছে এসব!!!

চলবে

কেন আমি ডাকি তারে -১৬

রেহানকে দেখে নিতুর ভাবী হাসল।
এসো, কেমন আছ?
রেহান বলল, ভালো আছি আপা, নিতুকে নিতে এলাম।

সে কী, মাত্র আজই এসেছে।

কেন, নিতু বলে নি, আমরা ট্যুরে যাচ্ছি। কাজ আছে তো!

সে যাও, যাবে। আজ থাকতে হবে, এখন এসো খেতে বসো।

রেহান খাওয়া শেষ করে বলল, আমি তো প্রিপারেশন নিয়ে আসিনি যে থাকব, সকালে অফিস আছে।

নিতু নিচুস্বরে বলল, আমি ম্যানেজ করছি।

নিতুর ভাইয়া বলল, কোনোভাবেই এখন যাওয়া চলবে না।

অগত্যা রেহান নিতুর ঘরে ঢুকল।

নিতু নিজের ব্যাগ থেকে রেহানের কাপড় বের করে দিলে রেহান মনে মনে ভাবল, মহারানী তাহলে ধারনা করেছে, আমি আসতে পারি!

কিন্তু মুখে কিছু বলল না, খুব স্বাভাবিক ভাবে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল।

নিতু, সকাল সকাল বের হতে হবে, বাসায় গিয়ে তৈরি হয়ে অফিস যাব।

নিতু বলল, দরকার নেই, অফিসের পোশাক আছে!

রেহান বলল, তুমি কি আন্ডারওয়্যারও নিয়ে এসেছ নাকি?

নিতু রেহানের দিকে তাকিয়ে বলল, লাগবে? বের করে দিব?

এতটুকু ব্যাগে সব তো আমার জামাকাপড়!

আমার জামাকাপড় তো এখানে আছে।

ওহ! তাই তো! এজন্য তোমাকে অপরিচিত লাগছিল।

নিতু গালে হাত দিয়ে হাসল। রেহান মনে মনে ভাবল, নিতু বুঝতে পারছে না, আমরা দুজনেই জড়িয়ে যাচ্ছি।

তোমার রুমটা সুন্দর।

হুম! – নিতু চোখ বন্ধ করে বলল।

রেহানের মনে হলো, নিতু একটু কাছে আসুক গতরাতের মত! কিন্তু নিতু আজ এগুলো না।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রেহান নিতুর হাতে হাত রাখল।

নিতু চোখ খুলল না।
আসলে ঘুমায় নি, চোখ খুললেই দৃষ্টি ফেরাতে পারবে না। একই ভুল বারবার করা যায় না। রেহানের স্পর্শে নিতু বুঝে ফেলেছে, রেহান কতটা চায়। কী চায়।

নিতু, এই নিতু!

নিতু চোখ মেলল।

ঘুম আসছে না। নতুন জায়গা তো।

মুভি দেখবেন?

না। ঘুমাতে হবে।

চোখ বন্ধ করে থাকুন, ঘুম হবে!

রেহান বুঝল, আজ আর ডাকাডাকি করে লাভ নেই!

তাই অন্য দিকে ফিরে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

নিতুও ঘুমিয়ে পড়ল অল্প সময়ে।

★★★

বান্দরবান যাওয়ার জন্য নিতু বেশ খুশি মনে গোছাতে শুরু করল। রেহানের দেওয়া শাড়িটা সাথে নিলো৷ রিসোর্টটা ভীষণ সুন্দর, ওখানে গেলে মন ভালো হবে।
নিতুর প্রিপারেশন দেখে রেহানেরও খুব ভালো লাগল। নিতুর সাথে স্পেশাল কিছু সময় কাটবে।
সায়রাকে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করল না রেহান।
নির্দিষ্ট দিন রাতে ওরা রওনা হয়ে গেল বান্দরবানের উদ্দ্যেশে।

বান্দরবান রিসোর্টে ঢুকে নিতুর মনটা ভালো হয়ে গেল। রেহানের দুই বন্ধুর ওয়াইফও আছে, সবার সাথে মোটামুটি আলাপ হয়েছে, তবে নিতু একটু হেজিটেট ফিল করছে। কারন এই সম্পর্কটা স্থায়ী নয়। সারা রাত জার্নি করে এসে রুমে ফ্রেশ হয়ে ওরা ব্রেকফাস্ট করতে বের হলো।
নিতু রেহানের কেনা স্কাই কালারের জামদানির সাথে রূপোর একটা গয়না পরেছে। রেহান চোখ ফেরাতে পারছে না, বার বার তাকাচ্ছিল নিতুর দিকে।

ব্রেকফাস্ট টাইম প্রায় শেষ, একটা কর্পোরেট অফিসের বেশ কিছু ইম্প্লোয়ি এসেছে, তিনটা কটেজ আর কনফারেন্স রুম ওদের।

ব্রেকফাস্টের জন্য রেস্তোরাঁয় ঢোকার সময় গেটে দেখা হয়ে গেল সায়রার সাথে। ওরা বের হচ্ছিল, আর রেহান নিতু ঢুকছিল।

-রেহান! তুমি!

বলে সায়রা নিতুর দিকে তাকালো।

বলো নি তো বউ নিয়ে বান্দরবান হানিমুনে এসেছ!

রেহান একটু অপ্রস্তুত হলো নিতুর সামনে।

সায়রার গ্রুপের দুজন সাথে দাঁড়িয়েছে। নিতুও বিব্রতবোধ করছে৷

নিতু, ও সায়রা।

নিতু একটু হাসার চেষ্টা করল। তারপর বলল, আপনারা কথা বলুন, আমি ভেতরে যাচ্ছি!

সায়রা বলল, ভেতরে একা যাবে কেন! হাজবেন্ড নিয়ে এসেছে, তার সাথে যান!

নিতু বলল, সায়রা আপনি হয়তো ভুল বুঝছেন, আপনারা কথা বলে বিষয়টা ফিক্স করে নিন, আমি অপেক্ষা করছি।

সায়রা হঠাৎ রেহানের কলার চেপে ধরল, এই ছিল তোমার মনে! আমাকে কেন ঝুলিয়ে রেখেছ তুমি! আমি কি ভুল করেছি! তোমাকে ভালোবেসে, বিশ্বাস করাটাই আমার ভুল! বউ নিয়ে হানিমুনে এসেছ! আবার আমাকে বলো, এক বছর পরে ডিভোর্স দিয়ে দিব!ট্রেইটর!

রেহান সায়রাকে সামলাতে বলল, সায়রা কন্ট্রোল ইউরসেলফ! এটা তোমার অফিস ট্যুর! সবাই দেখছে তোমাকে!

সায়রা আনরেস্ট হয়ে এবার নিতুকে এটাক করল। এই
মেয়ে, খুব শখ না! বড়লোক জামাই পেয়ে বয়ফ্রেন্ডকে ভুলে এখন হানিমুন করে বেড়াচ্ছ!
তোমাদের মত মেয়েদের না আমি ভালো করে চিনি! ভালো ফ্যামিলি সুন্দর চেহারা দেখিয়ে রেহানের মত ছেলেদের ঘাড়ে বসে পড়ো! তোমাদের জন্য আমরা ঠকে যাই! ইউ বিচ!

নিতু হতভম্ব, রিসোর্টে ঢুকতে বা ঢুকতেই এরকম ধাক্কা! নিতু হজম করতে পারছে না৷

তবু নিজেকে সামলে নিতু বলল, সায়রা, আপনার ভুল হচ্ছে কোথাও। আপনি শান্ত হয়ে কথা বলুন রেহানের সাথে!

সায়রা নিতুকে ধাক্কা দিলো!

সায়রা, হোয়াট ইজ হ্যাপেনিং! সায়রার কলিগরা ওকে সামলাতে এলো।

সায়রা চিৎকার করতে লাগল, এই ছেলেটা আমার বয়ফ্রেন্ড! আমাকে বলেছে মিথ্যমিথ্যে বিয়ে করছে, এক বছর পরে নাকি ডিভোর্স দিবে, আমাকে মিথ্যা বলে এখন বউকে নিয়ে ফুর্তি করতে এসেছে!

নিতু ধাক্কার টাল সামলাতে না পেরে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল। রেহান দৌড়ে গিয়ে নিতুকে ধরল।

নিতু, তুমি ঠিক আছ?

নিতু পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছে, হিলথেকে পা ফসকে মচকে গেছে মনে হয়!

ব্যাথায় নিতুর ফর্সা মুখ লাল৷ হয়ে গেছে, চোখ টলটলে হয়ে উঠল।

সায়রা বুঝল, ঘটনা ভালো ঘটেনি!

তবু নিজের ইগো ধরে রেখে রেহানকে বলল, বউয়ের প্রতি এত টান!

রেহান এবার নিজেকে ধরে রাখতে পারল না।

সায়রা, গেট লস্ট! এরপর আমার কোনো আচরণের জন্য আমি দায়ী থাকব না!

সায়রা হন হন করে হেঁটে চলে গেল!

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে