কুয়াশায় ঘেরা আঁধার পর্ব -০৫

0
942

#কুয়াশায় ঘেরা আঁধার
#লেখনীতে-জেনিফা চৌধুরী
#পর্ব-পাঁচ

“সরি আমরা বা’চ্চাটা’কে বাঁচাতে পারিনি” আর?

ডাক্তারের প্রথম কথাটুকু শুনে আর কিছু বলার আগেই নিহান কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো…..

—আর কি ডাঃ? থেমে গেলেন কেনো? প্লিজ বলুন নুহা। নুহা ঠিক আছে তো ডাঃ। প্লিজ এন্সার মি?

নিহান এক প্রকার চিৎকার করেই বললো। ডাক্তার নিহানের কাঁধে রেখে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো…..

—উনি আর কখনো মা হতে পারবে না মিস্টার খান।

ডাক্তারের কথা শুনে উপস্থিত সবার মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো। নিহান কথাটা শুনেই কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে পড়ে যেতে নিলেই আবরার ধরে ফেললো। নুহার মা কান্নায় ভেঙে পড়লো। নিহান ভাষাহীন হয়ে অশ্রু ভরা চোখে ঘুমন্ত নুহার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়ে টা যখন শুনবে ওর বাচ্চাটা আর নেই তখন ওর অবস্থা কি হবে? একটা মেয়ের মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, এটা শুনে মেয়েটার অবস্থা কি হবে? ভাবতেই নিহান হাঁটু ভেঙে পড়লো মেঝেতে। আবরারের চোখের কোনেও পানি। নিহান বুঝতে পারছেনা এই মুহূর্তে ওর কি করা উচিত। ডাক্তার ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। নুহার মা মুখে আঁচল চা’পা দিয়ে কাঁদছে। নিহান এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে গেলো হসপিটালের থেকে আবরার পিছু পিছু যেতে গিয়েও থেমে গেলো। এই মুহূর্তে ওকে একটু একা থাকতে দেওয়া উচিত। আবরার নুহার বেডের পাশে বসে নুহার মাথায় হাত রাখতেই চোখের থেকে এক ফোটা পানি নুহার হাতে পড়লো।
____________________________________________
চোখের সামনে এক্সি’ডেন্টের দৃশ্য ভেসে উঠতেই নুহা হুট করে চোখ খুকে ফেললো। শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রতঙ্গ ব্যাথায় জ’র্জরিত হয়ে আছে। পেটের ভেতরে কেমন যেনো ব্যাথায় জড়িয়ে আছে। নুহা চারদিকে চোখ বুলাতেই নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলো। নুহাকে নড়তে দেখে আবরার আর আশা খানম দৌড়ে এলো নুহার কাছে। নুহার বাচ্চার কথা মনে উঠতেই নুহা শুকনো ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলো……

—মা আমার সন্তান। ও ঠিক আছে তো। আহঃ

জোরে কথা বলতেই নুহার মাথায় আচমকা ব্যাথা করে উঠলো। নুহা হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে আছে। ওর চারদিক ঘুরছে। নুহা চোখ মেলে তাকাতে পারছেনা। নুহার মা নুহাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। আবরার শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। নুহা বার বার জিজ্ঞেস করছে ওর বাচ্চার কথা। আবরার নিজেকে শক্ত করে জোর গলায় বললো……

—আমর কেউ তোর সন্তানকে বাঁচাতে পারিনি…..

কথাটা শুনতেই নুহা বি’স্ফোরিত চোখে আবরারের দিকে তাকালো। আবরার কথাটা বলেই চোখ নিচে নামিয়ে ফেললো। নাহ! নুহার দিকে তাকানোর শক্তি ওর নেই। নুহা এক দৃষ্টিতে আবরার আর ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নুহা চিৎকার করতে চেয়েও পারলো না। নুহার মা নুহাকে জড়িয়ে ধরতেই নুহা শান্ত হয়ে গেলো। নুহাকে নিশ্চুপ দেখে নুহার মা ডাকতেই দেখলো নুহা সে’ন্সলেস হয়ে গেছে। আবরার ডাক্তার কে গিয়ে ডেকে আনতেই ডাক্তার নুহাকে চেক-আপ করে বললো…..

–এত বড় একটা শক উনি নিতে পারেন নি তাই জ্ঞান হা’রিয়ে ফেলেছেন। তা ছাড়া উনার শরীর টাও ভীষন দূর্বল।

আবরার নুহার মাকে শান্ত করে নুহার কাছে রেখে বেরিয়ে গেলো।
____________________________________________
–মাই ডিয়ার শাশুড়ী আম্মু। এখন নুহা আর প্রেগন্যান্ট নয়। আই হোপ এখন ওদের ডির্ভোস করাতে আপনার কোনো সমস্যা হবে না।

নুহা প্রেগন্যান্ট নয় কথাটা শুনতেই সিনথিয়া বেগম বড় বড় চোখ করে তৃধার দিকে তাকাতেই তৃধা বাঁকা হাসলো। সিনথিয়া বেগম জোর গলায় জিজ্ঞেস করে উঠলো…..

—নুহা প্রেগন্যান্ট নয় মানে কি? নুহার প্রেগন্যান্সির রির্পোট আমার কাছে আছে। তাহলে তুমি কি করে এই কথাটা বললে তৃধা?

সিনথিয়া বেগমের কথা শুনে তৃধা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো….

—সেটা না হয় আপনি আপনার ছেলের কাছের থেকে জেনে নিবেন। আমার ওইসব থার্ড ক্লাস মেয়ের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই।

বলেই সিনথিয়া বেগমের রুমের থেকে বেড়িয়ে গেলো। সিনথিয়া বেগমের বুকটা কেঁপে উঠলো অজানা ভয়ে। মুহূর্তেই নানা রকম চিন্তা মাথায় আসতে লাগলো। সিনথিয়া বেগম দ্রুত গতিতে ছেলের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
____________________________________________
নিহান রুমের দরজা আটকে বসে পা’গ’লের মতো কাঁদছে। যাদের বাঁচানোর জন্য এইসব করলো আজ তাকেই হারাতে হতো। নিহানের বার বার মনে হচ্ছে নুহা এই শকটা মেনে নিবে কি করে? সিনথিয়া বেগম দরজার বাইরের থেকে ডাকতেই নিহান দরজাটা খুলেই সিনথিয়া বেগম কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঝাপটে ধরে মেয়েদের মতো করে কান্না করতে করতে বলতে লাগলো…..

—মা আমি আমার সন্তান কে বাঁচাতে পারিনি। কেড়ে নিয়েছে। উপর ওয়ালা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে মা। শুধু আমার সন্তান না, আমাকে সারাজীবনের জন্য বাবা ডাক থেকে বঞ্চিত করে দিয়েছে। একটা মেয়ের মা হওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। আমি এত কিছু করেও আমার সন্তানকে ধরে রাখতে পারিনি।কি করে এই মুখ নিয়ে গিয়ে দাড়াব নুহার সামনে? কোন ভাষায় আমি স্বান্তনা দিব ওকে ?

নিহানের কথা গুলো শুনে সিনথিয়া বেগম অনুভূতি শূন্য হয়ে গেলো। উনার মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। নিহান ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সিনথিয়া বেগমের মস্তিষ্ক মুহূর্তেই নাড়া দিয়ে উঠলো। এই জঘন্য কাজটা কে করেছে? আজ ছেলেকে স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা উনার জানা নেই।
____________________________________________
একদিনের বেশি হয়ে গেছে নুহা হসপিটালে আছে। এই একদিনে নুহার একবার জ্ঞান ফিরেছিলো যখন সব সত্যিটা বলে দেওয়া হয়েছিলো তখনি ঠিক ৫ মিনিটের মাথায় আবারো জ্ঞা’ন হারায় নুহা। নুহা অবস্থার একটুও উন্নতি হয়নি এই একদিনে। নিহান অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছে নুহার কথা ভেবে। ঘড়ির কাটা ৩ টা বেজে ১৫ মিনিট। নুহার বেডের পাশে চেয়ার বসে নুহার চেপে ধরে বেডে মাথা রেখে সুয়ে আছে নিহান। ওর চোখে ঘুম নেই। নিহানের চোখ থেকে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে নুহার হাতে। নিহান নুহার হাতে ঠোঁট ছুয়ে বলতে লাগলো…..

—আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি পারিনি আমাদের সন্তানকে রক্ষা করতে। উপর ওয়ালা হয়তো কোনো ভালো বুঝেই আমাদের কেড়ে নিয়েছে আমাদের সন্তান কে। আমি জানি তুমি জেগে আমাকে দেখলেই রিয়েক্ট করবে। কিন্তু আজকে আর আমার পিছুটান নেই সব সত্যি বলে দিব তোমাকে? সবটা। তুমি প্লিজ সুস্থ হয়ে উঠো।

নিহান বিড় বিড় করে বলে উঠলো কথাগুলো। নিহান নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছিলো। তখনি ওর কানে বিড়বিড় শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। নিহান কান পেতে বোঝার চেষ্টা করলো নুহা ঠিক কি বলছে। নিহান কান পেতে দিতেই ওর কানে ভেসে আসলো…..

—“মা আমার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে পেলো না কেনো? ফিরিয়ে দাও আমার সন্তান কে । ও যে আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল ছিলো। ওকে কেড়ে নিও না প্লিজ। আমি ওকে ছাড়া বাঁ’চতে পা’রব না”

নুহা বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে ঘুমের মধ্যেই ফু্পিয়ে কাঁদতে লাগলো। নিহানের বুকের ভেতর টা ভেঙে চূড়ে যাচ্ছে। নিস্তব্দ রাতে নুহার ফু্ঁপানোর শব্দ ইটের তৈরি দেয়ালে গিয়ে বিধছে। নিহান ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। কতটা আঘাত পেলে একজন মানুষ ঘুমের ঘোরে কান্না করতে পারে নিহানের জানা নেই। কিছুক্ষনের মধ্যেই নুহা আবারো ঘুমে তলিয়ে গেলো। ওকে শান্ত করার জন্য ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। নিহানের দম বন্ধ হয়ে আসচ্ছে। নাহ! নুহার এই কষ্ট মেনে নেওয়া সম্ভব না। পারবে না নিহান মেনে নিতে। কি করে স্বাভাবিক করবে নুহাকে? নিহানের চোখ ঝাপসা হয়ে আসচ্ছে। নিহান বার বার হাতের উল্টো পিশ দিয়ে চোখের পানি মুছে যাচ্ছে। তাও যেনো চোখের পানি বাধ মানছে না। হঠাৎ করেই নিহানের ফোন বেজে উঠতেই নিহান তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আবরার বললো…..

–নুহার এ’ক্সিডে’ন্টটা ইচ্ছাকৃত ভাবে করানো হয়েছে নিহান। আমি তোকে একটা ভিডিও পাঠাচ্ছি। তুই দেখে সবটা বুঝে যাবি।

নিহান আর কিছু বলার আগেই আবরার ফোন টা কেটে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় নিহানের ফোনে একটা ভিডিও আসতেই নিহান তাড়াতাড়ি ভিডিও টা ওপেন করলো। মনোযোগ দিয়ে কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও টা দেখলো নিহান। বার বার জুম করে ভিডিও টা দেখে নিহানের চোখ জোড়া লাল বর্ন ধারন করলো। নিহানের শরীর বিদ্যুৎ গতিতে কেঁপে উঠছে। ভিডিও টায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটা থেমে থাকা কার ইচ্ছাকৃত ভাবে নুহাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। আর কার টা কার সেটা নিহান খুব ভালো করে জানে। নিহান ফোন টাকে শক্ত করে চেপে ধরে দাতে দাত কড়মড় করতে করতে বলে উঠলো…….

—“তুই এতদিনের নিহানের অসহায় রুপ টা দেখেছিস। এইবার দেখবি নিহান ঠিক কতটা ভ’য়ংক’র। তোকে আমি কতটা ভ’য়ংক’র মৃ/ত্যু দিব তুই ভাবতেএ পারছিস না তৃধা”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে