কুড়িয়ে পাওয়া ডায়েরি পর্ব-০৪

0
1095

গল্পঃ কুড়িয়ে পাওয়া ডায়েরি
পর্বঃ০৪
নিঝুম (ছদ্মনাম)

আমি কোচিং সেন্টারের ক্লাসে এসেছি
আমার ফোনে অনেকগুলো কল আসছে,ফোন ভাইব্রেট মোডে থাকায় বেশ বুঝতে পারছি কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস থাকায় কলটা রিসিভ করলাম না।
কিন্তু এতো বার কল করছে যে শেষমেষ বিরক্ত হয়ে ফোনটা ধরলাম। ফোনটা ধরে যা শুনলাম তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে।
ফোনটা রিসিভ করার পর ওই প্রান্ত থেকে একটি পুরুষ কন্ঠে শুনতে পেলাম,

— আপনার মা ট্রাক চাপায় গুরুতর আহত হয়েছে। অনেক ব্লিডিং হয়েছে যার কারনে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। স্হানীয় সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে আপনি দয়া করে তাড়াতাড়ি আসুন।

আমি একমুহূর্ত দেরী না করে হাসপাতালে ছুটে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম ছোট মামা, ঝুমা আপু কাঁদছে আর ছোট মামি তাদের সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম আমার ছোট্ট প্রিয় ভাইটা আর দুনিয়ায় নেই। কথাটা শুনে আমার মনে হচ্ছে কেউ আমার বুকটা চিরে ভেতর থেকে কলিজাটা টেনে ছিড়ে ফেলছে।আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাদঁতে পারছি না। কীভাবে কি হয়ে গেলো এতটুকু সময়ের মধ্যে?আমি বিশ্বাসই করতে পারছি যে আমার কলিজার ভাইটা আর নেই। আমি ঝুমা আপুর দুই বাহু ধরে জিজ্ঞেস করলাম,

–তুমি মিথ্যা বলছো তাই না ঝুমা আপু?আমার ভাইটা বেঁচে আছে। ওর শিক্ষা সফর শেষে ঠিকই বাড়ি ফিরবে। এতোকিছু কিভাবে হলো, কখন হলো?সকালেই তো রাজুকে টাকা দিলাম ঘুরতে গিয়ে কিছু কেনার জন্য…..

ঝুমা আপু আমার কোনো কথার উত্তর দিল না।আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল।ছোট মামি কান্না আটকে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,

–“তুমি শান্ত হও নীলা।আগে আমার কথা শোনো…
শিক্ষা সফরে যাওয়ার সময় রাজুদের বাস খাদে গিয়ে পড়ে সেখানেই স্পট ডেড।তারপর সেই খবর পেয়ে তোমার পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছিলেন রাস্তার গাড়ি খেয়াল না করেই। আর একটা ট্রাক এসে আপাকে চাপা দেয়।তোমার বড় মামা আর মামাতো ভাই মাহবুব রাজুর লাশ আনতে গেছে। ”

আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বললাম,

–“মামি,,রাজুর মৃত্যুর জন্য, মায়ের এই অবস্থার জন্য দায়ী একমাত্র আমি। মা ওকে ঘুরতে যেতে নিষেধ করেছিল। ওর মন খারাপ হবে বলে আমি টাকা দিয়ে ঘুরতে যেতে দিয়ে ওকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি। আজ যদি না যেত তাহলে ও এখন বেঁচে থাকতো আর মায়েরও কিছু হতো না।”

–“এখন যা হওয়ার হয়েছে মা…
এখানে কারো হাত নেই,সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তোমার এখন শক্ত হতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না।”
.
.
.
মায়ের অবস্থার উন্নতি নেই।বড় মামা আর মাহবুব রাজু’র লাশ নিয়ে এলো।রাজুর বিকৃত লাশ দেখে আমি আতকে উঠলাম। সবকিছু সম্পন্ন করে দাফন করা হলো।কিন্তু আমি যেন ঘরের ভেতর ওর আওয়াজই শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে ও হাঁটছে,আবার আমার সাথে ঝগড়ার কারন খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি ওর জামাকাপড় নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না ওকে যে জীবনে আর কখনো দেখব না।

…..

দিন যতো যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছি জীবনটা যে কতো কঠিন! আমাদের মতো ফ্যামিলির মেয়েদের জীবনে হয়ত সুখ নামক কথাটি লিখা নেই।রাজুুর মৃত্যুর ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে মায়ের মৃত্যু হলো। টানা পনেরো দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে করতে মা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেদিন তাদের সাথে আমারও মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। পরিবার হারিয়ে আমার মনের যে কি অবস্থা হয়েছিল বলে বোঝানো সম্ভব নয়। হারানোর বেদনা সেই বোঝে যার হারায়। প্রতিটা দিন আমার কাঁদতে কাঁদতে পার হতো। বাড়িটা ছেড়ে দিলাম।মামা তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল আমিই যাই নি।
স্টুডেন্টের বাবা-মা মানে আলভি ভাইয়া আর ভাবীর সহযোগিতায় আমি মেয়েদের হোস্টেলে গিয়ে উঠলাম। পরিবার হারিয়ে আমি হয়ে গেলাম একা..
সম্পূর্ণ একা…..

পরিবারের শোক কাটিয়ে পড়াশোনা করতে পারি নি। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় আমি চান্স পেলাম না। আরো ভেঙে পড়লাম। এবার নিজেকে
শক্ত করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলাম।একমাস কঠিন পরিশ্রম করলাম।
অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেলাম। আনন্দে মনটা ভরে গেল রেজাল্টটা দেখে।
কিন্তু আমার আনন্দ, আমার খুশি ভাগ করার মত কেউই নেই। মা থাকলে ভীষন খুশি হতেন।আমার রেজাল্টে মামা-মামি,আলভি ভাইয়া, ভাবী সবাই খুশি হলেন।
ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পর থেকেই ভালো করে পড়াশোনা শুরু করে দিলাম।আমাকে যে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতেই হবে। যাতে কেউ আমাকে আর ধর্ষিতা মেয়ে বলতে না পারে।আমার দুচোখে হাজারো স্বপ্ন। আমার ইচ্ছে আমার নিজের একটা সংস্থা থাকবে যেখানে এতিম, অসহায় মেয়েগুলোকে লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের পায়ে দাড়া করানো।
.
.
.
ভার্সিটির লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করতে গিয়ে একটা ছেলেকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। ছেলেটা আমার সিনিয়র তবে কোন ইয়ারে পড়ে তা জানি না।ছেলেটার নামটাও জানি না। লাইব্রেরীতে প্রতিদিন এসে পড়াশোনা করে।আমি প্রায়ই তার দিকে তাকিয়ে থাকি। ছেলেটা উজ্জ্বল শ্যামবর্নের, হাসি দিলে একগালে টোল পড়ে যা দেখে আমি প্রথম দিনেই পুরো ফিদা হয়ে গেছি।
আজকেও বইয়ের ফাঁকে একটু তার দিকে তাকালাম। সেও আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল।চোখে চোখ পড়ায় আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। লজ্জায় আমি তাড়াতাড়ি সেখান থেকে উঠে চলে আসলাম। তারপর হোস্টেলের রুমে এসে ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম……

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে