কলা পাতায় বাঁধিব ঘর পর্ব-১০+১১

0
787

#কলা পাতায় বাঁধিব ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১০+১১

ভড়কে গেলো রাউফুন। বিষ্ময়ভাব না কাটাতেই আচমকা আক্রমণে তাল সামলাতে পারলোনা।
পুষ্প কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দৌঁড়ে এসে রাউফুনকে জড়িয়ে ধরলো। ধাক্কা সামলাতে না পেরে রাউফুন খাটে পড়ে ভর্তা হয়ে গেলো। পুষ্প ছাড়লোনা। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“ডাক্তার প্লিজ আর রাগ করে থাকবেননা।”

রাউফুন জোরে শ্বাস নিয়ে বলল,
-“আগে ছাড়ো।”

পুষ্প ছাড়লোনা, বরং হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে বলল,
-“না ছাড়বোনা। আগে বলুন আপনি রাগ করে নেই।”

রাউফুন মজার ছলে বলল,
-“কি সাংঘাতিক! কি সাংঘাতিক পুষ্প। শশুর আব্বাকে কিভাবে বলি তার মেয়ে আমাকে ছাড়া বাঁচবেনা।”

পুষ্প মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
-“আপনাকে এত কথা তো বলতে বলিনি। আপনি আগে বলুন আমার উপর রাগ করে নেই।”

রাউফুন বলল,
-“আগে তো আমাকে ছাড়ো। ঘামে ভিজে আছে শরীর। আর বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে দুর্গন্ধ ছড়াবে। ফ্রেশ হতে দাও আগে।”

পুষ্প সরে বসলো। রাউফুন বড় বড় শ্বাস নেওয়ার ভঙ্গিতে উপরে দুহাত তুলে বলল,
-“আজ বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছি। আল্লাহ রক্ষা করেছেন। এক্ষুণি বুকে পাথর চাপা পড়ে মা’রা যেতাম।”

পুষ্পর তীক্ষ্ণ চাহনি নজরে পড়তেই রাউফুন ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। খাটের উপর বসে পা দোলাতে দোলাতে রাউফুনের অপেক্ষা করলো পুষ্প। এই ঘরটা দেখার মতো আর কিছুই নেই। আজ বিকেল থেকেই ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা শেষ।
একেবারে গোসল নিয়েই বের হলো রাউফুন। চুলে তোয়ালে চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি ব্যাপার বলোতো? তুমি একেবারে শশুর বাড়ি। কাহিনি কী?”

পুষ্প ভাব নিয়ে বলল,
-“আমার শশুর বাড়ি আমি কখন আসবো, কখন আসবোনা সেটা জানার আপনি কে?”

রাউফুন কিছু বুঝে ফেলার ভঙ্গিতে ঈষৎ চোখ বড় করে বলল,
-“ওওওওহ্, আমি তো ভুলেই গিয়েছি। এটা আপনার শশুর বাড়ি। তবে কৃপা করে যদি এই অধমকে কাহিনীটি বুঝিয়ে বলতেন, তাহলে বড়ই উপকৃত হতাম।”

পুষ্প বলল,
-“আপনি উপকৃত হলে আমার কী লাভ?”

রাউফুন কিছু একটা ভেবে বলল,
-“এই ধরুন, আপনার উপর আর রাগ করে থাকলামনা।”

পুষ্প ফটাফট মুখ খুললো,
-“আজ আঙ্কেল, আন্টি, রিশা গিয়ে আমাকে নিয়ে এসেছে। পরে রিসিপশন অনুষ্ঠান করা যাবে। তবে আপনাকে জানানো বারণ ছিলো।”

রাউফুন কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
-“নিশ্চয়ই এই বুদ্ধি আপনার আর আপনার ননদিনীর।”

পুষ্প ঠোঁট টিপে হাসি থামানোর চেষ্টা করে অন্যদিকে ফিরে গেলো।
রাউফুন মিটিমিটি হেসে পুষ্পর গালে চুমু দিয়ে বসলো। পুষ্প দুহাতে মুখ ঢেকে বলল,
-“খেতে আসুন। আন্টি বলে দিয়েছে আপনি আসলে খাবার দিতে।”

রাউফুন মাথা দুলিয়ে পুষ্পর পিছুপিছু ডাইনিং এ গেলো। খাবার সব বেড়ে রাখাই আছে। রাউফুন হাত ধুয়ে বসে পড়লো। পাশের চেয়ার টে’নে পুষ্পকে ইশারা করলো বসে পড়তে।
পুষ্প আমতা আমতা করে বলল,
-“আপনি খেয়ে নিন। আমি ও এই তো বসছি।”

রাউফুন বলল,
-“দুটো প্লেটের দরকার নেই। পাশে বসো, আমি খাইয়ে দিচ্ছি। এটা শুধু গতকাল রাতে একটু কষ্ট দেওয়ার জন্য পুষিয়ে দিচ্ছি।”

পুষ্প একটি খাবারের প্লেট ঢেকে রাখলো। একই প্লেটে ভোজন শেষে দুজন ঘরে গেলো। রাউফুন একটু রোমান্টিক মুডে আছে। তখনই ঘরে প্রবেশ করলো নাবিল। খাটের মাঝখানে বসে বলল,
-“আপু, আমি তুমি আর দুলাভাইয়ার মাঝখানে ঘুমাবো।”

রাউফুন হতবিহ্বল চাহনি নিক্ষেপ করে বলল,
-“এ আবার কোথা থেকে উদয় হলো?”

-“ও আমার সাথেই এসেছে।”
পুষ্পের কথা শেষ হতে না হতেই নাবিল বলল,
-“বালিশ দাও, রিশা আপুর সাথে ঘুমাবোনা। সে আমাকে লজ্জা কথা বলে।”

রাউফুন বলল,
-“তুমি না বড় হয়ে রিশাকে বিয়ে করবে? একটু লজ্জা কথা বললে কিছু হবেনা।”

নাবিল যাবেনা বলে জেদ ধরে রইলো। রাউফুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল,
-“শালাবাবু আসার আর সময় পেলোনা। শেষমেষ আমার মুডের বারোটা বাজাতে তাকে এখনই আসতে হলো।”

রিশা রুমে ঢুকে বলল,
-“নাবিল জামাই আসো, আসো। এতো রাগ করলে তো হবেনা। চলো আপু আর দুলাভাইয়াকে ডিসটার্ব করা একদম উচিত নয়।”

নাবিল মুখ ঝামটা মে’রে পুষ্পর পেছনে লুকিয়ে বলল,
-“তোমার সাথে যাবোনা। তুমি আমাকে লজ্জা কথা বলো। আমি তোমাকে বিয়ে করবোনা।”

পুষ্প রিশাকে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
-“আচ্ছা, ও ঘুমাক আমাদের কাছে।”

রিশা ভাইয়ের অসহায় চেহারায় নজর দিলো। রাউফুন ইশারায় বোঝালো “যা বোন, আমার কপালে এটাই লিখা ছিলো”।

রিশা চলে গেলো। মাঝখানে বালিশ দিয়ে নাবিল শুলো। দুপাশে রাউফুন আর পুষ্প। সকালে ঘুম ভাঙতেই পুষ্প নিজেকে আবিষ্কার করলো রাউফুনের পিঠে মাথা দেওয়া অবস্থায়। রাউফুন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, নাবিলের মাথা বিপরীত দিকে, পা পুষ্পর উপর। সকাল সকাল নিজেদের এই অবস্থা দেখে পুষ্প ধরেই নিলো রাতে এমন ওলটপালট হওয়ার সম্পূর্ণ দোষ নাবিল আর রাউফুনের। কারণ সেতো রাতে ওলটপালট হয়ে ঘুমায়না।

★★★

রাতে খাবার টেবিলে সবাই একত্র হয়েছে। রাউফুনের দাদি মেজো ছেলের কাছে গ্রামে ছিলেন কিছুদিন। এখন বড় ছেলের কাছে ঢাকা এসেছেন, কিছুদিন পর আবার ছোট ছেলে, আবার মেয়ের কাছে এভাবেই সব ছেলেমেয়ের কাছে ঘুরে ফিরে থাকছেন। নাতবউ তার পছন্দ হয়েছে। তবে খাবার টেবিলে একবার বেশ হুম’কি দিলেন, বাচ্চাকাচ্ছা নিয়ে নিতে। নয়তো নাতিকে আরেকটা বিয়ে করিয়ে ফেলবেন।
রাউফুন চুপচাপ খাবার গিলছে। সে ভাবলেশহীন, যেনো কিছুই তার কানে পৌঁছায়নি। পুষ্প কটমট দৃষ্টিতে তাকালো রাউফুন আর দাদী-শাশুড়ির দিকে। মনে মনে দাঁত দিয়ে দুজনের হাড় মাংশ চিবিয়ে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে।
খাবার শেষ করেই দাদি পুষ্পকে ডেকে বসলেন নিজের ঘরে। পুষ্প খাওয়া শেষ করেই দাদির ঘরে গেলো। তিনি পাশে ইশারা করে বললেন,
-” বসো।”

পুষ্প বিনা বাক্যব্যয়ে পাশে বসে পড়লো। দাদি নরম সুরে বলল,
-“শুনো বু তুমি আমার কথায় রাগ হইওনা। তোমরাতো বাচ্চার কথা কইলেই রাগ হও। সংসার তোমগো, বাচ্চা ও তোমগো, তবে জামাইরে আঁচলে বাইন্ধা রাখবা। দরকার হইলে কাঁঠালের আঠা দিয়ে আটকাইয়া রাখবা। কোনোমতেই যেনো আঁচল ছিঁইড়া যাইতে না পারে।”

রাউফুন হাত তালি দিতে দিতে ভেতরে প্রবেশ করে বলল,
-“বাহ্ দাদি! বাহ্! তুমিতো দিখছি সাংঘাতিক চিটারি করছো। চোরকে বলছো চুরি কর, গেরস্তকে বলছো সজাগ থাক। এদিকে আমার বিয়ে দিচ্ছো, আবার তাকে আঁচলে বাঁধা ও শিখিয়ে দিচ্ছো। আমার আর বিয়ে করা হলোনা।”

পুষ্প রোষানল দৃষ্টি মেলে বলল,
-“বিয়ে করা ছুটাচ্ছি।”

রাউফুন ভ’য় পাওয়ার ভান করে বলল,
-“দাদি তুমি আমার কি সর্বনাশটাই না করলে। আজ রাতে আমায় খাটের বাইরে ছুঁড়ে মারবে। শুধু একটা হাঁচিই আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।”

-“আমি সারাজীবন হেঁচে যাবো, তাতে কার কি সমস্যা? আমি কি বলেছি নাকি আমাকে বিয়ে করুন।”

রাউফুন আড়চোখে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলো। দাদি দুজনের কান্ডকারখানা দেখে ঠোঁট টিপে হাসছেন। পুষ্প দপদপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলো।
রাউফুন দাদির সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নিজেও ঘরে ফিরলো।
এসেই দেখলো তার জনাবা খাটের শেষ প্রান্তে উল্টো হয়ে শুয়ে আছে। এ ধারে জীবনেও গা ঘেষতে আসবেনা। রাউফুন আস্তে আস্তে কাছে ভীড়লো, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই ঝাঁঝালো সুর কানে বাজলো,
-“একদম কোনো কথা নেই আপনার সাথে। আমিতো হাঁচতে হাঁচতে দিনপার করি, যান একটা ভালোমেয়ে দেখে বিয়ে করুন।”

রাউফুন বলল,
-“সে কি? আমি বিয়ে করলে তুমি রাগ করবেনা?”

পুষ্প ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রাউফুনের দিকে ঘুরলো। শক্ত চোয়ালে বলল,
-“কাল সকালে গিয়েই রাম’দার অর্ডার দেবো।”

রাউফুন শব্দ করে হেসে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“এখন থেকে পিঠে ট্যাগ লাগিয়ে ঘুরতে হবে, “আমার একটা জল্লা’দ বউ আছে, মেয়েরা আমার থেকে দূরে থাকুন।”

এ পর্যায়ে পুষ্প নিজেও হেসে দিলো।

★★★

শরৎ এর স্নিগ্ধ, কোমল প্রকৃতি। মেঘমুক্ত আকাশে শিমুল তুলোর মতো শুভ্র মেঘের ভেলা।দূর্বাঘাস ভিজে ওঠে শিশিরবিন্দুর ছোঁযায়। দূর থেকে শিউলি ফুলের সুভাস ভেসে আসে। ইদানীং পুষ্পর সময়গুলো বেশ আনন্দে কাটে। সারাদিন শাশুড়ী, ননদ, শশুর এদের সাথেই সময় কাটে, রাত হলেই রাউফুনের সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকে। শুক্রবার দুজনে মিলে ঘোরাঘুরি করে, মাঝেমধ্যে রাতে লং ড্রাইভে বের হয়।

পুষ্প রান্নাঘরে ঢুকেই বলল,
-“মা তুমি কিন্তু আমাকে মে’রেধরে রান্না শেখাবে। আমি কিন্তু কিছুই শিখে আসিনি।”

পুষ্প প্রথম প্রথম আঙ্কেল-আন্টি বললেও এখন মা বাবা বলে ডাকে। রাউফুনের বাবা মা রাগ হন আঙ্কেল-আন্টি ডাকলে।
রাউফুনের মা রোকসানা বললেন,
-“পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে থাক। দেখতে দেখতেই শিখে যাবি। রিশাকেও আমি রান্না শেখাতে পারিনি। ওকে ওর শাশুড়ীই শেখাক।”

বিকেলে সোফায় শুয়ে শুয়ে বিভিন্ন রেসিপি দেখছিলো পুষ্প। রোকসানা জিজ্ঞেস করলো,
-“কি দেখছিস?”

পুষ্প বলল,
-“রেসিপি দেখছি। আজ বিকেলের নাস্তা আমি বানাবো। তুমি রেস্ট করো।”

সন্ধ্যায় রোকসানার ডাকে ঘুম ভাঙলো পুষ্পর। ঘুম থেকে উঠেই বলল,
-“বিকেল কি শেষ?”

রোকসানা মৃদু হেসে বলল,
-“ফ্রেশ হয়ে আয়। এখন সন্ধ্যা।”

পুষ্প লজ্জায় দাঁতে জিহবা কা’টলো। ওর বিকেলের নাস্তা বানানোর কথা ছিলো, অথচ রেসিপি দেখতে দেখতে সে নিজেই সোফাতে ঘুম রেসিপি হয়ে গিয়েছে।

#চলবে………

#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১১

জানালার পর্দা সরিয়ে খাটের পাশে এসে দাঁড়ালো রাউফুন। চিন্তিত গলায় ডাকলো ঘুমন্ত পুষ্পকে। ইদানীং মেয়েটা বেশিরভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটায়। ঘুমের কারণে প্রায়ই ভার্সিটি মিস দেয়। তার মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছে। আগের মতো খাওয়াদাওয়া নেই, সারাক্ষণ ঘুমাতে পারলেই বাঁচে। গতবার পিরিয়ড মিস গিয়েছে। তাই রাউফুনের মন কিছু একটা আঁচ করলো। ভাবলো একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিলে ভালো হবে। রাউফুনের ডাকে সাড়া দিলোনা পুষ্প। রাউফুন আরও কয়েকবার ডাকার পর পুষ্প অন্যপাশ ফিরে ঘুমায়। এবার রাউফুন কাঁথা সরিয়ে বলল,
-“দেখি ওঠো, বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। সকাল বেলা এতটা ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।”

পুষ্প বিরক্তি প্রকাশ করে সদ্য ঘুম থেকে জাগা ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
-“এমন করছেন কেনো? আমাকে ঘুমাতে দিন।”

রাউফুন ফোঁস করে শ্বাস ফেলে আরেকটু জোর দিয়ে পুষ্পকে উঠিয়ে বসালো। পুষ্প রেগে গেলো।
-“বিরক্ত করছেন কেনো? আপনি হাসপাতালে যাচ্ছেন যান। আমাকে কেনো ডাকছেন?”

রাউফুন পাত্তা দিলোনা পুষ্পর কথায়। জোর গলায় বলল,
-“যাও এক্ষুণি ফ্রেশ হয়ে আসো।”

পুষ্প দপদপ পা ফেলে মাথার রাগ ফ্লোরে ঝাড়লো। শব্দ করে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে নিলো। বাইরে থেকে রাউফুনের ডাকে চমক কাটলো। ঘুম পালিয়ে গেলো দুচোখ থেকে। রাউফুন বলল,
-“তাড়াতাড়ি আসছোনা কেনো? একসাথে নাস্তা করবো। কতদিন তুমি একা একা নাস্তা করছো খেয়াল আছে? এই তুমি কি ওয়াশরুমে ঘুমাচ্ছো?”

পুষ্প উত্তর না দিয়ে চটপট ফ্রেশ হয়ে বের হলো। মুখ ভার করে তোয়ালেতে মুখ মুছে নিলো। রাউফুন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের যত্নে হাত চালাতে চালাতেই বলল,
-“মনে হচ্ছে নিজের আরেকটু যত্ন নেওয়া উচিত।”

পুষ্প আয়নার ভেতর দিয়েই দৃষ্টি ফেলে আড় চোখের চাহনি নিক্ষেপ করলো রাউফুনের উপর। সেই দৃষ্টিকে উদ্দেশ্য করেই রাউফুন বলল,
-“নাহ্! আজকাল বউয়ের চোখ পড়ছেনা আমার উপর। সে সারাক্ষণ ঘুমিয়ে কাদা। ভাবলাম আমার রূপ বুঝি কমে গেলো। আদর কদর কিছুই পাচ্ছিনা।”

পুষ্পর ভাবান্তর হলোনা। তোয়ালে রেখে এলোমেলো চুলে বেরিয়ে গেলো। তার রাগ এখনো কমেনি। কেনো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে তুললো। কিছুক্ষণ পর আপনাআপনি রাগ পানি হয়ে যাবে। ইদানীং কেন এমন হচ্ছে সে নিজেও বুঝে পায়না।

নাস্তা করতে বসেও তেমন একটা খেলোনা পুষ্প। উঠে চলে গেলো রান্নাঘরে। একবাটি চানাচুর নিয়ে ঘরে ফিরলো।
রাউফুন ঘরে ঢুকেই হতাশ হলো। প্রতিদিনের মতো আজও বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাটছে। পাশে চানাচুরের বাটি রাখা। মাঝেমধ্যে দু’একটা চানাচুর পেটে চালান করছে। রাউফুন পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো,
-“নাস্তা করলেনা ঠিকমতো। এগুলো এখন কি খাচ্ছো? তুমি দেখছি দিন দিন স্বাস্থ্যের প্রতি অমনোযোগী হয়ে যাচ্ছো।”

পুষ্প স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলো,
-“আমার নাস্তা খেতে ভালোলাগে না।”

রাউফুনের কন্ঠ কোমল হলো। স্নিগ্ধ, নির্মল গলায় শুধালো,
-“আচ্ছা, ভার্সিটি যাবেনা? তুমি কিন্তু কারণ ছাড়া এখন ক্লাস মিস দিচ্ছো।”

এবার পুষ্প চোখমুখ কুঁচকে বলল,
-“ভালোলাগেনা ভার্সিটি যেতে।”

রাউফুন আদুরে হলো। কোমলতায় সিক্ত করলো পুষ্পর কপোল জোড়া। উষ্ণ চুম্বনে কন্ঠস্বর আরেকটু খাটো করে নিলো।
-“এভাবে সবকিছুতে হেলাফেলা করা ঠিকনা। পরে এসব নিয়ে প্রচুর সাফার করতে হয়। তখন আফসোস করবে।”

পুষ্পু মাথাটি এলিয়ে দিলো রাউফুনের কোলে। একপাশে ফোন ছুঁড়ে রেখে দুহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুঁজে বলল,
-“আমার ইদানীং কিছুই ভালোলাগেনা। শুধু ঘুমাতে ইচ্ছে করে, প্রচুর ঘুম পায়।”

চুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙ্গুল চালিয়ে আদর মেশানো গলায় রাউফুন বলল,
-“কেনো? আদর কি কম পড়ছে? আমি বোধহয় শুনেছি আদর কম পড়লে ঘুম পায় বেশি।”

পুষ্প নিঃশব্দে হেসে রাউফুনের পেটে নাক ঘষলো। হাসিতে শব্দ না হলেও টের পেলো রাউফুন। পুষ্পকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
-“উঠে বসো।”

পুষ্প উঠতে না চাইলেও অগত্যা উঠলো। দুহাতে পুষ্পর নরম চিবুক ধরে চিকন অধর জোড়ায় স্পর্শ দিয়ে বলল,
-“চলো, হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসি। রাতে আমরা ঘুরতে বের হবো।”

পুষ্প সরে বসলো।
-“নাহ্! ভালোলাগছেনা হাসপাতালে যেতে। আপনি যান।”

রাউফুনের জোর করাতেও কিছু হলোনা। হাসপাতালের দেরি হয়ে যাচ্ছে। রাউফুন ভাবলো রাতে ঘুরতে নিয়ে গেলে তখন রাজি করানো যাবে। পুষ্পর কপালে চুমু দিয়ে ঘর থেকে বের হলো। মাকে জড়িয়ে বলল,
-“আসছি মা।”

রোকসানা আল্লাহর হাওয়ালা করে বললেন,
-“সাবধানে যাস।”

★★★

পুষ্প নিচে নামলো রাউফুন যাওয়ার ঘন্টাখানেক পর। রান্নাঘরে উঁকি দিতেই দেখলো রোকসানা রান্না করছে, আর সাহায্যকারী মেয়েটি এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। পু্ষ্প রোকসানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তিনি একবার তাকিয়ে বললেন,
-“শরীর ঠিক আছে তোর?”

পুষ্প অবাক হয়ে বলল,
-“আমার আবার কী হবে?”

রোকসানা বললেন,
-“তোর শরীর কিন্তু অন্য কথা বলছে? কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করিসনি তুই? পিরিয়ড মিস গিয়েছে?”

পুষ্প অবাক হলো রোকসানার কথায়। মাথা নেড়ে জানালো তার গতমাসে পিরিয়ড মিস গিয়েছে। রোকসানা হাসিহাসি মুখ করে বললেন,
-“রাউফকে বলে একবার ডাক্তার দিখিয়ে এসো।”

পুষ্প বোধহয় বুঝতে পারলো রোকসানার ইঙ্গিত। তাই আমতা আমতা করে বলল,
-“কিন্তু মা, আমারতো মাথা ঘোরানো, বমি এসব হচ্ছে না। খালি ঘুম পাচ্ছে, আর শরীর একটু দুর্বল লাগছে।”

রোকসানা বললেন,
-“সবার তো আর এক রকম সমস্যা দেখা দেয়না। তাছাড়া সব সন্তানের ক্ষেত্রে ও মায়েদের সবসময় একরকম সমস্যা হয়না। একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম৷ পুষ্প খানিক লজ্জা পেলো। কথা ঘুরাতেই বলল,
-“আমি তোমাকে হেল্প করি। কী করতে হবে বলো।”

রোকসানা বাধ সাধলেন। বললেন,
-“এখন আর সাহায্য লাগবেনা। মুন্নি সব করে দিচ্ছে, আমি শুধু রান্নাটাই করছি।”

পুষ্প তবুও সাথে দাঁড়িয়ে রান্নায় হাত দিলো।

★★★

গোসল করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে তোয়ালে চালাতে গিয়েই মনে পড়লো শাশুড়ীর কথা। আপনাআপনি নজর চলে গেলো শরীরের সাথে লেগে থাকা চিকন পেটে। জামার উপর দিয়েই পেটে হাত রাখলো পুষ্প। অদ্ভুত অনুভূতিতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। সত্যি সত্যি কি এই পেটে একটি বাবু আছে? নরম, তুলতুলে, গুলুমুলু বাবু! আচ্ছা যদি বাবু না থাকে? কথাটি ভেবেই মন খারাপ হয়ে গেলো পুষ্পর।
মুঠোফোনের তীব্র শব্দে ভাবনার সুতো কাটলো। পুষ্প ফোন তুলে রাউফুনের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

রাতে বেশ হাসিখুশি ভাবেই রাউফুনের সাথে বের হলো পুষ্প। নির্জন রাস্তায় স্টিয়ারিং এ হাত রেখে ধীর গতিতে ড্রাইভ করতে করতেই রাউফুন বলল,
-“আমি তোমার কথা শুনছিনা। কাল একবার ডাক্তার দেখিয়ে আসবে আমার সাথে গিয়ে।”

পুষ্প মৃদু হেসে বলল,
-“ডাক্তার তো আমার পাশেই আছে। পুরো রাত ও ডাক্তার আমার পাশে থাকে।”

রাউফুন কপট রাগ দেখিয়ে চোখ রাঙালো। পুষ্প হেসে ফেললো। বলল,
-“আচ্ছা ঠিক আছে। কাল আপনার সাথে যাবো।”

রাউফুন স্বস্তির শ্বাস ফেললো।
জনমানবহীন একটা জায়গায় গাড়ি থামালো। পুষ্পকে নিজের দিকে ফিরিয়ে দুহাতে আলতো করে চিবুক চেপে ধরলো। ভাসা ভাসা চোখজোড়ায় গভীর দৃষ্টি ফেলে বলল,
-“নিজের খেয়াল রাখা শিখতে হবে। সাথে তোমাকে মনে রাখতে হবে তোমার সাথে কতগুলো মানুষ জড়িত। এখন তুমি যদি নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া না শেখো তাহলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তখন তো আমি আরেকটা বিয়ে করে ফেলবো। সে সময়টা তোমার ভালোলাগবে?”

রাউফুনের হাত সরিয়ে দিলো পুষ্প। রাউফুন ভাবলো বিয়ের কথা বলায় রাগ করে তার সাথে কথা বলবেনা। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে পুষ্প রাউফুনের দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে দু’হাতে রাউফুনের গালে হাত রাখলো। পরপর সময় নিয়ে গালে, কপালে, নাকে, চোখে, ঠোঁটে অধরের মিষ্টি ছোঁয়া দিয়ে বলল,
-“আপনাকে আমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করার সুযোগটাই দেবোনা। এত ভালোবাসবো যে, আমার ভালোবাসা ছেড়ে অন্যকারো ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছেই জাগবেনা।”

রাউফুনের চোখজোড়ায় হাসির ঝলক। পুষ্পকে টে’নে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো। নাকের ডগায় চুমু দিয়ে বলল,
-“আমার তো একটু একটু ভালোবাসায় হয়না। অনেকখানি ভালোবাসা লাগে।”

পুষ্প মিটিমিটি হেসে অধরের গাঢ় ছোঁয়া দিলো রাউফুনের অধরে। পুষ্পকে তার সিটে বসিয়ে রাউফুন পুনরায় ড্রাইভে মন দিলো। দুজনের মেজাজই বেশ ফুরফুরে। অনেক রাত করে তারা বাড়ি ফিরলো। ফ্রেশ হয়ে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলো। সকাল হলেই আবার ছুটতে হবে ব্যস্ত শহরের ব্যস্তময় জীবনে। নিজের শরীরের তুলনায় ছোট শরীরটাকে বুকে চেপে চোখ বুঁজলো রাউফুন।

★★★

চোখ সয়ে আসা অন্ধকার বিলীন হয়ে ধরনীর বুকে এক চিলতে আলোর দেখা মিললো। সূর্যের কিরণ জালানা ভেদ করে চোখে পড়তেই উঠে পড়লো রাউফুন। পাশে পুষ্প নেই। আজ এত তাড়াতাড়ি পুষ্প উঠে গিয়েছে দেখে অবাক হলো রাউফুন। ফ্রেশ হয়ে ঘরে ফেরার আগে বারান্দায় উঁকি দিলো। পুষ্পকে দেখা যাচ্ছে। মুখ ভার করে দূরের কিছু লক্ষ্য করছে। রাউফুন দূরে দৃষ্টি রেখে কিছুই দেখতে পেলোনা। তাই মুখের পানি ঝেড়ে পুষ্পর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,

-“কী দেখছেন মিসেস? আপনার হাসবেন্ড তো এখানে। তাকে দেখুন।”

পুষ্প মলিন চেহারায় তাকালেও কিছুই বললনা। রাউফুন সেটা লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলো। পুষ্পর কাঁধে হাত রেখে বলল,
-“কী হয়েছে? আজ আবার মন খারাপ কেনো?”

পুষ্প দুহাতে রাউফুনের পিঠ জড়িয়ে বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে মন মরা হয়ে বলল,
-“পিরিয়ড। আমি ভেবেছিলাম…..

পুষ্পর অসম্পূর্ণ বাক্য সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে রাউফুন শান্তনার সুরে বলল,
-“এত মন খারাপ করার কী আছে? মাঝেমধ্যে অনেকেরই এমন সমস্যা হয়। কারো দু’মাস-তিনমাস পিরিয়ড মিস হয়ে আবার সব ঠিক হয়ে যায়।
আল্লাহ যখন চাইবেন, তখন আমাদের ঘরেও বাবু আসবে।”

পুষ্পর মন খারাপ ভাব কিছুটা কাটলো। রাউফুন বলল,
-“ঘরে এসো। আমরা একসাথে নাস্তা করবো।”

পুষ্প রাউফুনের সাথেই নিচে গেলো। নাস্তা করে যথারীতি রাউফুন হসপিটালে চলে গেলো। রাউফুনের বাবা তার কাজে বের হলেন, রিশা ক্লাসের উদ্দেশ্যে গেলো। বাড়িতে বউ-শাশুড়ী দুজন রইলো। সাথে মুন্নি মেয়েটাও আছে। রোকসানা বললেন,
-“তোকে না বললাম আজ রাউফের সাথে হাসপাতাল যেতে?”

পুষ্প মুখ ভার করে বলল,
-“ওসব কিছুনা মা। আজ সকালেই পিরিয়ড শুরু হয়েছে।”

রোকসানা বললেন,
-“তাহলে আমার ভাবনাটাই ভুল। আচ্ছা মন খারাপ করে থাকিসনা।”

★★★

স্বাভাবিক এর তুলনায় অধিক রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তলপেটে অস্বাভাবিক যন্ত্রণা করছে। পুষ্প রোকসানাকে শুধু পেটে ব্যথার কথা জানালো। তিনি স্বাভাবিক পিরিয়ডের ব্যথা ধরে নিয়ে ব্যথা নিরাময়ের একটা ট্যাবলেট ধরিয়ে দিলেন। কিন্তু ব্যথা কমলোনা। পুরোদিন এভাবেই কাটলো। কিছুসময়ের জন্য ব্যথা কমে আসায় চোখের পাতা এক করলো পুষ্প। রাউফুন বাড়ি ফিরে আজ পুষ্পকে ঘুমে পেলো। খাবার খাওয়ার সময় রোকসানাকে একবার জিজ্ঞেস করলো,
-“সবাই খেয়েছে কি-না?”

তিনি বললেন,
-“পুষ্প খায়নি। পেটে ব্যথা হচ্ছে।”

রাউফুন কোনোরকমে খেয়ে পুষ্পকে ডাকলো। চোখমুখ কেমন সাদা হয়ে আছে। একদিনে চোখদুটো কেমন গভীরে তলিয়ে গিয়েছে। পুষ্প একবার তাকিয়ে আবার চোখ বুঁজে নিলো। রাউফুন চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-“না খেয়ে ঘুমিয়েছো কেনো? খাবেনা?”

পুষ্প মাথা নেড়ে জানালো খাবেনা। রাউফুন বেশ কয়েকবার খাওয়ার কথা বললেও পুষ্প উঠলোনা। অসুস্থ বলে রাউফুন ও আর বেশি জোর দিলোনা।
রাতে রাউফুন জেগে গেলো। অনেকক্ষণ যাবত কানে মৃদু গোঙানির শব্দ হচ্ছিলো। উঠে দেখলো পুষ্প পেটের নিচে বালিশ দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আছে। রাউফুন ডিম লাইট বন্ধ করে বেশি আলোর লাইট জ্বালিয়ে দিলো। অস্থির গলায় বলল,
-“কী হয়েছে? পেটে বেশি ব্যথা হচ্ছে?”

পুষ্প শুধু মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানালো। রাউফুন সময় দেখলো। এখন মধ্যরাত। এমুহূর্তে হাসপাতালে গেলেও গাইনোলজিস্ট পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ। তাদের ও একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে।
হট ব্যাগে গরম পানি নিয়ে পুষ্পর পেটে, কোমরে সেঁক দিলো। রাতটা কোনোভাবে পার হলো।
রাউফুন সকালে হাসপাতালে যাওয়ার সময় পুষ্পকে সাথে নিয়ে গেলো।

★★★

ছেলের ফোন পেয়ে রোকসানা হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটলেন।

#চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে