কলঙ্ক পর্ব-২৯ এবং শেষ পর্ব

0
1925

#কলঙ্ক
#২৯_তমো_এবং_শেষ_পর্ব(রম্যপর্ব)
#অনন্য_শফিক



আজ আমার গায়ে ধনিয়া।কী হলো! এই নাম শোনে ভীষণ অবাক হচ্ছেন তাই না?হওয়ার কথাও। এখন মূল গল্প বলি।
আমার এক মামা মওলানা। উনি এক সপ্তাহ আগে থেকেই কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করা যাবে না।করলে তিনি বিয়েতে আসবেন না। এরপর বাবা বাড়িতে গায়ে হলুদ যেন না হয় এর জন্য কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন।সে না হোক এতে আমার কিছুই যায় আসে না। এইসব গায়ে হলুদ টলুদ নিয়ে আমার অত মাথা ব্যথা নেই।আমি মেহরাবকে ফোন করে বলেছি ব্যপারটা। কিন্তু মেহরাব ব্যপারটা মেনে নিতে পারছে না। তাদের এখান থেকে নাকি কয়েকজন আগে ভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে আমাদের বাড়িতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে আসার জন্য। এদের না করলে নাকি খুব সমস্যা হবে।
আমি উপায়হীন হয়ে শিশির ভাইয়াকে ডাকলাম। শিশির ভাইয়া আর মা আমাদের বাড়িতেই উঠেছেন।মেহরাবদের বাড়িতে যাননি।মা বলেছেন, আমার মেয়ের বিয়ের চেয়ে ভাগ্নের বিয়ে বড় নয়।
শিশির ভাইয়াকে ডাকলেও লাভ নাই। ভাইয়া আসতে পারছে না। বিয়ে বাড়িতে কত আত্মীয় স্বজনই তো আসে। আমাদের বাড়িতেও এসেছে। এদের মধ্যে এক মেয়ের নাম তৃপ্তি।বড় অসভ্য মেয়ে। শিশির ভাইয়াকে জ্বালিয়ে মারছে। কিন্তু শিশির ভাইয়ার পাত্তা পাচ্ছে না।পাত্তা পাবে কী করে? শিশির ভাইয়ার পেছনে কী আর একজন লেগেছে!

অগত্যা শিশির ভাইয়াকে ডেকে লাভ নাই।আমি মেহরাবকে আবার ফোন দিলাম।কড়াভাবে এবার বললাম,’সাবধান, তুমি যদি গায়ে হলুদের উদ্দেশ্যে কাউকে পাঠাও তাইলে খবর আছে। বিয়ে ক্যান্সেল!’
মেহরাব বললো,’আচ্ছা যাও পাঠাবো না।’
আমি বললাম,’মনে থাকে যেন?’
মেহরাব বললো,’মনে থাকবে।’
কিন্তু সমস্যা হলো সকাল বেলা এক বানর এসে উপস্থিত হয়েছে আমাদের বাড়িতে।তার সাথে চার মেয়ে। মেয়ে চারটাও এমন অসভ্য যে ছেলেটার গায়ে পড়ে যাচ্ছে একেকবার।এই ছেলে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।
জিজ্ঞেস করেছে আমায়,’ভাবী কেমন আছেন?’
আমি শুকনো মুখেও হাসি ফুটিয়ে বললাম,’ভালো আছি।’
বাকী মেয়েরাও জিজ্ঞেস করলো আমায়।আমি সুন্দর করে উত্তর দিলাম।কুশল বিনিময় করলাম।
এবার এই ছেলে আমায় পরিচয় দিলো তার।সে নাকি মেহরাবের মামাতো ভাই।নাম অনন্য শফিক।এই ছেলেকে দেখতেই বানর কিসিমের মনে হয়।খালি ছটফট করে।হাত পা নাচিয়ে নাচিয়ে কথা বলে।এই মেয়ের গালে খোঁচা মারে তো ওই মেয়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।কী বিচ্ছিরি অবস্থা! আমার মনে হয় এর চরিত্রেও সমস্যা আছে। বিয়ের পর এর থেকে সাবধান থাকতে হবে!
ওদেরকে আসতে দেখেই মা এগিয়ে এলেন।মা এসে বললেন,’কিরে শফিক তুই হঠাৎ এখানে?’
শিশির ভাইয়ার মা আবার শফিকের ফুপু হন।
শফিক খিলখিল করে হেসে উঠে বললো,’ফুপু, গায়ে ধনিয়ার অনুষ্ঠানে আসছি।’
মা এমন অদ্ভুত ধরনের অনুষ্ঠানের নাম শুনে ভিরমি খেয়ে গেলেন। আমিও চমকে উঠলাম ভীষণ ভাবে। এই নাম তো জীবনেও শুনিনি কখনো!
মা শফিককে ধমক দিলেন।ধমক দিয়ে বললেন,’আসল কাহিনী বল।বানরামি এখন বন্ধ রাখ। এখনও তুই ছোট না!’
শফিক হাত পা নাড়িয়ে বানরের মতোই বলতে লাগলো,’ফুপু, ভাবীর মামার নাকি নিষেধ গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করতে।এই জন্য আমি গায়ে ধনিয়ার অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছি।’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বললাম,’এটা আবার কেমন ধরনের?জীবনেও তো নাম শুনিনি!’
শফিক বললো,’সিম্পল।এর আবিষ্কারক আমি। গোসলের আগে গায়ে হলুদ দেয়ার বদল গায়ে ধনিয়া দেয়া হবে।আর হলুদ শাড়ির বদল পরবেন ধনিয়া রঙের শাড়ি।আমি ধনিয়া রঙের শাড়ি আর ধনিয়া গুড়া নিয়ে এসেছি।আপনারা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করুন।’
মা ওর কথা শুনে ওর কান টেনে ধরে বললেন,’বানরামি ছুটাবো তোর আজ।তুই এখানে কিসের জন্য এসেছিস আমি বুঝি না।মাথায় মেয়ে পটাবার চিন্তা ছাড়া আর কিছু নাই না? মেট্রিক তো তিনবারে পাশ করেছিস!ইন্টরমিডিয়েট মনে হয় তিরিশ বারেও ডিঙাতে পারবি না!’
শফিক বানরামি রেখে এখন হনুমানগিরি করছে।তার সুন্দর মুখ এখন লজ্জায় সে হনুমানের মতো করে ফেলেছে।তার সাথে যে চারজন মেয়ে এসেছিল ওরা ততক্ষণে কেটে পড়েছে।শফিক বললো,’ফুপু যাই।’
মা বললেন,’না দাঁড়া।আমি শিশিরকে ডাকি!’
শফিক মার কথা সবটা শুনলো না।এর আগেই দৌড়ে পালালো।
ও চলে যাওয়ার পর মা হাসতে লাগলেন। হেসে বললেন,’এই ছেলে এক নম্বরের বানর।আদর করলেই ঘাড়ে চেপে বসে। শিশির ওকে একদম সহ্য করতে পারে না। একবার করলো কী শোন। ও ঢাকায় আমাদের বাসায় গেল। তখন শিশিরের এক মেয়ে বন্ধু এসেছে আমাদের বাসায় একটা নোট নেয়ার জন্য। শিশির ঘরে নাই।নোট বের করে দিলো শফিক।নোটের ভেতর সে এক চিঠিও দিয়ে ফেলেছে। সেই চিঠির নিচে আবার লিখা,ইতি-তোমার ভালোবাসার শফিক।কেমন লাগে বল? শিশিরের বন্ধু চিঠি পড়ে শিশিরের কাছে নালিশ করেছে। এরপর বাসায় এসে শিশির এমন শাসালো শফিককে। তখন থেকেই বেচারা শিশিরের নাম শুনলে লেজ গুটিয়ে পালায়!’
মা হাসছেন।মার সাথে আমিও হাসছি। আমাদের হাসিতে সাড়া বাড়ি মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে।

আজ বিয়ের দিন।একটু পর বর আসবে। নিতুর শরীরটা এখন একটু সেড়ে উঠেছে। তবে ও এখনও হাঁটতে পারে না। শুয়ে থাকে।একটু পর পর কাঁদে।
মা গতরাতে নিতু সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ‌।আমি তো এখন থেকে মেহরাবকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকবো তাই নিতুকে তিনি তার কাছে রাখতে চান।নিতুকে এখনও এই বিষয়ে জানানো হয়নি। বিয়ের পর সবকিছু জানানো হবে।

বর এসেছে। বাড়িতে হৈচৈ শুরু হয়েছে।এর মধ্যে ভাইয়া হঠাৎ দৌড়ে এলো ঘরে। এসে আমার কাছে বললো,’মেহরাব এসব কী পাগলামি শুরু করতে যাচ্ছে?’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’কী?কী করছে ও?’
ভাইয়া বললো,’তোর ব্যপারে সব নাকি গ্রামের মানুষদের সামনে চিৎকার করে বলবে!’
আমার তখন সবকিছু মনে পড়ে গেল। মেহরাব একদিন বলেছিল এসব কথা।যেদিন আমি সফল হবো সেদিন সে সবার সামনে উচ্চস্বরে এসব বলবে।
ভাইয়া এখানে থাকতে থাকতেই মেহরাবের গলা শোনা গেল। মেহরাব গলা উঁচিয়ে বলছে,’আমি যে মেয়েকে বিয়ে করছি এই মেয়ের নাম তূর্ণা।এই মেয়ের একটা অতীত আছে।তার আরেকটা বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু তার বর তাকে ঠকিয়েছে। তূর্ণা
প্রতারিত হয়ে যন্ত্রণায় দীর্ঘ ছয় ছয়টি বছর ধুঁকে ধুঁকে মরেছে।আজ সে সফল। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক।ঢাকা শহরের বড় ব্যাবসায়ী।এই বিষয়টা আপনাদেরকে আগে জানানো হয়নি।না জানানোর কারণ জানেন?কারণ আপনারাই।আপনারা যদি আগে এই বিষয়টা জানতেন তবে তূর্ণার নামে কলঙ্ক রটাতেন।একটা নির্দোষ মেয়েকে কলঙ্কিনী বানাতেন।এই জন্য আপনাদের বলা হয়নি!’
মেহরাবের কথাগুলো শুনে সবাই এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।বিয়েতে চেয়ারম্যান সাহেব উপস্থিত ছিলেন। তিনি মেহরাবকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন,’বাবা আর লজ্জা দিওনা আমাদের। আসলে আমরা এতোটাই জঘন্য যে সারাক্ষণ অন্যের সমালোচনায় মুখর থাকি। নিজেকে নিয়ে কখনো সমালোচনা করি না। নিজের কথা ভাবি না।এই যে তূর্ণা সফল হয়েছে এই তূর্ণাকে নিয়ে কত আলোচনা। তূর্ণার কতো গুণগান। কিন্তু ও যদি আজ সফল না হতো,আর ওর আগের বিয়ের বিষয়টা মানুষ জানতো তখন দেখতে তার চরিত্র নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে যেতো!এমনকি মাস্টার সাহেব নিজেও মুখ দেখাতে পারতেন না কাউকে। তারপর চেয়ারম্যান সাহেব উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’আপনি আমি আমাদের সবার শুধরাবার সময় এখন।আমরা শুধরে গেলেই আমাদের সমাজ বদলে যাবে।বদলে যাবে আমাদের পৃথিবী। আমাদের ছেলে মেয়েরা তখন হবে শিক্ষায় শিক্ষিত।ঘরে ঘরে জ্বলে উঠবে একেকটি জ্ঞানের বাতিঘর।’
সবাই চেয়ারম্যান সাহেবের কথা শুনে বলে উঠলো,’ঠিক বলেছেন চেয়ারম্যান সাহেব। ঠিক বলেছেন।’

মহা জাঁকজমকপূর্ণভাবে বিয়ে সম্পন্ন হলো। নিজের বাড়ি থেকে শশুর বাড়িতে এসে গেছি আমি। কিন্তু ভয় পাচ্ছি। শাশুড়ি মা যদি কিছু বলে বসেন।হতেও তো পারে আমার পুরনো কোনো বিষয় নিয়ে কথা তুলতে পারেন তিনি। জিজ্ঞেস করে বসতে পারেন কিছু একটা তখন আমার কী হবে?কী উত্তর করবো আমি!
কিন্তু আমায় অদ্ভুত রকম চমকে দিয়ে তিনি আমার কাছে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে ফেললেন। তারপর কপালে চুমু খেয়ে বললেন,’মা,মাগো, আমার নিজের কোন মেয়ে নাই। এতো দিন পর্যন্ত বুকটা আমার খা খা করতো।সারা জীবন একটা কন্যা সন্তানের জন্য কত যে আফশোস করে গেছি আমি! আল্লাহ এতো দিনে আমার ডাক শুনেছেন। আমার ঘর আলো করে তিনি সোনার কন্যা দান করছেন!’
শাশুড়ি মার কথাগুলো শুনে আমার চোখ ভিজে উঠলো জলে।আমি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।আর বললাম,’মা,মা,ওমা!’
আমার চোখের জলে মার বুক ভেসে উঠতে লাগলো!

বাসর ঘরে গিয়ে আমার চোখ কপালে উঠে গেল।এ কি!খাটের উপরে সুন্দর করে নানান ধরনের বই সাজিয়ে রাখা।ঘরের এদিকে ওদিকে সব খানেই বই আর বই।
আমি তখন মেহরাবকে বললাম,’এসব কী? ফুলশয্যার রাতে ফুল টুল বাদ রেখে বই দিয়ে ঘর সাজানো কেন?’
মেহরাব হা হা করে হেসে উঠে বলো,’এটা তোমার বানর দেবর অনন্য শফিকের আরেকটা বানরামি।সে বই দিয়ে ঘর সাজিয়েছে। তুমি বইয়ের ব্যবসায়ী।বইয়ের ব্যবসায়ীর বিয়েতে নাকি কোন ফুলসয্যা হয় না।হয় বইসয্যা।আসো আমরা এখন সারারাত ভর বসে বসে বই পড়ি!’
মেহরাব হাসছে।হা হা করে হাসছে।
আমি এবার ওকে এক ধাক্কায় বিছানার উপর ফেলে দিলাম। তারপর বললাম,আজ কোন বই পড়া নয়।আজ রাতভর আমি তোমাকেই পড়বো।আজ রাত শুধুই আমাদের—– ‘

___সমাপ্ত___

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে