কলঙ্ক পর্ব-১১

0
3812

#কলঙ্ক
#১১তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক


ওরা প্রায় বিছানার কাছাকাছি হতেই আমি ধরমড় করে বিছানার উপর উঠে বসলাম। আমাকে বসতে দেখেই ওরা কেমন থমকে গেল।একটা মেয়ে তো একেবারে দরজার কাছাকাছিই চলে গেল।
এলিজা তবুও বুক ফোলা ভাব নিয়ে আছে।
আমি হাঁটু দুটো ভাজ করে মাথার চুল ঠিক করতে করতে ঝাঁজালো গলায় বললাম,’কী?আয়।আয়না! এগিয়ে আয়!’
ওরা সব কজন ভয়ে চুপসে গেল।ভ্রু আর চুল কাটা মেয়ে দুটো এবার একেবারে বিড়াল সেজে গেছে।
আমি আবার বললাম,’আয়!আসিস না কেন এখন?’
এলিজা বললো,’আপনি কিন্তু আমার বন্ধুদের অপমান করছেন?আমি কিন্তু প্রভোস্ট ম্যামের কাছে কম্প্লেন করবো আপনার নামে?’
আমি বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বললাম,’কী কম্প্লেন করবি তুই আমার নামে?’
এলিজা বললো,’এটা কী আপনাকে বলতে হবে?’
আমার রাগ এবার মাথায় চড়ে বসলো। অনেক অপমান সহ্য করেছি।আর না।এই মেয়েগুলো বকে যেতে শুরু করেছে।সাহস বেড়ে গেছে এদের। এবার একটু শিক্ষা না দিলে অন্যসব বড় বোনদের সাথেও এমন বেয়াদবি করবে!
আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে এলিজার কাছে গেলাম এবং একহাতে ওর কান টেনে ধরে অন্য হাতে ওর গালে শক্ত করে দু দুটো চড় বসিয়ে দিলাম।চড় খেয়ে ও গালে হাত দিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। রুমের ভেতর ওর বন্ধুগুলো এতোক্ষণ যে এলোমেলো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা ততোক্ষণে দরজা খুলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।এলিজাও রুম থেকে বের হয়ে চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি ওকে বাইরে যাওয়ার সুযোগ দেইনি। রুমের দরজা আটকে দিয়ে বলেছি,’এক পায়ে দাঁড়া।’
এলিজা বললো,’একপায়ে কেন দাঁড়াবো?’
আমি এবার ওর গালে আরো একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললাম,’দাঁড়া বলছি। নয়তো থাবরিয়ে চাপার সবগুলো দাঁত ফেলে দিবো বেয়াদব মেয়ে!’
এলিজা ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো এবং এক পায়ে দাঁড়ালো।আমি এবার বললাম,’কান ধর।’
এলিজা কান ধরতে চায় না।
আমি ওকে ধমক দিলাম। এমন ভাবে ধমক দিলাম যেন আওয়াজটা বাইরে না যেতে পারে।
এলিজা ভয় পেলো। বুঝতে পারলো ও আমায় যা ভেবেছিল আমি আসলে তা না।
এলিজা কান ধরলো।
আমি এবার ওর দিকে চোখ লাল লাল করে তাকালাম। তারপর বললাম,’পিয়া তোর কাছে কী কী বলেছে?’
এলিজা চুপ করে থাকে।মুখ খুলে না।
আমি ওর কাছে গিয়ে মাথায় একটা জোরে চাটি মারতেই সে হড়বড় করে বলতে শুরু করলো।
বললো,’পিয়া আপু বলেছে, আপনি নাকি আমান ভাইয়ার সাথে মিছেমিছি বিয়ে করেছেন।মানে আপনার দু একজন বন্ধু জানে আপনি বিয়ে করেছেন কিন্তু আসলে এটা নাকি বিয়ে না।পিয়া আপুও নাকি বিষয়টা জানে।আর আপনি নাকি এই বিয়ের নাম করেই আমান ভাইয়ার সাথে হোটেলে হোটেলে রাত পাড় করতেন।এর পরেই নাকি আপনি কনসিভ করেন।কনসিভ করেছেন শুনে আমান ভাইয়া আপনার কাছ থেকে কেটে পড়ে।আর আপনি তখন অসহায় হয়ে এবরোশন করিয়ে নেন।’
‘কিন্তু তুই আমার সাথে এসব করছিলে কেন?তোর আমার সাথে শত্রুতা কী নিয়ে?’
এলিজা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,’আপনি আমায় একটা চড় দিয়েছিলেন। সেদিন আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম!’
আমি তখন বললাম,’এই চড়টা সেদিন না দিলে তুই রেগুলার আমার সামনে বসে তোর বন্ধুর সাথে ওসব নোংরা ভাষায় কথা বলতি। বড়দের সামনে এভাবে কথা বলা যে অনৈতিকতা তা কোনদিন তোর বুঝে আসতো না! এভাবে তুই একদিন বকে যেতি।তোর ভালোর জন্যই সেদিন চড়টা তোকে দিয়েছিলাম।’
এলিজা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার শরীর কেমন কাঁপছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার ভেতর এখনও রাগটা আছে।সে আজকের এই অপমান কিছুতেই হজম করতে পারছে না।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,’শোন, তোকে একটা মাত্র চড় দিয়েছিলাম। কিন্তু এরচেয়ে অনেকগুণ বেশি আদরও তো করেছিলাম।আপন বোনের মতো দেখেছিলাম।নাকি আদর করিনি?আপন বোনের মতো দেখিনি?’
এলিজার চোখ ভিজে উঠলো।সে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে বললো,’আপু,আমি সরি!অতসব বুঝতে পারিনি আমি!’
আমি ওকে আমার পা থেকে তুলে এনে আমার বুকের কাছে ধরলাম। তারপর বললাম,’এলিজা,অন্যের কথা শুনে কখনো কিছু বিশ্বাস করতে নাই! তাছাড়া অন্যের খুঁত নিয়ে কখনো ঘাঁটাঘাঁটি করাও উচিৎ নয়।আজ তুই আমার খুঁত নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবি তো কাল বাদে পড়শু দেখবি তোর খুঁত নিয়ে অন্যজন দৌড়াদৌড়ি করছে। তখন তোর কেমন লাগবে বল?’
এলিজা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,’আপু,প্লিজ আমায় আর লজ্জা দিবেন না!’
আমি বললাম,’না। তোকে লজ্জা দেয়ার জন্য নয়। শিক্ষা দেয়ার জন্য বলেছি। এখন এক কাজ কর তুই।পিয়াকে ডেকে নিয়ে আয় এখানে!’
এলিজা সঙ্গে সঙ্গে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এবং খানিক পরই পিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সে রুমে এলো।

পিয়া রুমে এসে বিরস মুখে বললো,’কিরে,আমায় খবর দিয়ে এখানে আনলে কেন?’
আমি মৃদু হাসলাম। তারপর বললাম,’তোর সাথে আমার শত্রুতা কী নিয়ে রে পিয়া?’
পিয়া বিরক্ত মুখে বললো,’এইসব বা*ল মার্কা আজাইরা কথা বলার জন্য আমায় এখানে ডাকিয়ে আনিয়েছিস?ফাউল!’
আমি আবার হাসলাম। হেসে বললাম,’বল।তোর সাথে শত্রুতা কী আমার?আমি তোর কী ক্ষতি করেছি?’
পিয়া রাগ দেখিয়ে বললো,’মেজাজ কিন্তু বিগড়ে যাচ্ছে!খারাপ হবে কিন্তু!’
আমি আবার একই কথা বললাম।
বললাম,’বল। আমার সাথে কী নিয়ে শত্রুতা তোর বল!’
পিয়া ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইলো।
আমি গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালাম। তারপর বললাম,’তাহলে বলতে চাইচিস তোর সাথে আমার কোন শত্রুতা নাই?’
পিয়া ফুসফুস করতে করতে বললো,’না নাই। এখন হয়েছে?’
আমি বললাম,’না হয়নি। এখন বল,যেহেতু তোর সাথে আমার কোন শত্রুতা নাই তবে কেন তুই আমার বিষয়ে মিথ্যে কথাগুলো এলিজার কাছে বললি?’
পিয়া বললো,’যা বলেছি তা সত্যি। মিথ্যে কিছু বলিনি।তুই আমান না কামান‌ কী বা*ল নাম ছেলের।ওর সাথে তুই শুয়াশুয়ি করিসনি? পেটে বেবি নিয়ে ঘুরিসনি? বয়ফ্রেন্ড ছেড়ে চলে যাওয়ায় এবরোশন করাসনি?আরে শালা! উপকারের কথাটাও এভাবে ভুলে গেলি! তোকে তো আমিই হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন!’
আমি বললাম,’মুখ সামলে কথা বল পিয়া।আমি বয়ফ্রেন্ডের সাথে ওসব করিনি। করেছিলাম আমার হাসব্যান্ডের সাথে।’
‘ও আচ্ছা।গুড।তাতে আমার কী?আমায় ডেকেছিস কেন?নাকি এখন শুনাতে চাস তোদের বাসর ঘরের কাহিনী?না এসব আমি শুনতে পারবো না!সময় নাই। পরীক্ষার ডেট হয়ে গেছে। এখন আমায় ছাড়!’
পিয়া চলে যেতে চাইলো।আমি ওকে যেতে দিলাম না।পথ রোধ করে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে বললাম,’তাহলে এলিজার কাছে এসব বলেছিস কেন?’
পিয়া হি হি করে হেসে উঠলো। হেসে বললো,’কোন আইনে লিখা আছে যে কারোর সম্পর্কে কিছু জানার পর তা অন্যের কাছে বলা যাবে না?’
আমার ভীষণ খারাপ লাগতে লাগলো। এবং রাগও উঠলো।আমি রাগ আর অভিমান মাখা গলায় বললাম,’ছিঃ পিয়া!তুই অতটা নীচ!অত নোংরা!’
পিয়া আমায় ধাক্কা দিয়ে বললো,’আর তুই?তুই কী রে বা*ল?তুই যে পেট বাঁধালি ওটা কী নেকের কাজ?সাওয়াব পাবি এতে?আর আমি একজনের কাছে বলেছি বলে পাপ করে ফেলেছি? আচ্ছা যা এই পাপ আমি আরো করবো।কাল দুপুরের আগেই দেখতে পাবি হোস্টেল আর ইউনিভার্সিটির হট নিউজ তুই!’
আমি চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে। ভয়ে ভয়ে বললাম,’পিয়া! আমার খুঁত নিয়ে কেন এসব করছিস?এতে তোর কী লাভ বল!প্লিজ যা হয়েছে তা ভুলে যা।আমরা তো বন্ধুই না?’
পিয়া আমায় ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে ফেলে দিয়ে বললো,’তুই আমার বন্ধু না,শত্রু।’
কথাটি বলে সে তার রুমের দিকে চলে গেল।
ও চলে যাওয়ার পর আমি বুকে প্রচণ্ড ব্যথা আর চোখ ভরা জল নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিক সময়ের জন্য নড়তেও ভুলে গেলাম।
এলিজা আমার কাছে এসে ভয়ে ভয়ে বললো,’আপু,কিচ্ছু হবে না।পিয়া আপু আপনাকে হুমকি দিয়েছে এমনি এমনি।আসলে ও কাউকেই কিছু বলবে না।বললে আগেই বলে দিতো।আর আমায় এমনিতেই বলেছে। হয়তো ভেবেছে আমি আপনার রুম মেইড। আপনার কাছ থেকে এমনিতেও আমি এক সময় সব জেনে ফেলবো!’
এলিজার কথা শুনেও আমার মন শান্ত হলো না। কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো।শরীর কাঁপতে লাগলো।মনে হলো আরেকটি ভয়ংকর বিপদ অপেক্ষা করছে আমার জন্য!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে