কনফিউশন পর্ব ৩৩+৩৪

0
1270

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩৩+৩৪

অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যায় কাব্য তিরা ও আরশির অপেক্ষায় ছাদে বসে ছিলো। আরশি যাওয়ার আগে তিনজনের জন্য চা করে নিলো সাথে থানকুনি পাতার বড়া। যখন তারা বের হবে ঠিক তখন রশ্নি বলল,
“মানুষ দুজন চা তিনকাপ কেন?”
আরশি হেসে বলল,
“কালা চন্ডীদাস আছেনা?”
ভাবি আঁৎকে উঠে বলল,
“এই তিরা তোর কিন্তু বিয়ে হয়ে গেছে।”
“উফ ভাবি। তুমি কী ভাবো আমাকে? কাব্যর এক্স গার্লফ্রেন্ডের আমার বয়সী মেয়ে আছে জানো তুমি?”
রশ্নি অবাক হয়ে বলল,
“মানে! কি বলে মেয়ে!”
তিরা আর দাঁড়ালো না। বের হয়ে ছাদের দিকে গেলো। আরশি বলল,
“পুরো কাহিনী আমি তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলব।”

আরশি তিরা ছাদে যেতেই কাব্য তিরার দিকে চেয়ে বলল,
“সুস্বাগতম মামনি!”
তিরা হেসে বলল,
“ধব্যবাদ আব্বাজান।”
আরশি চা বড়ার ট্রে কাব্যর সামনে রাখতেই
“ওহ কি দারুন জিনিস নিয়ে এসেছে আমাদের ডাক্তারা আপা!”
আরশি কিছু বলল না। চুপচাপ বসলো। কাব্যকে বলতে হলোনা নিজেই বড়া নিয়ে খাওয়া শুরু করল। খেতে খেতেই কাব্য বলল,
“তিরা ফোনে কথা বলার সময় তোমার শেষ কথার টোনটা যেন কেমন কেমন শোনাচ্ছিল। ভাল নেই তুমি? ডিপ্রেসড?”
তিরা বড়া নিতে নিতে বলল,
“আর বলোনা। ভালোটা থাকব কীভাবে একা একা?”
“তো নেভি অফিসারকে বিয়ে করেছো, একা একাই তো থাকতে হবে। সেটা আগে বোঝোনি?”
“ওর জন্য যে এত খারাপ লাগবে সেটা আগে কীভাবে বুঝব বলো?”
“হাজবেন্ডের জন্য মেয়েদের খারাপ লাগবেই এটাই স্বাভাবিক।”
“হ্যাঁ কিন্তু এত ব্যস্ত থাকা, এত খারাপ ব্যবহার করাটা স্বাভাবিক না। যাদিদ যে এরকম করবে তা তো বিয়ের আগে জানতাম না।”
“কেন তোমাদের কি অনেকদিন পর পর কথা হয়?”
“না প্রতিদিনই কথা হয়।”
“প্রতিদিন খারাপ ব্যবহার করে?”
“না। শোনো তোমাকে ভেঙে বলি। আমাদের প্রতিদিনই অনেকক্ষণ করে কথা হয়। বেশিরভাগ দিন সব স্বাভাবিক থাকে তখন আমাদের মধ্যে কোনো প্রব্লেম হয়না। হঠাৎ দু একদিন এক মিনিটের জন্য কল দেয়, দিয়েই বলে তোমার হাতে এক মিনিট আছে, যা বলার এর মধ্যে বলো। আবার কোনোদিন কথা না বলেই ঘুমিয়ে যায়। আমি অবাক হয়ে যাই আমার সাথে কথা না বললে ওর ঘুম আসে কীভাবে? আমার তো আসেনা। আবার কোনোদিন ২৪ ঘন্টায় সে এক মিনিটও বের করতে পারেনা আমার সাথে কথা বলার জন্য। এটা খুব আজব না? এরকম কিছু হলে আমি রিয়াক্ট করি। আমি খুব বেশি রিয়াক্ট করে ফেললে সে মাঝেমাঝে খারাপ ব্যবহার করে, মাঝেমাঝে আবার ফোন বন্ধ করে রাখে। আর সবচেয়ে বেশি যেটা করে সেটা হচ্ছে.. আমি চেঁচাতে থাকি কিন্তু সে কিছুই বলেনা, সাইলেন্ট হয়ে যায়। ড্যাম কেয়ার। কিছুই যায় আসেনা তার। আসলে কাব্য আমি ওর সাথে কথা বলার জন্য যতটা উতলা থাকি সে ততটা থাকে না।”
“হয়তো থাকে কিন্তু বোঝায় না।”
“উতলা থাকলে আবার বোঝাবে না কেন?”
কাব্য চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“এটাই হয়তো তার ন্যাচার।”
“সে উতলা থাকে না কাব্য। মাঝেমাঝে একটু কথা বলেই সে ঘুমানোর পায়তারা শুরু করে। সে কখনো আমাকে মিস করে না। কখনো তার আমাকে দেখতেও ইচ্ছে করেনা।”
“তুমি কী করে জানলে?”
“ভিডিও কলে কথা বলার কথা সবসময় আমিই আগে বলি।”
“একজন আগে বললেই তো হলো। তাছাড়া, তুমি আগে বলে হয়তো তার বলার আর সুযোগ রাখোনা।”
এবার তিরা একটু চিন্তায় পড়ে গেল। কাব্যর শেষ কথাটায় যুক্তি আছে। আরশি চা নিয়ে তিরাকে বলল,
“চা নে। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
তিরা চা নিল। তিরাকে চিন্তিত দেখে কাব্য আবার বলতে শুরু করল,
“দেখো তুমি নিজেই বলছো প্রতিদিন কথা হয়। মাঝেমাঝে কম হয়। প্রতিদিন কথা হয় মানে সব ঠিকই আছে। হঠাৎ দুয়েকদিন তার অসুবিধা তোমাকেও বুঝতে হবে। হয়তো ডিউটি বেশি পড়ে যায়, হয়তো টায়ার্ড থাকে। যাদিদ হয়তো একটু বদরাগী তাই খারাপ ব্যবহার করে। এছাড়া আমি ওর আর কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছি না।”
“তুমি ছেলে মানুষ তো, ছেলেদের দোষ কীভাবে দেখবে?”
কাব্য তিরার কথা শুনতে শুনতে চায়ে আরেক চুমুক দিয়ে নিল। এরপর হেসে বলল,
“ব্যাপারটা একদমই এমন নয়। আমি কারো পক্ষ নিচ্ছিনা। দেখো তিরা আমার মনে হয় ভালোবাসা কোনো নিয়মের মধ্যে রাখার জিনিস না। তুমি যতো নিয়মের মধ্যে আনতে যাবে সম্পর্ক খারাপ হবে। সম্পর্ককে ফ্রিডম দাও।”
“সম্পর্ককে আবার ফ্রিডম দেয় কীভাবে?”
“ধরো তুমি একটা সম্পর্ক একভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছো তোমার নিজস্ব স্ট্রাকচারে। তখন তুমি সবকিছুকেই সেই স্ট্রাকচারে আনার চেষ্টা করবে। তখনই গন্ডগোলটা বাঁধবে। তারচেয়ে সম্পর্ককে যদি নিজের গতিতে চলতে দাও, কিছু জিনিস তোমার মনমতো না হলেও সম্পর্ক ভালো থাকবে। সম্পর্ক ভালো থাকলে তোমরা ভালো থাকবে। ইউ ক্যান ট্রাই ইট। উপরওয়ালা কিছু আমাদের হাতে দেননি। যেটা আমাদের হাতে দেননি সেটার কন্ট্রোল আমাদের না নেয়াই শ্রেয়। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। সর্বপ্লাবী ভালোবাসা সবসময় সুখ এনে দেয় না।”
আরশি মুগ্ধ হয়ে শুনছে কাব্যর কথাগুলো। তিরা কিছুটা অবাক হচ্ছে, সে এভাবে কখনোই ভেবে দেখেনি। কাব্য বলল,
“যাদিদের কি পড়াশোনা শেষ?”
“না এখনো পড়ছে।”
“বোঝো তাহলে এতকিছুর মধ্যে ছেলেটার পড়াশোনাও আছে। পড়াশোনা না করলে তো সে ভালো পজিশনে যেতেও পারবে না।”
তিরা চুপ। কাব্য বলল,
“তুমি কি কখনো যাদিদকে জিজ্ঞেস করেছ সে সারাদিন কখন কি করে? তার ডেইলি রুটিন টা কেমন?”
“না ডিটেইলসে তো কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি।”
“একবার জিজ্ঞেস করে দেখো তো। আশা করি তার উত্তর শোনার পর বুঝতে পারবে সে কীভাবে তোমার সাথে কথা বলার সময় বের করে। কিছু কিছু সময় নিজের দিকটা কম ভেবে ওপাশের মানুষের দিকটা বেশি ভাবতে হয়।”
“আচ্ছা কাব্য সবসময় স্যাক্রিফাইস শুধু মেয়েদেরকেই কেন করতে হবে? কেন মেয়েদেরকেই সবকিছু বুঝতে হবে? কেন ছেলেরা কিছু বুঝবে না?”
“তাই তোমার মনে হয় শুধু তুমিই স্যাকরিফাইস করো? যাদিদ করে না?”
“একফোঁটা স্যাকরিফাইস যদি করতো নিজেকে ধন্য মনে করতাম।”
“যাদিদের স্যাকরিফাইস গুলো আমি বলি?”
“যাদিদ কোনো স্যাকরিফাইস করেনা। আর যদি করেও থাকে যাদিদের স্যাকরিফাইস গুলো তুমি কি করে বলবে?”
“বলি তারপর মিলিয়ে দেখো।”
“বলো।”
“প্রথমত, ছেলেটা বিয়ে করে মাত্র ৫ দিন পর নতুন বউকে রেখে চলে গেছে। এটা অনেক বড় একটা পেইন। ধরো একজন মানুষ কোথাও চলে যাচ্ছে। যাকে বা যাদেরকে রেখে যাচ্ছে তারচেয়ে বেশি পেইন যে চলে যাচ্ছে তার। যাদেরকে রেখে যাচ্ছে তাদের কাছে একটা শূণ্যস্থান তৈরি হচ্ছে। আর যে চলে যাচ্ছে সে নিজেই শূণ্য হয়ে যাচ্ছে। এটা তার একটা স্যাক্রিফাইস।
তিরা চুপ। তার কাপের চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কাব্য চা শেষ করে কাপটা রেখে আবার বলল,
দ্বিতীয়ত, সে প্রতিদিন তার বউয়ের অভিযোগ শোনে। এরচেয়ে বড় স্যাক্রিফাইস আর কী হতে পারে বলো? আমি যতদূর জানি ডিফেন্স অফিসাররা বিয়ের পর প্রথমেই তার স্ত্রীকে ধৈর্য ধরতে শেখায়। তারা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সবসময় স্বামীকে কাছে পাবেনা এটা বোঝায়। যাদিদ কি এরকম কিছু তোমাকে বোঝায়নি?”
“বিয়ের পরেও বলেছে, আগেও বলেছিল।”
“তাহলে তো যাদিদ আরো এডভান্স। বিয়ের আগেই তোমাকে সব ধারনা দিয়ে রেখেছিল। তবুও তুমি রিয়াক্ট করো। তুমি বললেনা মাঝেমাঝে তুমি চেঁচাতে থাকো আর সে চুপ থাকে, ড্যাম কেয়ার?”
“হ্যাঁ।”
“যখন সে খারাপ ব্যবহার করে, সেটা তার নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে রাগ দেখানো। টিট ফর ট্যাট। কিন্তু যখন সে ফোন বন্ধ করে রাখে বুঝে নেবে সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছেনা, পাছে রাগ দেখিয়ে ফেলে তাই ফোন বন্ধ করে রেখেছে। গিভ সাম রেস্পেক্ট যে সে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে চায় না। আর যখন চুপ থাকবে বুঝে নেবে সে তার রাগ কন্ট্রোল করে রাখছে, ফোন বন্ধ করে তোমাকেও টেনশন দিচ্ছে না। সো প্লিজ গিভ হিম লাভ। এটা তার একটা স্যাক্রিফাইস। এই স্যাক্রিফাইস টা শুধুই তোমার জন্য। তোমার বয়স কম বোঝো কম সেজন্য। সে কিন্তু এইক্ষেত্রে নিজের দিকটা একটু কম ভেবে তোমার দিকটা বেশি ভাবছে।”
কাব্যর কথাগুলো শুনে তিরা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল। সে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো কতবার সে এই বিষয়ে যাদিদকে ভুল বুঝেছে। আরশি তিরার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
“আরে পাগল কাঁদিস না।”
কাব্য হাতের ইশারায় আরশিকে থামিয়ে বলল,
“ওকে কাঁদতে দাও।”
আরশি থেমে গেল। কাব্য তিরার দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
“তৃতীয়ত, যাদিদ সদ্যবিবাহিত একজন শক্ত-সামর্থ্য পুরুষ। তার একটা ফিজিক্যাল নিড আছে। তার সেটাকেও কন্ট্রোল করে রাখতে হয়, এটাও তার একটা স্যাক্রিফাইস।”
তিরার কান্না আরো বেড়ে গেল। কাব্য বলল,
“চতুর্থত, ডিফেন্স অফিসাররা জব করেন না, তারা সার্ভিস করেন। তারা বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, নিজের বাড়ি, ভালোবাসার সবকিছু ছেড়ে নিজের জীবন বাজি রেখে তারা চলে যায় দেশের জন্য সার্ভিস দিতে। এটা তাদের সবচেয়ে বড় স্যাক্রিফাইস যেটা মানুষের চোখেই পড়েনা, যেটাকে সবাই স্বাভাবিক ভাবে। কিন্তু এটা তাদের জন্য অনেক কষ্টের। টাকাপয়সা তো যেকোনো জবেই পাওয়া যায়, ব্যবসা করেও কামানো যায়। তাহলে তারা ডিফেন্স সার্ভিস কেন করতে যায় ভেবে দেখেছো কখনো? আমি নেভিতে দুবার ট্রাই করেছি দুবারই ট্রেনিং এর সময় বাদ পড়েছি। কী পরিমাণ কঠিন ট্রেনিং করানো হয় ইউ কান্ট ইমাজিন। শুধু নেভি কেন প্রত্যেক ডিফেন্সেই প্রচন্ড কঠিন ট্রেনিং দেয়া হয়। ডিফেন্স অফিসারদেরকে দেখলে আমার ভেতর থেকে একটা আলাদা সম্মান আসে। মনে হয় এরা তো ওই ট্রেনিং উতরে যাওয়া মানে নিজের আবেগ, অনুভূতি, মরার ভয় সবকিছুকে হার মানাতে পারা কোনো বীর। দে আর আওয়ার রিয়েল হিরো। শুধু এই জন্য হলেও প্লিজ রেস্পেক্ট হিম, লাভ হিম এন্ড আন্ডারস্ট্যান্ড হিম। শুধু হাইট আর বডি দেখে ক্রাশ খেলেই হবেনা মিসেস তিরা মেহজাবিন। ধৈর্য সহকারে যাদিদের ছুটির জন্য অপেক্ষা করুন। ওই দিনগুলোতে দেখবেন এই বদরাগী মানুষটাই কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। স্বর্বপ্লাবী ভালোবাসা তখন আপনিও দেখাবেন।”
শেষ কথাটা বলে কাব্য হেসে ফেলল। তিরা এবার কাঁদতে কাঁদতেই ছুটে চলে গেল নীচে। আরশি উঠে পেছন পেছন যাচ্ছিলো, কাব্য হাত ধরে থামালো। ততক্ষণে আরশি সিঁড়িঘরের কাছে চলে গিয়েছিল। কাব্য বলল,
“এখন যাদিদকে কল করবে, সরি বলবে। এসবের মধ্যে তোমার থাকা লাগবে না। তুমি বরং অন্যকারো কাছে থাকো।”
আরশি সিঁড়িঘরে হেলান দিয়ে আশ্চর্য চোখে হেসে বলল,
“ইউ আর আ ম্যাজিশিয়ান।”
“ধুর।”
“সিরিয়াসলি কাল তিরা আসার পর থেকে আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু আমার বোঝানোতে কোনো কাজ হয়নি। এভাবে তো আমিও ভেবে দেখিনি।”
কাব্য আরশির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সিঁড়ঘরের হেয়ালে একটা হাত রাখলো। আরশির খুব কাছে গিয়ে চোখে চোখ রাখতেই সে চোখ নামিয়ে নিল। আকাশে মেঘগুলো সরে যাচ্ছে। মেঘের কন্ট্রোলে চাঁদের আলো কখনো কম কখনো বেশি। কাব্য সেই আলোয় আরশির মুখ দেখে বিমোহিত। কাব্য ডাকলো,
“আরশি।”
“শুনছি।”
“আমার চোখে তাকাও।”
আরশি তাকালো এবং সবসময়ের মত আবারো নার্ভাস হয়ে পড়লো। কাব্য বলল,
“নার্ভাস অর ডিসকমফোর্ট?”
আরশি চোখ নামিয়ে ঢোক গিলে বলল,
“জাস্ট নার্ভাস।”
“কেন?”
আরশি মাথা নেড়ে বলল,
“জানিনা।”
আরশির আবার সেই দম বন্ধ করা অনুভূতি হতে লাগলো। কাব্য বলল,
“যদি তোমার কেউ দূরে চলে যায়, তুমিও বোনের মতো পাগলামি করবে?”
আরশি কাব্যর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“যদি করি?”
“তার যদি রাগ হয়? সে যদি ফোন বন্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে তখন কি বুঝতে পারবে নাকি ভুল বুঝে ভাববে তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য করেছে?”
“সে এমনটা করবেই না। সে আমাকে সবচেয়ে বেশি বোঝে। যতটা এই পৃথিবীর আর কেউ বোঝেনা।”
কাব্য মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বলল,
“জানো কতবড় একটা কথা বলেছো? বুকটা ফুলে ফেঁপে এক আকাশ সমান হয়ে গেল।”
আরশি তাকিয়ে রইল। খুব খুশি লাগছে তার। কেন যেন অনেক অনেক দিন পর তার চোখ ভিজে আসতে চাইছে। সে হঠাৎ দ্রুতপায়ে নিচে নেমে গেল।

চলবে..

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩৪

“আমাকে মাফ করে দাও যাদিদ। সত্যিই আমি সবসময় শুধু নিজের কথা ভেবেছি। তোমার দিকটা কখনো ভাবিনি আমি।”
“আচ্ছা তিরা আর কতবার এক কথা বলবে? সন্ধ্যায় তো মাফ চাইলে। এখন আবার? আমি তোমার দূরের কেউ নই, এত মাফ চাইতে হবেনা আমার কাছে। তুমি যদি পাগলামি কমাও, ধৈর্য ধরে থাকো আর আমাকে একটু বুঝতে পারো তাহলে আমরা খুব সুখী হতে পারব।”
“আমি আর কোনো পাগলামি করব না। সবকিছু বুঝব দেখো।”
যাদিদ হেসে বলল,
“আচ্ছা ঠিকাছে। এখন একদম কান্নাকাটি না। হাসো তো একটু।”
“হাসলেও তুমি দেখতে পাবেনা।”
“পাব। আমি তিরাকে সবসময় দেখি।”
তিরা হাসলো। যাদিদ বলল,
“এইতো সুন্দর লাগছে। এবার লক্ষী মেয়ের মত আমার কথা শোনো।”
“বলো।”
“তুমি আগামীকাল খুলনা চলে যাবে।”
“আর কিছুদিন থাকি যাদিদ। এখানে আরশির সাথে সময় খুব ভালো কাটে।”
“হ্যাঁ সেজন্যই তুমি যেতে চাওয়ামাত্রই আমি যেতে দিয়েছি। কিন্তু তিরা বাবা মা ওখানে একা। আমার আর কোনো ভাইবোন থাকলে হয়তো তোমার উপর এত চাপ থাকতো না। কিন্তু যেহেতু নেই, বাবা মায়ের সব দায়িত্ব তোমাকে আমাকেই নিতে হবে। দুদিন তো থাকলে। আবার কিছুদিন পর গিয়ে থেকো। এখন ফিরে যাও প্লিজ।”
তিরার আবার মন খারাপ হয়ে গেল। যাদিদ জানে সে বাবা মায়ের কোনো খেয়ালই রাখতে পারেনা, উল্টো তারাই তিরার খেয়াল রাখে তবুও যাদিদ জোর করছে। যাদিদ সবসময় নিজের ইচ্ছেটা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। যাই হোক, মানুষটাকে বোঝার প্রতিজ্ঞা যখন নিয়েছ তখন যত কষ্টই হোক চেষ্টা সে করবে। পরদিন সকালের বাসেই তিরা খুলনা চলে গেল।

রশ্নি আরশিকে খুব সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিল। ভালোভাবে পিনও মারা হয়েছে। আরশি ঘরের ভেতর কয়েকবার হেঁটে দেখলো হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে কিনা। অসুবিধা না হলেও অস্বস্তি হচ্ছে। আরশি হুট করে বলে বসলো,
“আচ্ছা ভাবি শাড়ি টা খুলে যাবে না তো আবার?”
রশ্নি হেসে বলল,
“এত নার্ভাস কেন তুই? কোনোদিন তো তোকে এত নার্ভাস হতে দেখিনি।”
“ভাবি লজ্জা লাগছে আমার। তার সামনে এভাবে গেলে চোখ দুটো দিয়ে গিলে খাবে আমাকে। তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই যদি?”
রশ্নি এবার শব্দ করে হেসে ফেলল,
“বাসা চেনে তো? কোলে তুলে নিয়ে আসতে পারবে?”
“ধ্যাত ভাবি!”
“তুই একটা পাগল আরশি। ছেলেরা তো দেখবেই। এটাই তাদের ন্যাচার। সামনে যাবি প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগবে, পরে ঠিক হয়ে যাবে।”
“ভাবি আমি না ওকে বলিনি শাড়ি পরব। আমি বরং খুলে ফেলি। জামা পরে যাই। শাড়ি পরা আমার কর্ম না। রাস্তার লোকজন কী ভাববে বলো?”
“কিছু ভাববে না। এমনকি কেউ খেয়ালই করবে না। শাড়ি ভিনগ্রহের পোষাক না সোনা। বাংলাদেশী পোষাক, সব মেয়েরাই পরে। এবার বেশি কথা না বলে গয়নাগুলো পরে নে।”
“না গয়না পরব না।”
“একটু সাজলিও না৷ গয়নাও পরবি না। একদম সাদামাটা লাগবে।”
“সেটাতেই আমাকে স্বাভাবিক লাগবে ভাবি। শাড়ি পরেছি এটাই অনেক।”
“তাহলে চুলটা অন্তত খোলা রাখ।”
“ঠিকাছে, তোমার এই কথাটা রাখলাম।”
রশ্নি হাসলো। কাব্যর ফোন আসতেই আরশি রশ্নির থেকে দূরে গিয়ে ফোন ধরল,
“বলো।”
“উবার ডেকেছি। গাড়ি অলরেডি বাসার নীচে পৌঁছে গেছে, আমি রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে আছি। এখান থেকে উঠব। তুমি নামো।”
“আচ্ছা।”

রাস্তায় মাথায় যেতেই আরশি কাব্যকে দেখে ড্রাইভারকে দাঁড়াতে বলল। কাব্য বাইরে থেকে অতটা খেয়াল করল না। গাড়িতে উঠতেই হলুদ শাড়ি পরা আরশিকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। হা করে চেয়ে রইলো। নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেল। গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। আরশি আড়চোখে কাব্যকে দেখছে। কাব্য এবার চোখ ফিরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। দুহাতে ঠোঁট চেপে ধরে হাসলো কিছুক্ষণ। তারপর আবার নিজেই নিজের চুল টানলো। খুশিতে, উত্তেজনায় সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। আবার আরশির দিকে তাকালো। আরশি আড়চোখে তাকানো বন্ধ করল। তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাঁপছে। ভাগ্যিস বসে আছে নাহলে যে কী হতো! কাব্য বলল,
“ধন্য আজ কাব্য।”
আরশি মুচকি হেসে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তবে এটা পরে নিক।”
কাব্য প্যাকেট খুলে দেখে নীল রঙের পাঞ্জাবি। সাথে সাথে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো৷ আরশি অবাক হয়ে বলল,
“এখানেই?”
কাব্য হেসে বলল,
“সো হোয়াট! একজন অসম্ভব সম্ভব করল।”
“যদি তাই তাহলে সেই একজনটা তুমি।”
কাব্য আবার হাসল। আরশি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। কাব্য শার্ট খুলে পাঞ্জাবি পরে নিল। তারপর আরশির একদম কাছে গিয়ে বসলো।
“আরশি।”
“বলো।”
“খুব খুশি হয়েছি, খুব। আমার মনে পড়েনা এত খুশি আমি শেষ কবে হয়েছিলাম!”
আরশি হাসলো। খুশিটা সে কাব্যর চোখেমুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। কাব্যকে এত খুশি দেখে তার নিজেরও খুব খুশি লাগছে। কিছুক্ষণ পর কাব্য ফিসফিস করে বলল,
“তোমার হাতটা ধরতে দেবে?”
আরশি কাব্যর দিকে না তাকিয়েই বলল,
“এমনভাবে অনুমতি চাইছো যেন আগে কখনো ধরোনি!”
“এখন যেভাবে ধরতে চাই সেভাবে ধরতে অনুমতি লাগে আরশি।”
আরশি এবারো তাকালো না। মুচকি হেসে বলল,
“অনুমতি দিলাম।”
কাব্য আরশির একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল। তারপর আরশির হাতের আঙুলের ফাঁকে নিজের হাতের আঙুলগুলো রাখলো। তারপর হাতটা ভালোভাবে ধরল। আরশির হাতটা উপরের দিকে রেখে সেই হাতে চেয়ে রইলো। তারপর বলল,
“কি অন্যরকম লাগছে না?”
“হ্যাঁ।”
“ভালো লাগছে?”
“হ্যাঁ।”
“কিরে ভাই সবকিছুতেই দেখি হ্যাঁ বলছো!”
আরশি হাসলো। কাব্য বলল,
“ধরে থাকব এভাবে?”
“হ্যাঁ।”
“ছেড়ে দেব?”
“না।”
“যাক তাহলে বোঝা গেল যে তুমি র‍্যান্ডমলি হ্যাঁ বলছিলে না!”
আরশি এবার শব্দ করে হেসে ফেলল।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে