ও চোখে বৃষ্টি এলে পর্ব-০১

0
2402

#গল্পঃ_ও_চোখে_বৃষ্টি_এলে
#পর্ব: প্রথম
# তুহিনা পাকিরা
১.
আজ নিজের প্রাক্তন ভালোবাসার মানুষটার বিয়ে। তাকে নিশ্চয় বর বেশে খুব ভালো লাগছে। বিয়ে বাড়ির মসলিশে বিজলীবাতির রোশনার মাঝে সে নিশ্চয় খুব হাসছে। ৫ বছরের ভালোবাসার মুখের হাসি ছিনিয়ে সে এখন কাউকে নিয়ে স্বপ্ন সাজাচ্ছে। জীবনের প্রথম ভালোবাসা , প্রথম আবেগ এক নিমেষে কী সুন্দর ভাবে সে ভুলে গেলো।

এইতো আগের মাসে তার সঙ্গে সম্পর্কের বিচ্ছেদ হলো। কারণ,পিয়ালের সঙ্গে থাকতে পারবে না।পিয়াল বড্ড আদুরে, ন্যাকা, ওর সঙ্গে ঠিক ম্যাচ খায়না, আর দেখতেও খুব একটা আহামরি কিছু না। মানুষটাকে খুব করে বুঝিয়ে ছিল পিয়াল। পায়ে ধরতে বাকি রেখে ছিল। অগণতি চোখের জলের কোনো মূল্যও তার পাথর মনকে গলাতে পারেনি। পিয়াল বুঝেছিল তার জীবনে ওর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই আর তার পথ আটকায়নি পিয়াল। কী হবে আর পথ আটকে। ওই তো আরও কত তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বীকার হতে হতো তবে। থাকনা সে তার মতো , ভালো থাক।

চলে এসে ছিল সেই দিন পিয়াল। ভেবেছিল আর কখনো তার সামনে পড়বে না। জীবনটাকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু আবার তার সামনে পড়তে হলো। গত সপ্তাহে হঠাৎই তার সঙ্গে দেখা হলো ক্যাফেতে। মানুষটাকে দেখে যেনো ভুলেই গিয়েছিল তাদের বিচ্ছেদের কষ্ট। মনে হয়েছিল আগের মতোই তো আছে তারা। পিয়াল যখন তার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিল তার পাশে বসা মানবীকে দেখে বুঝেছিল মানুষটা সত্যিই আর পিয়ালের নেই। বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। তাই আর সামনে পা না বাড়িয়ে ফিরে আসছিল পিয়াল। কিন্তু সে দেখে নিয়েছিল। সেই দিন তার পাশের মানবী পিয়ালের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল এক খানা লাল আবরণে মোড়ানো কার্ড, বিয়ের কার্ড। বলেছিল সামনের সপ্তাহে তাদের বিয়ে। সেই দিন সে দুচোখ ভরে কেবল পিয়ালের মুখের হাসিটাই দেখেছিল। কিন্তু, চোখের পাতায় জমা অশ্রুকণা হয়তো তার চোখেই পড়েনি।

লাল কার্ডের উপরে গুটিকতক সোনালী অক্ষরে লেখা ” 16 ই শ্রাবণ, ইং -১২ /৮/২০২১ তারিখে সাম্য ও মৈত্রীর শুভ পরিণয়।” লেখাটা আবারও পড়ে পিয়ালের হৃদয় যেনো খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে। সাম্য এর সঙ্গে কোনো মেয়েকে পছন্দ না করা পিয়াল আজ কাঁদছে। প্রিয় মানুষ টাকে নিজের করতে পারলো না আর সে। আজ হবে সে অন্যের স্বপ্নপুরুষ। অথচ এই মানুষটার জন্যে ও কতো কী করেছে। বাবা মা এর পছন্দের পাত্রকে ছেড়ে ওই মানুষটার জন্যে তিনটে বছর অপেক্ষা করেছে মানুষটাকে প্রতিষ্ঠিত হতে দিতে। যাকে নিয়ে সে সাজিয়েছিল এক স্বপ্নের বাগান। সেই বাগান যে আজ প্রিয় মানুষের বিচ্ছেদের ঝড়ে এলোমেলো হয়ে গেছে।

চোখের জলটা মুছে বিয়ের কার্ডটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে কাজলটা হাতে তুলে নিলো পিয়াল। কেবল চোখের কোণে হালকা কাজল দিয়ে নিজের মনে হেসে দিল। আজ তাকে দেখতে আসছে। এতক্ষণে এসে গেছে বোধহয়। কী নিষ্ঠুর নীতি ভাগ্যের। আজ তার ভালোবাসার মানুষটা অন্যকারো সঙ্গে পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে, আর সে চিৎকার করে কেঁদেও নিজের মন হালকা করতে পারছে না। পৃথিবীর এই নিষ্ঠুর নীতি কিসের? ভালোবাসার মানুষটাকে যদি নিজের করে নাই পেলাম, তবে তার জন্যে কেনো একসময় নিজের মনের চোরা কুঠুরিতে ভালোবাসার সঞ্চার হয়েছিল? কেনো তাকে নিয়েই অবুঝ মন স্বপ্ন সাজিয়েছিল? কেনোই বা আজ তার বিরহে বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে? কেনো আসছে? তাকে কেনো ভোলা যাচ্ছে না।

-” বাহ্, আমার মেয়েটাকে তো খুব সুন্দর লাগছে। ”

মায়ের কথায় পিছন ঘুরলো পিয়াল। ওর মা হাতে কিছু গয়না নিয়ে এসেছে। সেগুলো ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে আলতো করে পিয়ালের মাথায় হাত রাখলো ওর মা।

-” ওরা এলো বলে, তাড়াতাড়ি এই গুলো পড়ে রেডি হয়ে নে। পরে এসে তোকে নিয়ে যাবো।”

পিয়ালের কোনো কিছু বলার যেমন নেই, তেমনি তার মায়ের শোনারও কিছু নেই। তিনি ব্যস্ত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। হাজার হোক একটা মাত্র মেয়েকে দেখতে আসছে।

ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের মায়ের যাবার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল পিয়াল। ওর বাবা, মা আজ কতো খুশি। তাদের হাসি মাখা মুখের আড়ালে তারা পিয়ালের কষ্টটা দেখেও দেখলো না। মেয়ে যে এতো দিন পর ওই ছেলের থেকে মুক্তি পেয়েছে, এটাই তো অনেক। কম চেষ্টা তো করেনি তাদের সম্পর্ক ভাঙার। অবশেষে ছেলেটা নিজেই ওকে ছেড়ে দিয়েছে। এতদিনে নিজের বন্ধুকে দেওয়া কথাটা পিয়ালের বাবা রাখতে পারলো। দুই বন্ধুত্ব এবার নতুন সম্পর্কের রূপ নেবে। পিয়ালের জন্মের আগে থেকেই তো এটাই কথা ছিল। আজ পিয়ালের বাবার বন্ধুর ছেলেই ওকে দেখতে আসছে।

গয়নার বাক্সটার দিকে তাকালো পিয়াল। সেখান থেকে একটা নেকলেস নিয়ে নিজের গলায় ফেলে দেখলো। কিন্তু পরিচিত মানুষটার গলার স্বর যেনো বলে দিলো, ” তোমাকে সেজে গুজে বেশি সুন্দর হতে হবে না, চোখের কোণে হালকা করে একটু কাজল টেনো তাহলেই আমার চলবে। এতেই আমি ঘায়েল হবো প্রাণাধিকা প্রেয়সী। ”

ছলছল চোখে নিজেকে আয়নায় একবার পর্যবেক্ষণ করলো পিয়াল। সত্যিই কি চোখে কাজল দিলে ওকে ভালো লাগে, নাকি পুরোটাই সাম্যের মিথ্যে বুলি।

হঠাৎ টেবিলে থাকা ফোনটায় মেসেজ টোন বেজে উঠলো। পিয়াল উঠে দাঁড়ালো, টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ অপশনে গেল। যা ভেবেছিল তাই হয়েছে, ওর পিসতুতো দাদা মেসেজ করেছে।

-” তোর কাজটা হয়ে গেছে। তুই কথা বলতে পারিস, সে তোর ফোনের অপেক্ষায় রয়েছে।”

মলিন হাসলো পিয়াল। সত্যিই সে ওর ফোনের অপেক্ষায় রয়েছে! না না এই সব ভাবা ঠিক হবে না। ফোনটা নিয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে একদম তিনতলার ছাদে চলে গেল পিয়াল। ছাদের রেলিং থেকে একবার নীচে সবাইকে ব্যস্ত দেখে ও ফোনটা নিয়ে অপর দিকের রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গে কল দিলো, বহু পরিচিত একটা নম্বরে। তবে আজ আর ওই নম্বরে ফোন না গিয়ে থাকতে পারলো না। অবশেষে এক মাস পর সেই নম্বরে কল গেলো।

একমাস আগের মতোই সঙ্গে সঙ্গে কেউ কলটা ধরলো। তবে আজ আর অপর ব্যাক্তিকে কিছু বলতে দিলো না, আজ নিজেই আগে পিয়াল বললো,

-” থ্যাংক ইউ, কিছুক্ষণের জন্য ব্লকলিস্ট থেকে মুক্তি দিলে তাই। ভেবেছিলাম আজও হয়তো ভাববে বিরক্ত করতে ফোন করেছি। তাই অভি দাকে আগেই তোমার কাছে পারমিশনের জন্যে পাঠিয়েছি। আর তুমি যে কথা বলতে রাজি হয়েছো এটাই অনেক।”

ফোনের ওপাশ থেকে সাম্য একহাতে পিয়ালকে দেওয়া নূপুর জোড়া হাতে নিয়ে ছলছল চোখে নিজের কষ্টটা লুকিয়ে বললো,

-” এটা কেনো ফেরত দিলে প্রাণা,, না মানে পিয়াল?”

প্রিয়র মুখে সেই নামটা শুনতে গিয়েও শুনলো না পিয়াল। সত্যিই তো আজ আর কি সে প্রাণাধিকা প্রেয়সী! এখন থেকে তো ও শুধুই পিয়াল। যার সাম্য এর জীবনে কোনো মূল্য নেই।

-” ওটার প্রয়োজন ফুরিয়েছে তাই। ওটার সঙ্গে আমাদের ভালোবাসাটা খুব নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ছিল। কিন্তু সেটা শেষ। আমি তো ওই অলঙ্কারের ভালোবাসা ছিলাম না, আমি ওই অলঙ্কার প্রেরকের ভালোবাসা ছিলাম। দিন শেষে তাকেই ভালবাসতাম, তাকেই চাইতাম। ওটা তো একটা স্মৃতি মাত্র। যে আমার প্রতিটা নিশ্বাসে মিশে আছে, তাকে মনে করার জন্য কি স্মৃতির প্রয়োজন আছে, নেই। তাই ওটা যার তাকেই ফিরিয়ে দিলাম।”

পিয়ালের কথাগুলো কাঁটার মতো বিঁধলো সাম্যের হৃদয়ের চোরা কোটায়। চেয়েও পারলো না বলতে, মানুষটা অন্যের না তারই থাকবে। হয়তো জীবনটা অন্য সুতোয় বাঁধা পড়বে, কিন্তু এই সাম্য তার প্রাণাধিকা প্রেয়সীরই থাকবে।

সাম্যকে এই ভাবে দেখে অভির একদম ভালো লাগছে না। দুটো মানুষ এই ভাবে কষ্ট পাচ্ছে, যা ও চেয়েও আটকাতে পারছে না। সবথেকে বড়ো কথা এখানের একজন যখন ওর মামাতো বোন, কিন্তু নিজের বোনের চেয়ে কম কিছু না। আর এই ছেলেটাকে ও তো ঠিক মতো জানেও না, কিন্তু ওর কষ্ট ও নিজের চোখে দেখতে পারছে।

কিছুক্ষণ নিরব রইলো ফোনের দুই পাশের মানুষ দুই। অন্ধকারে ছাদে একাই দাঁড়িয়ে রয়েছে পিয়াল। অনেকক্ষণ ধরেই ঝড় বয়ে চলেছে শুধু ওর মনে না, প্রকৃতিতেও। ঝড়ের তালে ওর শাড়ির আঁচল এলোমেলো হয়ে চলেছে। হুট করেই পিয়াল নীচে বসে গেলো, বেশ শান্ত ও আজ। এটাই কি তবে ঝড়ের পূর্ব লক্ষণ?

-” কিছু বললে না?”

কিছু বললো না সাম্য, পুনরায় পিয়ালই বললো,

-” পুরোনো কথা বাদ, নতুন জীবনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। সারাজীবন এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুখে থেকো, সরি থাকুন। কোনো দুঃখও যেনো না ছোঁয়। ভালো থাকবেন।”

-” তোমার মুখে আপনি শুনতে ভালো লাগে না, নিজেকে পর মনে হয়। তুমি বলে ডাকো না। ”

-” আমরা তো আজ থেকে পরই। আপনার নতুন বিবাহিত জীবন শুরু আর আমার,”

বাকিটা বলা হলো না পিয়ালের, ওপাশ থেকে সাম্যের বাবা সাম্য কে ডেকে বললো,

-” আর কতক্ষন বন্ধুর সঙ্গে গল্প করবি, আয় মৈত্রী মা যে অপেক্ষা করছে। উকিল এসে গেছে, আগে রেজিস্ট্রি হবে, পরে বাকি রিচুয়ালস।”

পিয়ালের গলার স্বর ধরে এলো, তবুও কষ্ট করে বললো, ” আপনার অনেকক্ষণ সময় নিলাম, ক্ষমা করবেন। ”

-” না শোনো, ফোনটা রেখো না।”

কিন্তু ততক্ষণে পিয়াল ফোন রেখে দিয়েছে। পাশের চেয়ারে বসে পড়লো সাম্য। খুব কান্না পাচ্ছে, কিন্তু চেয়েও কাঁদতে পাচ্ছে না, চোখ দুটো ভীষণ জ্বলছে।

-” সাম্য!”

অভির ডাকে ওর দিকে তাকালো সাম্য।

-” যা করবে ভেবে করবে, পড়ে যেনো মনে না হয় কাজটা পুরোটাই ভুল ছিল। ”

-” আমি কি করবো অভি দা, আমার মনে হচ্ছে মরে যাই। অন্তত এই বিয়েটা থেকে মুক্তি তো পাবো। পিয়ালকে তো কষ্ট দিতে পারছি না। #ও_চোখে_বৃষ্টি_এলে আমি তো সহ্য করতে পারি না।”

অভি সাম্যের হাতটা ধরে বললো, ” মরে যাওয়াটা কোনো সলিউশন না। নিজের ভালোবাসার পথে একপা এগিয়ে তো দেখো স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা তোমাদেরকে এক করবে।”

(চলবে)

{ বিঃ: ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং}

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে