এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ৫

0
1032

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ৫
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

মোহন ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। তার মাথার উপর সিলিং ফ্যানটা ভন ভন করে ঘুরছে। ফ্যানের শো শো শব্দ গুলো যেন গভীর থেকে আরো গভীর লাগছে। মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে মোহনের। অফিসে যায়নি সে। দুদিন হলো বাসায়ই বসে আছে। কারো সাথে কথা বলতেও ভালো লাগছে না। একা থাকতেই ভালো লাগছে। একাকীত্ব যখন খুব কষ্ট দেয় তখন একটু বাহিরে হেঁটে আসতে বের হয়। এই একাকীত্বের কারণ কী ? প্রিয়জন ছেড়ে গেলে এমনই লাগে হয়তো। মোহন সিলিং ফ্যানটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তবে তার মস্তিস্ক জুড়ে আছে ছায়ার স্মৃতি। যে বছর প্রথম অস্ট্রেলিয়া এসেছিলো মোহন, অনেক গুলো বছর আগের কথা। ভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ নিয়ে আসা হয়েছিলো এ দেশে। আসার সময় ছায়া আর মিলি মিলে সে কী কান্না! ছায়া তখন কলেজে পড়ে। সে এসে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলো, ‘ এটা তোমার জন্য ভাইয়া। ‘
মোহন প্যাকেট টা হাতে নিয়ে অবাক হয়েছিলো। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে জানতে চেয়েছিলো, ‘ কী আছে এতে ? ‘
ছায়া তখন কিছু বলেনি। বলেছিলো অস্ট্রেলিয়া আসার পর খুলে দেখতে। মোহন অস্ট্রেলিয়া আসে। এখানকার ভার্সিটিতে জয়েন করে। ভার্সিটির কাছেই একটা বাসা নেয়। ছায়ার দেয়া প্যাকেট টা খুলে সেদিন দেখতে পায় সেখানে তার জন্য দুটো টি-শার্ট, একটা ঘড়ি আর দুটো কলম। টি-শার্ট দুটোতে ছোট করে চিরকুট লিখা। লাল টি-শার্ট টা গরম কালে পড়বে। এটা অনেক পাতলা। গরম কম লাগবে। আর কালো টি-শার্ট টা পড়বে শীত কালে। পাতলা কাপড়ের মাঝে তবে খুব শীত মানবে এটাতে। ঘড়িটির মাঝে ছায়া, মিলি আর মোহনের এক সাথে তোলা একটা ছবি বাধানো। সব গুলো গিফট বের করে একটা চিরকুট দেখতে পায় মোহন। সেখানে লিখা,
– ‘ এই সব গুলো জিনিস আমি কলেজের টাকা জমিয়ে কিনেছি। তুমি কলম দুটো দিয়ে  তোমার জীবনের সব এক্সাম দেয়ার আগে লিখবে। আর ওই ঘড়িটা তোমার কাছে রাখবে সব সময়। যখন মনে পড়বে তখনি সেখানে দেখতে পাবে আমাদের। এতো দূরে থাকতে হবে তোমাকে। নিজের খেয়াল রেখো। কখনো বলা হয়নি, তোমাকে আমরা সবাই খুব ভালোবাসি ভাইয়া। ‘

সেদিন ছায়ার দেয়া এই কয়েক লাইনের চিরকুট পড়েই মোহনের চোখ ভিজে উঠেছিলো। ছায়া যখন কোন সমস্যায় পড়তো তখনই সে মোহন কে ফোন দিতো। তার সমস্যার কথা বলতো না। তবে ফোন দিয়ে কিছুক্ষন কথা বলাতেই নাকি তার হালকা লাগতো। সেই বোন, আদরের ছোট বোন তাকে এতো মায়া লাগিয়ে চলে গেলো। নাহ, ভালো লাগছে না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

মোহন চেয়ার ছেড়ে উঠলো। ছায়ার দেয়া ঘড়িটা হাতে নিয়ে অনেকটা সময় সেদিকে তাকিয়ে থেকে এগিয়ে গেলো সুবর্ণার দিকে। সুবর্ণা মায়াকে খাওয়াচ্ছিলো। মোহন গিয়ে তার পাশের চেয়ারটায় বসলো। শান্ত, ভারী কন্ঠে বললো,
– ‘ কাল আমাদের ফ্লাইট। ‘
মায়ার মুখে খাবার দিতে দিতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সুবর্ণা বললো,
– ‘ কিসের ফ্লাইট। ‘
– ‘ আমরা বাংলাদেশ যাচ্ছি কাল। ‘
সুবর্ণার মুখে খুশির ঝিলিক দেখা গেলো। সে উৎফুল্ল হয়ে বললো,
-‘ সত্যি! ‘
– ‘ হ্যাঁ। এখানকার সব গুছিয়ে নিও। আমরা আর এখানে আসবো না। ‘

সুবর্ণাকে এবারে একটু বিচলিত দেখালো। তার মুখের হাসির রেখাটা মিলেয়ে গেছে।
– ‘ আসবো না মানে ? ‘

– ‘ আমরা বাংলাদেশে একেবারে ফিরে যাচ্ছি। ‘

সুবর্ণা অবাক হয়ে তাকালো মোহনের দিকে। তার চোখে মুখে কৌতুহল। মুখটা ফ্যাকাশে।  মেয়েকে খাওয়ানো বন্ধ করে দিয়ে সে মোহনের দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। মায়ের হাত থেকে হালকা ছাড় পেয়েই মায়া দৌড়ে চলে গেলো অন্য রুমে।

– ‘ তাহলে এখানের সব কি হবে ?  আর তোমার বিজনেস ? ‘ সুবর্ণা মলিন ভাবে প্রশ্ন করলে।

– ‘ এভাবে থাকবে সব। ম্যানেজার কে দায়িত্ব দিয়ে যাবো। আর মাঝে মাঝে এসে দেখে যাবো আমি। ‘

– ‘ হুট করে দেশে একেবারে চলে যাবো বললেই হলো ? সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাবে তো। ‘

মোহন বিরক্ত হলো সুবর্ণার কথায়। ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
-‘ এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সব ব্যবস্থা করেই যাচ্ছি আমি। ‘

– ‘ ফ্লাইট কখন ? ‘ সুবর্ণার আহত স্বরে প্রশ্ন।
–  ‘ কাল রাতে । ‘

সুবর্ণা আর কথা বাড়ালো না। উঠে চলে এলো। তার দেশে যাবার ইচ্ছা আছে। সকলকে দেখারও ইচ্ছা আছে। তবে একেবারেই ইচ্ছা নেই অস্ট্রেলিয়ার বিলাসিতা ছেড়ে দেশে গিয়ে জীবন যাপন করার। সে চেয়েছিলো বাকি জীবনটা এখানেই থাকবে। মেয়ে বড় হবে। তারপর, এদেশি কোন ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবে। এখন এসবের কিছুই হবে না। ভাবতেই গা রি রি করছে রাগে। কিন্তু মোহন কে যে কিছু বলে লাভ হবে না সেটা সে জানে। মোহন হলো পরিবার বলতে কাতর। নিজের পরিবারের জন্য যেন জীবন দিয়ে দিতেও সমস্যা হবে না ! এসব আদিক্ষেতা একদম সহ্য হয় না তার।

আজ ছায়ার জন্মদিন ছিলো। কত প্ল্যান করেছিলো সৌরভ। ভেবেছিলো অনেক বড় করে সারপ্রাইজ দিবে। কিন্তু কিছুই হলো না।সব থেকে বড় সারপ্রাইজ টা ছায়া নিজেই দিলো। চলে গেলো সকলকে ফাঁকি দিয়ে। সৌরভ বারান্দায় বসে ছিলো। তার হাতে মোবাইল। হোম স্ক্রিনে ছায়ার ছবি। সৌরভ সে ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনের মাঝে চলছে অশান্তির উথাল পাথাল ঢেউ। থানা থেকে ফোন এসেছিলো। পুলিশ মোজাম্মেল শিকদার কে গ্রেপ্তার করেছে। এখন মোজাম্মেল শিকদার এর স্টেটমেন্ট নেয়া হবে। তার বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ যদি থাকে তাহলে এ খুনের জন্য তার কঠিন শাস্তি হবে। হয়তো ফাঁসি নয়তো যাবত জীবন তো হবেই। কিন্তু কি লাভ হবে এতে ? ছায়াকে কি সে ফেরত পাবে ? তার ছায়া কি আবারো তার কাছে চলে আসবে ?  আসবে না তো। তবে কেনো এতো আয়োজন! কেনো এতো খোঁজা খুঁজি, এতো প্রমাণ করার প্রচেষ্টা ! কি  হবে এসব করে?  ছায়া তো আর আসবে না।  নাহ!  লাভ আছে। যে ছায়াকে হত্যা করেছে তাকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে যে ছায়া শান্তি পাবে না। শান্তি পাবে না সৌরভ। এতো সব কথা মাথার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছিলো সৌরভের। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো। রুম ছেড়ে বের হতেই তোহার সাথে দেখা হয়। তার পাশেই মিলি দাঁড়িয়ে। মিলিকে দেখতে ছায়ার মতোই লাগে। কিছুটা অমিল হলেও খুব একটা ব্যবধান নেই। এই মুহূর্তে তাকে দেখে কিছুটা স্বাভাবিক লাগছে। এ দুদিন চোখ মুখ ফোলা ছিলো। এখন সেটা নেই। চোখের কোলে হালকা কালি জমেছে। রাতে হয়তো ঠিক ভাবে ঘুম হয় না। মিলি গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে না। সব সময় স্মার্টলি কথা বার্তা বলে। মিলি তার স্বভাবসুলভ ভাবেই সৌরভকে বললো,
– ‘ দুলাভাই কাল ভাইয়ারা অস্ট্রেলিয়া থেকে চলে আসবে। আমরা যেহেতু এখানে আছি তাই তারা এখানে এসে উঠতে চাচ্ছে। তারপর সকলে এক সাথে বাড়ি চলে যাবো। আপনার কোন অসুবিধে নেই তো ? ‘

সৌরভ মাধুর্যের সাথে বললো,
– ‘ আমার কোন অসুবিধে নেই মিলি। তোমরা যদি সব সময়ও এখানে থাকো আমাদেরই ভালো লাগবে। ‘

মিলি জানে সৌরভ কখনো এসব নিয়ে কিছু বলবে না। সে সব সময় ছায়ার ফ্যামিলিকে নিজের ফ্যামিলির মতো দেখেছে। শালি হওয়ার পরও কখনো মিলির সাথে কোন ঠাট্টা, তামাশা করেনি। স্বভাব, চরিত্র, আচরণ সব দিক দিয়ে সৌরভ একজন আদর্শ পুরুষ বলা যায়। তার বোন ভাগ্য গুণে এমন স্বামী পেয়েছিলো।

সৌরভ বের হচ্ছিলো। তোহা পেছন থেকে ডেকে বললো,
– ‘ কোথাও যাচ্ছো ভাইয়া ? ‘
– ‘ থানায় যাবো। অফিসার একবার যেতে বলেছেন। মোজাম্মেল শিকদার অ্যারেস্ট হয়েছে। সে বিষয়েই হয়তো কোন কথা।’ এটুকু বলে সৌরভ বের হয়ে গেলো।

সৌরভের ব্যাংকে যাওয়া হচ্ছে না। সে মনের দিক দিয়ে একদম ভেঙে পরেছে। এ অবস্থায় কেউ অফিস করতে পারে না। গুলশানের ইসলামি ব্যাংক এর ম্যানেজার সে। মালিকের পরই সব কিছু তার দেখাশুনা করতে হয়। মালিক পরিচিত এক বন্ধুর বড় ভাই। সে হিসেবে অনেক ছাড় দেয়া হয় তাকে। তবে সেসব এর কোন সুবিধাই সৌরভ এতো দিন নেয়নি। বরং প্রতিটি রুলস নিজেও যথাযথভাবে মেনেছে। কিন্তু ছায়ার মৃত্যুর পর এখন অফিসে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। তাই মালিক নিজেই তাকে বলেছে যতদিন ইচ্ছা সময় নাও। নিজেকে ঠিক করো, তারপর কাজ।

রাজিবের কাজ আছে। গত দুদিন সৌরভের জন্য অফিসে যায়নি সে। আজ থেকে আবার জয়েন করেছে। তবে সকালে সৌরভ ফোন করে বলে দিয়েছে লাঞ্চে ছুটি নিয়ে অফিসের সামনে থাকতে। থানায় যাবে। বন্ধুর এরকম একটা সময় রাজিবও তার পাশে থাকতে চায় সব সময়, সব ভাবে। দশ মিনিট হলো সে ব্যাংকের সামনে অপেক্ষা করছে কিন্তু সৌরভের এখনো খবর নেই। সৌরভ আসলো আরো মিনিট পাঁচেক পর। তারপর দুজন মিলে গেলো পুলিশ স্টেশন।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে