এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ২

0
1900

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ২
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

মর্গের ভেতর দুজন পুলিশ সহ একজন ডাক্তারের সাথে সৌরভ আর রাজিব প্রবেশ করেছে। তাদের সামনেই সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছে ছায়ার লাশ। সৌরভ যেন তার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সে মনে মনে হাজার বার আল্লাহ কে ডেকে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আল্লাহর কাছে তার জীবনের শেষ চাওয়া মুখ থেকে কাপড় সরানোর পর যেন দেখতে পায় এটি ছায়া না। সৌরভের চোখ রক্তবর্ণ। মুখ থমথমে। হাত পা অনবরত কাঁপছে। সে কাঁপা হাতে আস্তে করে লাশের মুখ থেকে কাপড়টি সরালো। তার সামনে ফুটফুটে পুতুলের মতো মেয়েটি শুয়ে আছে। সকালে পড়া কপালের টিপটি নেই। চোখের নিচে কাজল লেপ্টে কালো হয়ে আছে। আর কোন কিছু বলতে পারলো না সৌরভ। ধপ করে সেখানেই বসে পরলো।

রাজিব সৌরভকে বহু কষ্টে ধরে হসপিটালের ওয়েটিং রুমে নিয়ে এসে বসেছে। সে বুঝতে পারছে না কি বলবে। সৌরভকে শান্তনা দেয়ার মতো ভাষা তার জানা নেই। তাই বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে তার পাশে বসে রইলো। সৌরভ কে দেখে মনে হচ্ছে তার দেহে প্রাণ নেই। নিষ্প্রাণ একটা ছেলে বসে আছে। চোখ গুলো লাল টকটকে । সে চোখে নেই কোন অশ্রু। ‘চোখের অশ্রু তো সবাই দেখে। মনের অশ্রু দেখে কে ?’

বেশ কিছুটা সময় পর দুজন পুলিশ এসে ঢুকলেন রুমে। সৌরভের সামনে এসে দাঁড়িয়ে একজন বললেন,
– ‘আমরা লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়েছি।’

সৌরভ কোন উত্তর দিলো না। তার দৃষ্টি মেঝের দিকে। মুখটা ম্লান। চারপাশের জগতের কোন দিকে তার নজর নেই। সব যেন মিথ্যে হয়ে গেছে। পুলিশ লোকটি আবারো বললেন,

– ‘আমরা বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা ঠিক নেই। তবে আপনাকে এখন শক্ত হতে হবে। আপনি সাহায্য করলেই আমরা দ্রুত তদন্ত করতে পারবো।’

সৌরভ তখনো কিছু বললো না। তাকে চুপ থাকতে দেখে রাজিব উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

– ‘ আপনারা নিজেদের মতো তদন্ত শুরু  করুন অফিসার। ও একটু স্বাভাবিক হলেই কথা বলবে। ‘

অফিসার আর কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। একটু পরই দৌড়িয়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করলো তোহা। তার চুল এলো মেলো। প্রসাদনী বিহীন ম্লান মুখ। চোখ গুলো কান্নার কারণে ফুলে আছে। তোহা এসেই সৌরভ কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলো। তবে সৌরভ তখনো ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে। তার মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। নেই কোন উত্তেজনা। সে যেনো তার রক্তাভ চোখ দিয়ে শুধু পৃথিবীকে ধ্বংস করে যাচ্ছে।

তোহা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে। হসপিটালে এতো জোড়ে কান্না করা কেউ এলাও করে না। দুবার দুজন নার্স এসে তাকে শান্তনার স্বরে সতর্ক করে গেছে। কিন্তু মন কি আর বাঁধ মানে ? সৌরভের ওপর পাশের চেয়ারটায় বসে তোহা মুখে ওড়না চেপে কান্না করছে। তোহাকে এভাবে কাঁদতে দেখে রাজিবের খুব খারাপ লাগছিলো। সে এসে তোহার কাঁধে হাত রাখে। ইশারায় তাকে বুঝায় সৌরভের কথা। এ সময় তাদের উচিত সৌরভকে সামলানো। সৌরভ যে ইতোমধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে তা বুঝতে বাকি নেই কারো। ভাইয়ের কথা চিন্তা করে তোহা নিজের কান্নার আওয়াজটা কমিয়ে এনেছে। কিন্তু কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না সে। একটু পর পর কেঁপে কেঁপে কান্না করে যাচ্ছে।

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
ওরা বাড়ি ফেরে রাত একটার দিকে। হসপিটালের সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে লাশ নিয়ে বাড়ি আসা পর্যন্ত সকল ব্যবস্থা রাজিব আর তোহাই করেছে। আত্মীয় স্বজনদের খবর পাঠানো হয়েছে। কাল সকাল দশটায় মাটি দেয়া হবে। রাতেই ছায়ার বাড়ি কুমিল্লা থেকে তার মা বাবা আর বোন চলে এসেছে খবর পেয়ে। এসেছে আরো কিছু ঘনিষ্ঠ লোক। ছায়ার মা আমেনা বেগম এসে লাশের সামনে বসে প্রলাপ করে করে কান্না করছে। মিলি তোহাকে ধরে বোনের সামনে শক্ত হয়ে বসে আছে। তার চোখ থেকে শুধু টপ টপ করে পানি ঝরছে। মিলি ছায়ার ছোট বোন। এবারে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে আছে। দু বোনের মাঝে অনেক মিল। বয়সের ব্যবধানও আকাশ পাতাল না বিধায় ওরা ছিলো বন্ধুর মতোন।

আশফাক আহমেদ মেয়ের শোকে বাকশক্তি হারানোর উপক্রম। তিনি ড্রইং রুমের চেয়ারে বসা। এক হাত কপালে দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন। আর সৌরভ ? সে তো এখন শুধুই পাথরের মূর্তি। বাড়িতে কে আসছে, কে যাচ্ছে সেদিকে তার কোন নজরদারী নেই। সে ছায়ার মাথার কাছে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছায়ার মুখের দিকে। তার চোখ গুলো এখনো লাল, রক্তাভ।

পরদিন সকালে লাশ কবর দেয়া হলো। দূর আত্মীয়রা সকলে চলে গেছে। এখন বাড়িতে শুধু ছায়ার পরিবারের লোকজন। পুলিশ এসেছে। তাদের সাথে রাজিব কথা বলছে। কিন্তু পুলিশ চাচ্ছে সৌরভের স্টেটমেন্ট। রাজিব তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে সৌরভ কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। কিন্তু পুলিশ বুঝতে চাইছে না। আশফাক আহমেদ এগিয়ে গিয়ে অফিসারকে বললেন,
– ‘ জামাই আমার মেয়েটাকে অনেক ভালোবাসতো। ছায়ার মৃত্যুটা ওর কাছে অনেক বড় একটা ধাক্কা । ছায়ার মা ও পাশের রুমে বিলাপ করে কান্না করছে। ওরা কেউ এখন কথা বলার অবস্থায় নেই অফিসার। আপনারা আসুন এখন। ‘
কথাগুলো বলেই আশফাক আহমেদ ঢুকরে কেঁদে উঠলেন। উনাকে ভেতরে নিয়ে গেলো রাজিব।

তোহা আর ছায়াকে বেশির ভাগ সময় এক সাথে কাটাতে হতো। সৌরভ কোন কাজে বাহিরে গেলে বা অফিসে থাকলে ছায়ার সাথে খুনশুটি করে সময় কাটতো তোহার। যদিও ছায়া একটু গম্ভীর ভাবে থাকতো সব সময়। তেমন ভাবে হাসিখুশি থাকতে খুব বেশি তাকে দেখা যায়নি। কম কথা বলেছে। কিন্তু তোহা নিজ থেকে গিয়ে আড্ডা দিলে বা জ্বালাতন করলেও ছায়া কখনো রাগেনি। সে কারণেই ছায়াকে বেশি ভালো লাগতো তোহার।  সে বিরক্ত হলেও অন্য সব ভাবীদের মতো মুখে কিছু প্রকাশ করে যা তা শুনিয়ে দিতো না। ছায়া ছিলো অন্যরকম একটা মানুষ। যেনো যা হচ্ছে সব মেনে নিতো। কোন কাজের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ ছিলো না। আজ থেকে এ বাড়িতে কার সাথে কথা বলবে তোহা ? তার ভাই যখন অফিসে থাকবে কে তাকে সময় দিবে? নিজের বোনের মতো করে কে বোঝাবে ? এসব ভাবতেই তোহার চোখ উপচে জল গড়িয়ে পড়ছে।

রাজিব এসেছিলো দুপুরের খাবার খেতে সকলকে ডাকতে। কাল রাত থেকে কারো খাওয়া হয়নি। তোহার রুমে মিলিও ছিলো। সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কান্না করছে। রাজিবকে রুমের সামনে আসতে দেখেই তোহা দৌড়ে গিয়ে তার বুকে ঝাপিয়ে পরলো। রাজিবের শার্ট খামচে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
– ‘কি হয়ে গেলো এটা ? আমার ভাইটার কি হবে এখন ? ‘

রাজিব তোহার মাথায় আলতো করে একটা হাত রেখে বললো,
– ‘শান্ত হও তুমি প্লিজ। এভাবে আর কেঁদো না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সকলে দুর্বল হয়ে গেলে বাকিদের কিভাবে সামলাবে? সৌরভ কে দেখেছো?  ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না আমি।’

তোহা আর কিছু বললো না। সে রাজিবের বুকে মাথা রেখে কেঁদেই যাচ্ছে। এই মানুষটার বুকে এই মুহূর্তে একটু শান্তি খোঁজা ছাড়া তার আর কিচ্ছু করতে ভালো লাগছে না।

বিকেলে পুলিশ অফিসার আসলো। দরজা খুলে দিলো মিলি। অফিসার ভেতরে প্রবেশ করে বললেন,
– ‘সৌরভ সাহেব কে একটু ডেকে দিন। ‘
মিলি আবছা চোখে তাকিয়ে বললো,
-‘ দুলাভাই কি ডাকলেই আসবেন ? উনি তো কারোর সাথেই কথা বলছেন না। ‘

– ‘আমাকে উনিই ফোন করে ডেকেছেন।’

মিলি একটু অবাক হলো। তারপর অফিসারকে ড্রইং রুমে বসতে দিয়ে ডাকতে চলে গেলো সৌরভকে। 

– ‘আপনি অফিসার দেলোয়ার হোসেন ?’
ভারী গলায় বললো সৌরভ। তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চোখ মুখ ফুলে আছে। বোঝাই যাচ্ছে সবে মাত্র চোখে পানি দিয়ে এসেছে।

– ‘জি।’ দৃঢ় গলায় বললেন অফিসার।

অফিসার আবার বললেন,
– ‘আপনার স্ত্রীর বিষয়ে কিছু জানার ছিলো আমাদের।’
-‘ হ্যাঁ। বলুন। ‘

– ‘উনার কি পার্সোনাল কোন শত্রু ছিলো ?’
সৌরভ কিছু বললো না। তাকে চুপ থাকতে দেখে অফিসার বললেন,
– ‘দেখুন কাল আপনি স্বাভাবিক ছিলেন না বলে আপনাকে কিচ্ছু জানানো হয়নি। এখন চুপ থাকলে হবে না। এ বিষয়ে আপনার সাহায্য লাগবে আমাদের। ইটস অ্যা মার্ডার কেস।’

সৌরভ বিস্ময় নিয়ে তাকালো অফিসারের দিকে। মুখে কিছুই বললো না। মার্ডার শব্দটা তার মাথার ওপর যেন ভন ভন করছে। সে কাল নিজের মাঝে ছিলো না। ইনফেক্ট এখনো নেই। তবুও কাল একটা ঘোরে চলে গিয়েছিলো বলে কিচ্ছু জানা হয়নি। ছায়ার মতো একটা ভালো মেয়েকে মার্ডার করবে কে ! কে সেই ব্যক্তি? কেন মেরেছে তার ছায়াকে ? হাজার খানেক প্রশ্ন মাথার মাঝে জেঁকে বসেছে। যার কোন উত্তর তার কাছে  নেই। তার চোখের সামনে শুধু ভাসছে ছায়ার সেই নিষ্পাপ মুখটা।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে