এসো শব্দহীন পায়ে পর্ব ৭

0
996

এসো শব্দহীন পায়ে
পর্ব ৭
মিশু মনি
.
চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি নেমেছে। দমকা হাওয়াও সাথে তাল মিলিয়েছে। রূপসা ছাতা মাথায় দিয়ে গুটিগুটি পায়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটছে। এক মহিলা রূপসাদের ত্রিপল নিয়ে গেছে, সেটা ফেরত নিতে মা এই বৃষ্টির মধ্যেই রূপসাকে পাঠিয়েছেন।
সন্ধ্যা এখনো নামেনি। তবুও অন্ধকার। রূপসা খুব ধীরে পা ফেলছে যাতে পিছলে না যায়। আচমকা গাছের নীচে একটা ছায়ামানব দেখে চমকে ওঠে ও। ছায়ামানবের গলা শুনে পিলে চমকে যাবার পালা। সে আর কেউই নয়, তিতাস।

রূপসা ভয়ে ভয়ে কাছে এগোচ্ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল হয়তো মনের ভুল। কিন্তু সে নিজেই বৃষ্টির মধ্যে এগিয়ে এসে বলল, আপনি কি করে জানলেন আমি এখানে?
রূপসা অবাক ভঙ্গিতে বলল, আমি তো জানতাম না।
– কাছে আসুন। আমি ভিজে যাচ্ছি দেখছেন না?
রূপসা চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো কাউকে দেখা যায় কি না। যতদূর চোখ যায় শুধু ঝুম বৃষ্টি। কোথাও কেউ নেই। পাখিরাও আজ নিজের নীড় ছেড়ে বের হয় নি। তারমাঝে এই লোকটা এখানে কি করে এলো! এখনো মনে হচ্ছে এ রূপসার মনের ভুল ব্যতীত কিছুই নয়।

তিতাস বলল, আমাকে ছাতার নিচে নেয়া যাবে না?
– জ্বি।
রূপসা তিতাসের কাছে গিয়ে ছাতাটা ওর মাথার উপর ধরে রাখলো। মাঝখানে এক লম্বা হাত সমান দূরত্বের কারণে রূপসা নিজেই ভিজে যাচ্ছে। তিতাস ছাতাটা নিজ হাতে ধরলো। রূপসা হাত সরিয়ে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিতাস রূপসাকে ছাতার নিচে নিয়ে বলল, এই ঝড়ের মধ্যে আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
রূপসার মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছিল না। ভয় ও আড়ষ্টতা চেপে রেখেছে ওকে। মৃদু স্বরে বলল, ‘একটা কাজ ছিল তাই’। প্রত্যেকটা শব্দ আলাদা আলাদা করে উচ্চারণ করলো।

তিতাস বললো, আমি এই ঝড়ের মধ্যে এখানে কি করছি জিজ্ঞেস করবেন না?
রূপসা এবার দুটো শব্দ উচ্চারণ করলো কিন্তু দুটোই আলাদা আলাদা করে। কি – করছেন? কি ও করছেন এর মাঝখানে দশ সেকেন্ডের বিরতি দিয়ে।

তিতাস বললো, ভাগ্যিস আপনার সাথে এখানে দেখা হয়ে গেলো। সকালে তো ওয়েদার খুবই ভালো ছিল। ট্রেন থেকে নামার পরপরই এমন বৃষ্টির কবলে পড়লাম। কিন্তু আমাকে আবার রাতের ট্রেনেই ফিরতে হবে। কাজেই বৃষ্টিতে ভিজেই হাঁটা ধরেছি। এখানে এসে এত বেশি বৃষ্টিতে পেলো যে বাধ্য হয়ে দাঁড়াতে হলো। কিন্তু আমি কত ভাগ্যবান দেখুন, যার জন্য এতদূর ছুটে আসা, সে নিজেই ছাতা নিয়ে এসে হাজির।

রূপসার বুকের ঠিক মধ্যিখানে ঢিপঢিপ করে উঠলো। লোকটা যা বলছে তা কি আসলেই বলেছে? নাকি ভুল কিছু শুনে ফেলেছে ও। মনে এমনই প্রশ্ন নিয়ে তিতাসের চোখের দিকে তাকালো রূপসা। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা গেলো না। কি ভয়ংকর দৃষ্টি রে বাবাহ! এই অন্ধকারাচ্ছন্ন আলোতেও ঠিক বুকে এসে বিঁধে।

তিতাস বললো, কথাটা এখানেই শেষ করি?
– আপনি তো ঠান্ডায় কাঁপছেন। আপনার জ্বর হয়ে যাবে।
– হুম। তা অস্বাভাবিক কিছু না। জ্বর হলে তো আমি সার্থক।
– বুঝলাম না। আমাকে যাইতে হবে। দেরি হইলে মা রাগ করবেন।

তিতাস মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলল, শুনুন। আমি এত কষ্ট করে এসেছি শুধুমাত্র…

তিতাস কথা শেষ করতে পারলো না। রূপসা খপ করে ওর হাত থেকে ছাতাটা কেড়ে নিয়ে বলল, আমার চাচী আসতেছে।

তারপর এক দৌড়ে মুহুর্তেই অনেক দূরে চলে গেলো। টাল সামলাতে না পেরে কিছুদূর গিয়ে ধপাস করে পিছলে পড়ে গেলো রূপসা। তিতাস এগোতে গিয়েও থেমে গেলো। পাছে রূপসার কোনো বিপদের কারণ হয়ে যায়। শহরে মানুষ হলেও গ্রামের মানুষ ও পরিবেশ পরিস্থিতি সবকিছু ওর অজানা নয়। তাছাড়া আসার আগেই ছোটমামা এমন করে উপদেশ দিয়ে দিয়েছেন যে তিতাস সজ্ঞানে আজকে কোনো ভুল করবে না। কিন্তু রূপসা তো চলে গেলো। ওদের বাড়িতে কোনো ছুঁতোয় যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা কে জানে। মামা বলে দিয়েছিল যেন ছোট কোনো ছেলেকে পাঠিয়ে রূপসাকে বাইরে আসতে বলে। এই ঝড়ের মধ্যে কোনো ছেলেকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। রূপসাকে পেয়েও কথাটা বলা হলো না, ধেৎ। আবার এই পথে নিশ্চয় বাড়ি ফিরবে, বৃষ্টিতে ভিজেই পথের দিকে তাকিয়ে রইলো তিতাস।

রূপসা পিছলে পড়েও ওর বিস্ময় কাটছে না। এদিকে বুকে ধুকপুকানি। কি হবে, কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, সবকিছু কেমন যেন গোলমেলে পাকিয়ে যাচ্ছে। রূপসা বেশ বুঝতে পারছে তিতাস ওর জন্যই এসেছে। ওকে কিছু একটা বলতে চায়। কি বলতে চায় সেটাও আন্দাজের বাইরে নয়। ইস, এমন অস্থির অস্থির লাগছে কেন!

ত্রিপল নিয়ে ফেরার সময় গাছের নিচে ভালো করে তাকাচ্ছিল রূপসা। লোকটাকে আর দেখা গেলো না। সে কি চলে গেছে! বুকের বামপাশে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হলো। এসেই চলে গেলো? কিছু বলেও গেলো না যে!

মনটা খারাপ হতে শুরু করেছে। হুট করে উদয় হওয়া অস্থিরতাটা এখন ধীরেধীরে শীতল হয়ে যাচ্ছে। মনটা একেবারে মিইয়ে যেতে বসেছে।

রূপসা বাড়ি ফিরে বৃষ্টির জলে গোসল সেরে জামার ওপর একটা চাদর জড়িয়ে বসে রইলো। শীত শীত লাগছে। ওই মানুষটার না জানি কত শীত লাগছে! সে রেলস্টেশন থেকে ভিজতে ভিজতে এসেছে। কি অদ্ভুত! আচ্ছা, মানুষটা নিশ্চয় এই গ্রামেই কোথাও আছে। আবার আসবে নিশ্চয়ই। যে এত কষ্ট করে, এত পথ পাড়ি দিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে এসেছে, সে নিশ্চয় কথা না বলে যাবে না। রূপসা এতটুকু বুঝতে পারছে যে, সে কেন এসেছে। এখন রূপসাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। মনেমনে বললো, যদি আমার ধারণা ঠিক হয় তবে লোকটাকে কি উত্তর দেবো? লজ্জায় মরে যাবো, বুকের ভেতর উথাল পাথাল ঝড় শুরু হবে নাকি আমি ম্যালেরিয়া রোগীর মত কাঁপতে থাকবো? অবশ্য তাকে মুখ ফুটে কিছুই বলার দুঃসাহস আমার নেই। মনেমনে তারই প্রতীক্ষা করেছিলাম এ যেমন সত্য, তেমনই তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে এও সত্য। যদিও রূপসা এখনো জানেনা, সে আসলেই কি বলতে চায়।

অস্থিরতায় রূপসার রাত বাড়তে থাকে। এদিকে তিতাস মন্তাজ মাস্টারের বাড়িতে আবার আথিতেয়তা গ্রহণ করছে। তিতাস ভুল করেও এ বাড়ির ত্রিসীমানায় পা ফেলতো না। পথে দাঁড়িয়ে রূপসার জন্য অপেক্ষাই করছিল বেচারা, এমন সময় কোথ থেকে মন্তাজ মাস্টারের ভাইয়ের উদয় হলো। তিনি তিতাসকে সাদর সম্ভাষণে বাড়িতে নিয়ে এলেন। ওনার সামনে ‘আমি আপনাদের বাড়িতে আসিনি’ এটা বলাটাও বেখাপ্পা হয়ে যেত। এখানে আসলে এদের কারো সাথে দেখা হতে পারে, সে ভাবনা আগে ওর মাথায় আসেনি। এ জন্যই মামা বলে, তুই শুধু লম্বাই হয়েছিস কিন্তু বুদ্ধিটা হাঁটু পর্যন্তই থেকে গেছে, সেটা আর বাড়েনি।

তিতাস এখানে বসে ছটফট করছে। মন্তাজ মাস্টার সামনে বসে আছেন। টেবিলের উপর টিমটিমে আলোয় হারিকেন জ্বলছে। সোলারের চার্জ হয়নি বলে সোলার লাইট জ্বলছে না। সেটা নিয়ে মন্তাজ মাস্টার দুঃখপ্রকাশ করলেন। এ বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আছে, কিন্তু সামান্য ঝড় বাতাস হলেই সেটা দৌড়ে পালায়। হারিকেনের সুতোর দিকে তাকিয়ে একদৃষ্টে সেটার টিমটিম করে জ্বলার দৃশ্য উপভোগ করছে তিতাস। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে আছে।

মন্তাজ মাস্টার বললেন, তা বাবা আপনেরা তো আর কিছু জানাইলেন না। ঘটক সাহেব বলিছিলো আমাদের মেয়েকে আপনাদের পছন্দ হয় নি। কিন্তু আমি তো খাস দিলে দোয়া করিছি বাবা। সেইজন্য আপনি আবার ফেরত আসিছেন।

তিতাস শান্ত হয়ে বসে আছে। তার বাড়িতে আসেনি এই কঠিন সত্যটা কিছুতেই বলতে পারছে না। দারুণ এক মুশকিলে পড়া গেলো। এমন সময় মাথায় ঘোমটা টেনে ওয়ামিয়া ঘরে প্রবেশ করলো। হাতে নাস্তার ট্রে। সন্তর্পণে কাছে এসে টেবিলের উপর খুব সাবধানে ট্রে টা রাখলো যাতে একটুও শব্দ না হয়। তিতাস এখনো হারিকেনের দিকেই তাকিয়ে আছে।

মন্তাজ মাস্টার মেয়েকে বললেন, সাহেবরে সালাম দেও মা। উনি ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কষ্ট কইরা আসিছেন।
ওয়ামিয়া মৃদু স্বরে সালাম জানালো। তারপর পাশের ঘরে চলে গেলো। মন্তাজ মাস্টার বললেন, মেয়েটারে ডিগ্রী কলেজে পড়াচ্ছি। পড়াশোনায় খুবই ভালো আলহামদুলিল্লাহ। তার জন্য বহুত বিবাহের প্রস্তাব আসত, দেইনাই। বলছি যে, মেয়েটা আমার বড় হউক। আপনারে বাবা আমার এত ভালো লাগি গেলো, না করতি পারলাম না।

তিতাস সৌজন্যসূচক মুচকি হাসতে বাধ্য হলো। তবে সেই হাসিতে সৌজন্যবোধের বিন্দুমাত্রও ফুটে উঠলো না। মন্তাজ মাস্টারের অনুরোধে আবার নাস্তাও গিলতে শুরু করতে হলো। নাস্তা শেষ হলে লোকটা কিছুক্ষণের জন্য আড়াল হতেই তিতাস ফোন বের করে আগে বিস্তারিত লিখে মামাকে এসএমএস পাঠিয়ে দিলো।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে