এসো শব্দহীন পায়ে পর্ব ১১

0
973

এসো শব্দহীন পায়ে
পর্ব ১১
মিশু মনি

মেঘের উপর থেকে মেঘ দেখার দৃশ্য নিঃসন্দেহে অন্য সব সুন্দরের চেয়ে আলাদা। তিতাস উত্তেজনায় রীতিমতো লাফালাফি করতে চাইছে। পাশের সিটে ফ্রেরীহা শান্ত হয়ে বসে আছে। এই দৃশ্যে ওর তেমন কোনো ভাবান্তর নেই। তবে দৃষ্টি বাইরের দিকে।
তিতাস হাতের কাছে ক্যামেরা রেখেছে। ফট করে দুয়েকটা ছবি ক্যামেরায় ধারণ করে নিলো। আহ! এখন শান্তি লাগছে।

ফ্রেরীহা বললো, ‘ফটোগ্রাফারদের এই একটা প্রবলেম জানো তো? একটা অসাধারণ সিনেরি পেলেই হয়েছে। এনজয় করার চেয়ে ফটো শুট করাটা তাদের কাছে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।’
– ‘এটাই তো বুঝবে না মিস উইন্সলেট। ফটোগ্রাফাররা একটা দৃশ্যকে আজীবন একইরকম ভাবে ধরে রাখতে পারে।’
– ‘তাই? তো কোন ধরণের ছবি তুলতে ভালোবাসো তুমি? গাছ, জন্তু জানোয়ার নাকি পাখি?’
– ‘প্রকৃতিতে যা আছে সবকিছুর ছবি তুলতে ভালোবাসি।’
– ‘ওয়াও! তাহলে তো এই ওয়ার্কশপে তুমি টোটালি লাভবান হচ্ছো।’
– ‘তা জানি না। কারণ আমার মনে হচ্ছে ওখানে গিয়ে ওয়াইল্ডলাইফ ক্যাপচার করা হবে না। প্রকৃতিতে নতুন এক সৌন্দর্যের মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আমি শুধু সেটারই ছবি ধারণ করবো।’

ফ্রেরীহা বেশ নড়েচড়ে বসলো। তিতাসের কাছে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো, ‘প্লিজ বলো না আমাকে। প্রকৃতিতে কিসের নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে? প্লিজ বলো না?’
– ‘কেন? তুমিও ছবি তুলবে?’
– ‘হ্যাঁ। যদি সম্ভব হয়।’
– ‘সম্ভব হবে না মিস।’
– ‘কেন?’
– ‘কারণ নিজের ছবি নিজে তোলা যায় না।’

ফ্রেরীহা চমকালো। সেইসাথে মুখে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি। তিতাসের হাতে একটা ছোট্ট মাইর বসিয়ে দিয়ে বললো, ‘বলেছিলাম না জোকার? পুরাই একটা বাদর তুমি।’

তিতাস আঙুল দিয়ে দূরের এক খন্ড মেঘ দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘কত অপূর্ব তাই না?’
– ‘ তোমার বুঝি মেঘ দেখতে খুব ভালোলাগে?’
– ‘হ্যাঁ। কখনো তো এভাবে দেখা হয় নি।’
– ‘কেন? প্লেন জার্নিতে পাশে সুন্দরী মেয়ে না থাকলে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দাও?’

কথাটা বলেই হেসে উঠলো ফ্রেরীহা। তিতাস হেসে প্রত্যুত্তরে বললো, ‘এটাই আমার প্রথম প্লেন জার্নি।’
– ‘ওহ, সরি।’
– ‘ইটস ওকে। তুমি বড় হয়েছো কোথায়?’
– ‘নিউইয়র্কে। সতেরো বছর বয়সে আমি বাংলাদেশে চলে এসেছি। পাঁচ বছর ধরে এখানেই আছি।’
– ‘একা?’
– ‘না। মায়ের কাছে।’

তিতাসের ভীষণ আগ্রহ জন্মাচ্ছে ফ্রেরীহার প্রতি। ওর সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটা দেখতে খুব নিষ্পাপ। ফ্রেরীহার ছোট ছোট চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাওয়াতে ওকে আরো বেশি শুভ্র দেখাচ্ছে। তিতাস বিড়বিড় করে বললো, ‘মিস উইন্সলেট!’

১২
রূপসা উঠোনে গাছের ছায়ায় বসে ধান শুকোচ্ছে। আকাশে কড়া রোদ। ধানে যেন পাখি না বসে সেজন্য ওকে পাহারায় রাখা হয়েছে। আজকে বারবার উদাস চোখে পথের দিকে তাকাচ্ছিল রূপসা। ওর চোখ দুটো খুব করে সেই মুখটা খুঁজছিল, খুঁজছিল সেই পরিচিত পদচারণা। মানুষটা আর এলো না। কতগুলো দিন কেটে গেলো!

তবুও প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে চোখ বুজে রূপসা কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায়। দেখতে পায় হাজারো গল্প। একদিন হঠাৎ তিতাসের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠে ঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। তিতাস ধীরপদে কাছে এগিয়ে আসে। রূপসার খুব কাছে এসে আলতো করে ওর চিবুকে হাত রেখে বলে, ‘তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। যাবে আমার সাথে?’
রূপসা তিতাসের হাত ধরে বলে, ‘হ্যাঁ যাবো। আমার এখানে দম আটকে আসে। খাঁচায় বন্দি পাখির মত একটা জীবন আমার। কোনোদিনও ঘরের বাহির হইতে পারি না। আমাকে আপনি নিয়ে চলেন।’

তিতাসের হাত ধরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় ও। হারিয়ে যায় সমুদ্রের পাড়ে। সমুদ্র রঙের শাড়ি পরে, সাদা রঙের ব্লাউজ, চুলগুলো পিঠের উপর বিস্তৃত হয়ে থাকে। রূপসা তিতাসের হাত ধরে সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে বেড়ায়।

কখনো বা রান্নাঘর থেকে গরম গরম চালের আটার রুটি আর ডিম ভাজি করে তিতাসকে খেতে দেয়। দৌড়ে গিয়ে এক কাপ চা করে আনে। তিতাস খেয়ে বলে, ‘চা ভালো হয় নি।’ রূপসার মুখটা কালো হয়ে যায়।

রাত্রিবেলা রূপসা সেজেগুজে অপেক্ষা করে। তিতাস বাইরে থেকে ফেরার সময় একটা লাল টকটকে গোলাপ নিয়ে আসে। রূপসা গোলাপের ঘ্রাণ নেয়ার সময় তিতাস ওকে জড়িয়ে ধরে রাখে। কি সুন্দর একটা গল্পের মত জীবন।

এ সবই রূপসার কল্পনা। এরকম শত শত গল্প প্রতিদিন সাজায় ও। বই পড়ার ফাঁকে চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে থাকে। কখনো বা বৃষ্টির দিনে কাথা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে শুয়ে কল্পনা। দিবস রজনী ওর কল্পনাতেই কাটছে। বাড়ির বাইরে পা দেয়ার তো সুযোগ নেই। সারাদিন ঘরের কাজ করা, আর ফাঁকে সময় পেলে শুয়ে শুয়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া।

আজ পথের দিকে তাকিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপসা। মানুষটা হয়তো আর আসবে না। তবুও কেন তাকে নিয়ে এত স্বপ্ন? মেয়েদের মনটা হয়তো এমনই। অল্পতেই আবেগের স্রোতে টালমাটাল হয়ে পড়ে। যাকে চেনেই না, তার সামান্য সহানুভূতিতেই হৃদয়ে প্রেমের ফুল ফুটছে।

দুদিন পর চাচা রূপসাকে বললেন, ‘মা তোর টেবিলের উপর সাদা একটা খাতা ছিল। ওইখানে একটা ঠিকানা লিখে রাখছিলাম। দ্যাখ তো একটু বের কইরা দে।’
– ‘কার ঠিকানা চাচা?’
– ‘ওই যে আমাদের বাড়িতে এক কোঁকড়া চুলওয়ালা ছোঁকড়া আইছিলো না? ছবি তোলে। সে লিখে দিছিলো, ওর বাড়ির ঠিকানা।’

রূপসার বুকটা ধুকপুক করে ওঠে। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না। অজস্র প্রশ্ন মনে চেপে রেখে খাতায় ঠিকানা খুঁজতে লেগে যায়। প্রতিটা পাতা ওল্টানোর সময় ওর হার্ট খুব জোরে লাফ দিয়ে ওঠে। ঠিকানাটা বের করে কতক্ষণ হাত বুলায় লেখাটার উপর। কি সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা! কত পরিষ্কার। ঠিকানার নিচে একটা ফোন নাম্বারও দেয়া আছে। রূপসা উত্তেজনায় কাঁপছে। কাঁপা হাতেই আরেক পৃষ্ঠায় ফোন নাম্বারটা টুকে রেখে ঠিকানাটা চাচাকে দিলো। ওর এখনো বুক কাঁপছে। এই ঠিকানা দিয়ে চাচা কি করবে সেটা জানার আগ্রহ আর দমিয়ে রাখতে পারছে না।

চাচা ঠিকানা নিয়ে রূপসার দিকে তাকিয়ে দেখলেন মেয়েটা ঘামছে। চাচা বললেন, ‘কি রে মা?’
– ‘চাচা, এই ঠিকানা দিয়া আপনি কি করবেন?’
– ‘একটা কাজ আছে আরকি।’

রূপসার ধুকপুকানি আরো বেড়ে গেলো। উৎসুক চোখে চাচার দিকে তাকিয়ে রইলো। খপ করে চাচার হাত ধরে বললো, ‘কি কাজ চাচা?’
– ‘আরে আছে আছে। অন্য একটা কাজে যাবো। ওরা তো বাসায় যাইতে বলছিল, তাই সুযোগ পাইলে যাবো একবার। এই আরকি।’

চাচার উত্তর শুনেও সন্তুষ্ট হলো না রূপসা। ওর কেবলই মনে হতে লাগলো চাচা কিছু একটা লুকাচ্ছে। ওরা হয়তো চাচাকে ডেকেছেন। কিংবা কিছু একটার ইঙ্গিত দিয়েছেন। রূপসার মনে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠলো। চাচা বাড়িতে ফেরার সময় বিবাহের কথাবার্তা বলে ফিরবেন। এমন মনে হচ্ছে! স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না রূপসা। দ্রুত নিজের ঘরে এসে দরজা আটকিয়ে দিলো। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশ বুকে চেপে ধরে বিড়বিড় করে বললো, ‘আমার কি হচ্ছে! আমার এমন অস্থির লাগছে কেন! কি হয়ে গেলো আমার!’ এখন শুধুই অপেক্ষা। চাচা ওই বাড়িতে গিয়ে যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। আর ধৈর্য ধরতে পারছে না ও।

১৩
আজ তিতাসের ক্যাম্পিং শুরু। বনের ভেতর তাঁবু বসিয়ে সবকিছু গুছিয়ে নেয়া হচ্ছে। কাজ করে সবাই মোটামুটি ক্লান্ত। তিতাস পানি খাওয়ার জন্য বোতল বের করেছে, ফ্রেরীহা এসে বললো, ‘আমাকেও দাও।’
ফ্রেরীহার চিবুক, কপাল ও গলায় ঘামের বিন্দু জমেছে। কি অপূর্ব লাগছে দেখতে! সূর্যের সোনালী আলো ওর গালে লেগে গালদুটো চিকচিক করছে। ফ্রেরীহা বললো, ‘কি হলো দাও?’
তিতাস পানির বোতল এগিয়ে দিলো। ফ্রেরীহা ঢকঢক করে এক বোতল পানি শেষ করে দিয়ে বললো, ‘সরি। শেষ করে ফেলেছি।’
– ‘আই এম ব্লিসড।’
– ‘আমাদের ক্যাম্পিংয়ের প্লেসটা একদম পারফেক্ট হয়েছে তাই না?’
– ‘হুম। তোমার বেড গোছানো হয়ে গেছে?’
– ‘ইয়াহ। দেখবে?’

ফ্রেরীহার তাঁবুর ভিতরে ঢুকে তিতাস অবাক। কত সুন্দর করে গুছিয়ে ফেলেছে এরমধ্যেই। অথচ ওর তাঁবুর ভেতরে সব অগোছালো অবস্থায় পড়ে আছে। ফ্রেরীহা বললো, ‘আমাদের ওয়ার্কশপ কবে থেকে?’
– ‘ওসব বাদ দাও। আগে বলো এত সুন্দর করে এটা ডেকোর করলে কিভাবে? আমার টার অবস্থা চরম বাজে।’
– ‘হা হা। দ্যাট ইজ হোয়াই আই এম ওমেন এন্ড ইউ আর ম্যান। ওকে?’

তিতাস হেসে বললো, ‘আমাকে হেল্প করো না প্লিজ। আমার ক্যাম্পিংয়ের এক্সপেরিয়েন্স নেই। প্লিজ?’
– ‘ওকে।’

তিতাসের তাঁবুর ভেতর ওর বিছানাপত্র সুন্দর করে গুছিয়ে দেয়ার পর একদিকে ছোট্ট র‍্যাকে জিনিসপত্র গুলো গুছিয়ে দিচ্ছিলো ফ্রেরীহা। তিতাস বিছানায় শুয়ে এক হাতের ওপর ভর দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছে।
ফ্রেরীহা বললো, ‘ডান। কেমন লাগছে?’
তিতাস সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ফ্রেরীহার চিবুকের উপর হেলে পড়া বাদামী রঙের চুলগুলো হাত দিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করে বললো, ‘এটা আসল না নকল?’

ফ্রেরীহা হাসতে হাসতে বললো, ‘পুরোটাই আসল। টান দিয়ে দেখতে পারো।’
– ‘নো নো। এত সুন্দর বাদামী চুল।’
– ‘তোমার আমাকে ভালো লাগে?’

তিতাস চমকে উঠলো। কি বলবে বুঝতে পারলো না। ফ্রেরীহা ব্যাখ্যা করে বললো, ‘না মানে ফর্সা রং ভালো লাগে?’
– ‘লাগে। কেন?’
– ‘আমার ব্লাক পিপলস দের খুব ভালো লাগে। ব্লাকস আর বিউটিফুল।’
– ‘আই এম ব্লাক।’

ফ্রেরীহা হাসিতে ঢলে পড়ে বললো, ‘আমাদের টিমে একটা আফ্রিকান আছে না? ওরকম ব্লাক ভালো লাগে।’
তিতাস হতাশ হওয়ার ভান করে বললো, ‘কেন আরেকটু কালো হলাম না বিধাতা?’

ফ্রেরীহা আবারও হেসে উঠলো। তারপর তিতাসের পাশে চিৎ হয়ে শুয়ে বললো, ‘আমি ভাবিও নি এখানে তোমার মত একজন বন্ধু পেয়ে যাবো। আই এম সো লাকি।’
– ‘আমিও। লাস্ট তিনটা দিন খুব ভালো কাটিয়েছি আমরা। তাই না?’
– ‘হুমম। জানো, আমি আমার লাইফটা খুব একা কাটিয়েছি। একদম বন্ধুহীন ভাবে। আমার কাছের কোনো বন্ধু ছিলো না।’

তিতাস অবাক হয়ে বললো, ‘তোমার মত মিশুক মেয়ের কাছের বন্ধু ছিলো না?’
– ‘না। নিউইয়র্কে আমি খুব ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম। ছেলেদেরকে পাত্তা দিতাম না। বাংলাদেশে গিয়ে বুঝতে শিখেছি বন্ধু আসলে কেমন হয়।’
– ‘বাংলাদেশে তোমার বন্ধু হয়েছিল?’
– ‘হুম। কিন্তু সব রেপিস্ট দের দল। সবার শুধু আমার শরীরের দিকে আকর্ষণ। একটা বিশ্বস্ত বন্ধু খুঁজে পাওয়া টাফ।’

তিতাস উঠে বসলো। খুব মিষ্টি হাসি ভরা মুখে ফ্রেরীহার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমি মেয়েদেরকে অনেক রেস্পেক্ট করি। আমাকে মানুষ হিসেবে তোমার কেমন লাগে?’
– ‘যতটুকু জেনেছি, তুমি মানুষটা খারাপ না।’
– ‘বিশ্বাস করার জন্য ধন্যবাদ। আশাকরি তোমার বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখবে।’

ফ্রেরীহা মুচকি হেসে তিতাসের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তিতাসও ফ্রেরীহার চোখ থেকে চোখ সরাতে পারলো না।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে