এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_১৪

0
1840

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_১৪
লেখনিতে: চৈত্র রায়

২৮
,
,
,
যম ঠাকুর তার কথায় বহাল রইলেন এবং পরদিন যথারীতি আমাকে টেনে হিচড়ে গাইনি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেন….. বলা বাহুল্য আমার সমস্যা গুলো আমার থেকে ওনি বেশ সাবলীল ভাবেই মহিলা ডাক্তারের সাথে আলোচনা করলেন….. আমার অবস্থা দেখে ডাক্তার কয়েক মিনিটের জন্য ওনাকে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন….. তারপর একেএকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেই ক্ষান্ত হলেন….. কোন সমস্যা না পেয়ে ওনি বেশ কিছু কায়দা আর নিয়ম শিখিয়ে দিলেন….. কিভাবে চলতে হবে কি কি এরিয়ে চলতে হবে….. সব…. এবং ব্যাটা যম ঠাকুর সব গুলা কথা পারে না একেবারে হা করে গিলছে…..আমিই শুধু বসে বসে লজ্জায় কাচুমাচু খাচ্ছি…..
,
,
,
দুদিন পর আম্মু ফিরে এলেন ফুলি খালাকে নিয়ে….. সাথে করে নিয়ে এলেন রাজ্যার সব ফলফলাদি….. বড় আপুর শ্বাশুড়ি ই সব নাকি নিজে দাড়িয়ে থেকে গাড়িতে বোঝাই করে দিয়েছেন…… আম্মু বাড়ির নিচ তলায় দাড়িয়েই সব ভাগ বাটোয়ারা করতে শুরু করে দিলেন…. বাড়ির দাড়োয়ান থেকে শুরু করে ভাড়াটিয়া, নতুন রান্নার খালা এমনকি ড্রাইভার পর্যন্ত ও এর ভাগ পেয়েছেন….. সেদিন ফুলি খালাকে আর আটকান নি আম্মু…. ওনাকে ওনার ভাগ বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন….. সেদিন সন্ধ্যায় যম ঠাকুর ফিরে এসে আম্মুকে দেখেই ঘেমে নেয়ে যাওয়া শরীরে বেশ অনেকটা সময় জড়িয়ে ধরে রইলেন….. আম্মু ও বাবু এটা, বাবু সেটা… হাজার হাজার গল্পের ঝুড়ি নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন…. ওনিও বেশ গুরুত্ব সহকারে মনোযোগ দিয়ে কথা শুনে যাচ্ছে…. তাদের মা ছেলের এতো স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক দেখে মনে হচ্ছে আমি টিভি চ্যানেলের কোন জনপ্রিয় পারিবারিক মূহুর্ত উপভোগ করছি…..আশেপাশের সকল দুনিয়া ভুলে ওনারা মা ছেলেতে মন উজার করে শত শহস্র গল্পের হাট খুলে বসেছেন….. রাতে খাবার টেবিলে বসে আম্মু বড় আপুর বাড়ির গল্প ফের জুড়ে দিলেন….. ওনার কথা শুনেই বেশ বুঝা যাচ্ছেন খুব মিস করছেন আপুকে…..আমি মানুষটাকে দেখে বারংবার অবাক হই…..আপুতো তার নিজের সন্তান নয়….. অন্যার সন্তানের জন্য এতো মায়া….!!! মানুষটাকে যতবার দেখি ততবারই মনে হয় এখনো অনেক অবাক হবার বাকি আছে আমার…..
,
,
,
খাবার টেবিল গুছিয়ে ড্রয়িং রুমে যেতেই দেখলাম আম্মুর পায়ে মালিশ করে দিচ্ছেন ওনি….. আমাকে দেখেই বললেন টুকি যাতো নারকেল তেলের বোতল টা নিয়ে আয়….. আজ বড্ড শ্বাশুড়ি হয়ে সেবা যন্ত নিতে ইচ্ছা করছে….জামাই বউ মিলে হাত চালা জলদি…..আম্মুর কথা শুনে আমার পেট ফেটে হাসি আসছে…. এতো মজা করে কথা বলতে পারেন…. আমি খুব আগ্রহ নিয়ে আম্মুর মাথায় তেল মালিশ করছি…. আর যম ঠাকুর পায়ের কাছে বসে পা মালিশ করে দিয়ে আম্মুর পায়ের নখ কেটে দিচ্ছেন…… ওনি ওনার কাজ শেষ করে সোফায় বসেই বললেন……
,
,
,
——— শ্বাশুড়ি সেবা শেষ করে একটু পতি সেবায় নিয়োজিত হবা বুঝলা….!পতি সেবা হচ্ছে পরম ধর্ম….
,
,
——— বাবু স্ত্রীর যত্ন নেওয়া কিন্তু একজন আদর্শ পতির কর্ম…. জানিস তো!!! তুলি তোকে তেল মালিশ করে দেবার পর তুই ও ওর মাথায় তেল দিয়ে দিবি!! নাকের উপর থেকে আঙুলের ডগায় করে চশমা টা চোখে পড়ে….
,
,
——— তোমার কপাল ভালো বুঝলে…. আমার মতোন একখানা জামাই পাইছো….
,
,
——— সে তো তর কপাল ও বড্ড ভালো রে বাবু…. আমার মতন একখানা এতো ভালো মা আর টুকির মতোন একখানা লক্ষিমন্ত বউ পেয়েছিস
,
,
——— বাহ…. দল করা হচ্ছে…. বউ শ্বাশুড়ি মিলে!!!আগে তো ফুলি খালাকে হেল্পার করেছিলে…. তা এই মাথা মোটা টাকে কি পদ দিলে!!
,
,
——— খবর দার বাবু আর যদি দেখেছি আমার মন্ত্রীর মাথায় চটি মারতে….তুই পেয়াদা পেয়াদার মতন থাক….. বেশি বেশি করলে কিন্তু শোলে চড়াবো…..
,
,
——— না…. বেশ নির্যাতন হয়ে যাচ্ছে আমার উপর….. তোমরা অত্যাচারী স্বৈরশাসকেরা বেশি দিন না…. তারপর আমিও দল ভারি করছি আমার…. আমাকে চোখ মেরে
,
,
,
ব্যাপার টা কি হলো ঠিক কিছুই বুঝলাম না….. আম্মুর দিকে তাকাতেই দেখলাম ওনি মুখ টিপে লুকিয়ে হেসে যাচ্ছেন….. ততক্ষণে আমি যম ঠাকুরকে মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছি….
,
,
,
——— কিরে টুকি আসার পর থেকেই লক্ষ্য করে যাচ্ছি তোকে কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।।।। চোখ কেমন বসে আছে….. খাওয়া দাওয়া করিস না ঠিক মতো!!
,
,
——— আম্মু ও তিনদিন ধরেই সিক…. কিন্তু তোমার টুকি সময় পেলেই জান জীবন দিয়ে ঘুমাচ্ছে….
,
,
——— ও দূর্বলতার থেকে হচ্ছে….
,
,
আম্মু ওনার সাথে কথা বলেই আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় করতেই আমিও ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম…..ওনি কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে চলে গেলেন আর যাবার আগে বলে গেলেন যম ঠাকুরকে যেনো দুধ গরম করে দেয় আমকে….এই দায়িত্ব টা যে ওনি বেশ ভালো ভাবেই করে তা তো আর আম্মু জানতেন না…..সেদিন সব কাজ শেষ করে যখন আম্মুর কাছে গিয়েছিলাম কিছু লাগবে কি না দেখতে…. গিয়ে দেখি আম্মু সজাগ….. আমি যেতেই আমাকে পাশে বসিয়ে নিজে উঠে বসলেন….. তারপর পাশের টেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললেন ———
,
,
,
——— এই কয়দিন খুব ধকল গিয়েছে রে টুকি তর উপর…… মেয়েটাও এমন ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লো…… তর ও তো নতুন জায়গা…… এরপর থেকে আমি মাথায় রাখবো রে টুকি……
,
,
——— না আম্মু….. আমার কোন সমস্যা হয় নাই….. ওনি আমাকে কাল জোড় করে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে এসেছে….. খুব লজ্জা পেয়েই কথাখানি বললাম
,
,
——— বেশ ভালো করেছে….. জানিস আমাদের বাড়ির সবাই কিন্তু বিজ্ঞানের ছাত্র….. সাদাফ যখন নাইনে পড়ে তখন আমাকে একদিন হুট করে এসে জিজ্ঞেস করছে আম্মু এই ঋতুস্রাব কি!! এইটা নাকি শুধু মেয়েদেরই হয়…..প্রথমে কিছুটা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতেই বললো বইয়ে নাকি পেয়েছে…… তারপর ওকে যখন সব খুলে বললাম ওমা ছেলের সেকি কান্না…… কাদতে কাদতে জড়িয়ে ধরে বলছে আম্মু তোমার খুব কষ্ট হয় না!!! এরপর থেকে আমাকে বলবা আমি তোমার সব কাজ করে দিবো তোমার কিছু করতে হবে না…… এরপর থেকে শুরু হয়েছে এই নিয়ে তদারকি…. আম্মু এটা খাবা… এটা করবা না…. এই নাও এটা খাও….. সারাদিন আমার পেছনে ঘুরঘুর করতো……. তারপর তো ইন্টার দিয়ে আমার আধখানা কলিজা ছিড়ে এই ঢাকায়…… ছেলেটা বড্ড নরম মনের রে….. ওরে কোনদিন কষ্ট দিস না টুকি…..নিজের ছেলে বলে বলছি না….. একদিন তুই নিজের মুখে স্বিকার করবি…..তুই কি পেয়েছিস…… নে যা এবার ঘুমাতে যা….. কথা শেষ করে পেছন থেকে দুটো বেণি ঘাড়ের দুপাশে ফেলে……
,
,
,
এই দুই বেণি দেখে যম ঠাকুর সমানে খিলখিল করে হেসে যাচ্ছে….. বিছানার সামনে যেতেই বেণি দুইটা টেনে একদম নিজের কোলের উপর নিয়ে শুয়ে পড়লো…..
,
,
,
২৯
,
,
,
সময় যে কিভাবে পার হয়ে যাচ্ছে টেরই পাই না….. দিনের বেলা ফুলি খালা আর আম্মুর সাথে জমিয়ে আড্ডা….. বিকেলে আম্মুর সাথে হাটতে বের হওয়া….. মাঝেমধ্যে মায়ের সাথে দেখা করতে যাওয়া আম্মু আর ফুলি খালাকে নিয়ে….. বা কখনো মা-বাবার স্বয়ং উপস্থিতি এভাবেই দিব্যি কেটে যাচ্ছিলো সময়…….যম ঠাকুর গুনে গুনে সাত দিন পর বগলদাবা করে আমাকে নিয়ে কলেজে ছুটলেন…..কই বিয়ে করেছি সংসারি করবো বাচ্ছাকাচ্চা মানুষ করবো তা না…. এখনো এই পড়াশোনা আমার পিছু ছাড়লো না……. রোজ সাথে করে কলেজ নিয়ে যাবে…. আমার সাথে ফিরতে না পাড়লে গেইট থেকে রিক্সা করে দিবেন….. তারপর বাড়ি ফিরে আদর্শ লিপির বাচ্চাদের মতন বই নিয়া বসাবেন….. তখন বাই এনিচান্স ওনার কোন বন্ধু ফোন করলে আমার ইজ্জতের জগাখিচুরি বানিয়ে বলবেন ———
,
,
,
——— নারে ভাই বউটারে মাত্র পড়তে বসাইছি….. ছোট মানুষ…. একটু পর আবার খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হবে…… হাহ…. আমার কতো কাজ….. আগের মত আছি বল!! এখন বিয়ে করেছি….. বউকে তো কোলে পিঠে করে মানুষ করা লাগবে…. নাকি!!! অনেক দায়িত্ব…. ফোন রাখ…. ডিস্টার্ব করবি না….
,
,
,
ওনার এই কথা শুনে আমি লজ্জায় পারিনা টেবিলের নিচে ঢুকে বসে থাকি….. কোন মানে হয় এই বাজে কথা গুলোর….. একেতো আমি বিবাহ শোক পালন করছি বই নিয়ে তার উপর ওনি এভাবে আমাকে নাস্তানাবুদ করছেন….. রোজই এভাবে চলে তার এই পড়াশোনার অত্যাচার….. বই নিয়ে না বসলে আম্মু ও বকা দেয়…. আমি মন খারাপ করি…. খুব মন খারাপ হয়…. এর মধ্যেই একদিন বারোটা বাজে মা ফোন দিয়ে জানালেন যে নানু মারা গেছেন। আমি সবেমাত্র কলেজ থেকে ফিরেছি….. মা-বাবা রউনা দিয়েছেন….. ফোনে আম্মুর সাথে কথা বলে শুধু নানির চেহারাটাই চোখে ভাসছে…. ওনার বলা প্রতিটি কথা রেকর্ডের মতোন কানের কাছে বেজেই চলেছে….. মনে হচ্ছে নানি নিজে প্রত্যেকটা কথা আমার পাশে বসে বলছেন….. এই একটা মানুষ যার কাছে আমি সাবলিল…. যে আমাকে সবচেয়ে প্রাধান্য দিতো…. বিয়ের কথা নানিকে জানানোর পর সর্বপ্রথম নানি মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি রাজি আছি কি না….. বিয়ের পর প্রথম যেদিন গেলাম যম ঠাকুর কে দেখে আমার কাছে চুপিচুপি বসে কত কথা বলেছেন….
,
,
——— বইন জামায়ের মন রক্ষা কইরা চলবা…. শ্বাশুড়ি যা মানতে বলে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবা…. মায়েরা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না বইন….. জামাই তোমার লাখে একটা…. খুব বালা মনের মানুষ…. আমি জানি হেয় বাইচা থাকতে তোমার কোন কষ্ট হবে না…..
,
,
,
কতো কথা বলেছেন….. কত মশকরা করেছেন….. অথচ মানুষ টা নাকি নাই….. আমার হাউমাউ কান্না শুনে আম্মু ছুটে এলেন সাথে ফুলি খালাও….. হেচকি তুলতে তুলতে সব খুলে বললাম….. আম্মু মাকে ফোন করে বললেন এক সাথে যাওয়ার কথা কিন্তু তারা বেশ অনেকটা এগিয়ে গেছেন…… এদিকে আম্মু আমাকে নিয়ে একা যাবার সাহস করতে পারছেন না…. তারউপর ওনি ও সেদিন ফোন বাসায় ফেলে গেছেন ভুলে….. আমি কোনমতেই নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না কি করেই বা পারবো….. দাদা দাদির কথা মনে নাই…. নানু খুব ছোটবেলাতে মারা গেছেন….. মায়ের চাকরির জন্য নানির কাছেই আমার বেশি থাকা হয়েছে…… এই মানুষটা যে আমার কত বড় অবলম্বন তা আমার আল্লাহ জানে….. অথচ এই মানুষ টাই নাই….. কেমন যেন দুঃস্বপ্ন লাগছে সব কিছু…..ওনি ফিরে এলেন দুপুর দুটোর দিকে….. আমি তখন আম্মুর বুকের উপর মাথা রেখে এলোমেলো হয়ে বসে আছি…..
,
,
,
——— আম্মু তুলির কি হয়েছে!! ও এভাবে বসে আছে যে!!!
,
,
——— বাবু টুকির নানি ভোরে মারা গেছেন
,
,
,
আম্মু আর ফুলি খালা মিলে সবটা খুলে বললেন ওনাকে….. সব কিছু শুনে ওনি ঠিক করলেন আমাকে নিয়ে যাবেন……কিন্তু ততক্ষণে বাবা ফোন করে জানালেন নানিকে মাটি দেওয়া হয়ে গেছে….. কথাটা শুনেই নানির কাফনে ঘেরা মুখটা আমার মানসপটে ভেসে উঠলো …… নিজেকে আর কোনমতেই আটকে রাখতে পারলাম না….. নানিকে শেষ দেখাটা হলো না….. আমাকে এতো ভালোবাসতো মানুষ টা…. তার মুখটা দেখার ভাগ্য হলো না আমার….. আমি কি পাপ করেছিলাম আল্লাহ….. এভাবে শাস্তি কেন দিলা আল্লাহ….. আম্মুকে ছেড়ে আমি মাটিতে লুটিয়ে কান্না করে যাচ্ছি…. কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে….. কারো কোন খেয়াল নেই আমার….. আম্মু এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে থামানোর চেষ্টা করলেন….
,
,
——— টুকি থাম মা…. এভাবে কাদতে নাই…. মা…
,
,
——— আম্মু আয়ায়ায়ামিইই ক্ককি করবো….. আমারতো ভভেতর টা ছিড়ে যাচ্ছে….. নানিকে আমি শেষবারের মতন দেখতে পারলাম আম্মু….. আমি…..
,
,
——— কাদিস না মা আমার মাথা ব্যাথা করবে…. অসুস্থ হয়ে পড়বি……
,
,
,
হাউমাউ করে কান্না করার পর একপ্রকার নেতিয়ে আগের মতোই আম্মুর বুকেই হেলান দিয়ে বসে আছি….. গলার স্বর বসে গেছে…..মাথা কোনমতেই সোজা করতে পারছি না….. রুমে আর কে আছে আমার কোন হেলদোল নেই…..ফুলি খালা এসে আমার কাধে কাপড় তুলে দিলেন কোল থেকে…… চোখ খুলে নিজেকে রুমে পেলাম….. ওনি তখন রুমেই ছিলেন….. স্টাডি টেবিলের চেয়ারটায় বসে হাটুর উপর দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে….আমাকে উঠতে দেখে আমার কাছে এগিয়ে এলেন…..
,
,
——— এখন কেমন লাগছে!!! আম্মুর কাছেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে…..
,
,
আর কি বললো আমার মাথায় ঢুকছে না….. ভেতর টা হু হু করে উঠছে…. কি যেনো নাই নাই একটা হাহাকার….. হুট করেই ওনি আমায় জড়িয়ে ধরলেন……
,
,
——— এবার আমি ভয় পাচ্ছি তুলি….. তুমি প্লিজ একটু স্বাভাবিক হও…..
,
,
ওনার কথা বলার মাঝেই আম্মু রুমে খাবার নিয়ে এলেন….. সাথে ফুলি খালাও…..ওনাদের দেখে যম ঠাকুর আমায় ছেড়ে বিছানা থেকে উঠে গেলো….. ফুলি খালা একটা ভেজা গামছা দিয়ে মুখ মুছিয়ে হাতে জলের গ্লাস দিলেন…… আম্মু ভাত মাখিয়ে মুখের সামনে ধরতেই আমি পিছিয়ে গেলাম….
,
,
——— টুকি সেই কোন সকালে কয়টা পাউরুটি খেয়েছিস….. এখন রাত নটা বাজে মা….. একটু খেয়ে নে….. তোর ঘুম দরকার ছিলো বলেই আমি জাগাই নি….. আম্মুর কথা রাখবি না…!!! একদিন তো আম্মু ও নানির মতন চলে যাবো….. তখন কে এভাবে খাতির করবে বলতো…..
,
,
আম্মুর কথাটা আর বাড়াতে দিলাম না…. দুই তিন নলা মুখে নিয়ে আর খেলাম না…. আম্মু ও আর জোড় করলেন না….. রাতে হাত মুখ ধুইয়ে কিছু সময় বারান্দায় বসে ছিলাম….. যম ঠাকুর তখন খেতে গিয়েছে….. নানির কথা ফের মনে পড়ছে….. নানা মারা যাবার পর প্রায়ই একটা কথা বলতেন…..
,
,
——— বইন তোর নানা রোজ রাইতে আমার স্বপ্নে আসে…. আমায় শিয়রের পাশে বইয়া সবার কথা জিগায়…..
,
,
নানির এই কথা শুনে তুলি কতো বুঝিয়েছে ওগুলো স্বপ্ন নানি…. তুমি নানাকে সারাদিন ভাবো তো তাই অমন দেখো…. কিন্তু কে শুনে কার কথা…. নানি বিশ্বাস করতেন নানা সত্যিই আসেন…..
,
,
,
রাতে ওনি রুমে এসে আমার পাশে বসতেই বললাম ———
,
,
——— আমাকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরবেন তখন কার মতন করে….. ভেতর টা না আমার খুব পুরছে…. আমার বলা কথা ওনি বুঝা মাত্রই খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন….তারচেয়ে বেশি শক্তি দিয়ে আমিই ওনাকে খামচে আকড়ে ধরলাম…. আমার মাথায় ওনার হাত বুলিয়ে যাওয়াটা একেবারে পরম শান্তির মতন লাগছিলো সেদিন.
,
,
,
৩০
,
,
,
নানি মারা যাবার পর থেকেই আমার উদাসীনতা আর অন্যমনস্কতা বেড়ে গেলো….. যম ঠাকুর ও আগের মতন জোর করে না পড়াশোনা নিয়ে…..এর মধ্যে দুদিন আমাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছেন ওনি…..কেন যেন কোন কিছুতেই নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছিলাম না….. নানির কথাগুলো হুটহাট কানে বাজে…. তখন মনে হয় আশেপাশেই আছে….. ভুলতে পারি না….. কিভাবেই বা ভুলবো…. আমার নিজের মা ও আমাকে ওতোটা যত্ন করে নি যতটা নানি করেছেন…… ওনার মৃত্যুটা খুব পুড়ায় আমায়….. তার চেয়ে বেশি পুড়ায় ওনাকে শেষ বারের মতোন না দেখাটা…. মা এর মধ্যে এসেছিলেন আমাকে নিতে…. কয়দিন বাড়ি ঘুরে এলে হয়তো ভালো লাগবে….. কিন্তু যম ঠাকুর দেয় নি….. আম্মু ও বাধ সাধেন….. মা সেদিন সারাদিন আমার সাথে থেকে একাই ফিরে গেলেন……
,
,
,
ওনার জয়েনিং ডেট এগিয়ে এসেছেন….. কলেজের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দিয়েছেন….. হাতে সপ্তাহ খানেকের সময় থাকায় আম্মু ঠিক করলেন আমাদের নিয়ে গ্রামে যাবেন….. ওখানে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা প্রয়োজন…… এতে করে হাওয়া বদল হবে…..আমার সব গোছগাছ আম্মু আর ফুলি খালা মিলে করে দিলেন….. মা বাবাকে ও আম্মু সাথে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু মায়ের চাকরি বাবার কি যেন কাজ পড়েছে তাই আর যাওয়া হয় নি…..
,
,
,
রূপসী গ্রাম টা একেবারে জীবনানন্দের রূপসী বাংলার মতন…. গ্রামের মাটিতে পা দিতেই কেমন যেন পরিশুদ্ধ লাগছে সতেজ নির্মল মনে হচ্ছে নিজেকে….. এতো নির্মল পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্য আর শুদ্ধতার মধ্যে যম ঠাকুরকে একেবারে নতুন করে আবিষ্কার করলাম যেনো ….. যেকটা দিন ছিলাম মানুষ টা একেবারে দু’হাতে আগলে রেখেছেন আমায়……এখানে এটা চলে না…. ওনার সাথে ওভাবে কথা বলবে…. মাথায় ঘুমটা টানো…. এটা এভাবে করবে সব…. তারপরে রাতের বেলায় লুকিয়ে বাগান বিলাশ তো আছেই….. ওনার এই আগলে রাখা,কথা না শুনলে চোখ রাঙানো… ধমক দেওয়া, হুটহাট করে কাছে আসা,জড়িয়ে ধরে পিষে ফেলা, বিনা নোটিশে চুমু খাওয়া সবকিছুতেই কেমন যেনো একটা ভালোলাগা ধরে গেছে…..আজকাল তো ওনার মুখে নিজের নামের উচ্চারণ টার ও প্রেমে পড়ে গেছি…..ভালোবেসেছি কি না জানি না…. তবে ওনাকে যে আমি আমার সর্বস্বদিয়ে নিজের মধ্যে ধারণ করছি তা আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি….
,
,
,
,
,
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে