এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৬

0
1968

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৬
লেখনিতে: চৈত্র রায়

১১
,
,
,
বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে মুরুব্বি রা সবাই দোয়া দারুদ পড়ে আর দেরি করলেন না….. আকাশে মেঘ করেছে….. যেকোনো মূহুর্তে বৃষ্টি নেমে পরবে…… শিমুল ভাই তার বিদেশ থেকে আনা ক্যামেরা দিয়ে আমার আর সাদাফ ভাইয়ের বেশ কয়েকটা ছবি তুললেন….. দুজনই সোফায় বসা…… লজ্জায়….. অভিমানে মাথাই তুলতে পারছিলাম না….. যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি জেগে জেগে সেই আজ আমার সামনে বসে আছে অন্য জনের সাথে স্মৃতি গড়ে দিতে….. অথচ এই পাশে বসা মানুষটাই আমার কাছে অবাঞ্চিত…. তাকে আমি চাই নি….. ঘুনাক্ষরে ও না….. চোখ ফেটে কান্না চলে এলো যখন শিমুল ভাই বললেন তুলা এদিকে একটু হাসি হাসি করে তাকা….. ভাইয়া ইফ ইয়ো ডোন্ট মাইণ্ড মাঝখানের গ্যাপ টা ছবিতে ভালো লাগছে না…. সাদাফ ভাই আমার গা ঘেষে বসলেন না তবে মাঝখানের দূরত্ব টা বেশ কমিয়ে সুন্দর করে বসলেন…… শিমুল ভাই আবার বললেন তুলা তোর মুখ টাই দেখা যাচ্ছে তাকা জলদি আমার হাটু ব্যাথা করছে এইভাবে বসে থাকতে থাকতে …… তখন আমার কি হলো জানি না।।।।। দু হাতে মুখ চেপে হু হু করে কেদে উঠলাম…..
,
,
,
মুরুব্বি রা সবাই আশেপাশেই ছিলেন….. কান্না শুনে সবাই এদিকে চলে এলেন…… বাবা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন….. কিন্তু আমার কান্না থামার নামই নেই…… আমি বাবাকে না ধরে তখনও কেদে যাচ্ছি….. খুব অভিমান হচ্ছিলো তখন সবার উপর…… কাউকেই সহ্য হচ্ছিলো না আমার…… শিমুল ভাই কে আমি অবিশ্বাস্য ভাবে সহ্য করতে পারছিলাম না তখন …… কেনো ওনি আমার ছবি তুলবেন সাদাফ ভায়ের সাথে….. ওনাকে কি আমি আমার মাথার দিব্যি দিয়েছি যে ওনি যা বলবে আমাকে তাই করতে হবে!!! ওনি কেন এলেন আমাদের বাসায়….. এই লোকটা কেনো এলো….. ওনি আমার ভালো থাকা কেড়ে নিয়েছে…. আমার মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে…… ওনি এখনো কেন যাচ্ছে না….. কিন্তু মুখ থেকে একটা শব্দ ও বের হলো না…… ততক্ষণে হেচকি উঠে গিয়েছে আমার….. বাবা কোন ভাবেই আমাকে শান্ত করতে পারছেন না….. মা এলেন সাথে সুফিয়া খালাকে নিয়ে….. আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন……. যাওয়ার আগে সাদাফ ভায়ের মা আর বোন এলেন….. আমাকে বেশ বোঝালেন…… ভয় পেতে বারন করলেন….. মেয়ে যখন হয়েছি তখন বিয়ের ব্যাপারটা মেনে নিতেই হবে….. আমি চুপ ছিলাম সেদিন….. অনেকক্ষণ কান্না করার কারনে মাঝেমধ্যে ফুপিয়ে শ্বাস নিচ্ছিলাম কিন্তু চোখে কোন জল ছিলো না…..
,
,
,
রাতে মা বাবা দুজনেই আমার রুমে এলেন…… রাগটা তখন ধরে রাখতে পারি নি আর….. জুড়ে দিলাম চিল্লাচিল্লি…… একপর্যায়ে বলেই দিলাম আমার মতামত না নিয়ে কেন তারা বিয়ে ঠিক করলেন…… মা বেশ বিরক্ত নিয়ে জানতে চাইলেন আমি কেন এই বিয়েতে রাজি না তার যুক্তিসঙ্গত কারণ দর্শাতে….. আমিও বলে দিলাম…. সাদাফ ভাইকে আমি কখনো সেই ভাবে দেখি নি….. জবাবে মা বললেন সাদাফ তুমাকে পড়াতেন তাকে তুমি অন্য চোখে কেন দেখতে যাবে….. তাছাড়া সাদাফ ছেলে হিসেবে ভালো তাই তুমার বাবা আর আমি তোমার জন্য তাকে ঠিক করেছি……এখানে তোমার ভাবা ভাবির কি আছে তাই তো বুঝতে পারছি না….. অন্য কোন কথা থাকলে বলো….. আমি না দমে আবার বললাম সাদাফ ভাই অত্যন্ত রাগি….. ওনাকে আমার ভয় করে….. পড়ানোর এক ঘন্টাই আমার কাছে দুযোখের মতোন লাগে….. সেখানে সারা জীবন আমি কিভাবে থাকবো!!!! মা মুচকি হেসে উঠলেন…… আমার কাছে এসে আমার হাতটা তার কোলের উপর রেখে বললেন তোমার বাবার রাগ সম্পর্কে আশা রাখি তোমার ধারনা আছে…. কি আছে না!! আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম….. আমাকে দেখে কী মনে হয় আমি তোমার বাবার সাথে অসুখি!!! আমি এবার মাথা নাড়ালাম ডানে বামে হেলিয়ে…… মা আবার ও বললেন সাদাফ কে তুমি একজন শিক্ষক হিসেবেই জানো…. এর বাইরে গিয়ে সে তোমার সাথে মিশে নাই বলেই তুমি এতো ভয় পাচ্ছো…..এবার বাবা ও আমার পাশে বসলেন…. আমার মাথাটা তার বুকে নিয়ে বললেন তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান তুলি….. তোমার জন্য বিন্দু পরিমান খারাপ টা ও আমরা মেনে নিতে পারবো না…… আশা করি এই ভরশা টা তুমি আমাদের উপর রাখো…..
,
,
,
আর কিছু বলতে পারলাম না সেদিন…… বাবাকে জড়িয়ে ধরে শুধু এই টুকুই বললাম আমাকে এতো দ্রুত পর করে দিচ্ছো কেন তুমরা!!! আমাকে ছাড়া একা থাকতে পারবে তো…. আর বলতে পারলাম না….. হাউ মাউ করে বাবাকে ধরেই কান্না জুড়ে দিলাম…… বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন……. বাবার চোখের জল টা আমি সেদিন দেখতে পাই নি….. তবে মাকে দেখেছি আমার হাত খানা নিজের দু হাতে নিয়ে চুমু খেয়ে কাদছেন…… এই কান্না টা আমার জন্য….. আমার প্রতি তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ…… নিজের জন্য অন্যের চোখে জল ঝড়তে দেখার মধ্যে নাকি আলাদা একটা প্রশান্তি আছে কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে খুব কষ্ট…….. ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে…….. বারবার মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়ে গেলেই আমি তাদের থেকে দূরে চলে যাবো……. এই মানুষ গুলো পর হয়ে যাবে…….মা-বাবা আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে চলে গেলেন…….. রাতে খুব বৃষ্টি হলো……. সারারাত ই সিলিং এরদিকে তাকিয়ে বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ টা শুনেছি…….
,
,
,
আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে খবর টা পাড়া পড়সি জানাজানির সাথে সাথে আরও একটা বিষয় সবাই যেনে গেলো……. সেটা হচ্ছে লোকমুখে রচিত আমার আর সাদাফ ভায়ের প্রেমের কাহিনি……. এবং এই কাহিনি রচনাতে তারা একাধারে সংযোজক,প্রযোজক এবং সমালোচকের ভূমিকা পালন করেছে বিনা বেতনে……. তাদের ভাষ্যমতে সাদাফ ভায়ের সাথে পড়ানোর সূত্র থেকেই নাকি আমাদের প্রেম….কতো কত মানুষ আমাদের এক সাথে ঘুরে বেড়াতেও দেখেছেন…… এখন হয়তো কোন কেলেংকারী হয়েছে তাই মেয়ে বিয়ে দিচ্ছে মাস্টারের সাথে…….
,
,
,
আমাদের অবাক করে দিয়ে চাচা-চাচিকে ও দেখলাম সেই কথায় তাল মেলাতে….. কথা ছিলো ওনাদের ছেলের সাথে বিয়ে দেবার কিন্তু তা না করে এমন তাড়াহুড়ো করে মাস্টারের সাথে বিয়ে দেবার তো নিশ্চয়ই কোন বড়সড় কারণ আছে…… আমি এসব শুনে শুধু হেসেছিলাম…… তাদের সন্দেহ তো যুক্তিসঙ্গতই…… সাদাফ ভাইয়ের সাথে আমি কতবারই বাইরে গিয়েছি তবে সেটা আমার প্রয়োজনে আর সাদাফ ভাই গিয়েছেন তার দায়িত্ব থেকে…….বাবা সেদিন সাদাফ ভাইদের আবার ডাকালেন এবং তাদের সব খুলে বললেন কারণ তিনি চান না পরে এই সব কথার জের টেনে তার মেয়ে কষ্ট পায়…..
,
,
,
১২
,
,
,
আংটি পরিয়ে যাবার দুদিন পর থেকেই শুরু হয়েছে আমার ভয়াবহ রকমের পেট খারাপ……. দিনে রাতে কতো বার বাথরুমে ছুটছি তার কোন হিসেব নেই…. বলতে গেলে বাথরুম দৌড়াতে দৌড়াতে আমার উর্ধশ্বাস প্রায়…… প্রথম দিন বাসায় আর কিছু জানালাম না….. ভাবলাম ঠিক হয়ে যাবে….. কিন্তু না ঠিক তো দূরে থাক যাওয়া আসার পরিমাণ আরও বেরে গেলো…… সেদিন সাদাফ ভাইয়ের মা ফোন করে জানালেন আমাকে নিয়ে নাকি শপিংয়ে বের হবেন……. কিন্তু আমি আমার ঘড় থেকে মেইন দরজা পর্যন্তই যাবার সাহস পাচ্ছি না…… একটু হাটাহাটি করলেই বাথরুম ধরে যায়….. উপায় না পেয়ে মাকে খুলে বললাম…….. আমি অসুস্থ শুনে তারা কাল যাবে বলে জানালেন……. মা ও আশায় ছিলেন আমি সুস্থ হয়ে যাবো কালকের আগেই….. কিন্তু মরার পেট খারাপ আর আমায় ছাড়লো না….. ডাক্তার দেখিয়ে ও কোন কাজ হচ্ছে না……… কারণ পাকস্থলী গরম হয়ে হজমে সমস্যা হচ্ছিলো…….. উপায়ন্তর না দেখে মা তাদের সব খুলে বললেন…….. মান সম্মান ধূলিসাৎ……..
,
,
,
আমাকে ছাড়াই শপিং করে সব জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন…… গয়না টা জুয়েলার্স থেকে এখনো দেয় নি বলে তারা আবার গয়না পড়ে নিয়ে আসবেন……. এদিকে আমার পাতলা পায়খানা থামার নাম নেই….. পানি শূন্যতা দেখা দিয়েছে তার সাথে দূর্বলতা তো আছেই……. ডাক্তার দেখে স্যালাইন প্রেসক্রাইব করে গেলেন চারটে…… একজন কম্পাউন্ডার এসে বাসাই আমার হাতে ক্যানেলা ফিট করে দিয়ে স্যালাইন চালু করে দিয়ে গেছেন…..
,
,
,
এদিকে বাসায় আত্নীয় স্বজন আসা শুরু করে দিয়েছে…… যে আমাকে দেখছেন সেই আফসোস করছে…. আর মায়ের তিনবেলা খাবার খাওয়ানোর সময় কান্নাকাটি তো আছেই…….. খাওয়া দাওয়া ওর স্যালাইন চিড়া,কলা আর ডাল বাদে কিছুই না….. চোখের নিচে কালি পড়ে একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছি যাকে বলে……. শাম্মি তো এসেই বলতে শুরু করেছে কিরে বিয়ের কনে বিয়ের টেনশনে হাগতে হাগতে তো দেখি সিরিয়ার অভুক্ত প্রানীতে পরিণত হয়েছিস…… শাম্মির কথা পাত্তা না দিয়ে সেদিন কাচুমাচু করতে করতে বাথরুমে ঢুকেছিলাম……… এর মধ্যেই স্যালাইন রত অবস্থায় আমার হবু শ্বাশুড়ি এসে আমাকে দেখে গয়না দিয়ে গেলেন….
,
,
,
বিয়েবাড়িতে সবাই মজার মজার খাবার খায় আর আমি চিড়া কলা খাই সাথে স্যালাইন….. গায়ে হলুদের দিন সকালেও কম্পাউন্ডার এসে স্যালান অন করে গেছে……. আমার সূচনীয় অবস্থা দেখে সাদাফ ভায়ের মা ধুর শ্বাশুড়ি সকালে এসে নতুন করে শপিং করে দিয়ে গেলেন…… আর বলে গেলেন বিয়ে গায়ে হলুদে যেনো এখান থেকেই শাড়ি পড়ি….মনে মনে একটা বড় হাফ ছাড়লাম….. ওসব ভাড়ি কিছু পড়তে হবে না বলে…….
,
,
,
গায়ে হলুদের দিন সকালের পর থেকে আমার অবস্থা কিছুটা ভালো কিন্তু তারপরও মা কোন রিক্স নিলেন না….. নিজে দারিয়ে থেকে ডাবের পানি নাহয় স্যালাইন খাইয়ে যাচ্ছেন…….. আর ঘর ভর্তি মেহমানের সামনেই জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন আবার বাথরুমে গিয়েছি কি না…… গেলে কয়বার!!! পায়খানা কেমন হয়ে ছে….. আমি যঅতই মাকে আস্তে কথা বলতে বলি ততই মা ক্ষেপে যায়।।।।। গায়ে রোগ নিয়ে ভদ্রতা নাকি তার ধাতে নেই…… আমি চোরের মতো এদিক ওদিক তাকাই আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি

,
,
,
চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে