এক শহর ভালোবাসা পর্ব-৪+৫

0
3898

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৪
#সুরাইয়া_নাজিফা

“আমার কাছে আসো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
শান ভাইয়া এসে আমার পাশে বসল। আমি একবার ওনার দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। এখন আসছে দরদ দেখাতে। একটু আগে শ্বাশুড়ী মা যখন বললো তখন কি ক্ষতি হতো খাইয়ে দিলে। আমি মুখ গোমড়া করে বললাম,
“লাগবে না কারো হেল্প। ”

শান ভাইয়া কিছু না বলে পায়ের উপর পা তুলে বসে রইল। আমিও আমার খাওয়ায় মন দিলাম। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে কাঁটা হাত দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা। এবার চামচ দিয়ে গুঁতাগুঁতি করতে থাকলাম। কিন্তু বাম হাত দিয়ে কতটাই বা পারা যায়। কালকে রাতে অতটা বুঝতে পারিনি তবে হাতটা বেশ কয়েক জায়গায় অনেকটাই কেঁটে গেছে। শ্বাশুড়ী মা, ভূমিকা ভাবী, বাবা বেশ কয়েকবার চেয়েছিল খাইয়ে দিতে। কিন্তু আমিই বারণ করেছি। ভেবেছিলাম পারব। কিন্তু এখনও একটুও মুখে দিতে পারিনি। শান ভাইয়া অনেকক্ষন ধরে আমার কান্ড-কারখানা দেখে চলেছে।উনার এভাবে তাকিয়ে থাকাতে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। তাই চামচটা হাত থেকে প্লেটে ফেলে বললাম,

“দূর খাবোই না। ”

চোখ মুখ কুচকে কথাটি বলতেই শান ভাইয়া খিলখিল করে হেসে উঠল। আমি উনার দিকে একবার তাকালাম ওনার হাসিটা দেখে আরো রাগ হচ্ছে। যেন মনে হচ্ছে উনি আমাকে ব্যঙ্গ করছেন। উনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বিরক্ত হয়ে উনার পাশ থেকে উঠে যেতে চাইতেই শান ভাইয়া আমার হাত ধরে টান দিয়ে আবার উনার পাশে বসিয়ে দিলেন।

“এটা কোন ধরনের অসভ্যতা? ”
“অসভ্যতামি তো এখনও শুরুই করিনি তবে তুমি দেখতে চাইলে করতে পারি কি দেখতে চাও? ”

শান ভাইয়া বাঁকা হেসে আমার আরো একটু কাছ ঘেঁসে বসল। উনার এমন বিহেভ দেখে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মানে এই কিছুক্ষন আগেই তো কেমন ব্যবহার করল এর মধ্যেই আবার পাল্টি খেয়ে গেল। আমি ওনার থেকে একটু সরে গিয়ে বললাম,

“আচ্ছা আপনার কি ছোটবেলায় কোনো এক্সিডেন্ট হয়েছিল?”

শান ভাইয়ার হাসি মুখ থেকে গায়েব হয়ে অবাক হয়ে বললো,
“মানে? এক্সিডেন্ট হবে কেন?”
“হতেও পারে হয়তো আপনার মনে নেই। এই যে যেমন ধরেন মাথায় কোথাও চোট ফোট পেয়েছেন এরপর থেকে একটু আগে যা করেছেন কিছুক্ষন পর সেটা ভুলে যান।”

এবার শান ভাইয়ার অবাকের মাত্রা দ্বিগুন হলো। উনি জিজ্ঞেস করলেন,
“কি ভুলে গেছি আমি?
“কেন একটু আগেই আমার সাথে তিতা করলার মতো ব্যবহার করলেন। এখন মুখ থেকে মধু ঝরে কিভাবে?”

আমার কথা শুনে উনি কিছুক্ষণ চোখ ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরই হো হো করে হেসে উঠল যাকে ঘর কাঁপানো হাসি বলে,

“এভাবে হাসার কি হলো? আমি হাসার মতো কি বললাম। ”
শান ভাইয়া হাসতে হাসতে বললো,
“যতই ভাবি রাগ করে থাকব। কথা বলব না। বাট তোমার এই কিউট কিউট কথা গুলো কখনো হতেই দেয় না। ”
“কথা আবার কিউট কিউট হয় নাকি? ”
“হয়। এইবার হা করো সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। ”
“না খাবো না। আমি না খেলেও বা কার কি? কারো তো আর ঠেকা পড়ে নাই আমাকে খাওয়ানোর। ”

আমি কথাটা শান ভাইয়াকে খোঁচা মেরেই বললাম। কারণ তার তখনের কথাটা আমার অনেক খারাপ লেগেছে। শান ভাইয়া গালে হাত দিয়ে বললো,

“বাবা এখানে দেখছি আমার উপর একজন অভিমান করে বসে আছে।”
আমি মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললাম,
“আমি কারো উপর অভিমান করিনি। ”
“জানি আমি। তা কি পেলে রাগ কমবে?”
“আমার কিছু চাই না। ”
“আচ্ছা। তাহলে আর কি করার। তবে এখন তো খাওয়াটা খেতে হবে। ”
“খাবো না আমি। ”
“কোনো না শুনতে চাইনা। দেখি হা করো। ”
“বললাম তো খা।”

পুরো কথাটা আর বলতে পারলাম না তার আগেই উনি খাবারটা আমার মুখে পুড়ে দিলেন,
“একটা কথাও সোজা ভাবে শুনতে চাও না। তোমার জন্য সবসময় বাঁকা পথটাই বাঁচতে হয়। ”
আমি উনাকে মুখ ভেঙালাম উনি হাসলেন।
“আচ্ছা আপনার সাথে আমার একটা কথা ছিল।”
“বলো? ”
“নিচে তখন সবাই আমাকে বকেছে।”
শান ভাইয়া অস্থির হয়ে বললেন,
“কে বকেছে? কেন বকেছে? কি হয়েছে বলো আমাকে? ”
“আরে আপনি এতে অস্থির হচ্ছেন কেন? বলছি তো।ঐ আপনাকে বিয়ের পরেও এখনো ভাইয়া ডাকি তাই শুনে বকেছে।”
আমার কথাটা শুনে উনি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। তারপর বললেন,
“বেশ করেছে। ”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
” বেশ করেছে মানে? ”
“দেখো আমরা মানি আর না মানি আমাদের বিয়েটা তো হয়ে গেছে। এখন তুমি যদি সবার সামনে নিজের হাজবেন্ডকে ভাইয়া বলো তাহলে সেটা তো দৃষ্টিকটু দেখাবেই। ”
আমি হতাশ হয়ে বললাম,
“তাহলে কি ডাকব?”
“শান বলবে?আমার নামটা কি ডাকার মতো না?”
“সেটা না কিন্তু আমার শান ডাকতে কেমন জানি লাগে। ”
“কেমন লাগে। ”
“জানি না। মনে মধ্যে সুড়সুড়ি লাগে।”

শান ভাইয়া আবারও খিলখিল করে হেসে দিলেন,
“প্লিজ সোহা আর কিছু বলো না। তুমি আজকে হাসাতে হাসাতেই আমাকে মেরে ফেলবে। বাঁপের জন্মে এমন কথা শুনিনি। তোমার সাথে থাকলে যে আরো কতো নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারবো আল্লাহ ভালো জানেন। ”
আমি দুইহাত দুই দিকে প্রসারিত করে বললাম,
“আরো অনেক কিছু শিখতে পারবেন যেটা আগে জানতেনই না। ”
শান ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“বাচ্চা মেয়ে। আচ্ছা তোমার যেটা ডাকতে ইচ্ছা হয় সেটা ডেকো।এইবার খাওয়াটা শেষ করো।”

উনি একমনে আমাকে খাইয়ে যাচ্ছেন।একদম বাচ্চাদের মতো যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। আমার কেমন অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছিল। ওনাকে চুপ থাকতে দেখে বললাম,

“আচ্ছা আপনি কি রাগ করেছেন? ”
“রাগ করার কোনো কারণ আছে কি?”
“আচ্ছা শান ডাকব হ্যাপি। ”
শান ভাইয়া অবাক হয়ে বললো,
“কি বললে শুনতে পেলাম না? ”
“নাটক করবেন না তো আপনি কি কানে কম শুনেন নাকি? ”
“ব্যাস শ্রীমতী চলে এসেছে নিজের রূপে। তোমার এই রূপটাই এতক্ষন মিস করছিলাম। ”
“তাই নাকি?
“একদম। আচ্ছা তখন মিথ্যে বললে কেন যে ওয়াসরুমে পড়ে গেছ সত্যিটা কেন বললে না। ”
“এখন আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে না এখন চাইলেই তো সবাইকে সব বলা যাবে না। ”
“বাবা মেয়ে তো দেখি বড় হয়ে গেছে। ”
“তো আপনার কি মনে হয় আমি বাচ্চা? ”
আমি কোমড়ে হাত দিয়ে বললাম। শান ভাইয়া একটু মুচকি হেসে বললেন,
“না কার এতো সাহস আছে তোমাকে বাচ্চা বলবে তুমি তো পাকা বুড়ি।”
আমি হেসে বললাম,
“দূর কি যে বলেন না। ”
“হুম। একটা কথা রাখবে।”
“কি?”
“কখনো চেন্জ হয়ো না। তোমাকে এরকম ভাবেই ভালো লাগে। তুমি একটু চেন্জ হলেই ভয় হয়। তাই প্লিজ।”

আমরা দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অনেক না বলা কথা একে অপরের চোখে চোখ রেখেই যেন বলে দিচ্ছিলাম। ওনার এতো আবেগময় কথা মাঝে মাঝে আমার মনটা তোলপাড় করে দেয়। আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিলো তাই চোখ সরিয়ে মাথা একবার উপর নিচ করে নাড়ালাম।

“আচ্ছা আরেকটা কথা বলি?”
“এখন আর কোনো কথা না আগে খেয়ে নেও। খাবার সময় এতো কথা বলতে হয় না। বিষম লাগবে।”
“কিছু হবে না। ”

মুখের কথা মুখে রয়ে গেল আর তখনই আমার বিষম লেগে কাঁশতে আরম্ভ করলাম। শান ভাইয়া তাড়তাড়ি পানি এগিয়ে দিয়ে মাথা আর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। কিছুক্ষন পর আমি একটু স্বাভাবিক হতেই রেগে বললেন,

“একটা কথাও যদি আমার শুনতে তুমি।কখনো মানুষ হবে না। ”
কথাটা বলেই উনি উঠে চলে গেলেন। আমি হা করে রইলাম,
” যাক বাবা তাহলে এখন কি আমি মানুষ না তাহলে কি? অদ্ভুত।”



দুপুরে খাওয়ার পর একটু সুয়ে ছিলাম। কালকে রাতে ঘুম হয়নি তাই শোয়া মাত্রই চোখে ঘুম নেমে আসল।দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরেই সব আত্মীয়-স্বজনরা চলে গেছে তাই একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারলাম। শান ভাইয়া বাড়িতে নাই। দুপুরে খেয়েই কোথায় জানি বেরিয়েছে। যদিও আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি শুধু বলেছিল কাজ আছে বাট কি কাজ সেটা বলেনি। আমিও আর জিজ্ঞেস করিনি।

আমার চোখ খুলতেই চাইছে না।আমি ঘুমালে আমার মাথার পাশে বসে মা যেমন বিলি কেঁটে দিতো তেমনি অনুভব হচ্ছে।যেন কারো ছোট ছোট আঙ্গুল গুলো সারা চুলে খেলে বেড়াচ্ছে। চোখ খুলতে না চাইলেও কে দেখার জন্য চোখ খুলতেই আমার মুখে হাসি ফুটে উঠল,

“আরে আমার পুষ্প সোনা যে কখন এলে তুমি? ”
“তুমি যখন ঘুমাচ্ছিলে তখন। ”
“আমাকে ডাকোনি কেন সোনা তাহলে?”
“তোমাকে ঘুমাতে দেখে অনেক মিষ্টি লাগছিলো তাই ডাকিনি। ”

বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমিও ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলাম। পুষ্পর বয়স মাত্র পাঁচ বছর। কিন্তু এখনি যেভাবে কথা বলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে কথা গুলো কোনো পিচ্ছি বলছে একদম গুছিয়ে।এতো গুছিয়ে মনে হয় আমিও কথা বলতে পারিনা। যেকোনো মানুষকে ওর কথার দ্বারাই সব কিছু ভুলিয়ে দিতে পারবে। আমি ওকে ছেড়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম,

“পাঁচটা বাজে।”

কিন্তু তখনও শান ভাইয়া আসেনি।পুষ্প আবার বললো,
“মিষ্টি এখন থেকে তুমি আমাদের সাথে থাকবে?”
“হুম এখন থেকে আমি পুষ্পের সাথে থাকব। ”
কথাটা বলতেই পুষ্প লাফিয়ে আমার কোলে উঠে আমার গালে একটা চুম্মা দিয়ে বললো,
“ইয়ে তাহলে এখন থেকে আমি সবসময় তেমার সাথে থাকব আর অনেক মজা করব। ”

পুষ্পের খুশি দেখে আমার মুখেও হাসি ফু্ঁটে উঠল।আমি পুষ্পকে বসিয়ে রেখে ফ্রেস হয়ে নিলাম। ঘরে আর থাকতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। তাই ভাবলাম পুষ্পকে নিয়ে একটু বাগানের দিকটায় ঘুরে আসি। যেই ভাবা সেই কাজ।

আমি আর পুষ্প বাগানের একটা বেন্ঞ্চে গিয়ে বসলাম। অনেক সুন্দর পরিবেশ। না আলো না অন্ধকার। মাঝে মাঝে একটা ঠান্ডা ধমকা হাওয়া দিচ্ছে আর তার সাথে নাকে এসে ঠেকছে বিভিন্ন ফুলের সুভাস। একদম মনটা শান্ত হয়ে যায় এমন পরিবেশে এলে। সব সমস্যা,চিন্তা ভুলে যাওয়া যায় এক নিমিষে। হঠাৎ পুষ্প বললো,

“মিষ্টি তুমি ঘুড়ি বানাতে পারো?”
“পারি তো কেন?”
“আমি পারিনা কিন্তু ঘুড়ি উড়াতে চাই কিন্তু মা, দাদু,দাদি মনি, শান, আরশ, বাবা কেউ পারে না। তাই আর উড়াতেও পারিনি। ”
“ওকে আমি আছি তো আমি শিখিয়ে দিবো হবে না? ”
পুষ্পের চোখে মুখে খুশি ফুঁটে উঠল,
“সত্যি?”
“একদম। ”
“কখন?”
“এখনি।”
“ইয়ে মিষ্টি ইউ আর বেষ্ট। ”
“বেষ্ট তো হতেই হবে পুষ্পের মিষ্টি বলে কথা। এখন তুমি গিয়ে কমলাকে ডেকে নিয়ে আসো বলো যে মিষ্টি ডাকছে যাও। ”

কথাটা বলতেই পুষ্প দৌঁড়ে গিয়ে কমলাকে ডেকে নিয়ে আসল। কমলা আসতেই বললো,
“আফনে আমারে ডাকছিলেন ভাবী? ”
“হুম। তুমি এক কাজ করো তো কমলা শলা, পেপার আর সুতা নিয়ে আসো তো। ”
“আফনার কি কাম করতে হইবো হেইডা কন। হেগুলা দিয়া আফনে কি করবেন?”
“ঘুড়ি বানাবো। ”
“আফনে ঘুড়ি বানাইতে পারেন?”
“হুম পারি।এখন বেশি কথা না বলে নিয়ে আসো। ”

কমলা চলে গেল।অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে। পুষ্পের দেখা শুনা করে। ওকে একটা কাজ বললে ও কখনো না করেনা। বিয়ের আগেও যখন মাঝে মাঝে আসতাম দেখতাম ভাবী আর শ্বাশুড়ী মা ওকে ছাড়া থাকতেই পারে না।অনেক খেয়াল রাখে সবার।

“এই যে আফা লন আফনের জিনিস। ”

আমি শলা আর পেপার কেঁটে ঘুড়ি বানাতে থাকলাম। আমার পাশে পুষ্প আর কমলা বসে চুপচাপ মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগল। বেশ কিছুক্ষন পর আমার ঘুড়ি বানানো শেষ হলে সেটাতে সুতা বাঁধতে বাঁধতে কমলাকে বললাম,
“তুমি ঘুড়ি উড়াতে পারো কমলা?”
“হয় পারি। আমাগো গেরামে একবার ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম পুরষ্কার পাইছিলাম। ”
“ওহ তাহলে তো ভালোই তাহলে হবে নাকি আমার সাথে একবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা? ”
“হইতেই পারে খারাফ না। ”

ওর কথা শুনে হেসে দিলাম। তারপর কমলাও একটা ঘুড়ি বানিয়ে নিল। আমি আর কমলা দুজনেই ঘুড়ি উড়িয়ে দিলাম। পুষ্প দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল আর আমাকে উৎসাহ দিচ্ছিল ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল ও অনেক উপভোগ করছে বিষয়টা। খেলা পুরো জমে উঠেছে। আমি ঘুড়ি উড়াতে উড়াতে কখন বেন্ঞ্চের উপরে উঠে গেছি খেয়াল নেই। তখনই পাশ থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠ বলে উঠল,

“এসব কি হচ্ছে এখানে বাচ্চাদের মতো । ”

কন্ঠটা শুনে বুঝতে বাকি রইল না যে এটা শান ভাইয়া। আমি বললাম,
“চোখ নাই সাথে দেখতে পাচ্ছেন না। ”
“এখনি নামো তুমি কোথায় উঠছো এখনি পড়বে। ”
“উফ বিরক্ত করবেন না তো নাহলে আমি হেরে যাবো।”
“কথা শুনবে না তো যখন এখান থেকে পড়বে তখন বুঝবে।”

কথাটা বলেই শান বেন্ঞ্চে বসে পড়ল। তখনি আমি কমলার ঘুড়িটা কেঁটে দিলাম আর খুশিতে আমি আর পুষ্প চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমি কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটা ভুলেই গেলাম ব্যাস আর কি আমার লাফালাফিতে ধপাস করে বেন্ঞ্চ থেকে কাঁত হয়ে পড়ে গেলাম। আমি পড়তেই কমলা আর পুষ্প ভয়ে চিৎকার করে উঠল আর আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম।

পড়ার পরও যখন শরীরে একটুও ব্যাথা পেলাম না তখনই তাড়াতাড়ি চোখ খুলে তাকালাম। চোখ খুলতেই আমার চোখ রসগোল্লার মতো হয়ে গেল। আমি শান ভাইয়ার কোলে ছিলাম। আর শান ভাইয়া আমাকে দুহাতে শক্ত করে ওনার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল আমাকে চোখ মেলতে দেখেই শান বললো,

“বলেছিলাম না দেখলে তো বড় মানুষের কথা না শুনলে এমনটাই হয়। ”
“কি এমন হতো একটু ব্যাথা পেতাম তেমন তো কিছু না। ”
“এজন্যই বলে কারো সাহায্য করতে নাই। কই ধন্যবাদ দিবে তা না ঝগড়া করছে। ”

হঠাৎ খিলখিলিয়ে হাসার শব্দ কানে আসতেই দেখলাম পুষ্প হাসছে। আর কমলা ওড়নার আঁচল মুখে দিয়ে মুচকি হাসছে। আমার খেয়াল হলো আমি এখনো শান ভাইয়ার কোলে আর উনি এখনো আমাকে ওভাবেই ধরে আছে। আমি তাড়াতাড়ি করে ওনার কোল থেকে নেমে গেলাম। কি লজ্জা আল্লাহ।

শান বললো,
“এমন জংলী বিড়ালের মতো করছো কেন? অদ্ভুত তো। ”

আমি উনার দিকে রাগি চোখে তাকালাম কিন্তু কিছু বললাম না। শানকে দেখে কমলা চলে গেল।পুষ্প শানের কাছে গিয়ে বললো,

“জানো শান আজ থেকে মিষ্টি আমাদের সাথে থাকবে। ”
শান পুষ্পকে কোলে নিয়ে বললো,
“জানি তো প্রিন্সেস। তোমার মিষ্টিকে তো আমিই নিয়ে এসেছি কাল তেমার জন্য।”
পুষ্প খুশি হয়ে বললো,
“সত্যি?”
“হুম।”
পুষ্প শানের গালে একটা কিস করে বললো,
“আই লাভ ইউ শান।”
“লাভ ইউ টু প্রিন্সেস। ”

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দুজনের কাহিনী দেখছিলাম। এদের সম্পর্কটা এমন যে দেখলে কেউ বলবেই না শান ওর চাচ্চু। ওর মানা হলো ও শান ভাইয়াদের মতো বড় তাই ও শান ভাইয়া আর আরশ ভাইয়াকে সরাসরি নাম ধরে ডাকে। যদিও এই ডাকটা শান ভাইয়াই শিখিয়েছে। পুষ্পর মুখে নাম ধরে ডাকলেও শুনতে খুব ভালোই লাগে।

তারপর পুষ্প শানের কোল থেকে নেমে আমার কাছে এসে বললো,
“চলো মিষ্টি আমরা আরো অনেক কিছু খেলবো ঘরে গিয়ে।”
“ওকে সোনা চলো। ”
তখনই শান ভাইয়া বলে উঠল,
“প্রিন্সেস তুমি শানকে ফেলে চলে যাচ্ছো?”
“হুম যাচ্ছি। কারণ এখন আমি মিষ্টির সাথে খেলবো। ”
“আমিও খেলবো আমাকেও নেও। ”
“না তোমাকে নিবো না। অন্য সময় যখন বলি তোমাকে তুমি তো খেলো না বলো বিজি। আর আমি বিজি মানুষদের সাথে খেলি না। যাও এখন। ”
শান পুষ্পের সামনে বসে বললো,
“এমন করে বলছো কেন সোনা?মিষ্টিকে নিয়ে গেলে শানের কি হবে ভাবো একবার। ”
“শোনো এই বাড়িতে যারা আছে সব আমার আর এখন মিষ্টিও আমার একদম ভাগ বসাবে না। ”
তখন শান মন খারাপ করে বললো,
“হ্যাঁ মা এই বাড়ির সব তোর। আমার মা ও তোর, আমার বাবা ও তোর, আমার ভাইও তোর, আমার ভাবীও তোর। থাকার মধ্যে যা ছিল বউটা এখন সেটাও তোর বলে নিয়ে নিলি এই কষ্ট কই রাখব। ”

শান ভাইয়ার কথা শুনে কেন জানি না আমার অনেক হাসি আসল। আমি আর হাসি আটকাতে না পেরে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। শান ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমাকে হাসতে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে উনিও মুচকি হাসলো।
.
.
চলবে

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৫
#সুরাইয়া_নাজিফা

“তোমাদের এই লায়লী-মজনুর প্রেম কাহিনী মাঝে মাঝে আমি বুঝতে পারিনা। এই দেখি হাসছ, কখনো কাঁদছো, কখনো ঝগড়া করছ, তো কখনো আবার প্রেম-ভালোবাসায় ভরপুর।”

আমি পুষ্পের সাথে ভিডিও গেমস খেলছিলাম। হঠাৎ ভূমিকা ভাবী এসে কথাটা বলতেই খেলা বন্ধ করে উনার দিকে ফিরে বললাম,

“প্রেম-ভালোবাসায় আর ওনার সাথে এটা হতেই পারেনা। আগে থেকেই তো দেখছেন আমাদের কখনো মিল হয়েছে?”

“হুম ওটা তো আমাদের সামনে দেখাও যাতে নজর না লাগে।”

“মোটেও না। ”

“একদম মিথ্যা বলো না আমি কিন্তু সব দেখেছি আর আজকে সকালের ঘটনাটাও কিন্তু ভুলিনি।”

ভাবীর কথা শুনে আবার সকালের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল আর লজ্জায় পড়ে গেলাম,

“উফ আর কতো পঁচাবেন। ওটা শুধু চোখের ভুল ছিল। আর বাদ বাকি প্রেম-ভালোবাসার কথা বলছেন ওইটা আপনি আপনার দেবরকেই জিজ্ঞেস করেন উনিই বলতে পারবে। ওনার হাল-চাল মাঝে মাঝে আমিই বুঝতে পারিনা। ”

“বুঝতে না পারলে হবে?এখন থেকে সারাজীবন সংসারটা তো তোমাকেই করতে হবে। তাই বুঝতে শিখো। শানকে বুঝলে একদম পানির মতো সরল আর না বুঝলে জিলাপির মতো পেঁচালোই লাগবে। ”

ভূমিকা ভাবীর কথা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলাম।দূর্ভাগ্যবসত উনার দ্বিতীয় কথাটি এখন আমার জন্য প্রযোয্য। আগে যাও বুঝতে পারতাম কিন্তু কালকে থেকে উনার কথা বার্তা মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। কি বলছে? কি করছে উনিই ভালো বুঝে।

ভূমিকা ভাবী আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
“কি হলো কই হারিয়ে গেলে?”
উনার কথা আমি ভাবনার সাগর থেকে উঠে এলাম,
“ঐ মানে না কিছু না। ”
“আচ্ছা তোমাকে পুষ্প বেশী জ্বালাতন করছে নাতো?”
“না না জ্বালাবে কেন? ও তো আমার উপকার করছে আমি বোর হচ্ছিলাম ঘরে বসে। ওর সাথে থাকতে পেরে আমারও অনেক ভালো লাগে।”
“হুম পুষ্পও তোমার পাগল একেবারে।আমার কাছে তো থাকতেই চায় না এখন। ”
ভূমিকা ভাবীর কথায় একটু মুচকি হাসলাম।সবাই বলতো আমি নাকি বাচ্চাদের সাথে খুব সহজেই মিশতে পারি। আসলে কথাটা সত্যি। বাচ্চাগুলো এতো কিউট যে কেউ এদের থেকে দূরে কি করে থাকবে।আমি ভূমিকা ভাবীকে বললাম,

“আচ্ছা আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি কি আপনাকে ভাবী না বলে আপু বলতে পারি?”
“তোমার যা ইচ্ছা তাই বলতে পারো। তবে আজকে একটা কথা বলি এখন থেকে তুমিও আমাকে তুমি বলবে। তুমিতো আপনি আপনি বলে আমাকে দূরেই ঠেলে দিচ্ছো।”
“না দূরে ঠেলবো কেন আপনার মধ্যে আমি আমার আপুকে দেখতে পাই যে আমার অনেক আপন এজন্যই তো বললাম আপু বলব। ”
“তুমি কিন্তু আবার আপনি বলছো।”
“স্যরি তুমি।”
আমি হেসে দিলাম সাথে ভূমিকা আপুও।



পুষ্প আর ভূমিকা আপুর সাথে আড্ডা দিয়ে ঘরে আসার জন্য বের হলাম। মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। কখনো আম্মুকে ছেড়ে থাকিনি। আর আজকে পুরা একদিন হয়ে গেল না আম্মুকে দেখেছি না কথা বলেছি। ফোনটাও নেই যে কথা বলব। এদিকে স্মৃতি আপু সাথেও ভালো করে কথা হয়নি। কি করছে?কোথায় আছে? তারা কি বিয়ে করেছে?উফ আর নিতে পারছি না। এতো ঝামেলা সবসময় আমার গলাতেই এসে ঝুলে আল্লাহ জানে।

কথা বলতে বলতে ঘরে ডুকতেই আমার চোখ রসগোল্লা আর মুখ হা হয়ে গেল। শান ভাইয়া সম্ভবত এখন গোসল করে বের হয়েছে। শুধু একটা টাওয়াল ছিল। পুরো ধবধবে সাদা শরীরটা দৃশ্যমান।জিম করা বডি।শরীর থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।আমি তাড়াতাড়ি করে অন্যদিকে ফিরে বললাম,

“উফ চেন্জ করার আগে দরজাটা লাগাতে পারেননি। ”

আমার কথা শুনে শান ভাইয়া বললো,
“কি হলো তুমি ওদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

“তাহলে কি আপনার দিকে ফিরে থাকব?”

“সে তুমি চাইলে তাকাতেই পারো আফটার অল তোমারই তো হাজবেন্ড। ”

“আপনার মাথা। নিজের কি অবস্থা একবার দেখেছেন। ”

শান ভাইয়া আমার সামনে এসে বললো,
“কি অবস্থা? ”

শান ভাইয়া সামনে আসতেই আমি অন্যদিকে ঘুরে গেলাম,
“একদম সামনে আসবেন না। আপনার জামা-কাপড় কই?শুধু টাওয়াল পড়ে আছেন কেন? আপনি কি ভুলে গেছেন যে ঘরে আপনি ছাড়া আরো একজন থাকে।”

“এমন কি খারাপ অবস্থায় আছি। টাওয়াল আছে তো। আর তুমি এমন করছো এই প্রথম আমাকে এভাবে দেখছো।বাপরে তোমার দাঁতে কি জোড় সেদিন কি জোরে কামড় মেরেছিলে রাক্ষসী । ”


শান ভাইয়ার কথা শুনে আমার আমাদের প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে গেল। যেটা চাইলেও কখনো আমি ভুলতে পারব না।
আমি শান ভাইয়াদের বাড়িতে বেড়াতে গেছিলাম। সবার সাথেই দেখা হয়েছিল শুধু শান ভাইয়া ছাড়া। ওনাকে এর আগে আমি কখনো দেখিনি। কারণ উনি স্ট্যাডির জন্য বাহিরে থাকতেন।এই বাড়িতে আসলেই একটা রুমে আমি বেশী থাকতাম।কারণ ওই রুমটা একদম আমার মন মতো সাজানো ছিল। সবথেকে ভালো লাগত বেলকনিটা। তবে সেটা কার রুম ছিল আমি জানতাম না। তাই প্রতিবারের মতো এসেই আমি বেলকনিতে চলে গেলাম। এখান থেকে প্রকৃতির সৌন্দর্যটা ভালোই উপভোগ করা যেত বাহিরে না গিয়ে।

হঠাৎ খট করে দরজা আটকানোর শব্দ হতেই আমি ভয়ে দৌড়ে বেলকনি থেকে আসতেই দেখলাম একটা ছেলে খালি গায়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। শুধু একটা ট্রাউজার পরা ছিল। আর শরীর মুছছিল। সম্ভবত গোসল করে বেরিয়েছে। যেহেতু আমি আগে উনাকে দেখিনি তাই ভয় পেয়ে দিলাম চিৎকার।

“আআআআআআআ।”

আমার চিৎকার শুনে ছেলেটা দ্রুত আমার দিকে ফিরেই হা করে তাকিয়ে থাকল। আমি তখনও চিৎকার করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ উনাকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি ভয়ে বেডের উপরে উঠে বলে উঠলাম,

“এই ওখানেই দাড়ান একদম আগাবেন না বলছি।”
“তার আগে বলো তুমি কে?এখানে কি করছ? ”
“আগে বলুন আপনি কে?”
ছেলেটা আমার কথায় হাহা করে হেসে বললো,
“আমার বাড়ি আমার ঘর কোথা থেকে টপকে বলছে আমি কে?এবার বলো তুমি কে?”
“আমি এখানে বেড়াতে এসেছি। ”
“তুমি নজরুল আঙ্কেলের মেয়ে।”
“হুম।”
“আচ্ছা নিচে নেমে আসো।”
“নামছি আগে আপনি সরুন। ”
“না তুমি নামো আগে। ”

আমি না বোধক মাথা নাড়ালাম। উনি না সরলে আমি নামবো না। এভাবেই আমাদের তর্ক চলতে লাগল। হঠাৎ কথার মাঝে উনি কখন বেডে উঠেছে খেয়াল করিনি। এসেই আমার হাত ধরে বসলো

“আরে আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন?ছাড়ুন বলছি নাহলে আমি কিন্তু চিৎকার করব।”
“এতক্ষন ভালো ভাবে বলেছি শুনোনি এখন করো চিৎকার আমিও দেখি তোমার স্পিকারে কত দম। ”

উনার কথা শুনে ভয়ে আমার গা কাঁপতে লাগল। তাই নিজেকে ছাড়াতে উনার বাহুতে একটা কামড় দিতেই উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন আর সেই সুযোগে আমিও দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। ব্যাস সেদিন থেকেই উনাকে অসহ্য লাগত। আর শুরু হলো উনার সাথে আমার ঝগড়া। যেটা আজ পর্যন্ত চলছে।

“ও ম্যাডাম কি ভাবছ। চুপ কেন?”

শান ভাইয়ার কথা শুনে আমি বাস্তবে ফিরে এলাম,

“ছি ছি কি খারাপ আপনি। ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো ওকে। আমি ইচ্ছা করে দেখতে যাইনি আর কামড়টা আপনার ভাগ্যে ছিল।?”

“হুম। তাহলে আজকেও তো এক্সিডেন্টলি হয়েছে এতো হাইপার হওয়ার কি আছে নাকি আজকে ইচ্ছা করেই দেখেছো। ”

“ছি ছি কি সব কথা বার্তা। আমার বয়েই গেছে আপনাকে দেখতে। কখন এসেছেন বাসায় আমি ভাবলাম এতক্ষণে চেন্জ করে নিয়েছেন। ”

“এতো তাড়াতাড়ি হয় নাকি।ভালো করে ফ্রেস হতে হবে না। ”
“হুম মেয়েদের থেকেও বেশী টাইম লাগে বসে বসে রূপচর্চা করেন। ”
“কি ফালতু কথা বলছো তুমি। ”
“বেশ করেছি। এখন তাড়াতাড়ি ড্রেস পড়েন।”

শান ভাইয়া আর কোনো কথা না বলে নিজের ড্রেস পড়ে নিলো।
“এই যে ম্যাডাম এইবার এদিকে তাকাতে পারেন। ”

শান ভাইয়ার কথা আমি ঘুরে তাকালাম। উনি একটা হোয়াইট ট্রাউজার আর লাল টি-শার্ট পড়েছে। জাস্ট ওয়াও লাগছে দেখতে। তাও আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষন চুপ থেকে বললাম,

“আপনার ফোনটা একটু দেয়া যাবে। ”
শান ভাইয়া আমার পাশের সোফায় বসে বললো,
“কি করবে?”
“আম্মুর সাথে কথা বলব।”

শান ভাইয়া তার ফোনটা আমার হাতে দিতেই আমি ফোনটা নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলাম। আম্মুকে ফোন দেওয়ার সাথে সাথে আম্মু রিসিভড করলেন,

“হ্যাঁলো শান। কেমন আছিস। ”
“আম্মু আমি সোহা। ”
“শানের ফোন থেকে হঠাৎ। তোর ফোন কই? ”
“হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে।”
“কি যে করিস নিজের জিনিস নিজে সামলাতেও শিখিসনি। এখনো বাচ্চাই রয়ে গেলি। ”
“হুম তোমার এই কথা গুলো অনেক মিস করছিলাম আম্মু। ”

কথাটা বলতেই আমার গলা ধরে এলো। আম্মু বললো,
“সোহা তুই কাঁদছিস কেন। ”
আম্মুও কান্না করে দিলো,
“তোমাদের দেখতে ইচ্ছা করছে। কবে আসবা তোমরা। ”
“আরে বোকা মেয়ে তুই কাঁদছিস কেন?আমরা খুব তাড়াতাড়ি আসব। আর নাহলে শানকে নিয়ে তুই চলে আয়। তোর বাড়ি তোর ঘর। ”
“হুম অবশ্যই আসব তবে ওই হনুমানটাকে আনব না। ”
“ছি মা নিজের হাজবেন্ডের সম্পর্কে এমন বলে না। এইবার একটু নিজের জিনিস গুলো আগলাতে শিখ নাহলে কখন হাতছাড়া হয়ে যাবে টেরও পাবি না। ”
“উফ মা কিছু হবে না আমি সব সামলে নেবো।”

এরপর আম্মুর সাথে অনেক কথা বললাম। কথা শেষ করে চোখ মুছে বেলকনি থেকে বেরিয়ে গেলাম।তারপর শান ভাইয়ার ফোন ওনাকে দিয়ে দিলাম।তখনই শান ভাইয়া বললো,

“কি হলো তুমি কাঁদছিলে?”
“না কাঁদবো কেন?”
“মিথ্যা বলছো কেন সোহা। তোমার চোখ মুখ দেখলেই বুঝা যায় তুমি কান্না করছিলে। বলো কি হয়েছে?”
“কিছু না ওই আম্মুর সাথে কথা বলছিলাম তাই। ”
শান ভাইয়া একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললেন,
“তুমি আন্টির সাথে কান্নাকাটি করেছিলে? আন্টি কি ভাবল। আমরা কি তোমাকে কষ্টে রেখেছি। ”
“আমি কি সেটা একবারও বলেছি? আপনার কি মনে হয় আমি শ্বশুরবাড়ীর নিন্দা করেছি?”
“তাহলে কাঁদছিলে কেন?”
“আপনারা ছেলেরা সেটা বুঝবেন না। কারণ আপনাদেরকে তো আর আপনার চেনা জায়গা, চেনা মানুষ, চেনা বাড়ি, বাবা,মা ছেড়ে একেবারের জন্য চলে যেতে হয় না। যদি হতো তাহলে হয়তো আমার অবস্থা বুঝতেন। ”

কথাটা বলেই আমি বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে।
শান হা করে তাকিয়ে আছে। ও ভাবতেও পারেনি সোহার মনে অবস্থা এমন হয়ে আছে। তাই ও মনে মনে ভাবল সময় করে একবার সোহাদের বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।
ভেবেই সোফায় বসল শান। ফোনের দিকে তাকিয়ে রেকর্ডিংটা একবার শুনে ডিলেট করে দিলো। শান ভেবেছিল সোহা হয়তো ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলবে বলে ফোন নিয়েছে তাই রেকর্ডিংটা অন রেখেছিল। নিজের বোকামির কথা মনে করে নিজেই হেসে দিল।



রাতে সবাই ডিনার করতে বসল। আমি আর ভূমিকা আপু সবাইকে সার্ভ করে দিতে লাগলাম। আমার হাত কাঁটা তাই শান ভাইয়া আমাকে আগেই খাইয়ে দিয়েছিলো। এখন নিজে বসল। আমার সবার সামনে এতো লজ্জা লাগছিলো বলার বাহিরে। সবাই খাচ্ছিল তখনই শান ভাইয়া বলে উঠল,

“আব্বু আমি এই সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকা ব্যাক করবো। ওখানে অনেক কাজ পেন্ডিং পড়ে আছে। তাই আমাকে যেতে হবে।”

শান ভাইয়ার কথা শুনে আমি অবাক হলাম। ঢাকা যাবে মানে?তাহলে কি আমাকেও যেতে হবে?তাহলে আমার পড়া? তখনই শান ভাইয়ার আব্বু বলে উঠল,

“ঢাকা যাবে মানে? ঢাকা গেলে সোহার পড়াশুনার কি হবে?”
“ও তো যাচ্ছে না। আমি যাবো শুধু। ও এখানেই পড়াশুনা করবে।”
“মানে?ও এখানে একা থাকবে নাকি?”
“একা কই তোমরা তো আছো?”
“আমরা থাকা আর তুমি থাকা কি এক শান? বাচ্চাদের মতো কথা বলো না।ওর কতো কাজে তোমার হেল্প লাগতে পারে। ”
“জানি বাবা কিন্তু বিজন্যাসের দিকটাও দেখতে হবে। আর এছাড়া ও তো এখানে আগে থেকেই থাকে সবকিছু চেনা জানা আশা করি সমস্যা হবে না। আর এখানে থাকতে ভালো না লাগলে ওর বাবা মায়ের কাছে গিয়েও থাকতে পারে সমস্যা তো কিছু নেই। ”

শান ভাইয়ার এমন গা ছাড়া ভাব দেখে একটু কষ্ট হলো আর উনি চলে যাবে শুনে কেমন যেন খারাপ লাগছিল। কিন্তু কেন?উনি চলে যাবে সেটা তো ভালো খবর আমার জন্য। আমার ইচ্ছা অনুযায়ী থাকতে পারবো। তাহলে এতোটা খারাপ লাগছে কেন?

“সমস্যা আছে শান। তুমি যাবে না। ”
“তাহলে ঐ দিকের কি হবে?”
“সাম্য আছে তো ও সামলে নিবে। ”
তখনই সাম্য ভাইয়া বলে উঠল,
“হ্যঁ শান আমি সামলে নিবো। তুই এখানেই থাক। ”
“কিন্তু ভাইয়া। ”
“কোনো কিন্তু নয় শান। আমাদের বিজন্যাসের ব্রান্ঞ্চ তো চট্টগ্রামেও আছে। আগে আরশ সামলাতো। কিন্তু এখন তো ও নেই। ”
বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“এখন তুমি সামলাও এখানে আর সাম্য ঢাকা। ”

এরপর সবাই যার যার মতো খেয়ে চলে গেল। সাম্য ভাইয়ারা কাল সকালে চলে যাবে। অনেকটা খারাপ লাগছিলো শুনে। কিন্তু কিছু করার নেই। সবার খাওয়ার পর আমরা মেয়েরা মিলে টেবিল গুছিয়ে যার যার ঘরে চলে গেলাম।



রুমে এসে দেখলাম শান ভাইয়া কিছু ফাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। আমি এসে সোফায় বসলাম। হঠাৎ কি মনে হতে শান ভাইয়াকে বললাম,

“আপনার গার্লফ্রেন্ড কোথায় থাকে।”

আমার কথায় শান ভাইয়া মুখ তুলে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকালো তারপর আবার কাজে মন দিয়ে বললো,

“ঢাকা। ”

আমি বিরবির করে বললাম,
“ওহ এইবার বুঝেছি এজন্যই ঢাকা যাওয়ার এতো তাড়া। দেখা হয় না তো অনেকদিন যতোসব আদিখ্যেতা। ”

আমি আস্তে করে সোফায় শুয়ে পড়লাম।তখনই শান ভাইয়া বললো,
“বিছানায় এসে শুয়ে পড়।”
“দরকার নেই আমি এখানে ঠিক আছি। ”
“তোমাকে আমি অনুরোধ করিনি। তাড়াতাড়ি এসো।এতো বড় বিছানা থাকতে সোফায় কেন ঘুমাচ্ছো।”
আমি কিছু না বলে চুপ থাকলাম।আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি বললেন,
“ভয় নেই আমি আমার সীমানার মধ্যে থাকব। ”

উনি কথাটা বলতেই আমি অবাক হয়ে তাকালাম। উনি বুঝল কি করে যে আমি এজন্যই চিন্তা করছিলাম। উনি এখনো নিচের দিকে তাকিয়ে কাজ করছিলো। আজকে কেন জানি ওনাকেই দেখতে ইচ্ছা করছে বারবার। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম কিন্তু বিছানায় যেতে কেমন জানি লাগছিল তাই বসেছিলাম। হঠাৎ শান ভাইয়া আমার
কাছে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলো,

“আরে কি করছেন আপনি। নামান আমাকে। প্লিজ প্লিজ। ”

আমি ছোটাছুটি করছিলাম। শান ভাইয়া আমাকে বেডে শুয়ে দিলো।আমি অবাক হলাম,

“এখন ঘুমাও। ভালো কথা শুনলে এতো কষ্ট করতে হতো না আমার। ”

“আমি….। ”

উনি আমার উপর ঝুঁকে ঠোঁটে একটা আঙ্গুল দিয়ে আমাকে থামিয়ে দিলো। আমার নিঃশ্বাস খুব দ্রুত চলছিল। আমি এখনও উনার দিকেই তাকিয়ে। এটা কোন শানকে দেখছি যেন চিনতেই পারছি না।শান বললো,

“হুশ কোনো কথা নয়। ঘুমাও। ”

আমি আর বাক্য ব্যয় না করে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লাম।



সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম শান ভাইয়া একদম নিছানার একপাশে ঘুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। মাঝে কোল বালিশ থাকা স্বত্ত্বেও উনি অনেকটা জায়গা ফাঁকা রেখে শুয়েছে। এমন অবস্থা যে আরেকটু হলেই নিচে পড়বে। আমার কেন জানি হাসি চলে আসল।

ওনার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে ফ্রেস হতে গেলাম। নিচে গিয়ে আজ নিজের হাতে চা বানিয়ে সবাইকে দিলাম। এখন হাতে ব্যাথাটাও কম আছে। শান ভাইয়া মেডিসিন এনে দিয়েছিলেন। সবাইকে দেওয়ার পর রুমে গিয়ে দেখলাম শান ভাইয়াও উঠে গেছে।

“এই নিন আপনার তিতা করলার রস। ”

আমার কথা শুনে শান ভাইয়া আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকলো।

“আই মিন কফি। ”

শান ভাইয়া কপালে একবার স্লাইড করে একটা নিশ্বাস নিলেন তারপর কফিটা নিলেন আমার থেকে।

“ধন্যবাদ।”
“হুম। ”
“আচ্ছা সোহা একটু বিছানার উপর থেকে আমার ফোনটা নিয়ে আসো তো।”
“আমি কেন আপনি যান। ”
“প্লিজ।”

হঠাৎ উনার প্লিজ শুনে থতমত খেয়ে গেলাম কি ব্যাপার আজ এতো সুন্দর ভাবে কথা বলছে? আমি ওনার ফোন আনতে বিছানার কাছে যেতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম।

উনার ফোনের পাশেই একটা নতুন ফোন রাখা। বক্সের নিচে একটা রঙ্গিন কাগজে লেখা,

“স্যরি কালকে তোমার সাথে অমন ব্যবহার করার জন্য। আমি এমন করতে চাইনি। কিন্তু তোমার কথা শুনে রাগ হয়েছিল। আমি জানি না তুমি আমাকে কেমন ভাবো। তবে তুমি আমাকে যতটা খারাপ ভাবো অতটা খারাপ আমি নই। তোমার ফোনটা ভেঙে দিয়েছিলাম তাই তেমনই দেখতে আরেকটা কিনে দিলাম। ভেবে নিও এটাই তোমার আপুর দেওয়া।”
ইতি,
শান।

আমি ফোনটা পেয়ে অনেক খুশি হয়ে গেলাম। পিছনে ফিরতেই দেখি শান ভাইয়া দুই পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। আমি আমার খুশি আটকাতে না পেরে শান ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলাম। সোহার এমন কাজে শান পুরা ফ্রিজড হয়ে গেল। ও ভাবতেও পারেনি এমন কিছু হবে।
.
.
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে