এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা পর্ব-২১+২২

0
1137

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২১ |

———————–
–“আপনি কেন আমায় “আপনি” সম্বোধন করেন? ধারণা করছি আপনি আমার থেকে প্রায় দশ-এগারো বছরের বড়ো! এত বড়ো ছেলে হয়ে আমার মতো পিচ্চি মেয়েকে “আপনি” সম্বোধন করছেন। এটা বড্ড অস্বস্তিকর আমার জন্যে!”

ইরা’দ বিস্তর হাসি দিলো। নওরি পিটপিট করে চেয়েই রইলো। ইরা’দ হাসি থামিয়ে বলে,
–“আমি চাই না অনুমতি ছাড়া “তুমি” সম্বোধন করে অ!সভ্য, অ!ভদ্র খেতাব পেতে। আপনার ক্ষেত্রে তো একদমই নয়।”
–“কেন? অন্যদের থেকেও অনুমতি নেন বুঝি?”
–“না তেমন কিছু নয়।”
–“তাহলে?”

ইরা’দ এবার গভীর নজরে তাকালো। সেই চাহনি যেন চৌম্বুকের মতো টানছে নওরিকে। নওরি দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেললো। ইরা’দ অধর বাঁকিয়ে হেসে বলে,
–“সবক্ষেত্রে অনুমতি নিতে হয় না আবার হয়ও। অনুমতির জন্যে আপনি নাহয় হলেন স্পেশাল মানুষ। তাতে কী? তবে আপনার অনুমতি ছাড়া আমি “তুমি” তে আসতে পারব না।”

–“আপনি আমার কোন কথার অনুমতি নেন শুনি? সবই তো নিজ ইচ্ছাতেই করেন!”
বাক্য দুটি নওরির খুব করে বলতে চাইলেও গলার স্বর তাকে প্রত্যাখান করলো৷ নওরি অস্বস্তিতে অধর ভিঁজিয়ে নিলো। কম্পিত কন্ঠে আওড়ায়,
–“অনুমতি দিলাম!”
–“কিসের? বিয়ের?”

নওরি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো ইরা’দের পানে। ইরা’দ খিলখিলিয়ে হাসলো। হাসি থামিয়ে আবারও বলে,
–“জাস্ট কিডিং!”
নওরি মুখশ্রী ঘুচে জবাব দেয়,
–“তুমি সম্বোধনের।”

——————-
দিনটা সোমবার। বিকাল চারটা বেজে পাঁচ। এডমিশনের আর মাত্র কিছুদিন বাকি। নার্ভাসনেস এবং পড়ার চাপে নওরির বেহাল অবস্থা। পারা জিনিসগুলো ভুলে যাচ্ছে। এ বিষয়টি বড্ড বিরক্তিকর। নওরি ঠিক এ সময়টাতেই কেমিস্ট্রির এক জায়গায় আটকালো। মাথায় এলো আরও পড়া আছে, একটা বিষয় নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বিরক্তি ঠেলে নওরি বই নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ইরা’দ নিশ্চয়ই এ সময়ে বাসায় আছে। তাকেই লাগবে এখন। নওরি প্রথমে ইরা’দকে কল দেয়। একবার, দু’বার, তিনবার। কিন্তু ইরা’দ কল রিসিভ করেনি। নওরি এবার আগে পিছে না ভেবে দ্রুত ছুটলো ইরা’দের বাসার উদ্দেশ্যে। বৈঠকঘর অতিক্রম করতেই নূরজাহানের পিছুডাক শ্রবণ হলো। তড়িৎ থমকে দাঁড়ায় নওরি। নূরজাহান কিচেন থেকে এগিয়ে এসে বলে,
–“কোথাও যাচ্ছো?”
–“জ্বী আন্টি। পড়া বুঝছি না, তাই দো’তলায় যাচ্ছি।”
–“ওহ! তাহলে তো বেশ ভালো। একটু দাঁড়াও আমি যাবো আর আসবো!”

নূরজাহানের দাঁড় করানোর মানে বুঝলো না নওরি। নূরজাহান নওরির হ্যাঁ, না; না শুনেই কিচেনের দিকে ছুটলো। এক বাটিতে কতগুলো পিঠা নিয়ে ফেরত এলো। নওরি পিঠার নাম না জানলেও এইটুকু মাথায় এলো এগুলো তেলের পিঠা। নওরি মূলত এই নামেই চেনে। কিন্তু এই গরমে পিঠা? হাস্যকর লাগলেও নওরি প্রকাশ করলো না।

নূরজাহান নওরির দিকে পিঠা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–“ইরা’দের নাকি হঠাৎ পিঠা খেতে ইচ্ছা হয়েছে। তাই সবার জন্যে বানিয়েছি। তুই যেহেতু যাচ্ছিস-ই সেহেতু এটাও নিয়ে যা!”
নওরি সপ্তপর্ণে পিঠার বাটিটা নিয়ে বলে,
–“ঠিকাছে!”

নওরি এক মুহূর্তও দেরী না করে নিচে চলে গেলো। দুই হাত ভর্তি থাকায় সদর দরজা লাগাতে ভুলে গেলো। কলিংবেল বাজিয়ে নওরি একমনে দরজায় লাগানো লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিশ্চয়ই মৌসুমি আন্টি নওরিকে এখান দিয়ে উঁকি মেরে দেখবে। ভাবনাটা মাথায় আসতেই নওরি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলো। এক হাতে ক্ষণে ক্ষণে ঘোমটা আরও টেনে আনছে। ঘোমটা টানতে টানতে কপাল ছুঁয়েছে৷ তাও যেন নওরির কাছে লাগছে ওড়নাটা এখনই পরে যাবে। মিনিট পাঁচেক পর আবার কলিংবেল চাপতেই সাথে সাথে দরজা খুলে গেলো৷ নওরি চোখ তুলে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। ইরা’দ টাউজার পরিহিত অবস্থায়। গায়ে এক পট্টি জামার অংশ নেই; উম্মুক্ত৷ গলায় ঝুলানো তোয়ালের এক অংশ দিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে ইরা’দ বলে,
–“স্যরি মা, আমি আসলে গোসলে ছিলাম। ভে…”

ইরা’দ তখনো লক্ষ্য করেনি নওরিকে। চোখ তুলে তাকাতেই ইরা’দ নিজেও অপ্রস্তুত হলো। নওরির চোখ জোড়া ততক্ষণে যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। ইরা’দ তৎক্ষণাৎ নওরির মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো। ভেতর থেকে দৌড়-ঝাপের শব্দ আসছে। ঘটনা সব এত দ্রুত ঘটলো যে নওরির মাথার উপর দিয়ে গেলো। মিনিটখানেকের মধ্যে আবারও দরজা খুললো ইরা’দ। তবে এবার খালি গায়ে নয়। টি-শার্ট পরেছে। তাও পেশিবহুল হাত গুলোর দিকে তাকালে সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে আসছে নওরির। হৃদপিন্ড তাঁর ওঠা-নামার শব্দ বাড়ালো। ঢিপঢিপ শব্দ। নওরি দৃষ্টি পদতলের দিকে নিক্ষেপ করে কম্পিত হাতে পিঠার বাটিটা এগিয়ে দিলো। ইরা’দ বুঝতে পারছে নওরি ভীষণ অস্বস্তিতে ভুগছে।

ইরা’দের নিজের উপর-ই রাগ হচ্ছে। বিরক্তিতে কপালে ভাঁজ পরেছে। নওরিকে নিজের সাথে সহজ করতে বহুত কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। এমতাবস্থায় আজকের এই অপ্রস্তুত ঘটনায় নওরির মস্তিষ্কে আবারও পুরানো অস্বস্তিটা ফিরবে! ফিরেও গিয়েছে নির্ঘাত! ইরা’দ নিচু স্বরে বলে,
–“স্যরি! আমি ভেবেছিলাম মা এসেছে! হঠাৎ আসলে যে?”
–“আসলে,”

নওরির কথা গলাতেই বারবার আটকে যাচ্ছে। শুকনো ঢোঁকে কয়েকবার গলা ভেঁজানোর মিথ্যে প্রচেষ্টা চালালো। ইরা’দ উৎসুক নজরে তাকিয়ে আছে নওরির পানে; উত্তরের অপেক্ষায়। নওরি আমতা আমতা করে বললো,
–“পড়া বুঝি না। কলও দিয়েছিলাম আপনাকে, কিন্তু রিসিভ করেননি!”

বলেই ইরা’দের দিকে কিছুটা নজর উঠিয়ে দেখতেই বিষম খেলো। ইরা’দের কপাল ভেঁজা চুলগুলো বিচরণ করছে। এক দুই বার চুল চুইয়ে সূক্ষ্ম পানির বিন্দু পরেছে৷ নওরি সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে ফেলে। ইরা’দ বলে, “ও আচ্ছা!”

ইরা’দ হঠাৎ ভেতরে চলে গেলো। নওরি ভাবলো হয়তো এখানেই তাকে পড়াবে। নওরির ভেতরে যাওয়ার সাহস হলো না। তাও পড়ার খাতিরে ভেতরে প্রবেশ করতে নিবে ওমনি ইরা’দ এসে হাজির। দরজা ধরে এমন ভাবে দাঁড়ালো যেন নওরি প্রবেশ করতে না পারে। এটা নওরি সহজেই বুঝে ফেললো। সাথে পরলো একরাশ লজ্জায়। কী বো!কামি করতে নিয়েছিলো সে। নিজেকে নিজেই গাল-মন্দ করলো। আর ইরা’দের-ই বা কী সমস্যা? ভদ্রতা বজায় রেখে ভেতরে আসার কথা একবারও তো বললো-ই না উল্টো ভেতরে যেতেও দিচ্ছে না। নওরির ভাবনায় জোরালো ছেদ ঘটিয়ে ইরা’দ বলে ওঠে,
–“আমাকে অ!ভদ্র ভেবো না। বাসায় কেউ নেই। তোমাকে নিয়ে ফাঁকা বাসায় থাকাটা দৃষ্টিকটু।”

নওরির মনে পরলো একটু আগে যখন ইরা’দ দরজা খুলেছে তখন ভুলবশত “মা” এর কথা বলছিলো। এত সহজে মাথা থেকে ব্যাপারটি বেরিয়ে গেলো। নওরি নিজের হাতে নিজেই চিমটি কাটলো। নওরি যেন আপাদমস্তক বো!কামীর ভান্ডার। তবে এক মুহূর্তের জন্যে ইরা’দের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ বাড়লো। নওরি তড়তড় করে বলে ওঠে,
–“না, না। ভাবিনি। আমি বুঝতে ভুল করেছি।”
–“রাগ করেছো?” ইরা’দের কন্ঠস্বর কিছুটা করুণ শোনালো। নওরি চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলে।
–“রাগ করবো কেন? আপনি আসুন বাসায়, আমি যাচ্ছি।”

নওরি সিঁড়িদ দিকে চলে গেলো। ইরা’দ নওরির যাওয়ার পানে তাকিয়ে মিনমিন করে বলে,
–“যেদিন আমার বউ হবে, সেদিন তুমি নির্দ্বিধায় আমার সাথে একা থাকতে পারবে নৌরি ফুল। আমি চাই না আমার এই সতেজ ফুলের গায়ে কোনোরূপ দাগ লাগুক, তাঁর স্নিগ্ধ, সুগন্ধীময় পাঁপড়ি ঝড়ে পরুক। অন্তত এই ইরা’দ ঝড়তে দিবে না। সপ্তপর্ণে আগলে নিবে!”

বলেই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। সিঁড়ি দিয়ে কারো নামার শব্দ শুনে ইরা’দ ভেতরে গিয়ে দরজার লাগিয়ে দিলো। দরজা লাগিয়ে পেছনে ফিরতেই দেখলো ফ্রিশা আয়েশ করে বসে ইরা’দের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে লেজ নাড়াতেও ভুলতে না। ইরা’দ ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে বলে,
–“ও হ্যালো! আপনার ম্যাডাম আমার কাছে নেই। এখানে কী চাই?”

ফ্রিশা কোনো পতিক্রিয়া দেখালো না। নিশ্চয়ই ইরা’দের কথা বুঝতে পারেনি। সে আগের মতোই বসে আছে। এক প্রকার চোখ দিয়ে গিলছে!

——————-
ইরা’দ যেদিকেই যাচ্ছে ফ্রিশা তাঁর পিছু পিছু হাঁটছে। ইরা’দ এবার মজা বিরক্ত। অলরেডি দুবার পুরো বাসা টহল দেয়া শেষ। তাও এই বিল্লুরাণী তাঁর পিছুই ছাড়ছে না। ছায়ার মতো তাঁর পিছে পরে আছে। একসময় হাঁপিয়ে গিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পরলো। ফ্রিশাও সময় বিলম্ব না করে এক লাফে ইরা’দের কোলে গিয়ে বসলো। ইরা’দের যেন নিজেকে সবচেয়ে অসহায় মনে হলো। ইচ্ছে করছে দুই চিমটিতে ধরে জানালা দিয়ে ফেলে দিতে। কিন্তু কিছুই করার নেই। তাঁর নৌরি ফুলের বিড়াল বলে কথা। ইরা’দ একসময় বিরক্ত হয়ে চেঁচালো,
–“এই তুই ছেলে নাকি মেয়ে? আমার পিছে লেগেছিস কেন?”
ফ্রিশা ঘাড় বাঁকিয়ে ইরা’দের বিরক্তিমাখা মুখমন্ডলের দিকে তাকালো। ইরা’দের আরও কাছ ঘেঁষে আহ্লাদী হয়ে মাথা ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,
–“মিঁয়্যাও!”
–“মিউমিউ আমার সাথে চলবে না। সর, নিজের পথে যা!”

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২২ |

——————–
–“এটা তো সেদিন-ও বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। এত দ্রুত ভুলে গেলে?”

নওরি ইতস্তত সহিত বলে,
–“নার্ভাসনেসে ভুলে যাচ্ছি!”
ইরা’দ নিরবে শুনলো। পড়া আবার বুঝালো। পরে কী ভেবে পকেট থেকে চুইংগাম বের করে নওরির দিকে এগিয়ে দিলো। নওরি একবার চুইংগাম তো একবার ইরা’দের দিকে তাকাচ্ছে।
–“এটা কেন?”
–“অফ কোর্স খাওয়ার জন্যে।”
–“হঠাৎ?”

ইরা’দ চুইংগামের প্যাকেট খুলতে খুলতে বললো,
–“নার্ভাস হলে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়, এজন্য অনেক সময় জানা কথা বা পড়াগুলোও ভুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য মুখে চুইংগাম রাখো। চিবুলে তোমার মস্তিষ্ক নার্ভাসনেস বুঝতে পারবে না। নাও খাও!”

নওরির প্রথমে জড়তা হচ্ছিলো নিতে। নাকোচ করলেও পরবর্তীতে ইরা’দ জোর করে চুইংগাম মুখে দিয়ে দেয়। অতঃপর বলে,
–“চিবাও আর দ্বিতীয়বার পড়ায় মনোযোগ দাও। আমার বাইরে যেতে হবে। কাজ আছে!”
–“রাজনীতিতে কী শুধু মা!র-পিটই হয়?”

উঠে দাঁড়ানো ইরা’দ নওরির এহেম প্রশ্নে থমকে যায়। পরমুহূর্তে হেসে বলে,
–“জ্বী না। মানুষদের সুবিধা, অসুবিধা দেখা আমাদের কাজ। অ!ন্যায় হলে প্রতিরোধ করা। এছাড়া কাগজ-পত্রের কিছু কাজও আছে। যা তুমি বুঝবে না। আপাতত পড়ায় মনোযোগ দাও।”

ইরা’দ চলে গেলো। নওরি ইরা’দের যাওয়ার পানে তাকিয়ে হাসলো। আজকাল কেন যেন ইরা’দকে তার ভীষণ ভালো লাগে। ইরা’দের সাথে সময় কাটালে যেন পুরানো ক্ষত গুলো হারিয়ে যায়। কেন হয় নওরি জানে না। অদ্ভুত অনুভূতি হয় তাঁর। সবথেকে বড়ো কথা, ইরা’দের দেয়া অতিরিক্ত সম্মানে নওরি মুগ্ধের উপর পর্যায়ে যদি কিছু থাকে তাহলে সেটা! নওরি হাসি থামিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলো।

ইরা’দ সদর দরজা খুলতে গেলে তাঁর মন তেমন খচখচ করে উঠলো। ভ্রু কুচকে পিছে তাকালো। যা ভেবেছিলো তাই! এই বিড়াল এই জম্মেও তাঁর পিছু ছাড়বে না। ইরা’দ জোরে চেঁচিয়ে সারিফাকে ডাকলো। সারিফা হন্তদন্ত হয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
–“কী হয়েছে ভাইয়া!?”
–“এই স্টুপিড বিড়ালকে সরা আমার থেকে। এটা আজ নওরির পিছু পিছু আমার বাসা পর্যন্ত চলে গেছে। আর এখন আমার সাথেই যাবার প্ল্যান করছে!”

চেঁচামেচি শুনে নূরজাহানও আসলো। ইরা’দের মুখে ফ্রিশাকে নিয়ে অভিযোগ শুনে মুখ টিপে হাসলো। সারিফা গোমড়ামুখো ফ্রিশাকে কোলে নিয়ে বলে,
–“তুমি যাও। ফ্রিশা আর যাবে না!”

ইরা’দ ফ্রিশার দিকে একপলক গরম চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো।

—————-
একমাস লাগিয়ে বিভিন্ন পাবলিক ভার্সিটিতে এডমিশন টেস্ট দিলো নওরি। নওরিকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছে সৈকত সাহেব এবং ইরাদ। তবে সৈকত সাহেব-ই বেশি সময় দিয়েছেন। তিনি এ নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ। কিন্তু স্ত্রীর অসংখ্য অনুরোধে তিনি আর না করতে পারেননি। কিন্তু এই গরমে এত মানুষের ভীড় ঠেলে চলাচল তাঁর জন্যে বড্ড কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সৈকত সাহেব মুখে কিছু না বললেও তাঁর চেহারা – ভঙ্গি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে যে তিনি কতটা বিরক্ত। নওরি বুঝেও একদম চুপ থাকে। মন-প্রাণ দিয়ে দোয়া করে যেন সৈকত সাহেবের কষ্ট বিফলে না যায়। মানুষটা আসলেই খেটেছে নওরির জন্যে। নওরি যেন একটা পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যায়!

পরীক্ষা শেষে বের হবার পর সৈকত সাহেবের কল আসলো। সৈকত সাহেব কানে ফোন দিয়ে কথা বলে নেয়। অতঃপর কল কেটে বলে,
–“আমার অফিস আছে যেতে হবে।”
নওরি চোখ বড়ো বড়ো করে সৈকত সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“আমি কী তাহলে একা যাবো?”
–“আমি বেপরোয়া নই যে তোমায় একা ছাড়বো। ইরা’দ আসবে নিতে। তুমি গেটের কাছে অপেক্ষা করো। আর এই নাও তোমার ফোন!”

বলেই সৈকত সাহেব নওরির ফোনটা দিয়ে চলে যায়। নওরি গেটের কাছেই নিরবে দাঁড়িয়ে রয়। চারপাশে মেলা মানুষের ভীড়ে নিজেকে বড়োই একা লাগছে নওরির। তবে নওরি পর্যবেক্ষণ করে দেখছে ভীড়ের মাঝে থাকা কিছু মানুষদের। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী’রা তাদের বাবা-মায়ের সাথে এসেছে। তাদের মুহূর্তও প্রাণভরে দেখছে নওরি। এর মাঝে বক্ষঃস্থলে শূণ্য অনুভূত হলো। খা খা করে উঠলো অন্তঃস্থল। কেন তাঁর মা নেই? বাবা কেন থেকেও নেই? আজ বড্ড মনে পরছে তাদের। মনে পরছে সেই দিনের কথা; যেদিন নওরির বাবা নিজে রাফিয়াকে নিয়ে ভার্সিটি ভর্তি করাতে নিয়ে গেছিলো। কী হাসি-খুশি ছিলো তাঁর বাবা। আজও চোখের সামনে ভাসছে সেই দিনটি। রাফিয়া, নওরির বাবা; সে কী হাসা-হাসি।

বুক চিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইলো যেন। নওরি বাঁধ সাধলো না। সপ্তপর্ণে চাপা দীর্ঘশ্বাসটি মুক্ত করলো। এসব নানান স্মৃতি চারণ করার মুহূর্তে-ই পেছন থেকে হাতে হেঁচকা টান পেলো। নওরি বাস্তবে ফিরে ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে তাকালো। পেছনে তাকাতেই সেই চিরচেনা পারফিউম নাকে এসে বিঁধলো। অপ্রস্তুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নওরি। তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়েছে ইরা’দ। বরাবরের মতোই তাঁর মুখে মাস্ক এবং চোখে কালো সানগ্লাস। এ রূপেও ইরা’দকে চিনতে অসুবিধে হয় না নওরির। নওরি বলে,
–“এসেছেন?”
–“হুম। পরীক্ষা ভালো হয়েছে?”
–“হ্যাঁ।”
–“তাহলে চলো। ভীড়ে থাকার দরকার নেই। রোদের যা উত্তাপ!”

নওরি হ্যাঁ, না কিছু বললো না। ইরা’দ নওরির হাত ছাড়লো না। বরং নওরির হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে সাবধানে চলাচল করতে থাকে। ইরা’দের ভাব-ভঙ্গি এমন, হাত ছাড়লেই নওরি ছোট বাচ্চার মতো ভীড়ের মাঝে হারিয়ে যাবে। নওরি আনমনেই হাসলো। এই ছোট ছোট যত্নগুলো খুব-ই প্রশান্তিময়, একরাশ ভালো লাগার।

ইরা’দ উবার নিয়ে এসেছে। এখান থেকে তাদের বাসা মিনিমাম দুই ঘন্টার পথ। জ্যামেরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাঁর উপর যা গরম। বাসে করে যাওয়াও সম্ভব না। অন্তত ইরা’দের পক্ষে তো অসম্ভব এবং অসম্ভব।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ইরাদ ফোন চালাতে ব্যস্ত। নওরি আড়চোখে ইরাদকে খেয়াল করছে। ইরাদ মাস্ক এবং চশমা খুলে ফেলেছে। উবারের ভেতরে ঠান্ডা কৃত্রিম হাওয়া বিচরণ।
–“বাহিরে মাস্ক পরেন কেন?”
–“সেফটির জন্যে!”
–“কিসের?”

ইরাদ ফোন রেখে নওরির দিকে তাকালো। হাসার চেষ্টা করে লহু কন্ঠে বলে,
–“সব জায়গাতে-ই আমার শত্রু’রা ওঁৎ পেতে থাকে। তাঁরা আমার চেয়েও আমার আপন, প্রিয়জনদের ক্ষতি করতে বেশি পছন্দ করে। এজন্য আমার সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর জন্যে এই পথ অবলম্বন করতে হয়!”
–“মাস্ক পরিহিত আপনাকে চিনতে পারে না কেউ?”
–“না। সানগ্লাসও চোখে দেই, এজন্য চেনা সম্ভব হয় না।”
–“এই কাজে যেহেতু এতই বিপদ, তাহলে ছাড়ছেন না কেন?”
–“যেটা রক্তের সাথে মিশে যায় সেটা কী ছাড়া সম্ভব?”

নওরি ফ্যালফ্যাল নজরে তাকিয়ে রয় ক্ষণিক সময়। “প্রিয় মানুষ” শব্দ দুইটি কেমন ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো যেন। ইরাদ ফোনের দিকে তাকিয়েই বলে,
–“তোমার দেখা শেষ হলে চলো লাঞ্চ করা যাক। খেতে খেতেই নাহয় বাকিটা পথ পার করবো। অথবা দৃষ্টিকথনে এই লম্বা পথ পাড়ি দিবো। এখন বলো, কোন অপশনটা বেছে নিতে রাজি?”

——————-
বাসায় আসতেই নওরি অচেনা একজন মেয়েকে দেখতে পেলো। পোশাক – আশাকে মর্ডান মনে হয়। দেখতেও দারুণ মেয়েটা। বৈঠকঘরে মেয়েটি নূরজাহান এবং সারিফার সাথে গল্প করছে। নওরিকে প্রথমে নূরজাহান দেখতে পেলো। অমায়িক সুন্দর হাসি দিয়ে এগিয়ে এলেন। নূরজাহানের সাথে সেই অচেনা মেয়েটিও নওরির দিকে তাকালো। সারিফাও মুচকি হাসি দিয়ে নওরির দিকে তাকিয়ে আছে। নূরজাহান এগিয়ে আসলে নওরি সপ্তপর্ণে সালাম দেয়। নূরজাহান বেশ মিষ্টি হাসি দিয়ে সালামের উত্তর নিয়ে বলে,
–“পরীক্ষা কেমন হলো?”
–“জ্বী আন্টি ভালো।”
–“যাক, তাহলে তো ভালোই হলো। ভেতরে চলো আমার কাছে। কিছু জানানোর আছে!”

নওরি দ্বিরুক্তি না জানিয়ে নূরজাহানের পিছে চলে গেলো। যাওয়ার পূর্বে একপলক মেয়েটিকে পুণরায় দেখে নিলো। মেয়েটির চাহনিতে কীরকম অহং এবং অশান্ত মনোভাব অনুভব করলো নওরি। পরমুহূর্তেই মনের ভুল ভেবে বিষয়টি এড়িয়ে গেলো।

নূরজাহান নওরিকে রান্নাঘরে এনে বললো,
–“আফিফাকে দেখেছো?”
–“কে আফিফা?”
–“সারিফার সাথে বসেছিলো যে মেয়েটা!”
নওরির মাঝে হালকা অপ্রস্তুত ভাব আসলো। আমতা আমতা করে বললো,
–“দেখেছি।”
–“কেমন?”
নওরি জড়তার সঙ্গে বললো,
–“ভালো।”
নূরজাহানের চোখ-মুখ হঠাৎ চকচকে হয়ে গেলো। ঝলমলে চোখে কিচেনের বাহিরে একপলক তাকিয়ে নিলো নূরজাহান।
–“কিন্তু আন্টি উনি কে?”
–“তুষারের হবু স্ত্রী। আমি ওকে তুষারের জন্যে পছন্দ করেছি। মেয়েটাও তুষারকে খুব পছন্দ করে।”

—————
–“মৌসুমি কই রে? হুনলাম নূরজাহানে নাকি হের পুলার লেইগা মাইয়া ঠিক করছে? হাছানি?”

মাজেদা বেগম পান মুখে নিয়ে উচ্চস্বরে কথাগুলো বলছিলেন। পান মুখে মানেই তাঁর ফুরফুরে আমেজ। কথা বলতেও আলাদা শান্তি বিরাজ করে। ইদানীং ডাক্তার, হাসপাতাল আর ছেলের বাড়ি করতে করতেই কেটে গেছে। কতদিন তাঁর প্রিয় লাঠিটার যত্ন নেয়া হয় না। আজ সময় নিয়ে লাঠিটাকে তেল দিচ্ছে আর নরম কাপড় দিয়ে মুছে নিচ্ছে। এমতাবস্থায় রুমে প্রবেশ করলো নিদ্র। কোলে তাঁর ফ্রিশা। নিদ্র শুনেছে মাজেদা বেগমের চেঁচিয়ে বলা কথাগুলো।
–“কেন গো নানু। আমার ভাইয়ের জন্যে বউ ঠিক হয়েছে বলে কী তুমি হিংসে করছো?”

মাজেদা বেগম চোখ উল্টে নিদ্র’র দিকে তাকালো। ফ্রিশাকেও ভালোভাবে লক্ষ্য করলো।
–“এই পাকনা কাডাল আইলি কইত্তে? আর এইডি কী-সব পশু-পাখি ছাদনাতলায় আনছিস?”
–“এটা বিড়াল নানু। ওর নাম ফ্রিশা। বুড়ো বয়সে পশুর একটা নাম জানো না?”
–“চুপ কর! কানা না আমি। আমি ভালোভাবেই দেখতাছি ওইডা বিলাই। এই বিলাই তুই আনছিস কেন? দূর হ! এসব ছাইপাশ আমার এহানে কী?”
–“কী বলছো? সারাজীবন তো ইসলাম নিয়ে জ্ঞান দিলা, অথচ এটা জানো না আমাদের নবীজি(স.) এর বিড়াল পছন্দ! এখন তো মনে হচ্ছে আমার না বরং তোমার ক্লাস টু তে ভর্তি হওয়া উচিত। আমি তো তোমার থেকেও জ্ঞানী!”
–“এসব আলতু-ফালতু কথা বলতে আইছিস তুই? শেষবার কইতাছি! ভাগ নয়তো এই লাঠি দিয়া তোর পাছা লাল করুম। সাহস কতো বড়ো, আমারে জ্ঞান দেয়!”

ফ্রিশা তৎক্ষণাৎ বিছানায় উঠে গেলো। অসাবধান বশত পানের বড়ো বোয়ামটা ঠাস করে পরলো। যার ফলে বিছানা জর্দা, সুপারি, পান এবং নানান মশলায় ছড়াছড়ি। এসব দেখে মাজেদা বেগম ঘর কাঁপানো চিৎকার দিয়ে উঠলো। ফ্রিশা আরও কিছু সর্বনাশ করার পূর্বেই নিদ্র ফ্রিশাকে নিয়ে দ্রুত কেটে পরে।

——————
আজ নওরির রেজাল্ট দিয়েছে। প্রতিটি ভার্সিটি থেকেই। সকাল থেকে রেজাল্ট দেখে নওরির পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। তাঁর এতদিনের পরিশ্রম, সংগ্রাম এক নিমিষেই যেন হাওয়ায় মিশে গেলো। প্রাপ্তির পাল্লা ভারি হবার পূর্বেই যেন সব খুঁইয়ে পথে বসে পরলো নওরি। কেন সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা এভাবে ঘুরে গেলো? সে কী ভালো থাকতে পারবে না, নাকি ভালো থাকাটা তাঁর ভাগ্যে নেই?

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় আছি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে