এক বসন্ত প্রেম পর্ব-০৪

0
1259

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৪

হাড় কাঁপানো শীতের রাতে গায়ে একটা মাত্র চাদর জড়িয়ে স্নেহর পাশে বসে আছে লতা। গা জরে পুড়ে যাচ্ছে। অনেকটা সময় ধরে মাথায় জল পট্টি দিচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই জর নামছেনা। পুরো মুখ লাল হয়ে আছে। মুখ দেখেই আন্দাজ করা সম্ভব ঠিক কতটা জর এই মুহূর্তে তার শরীরে থাকতে পারে।

“বুবু জর তো কমতেছেনা। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে হয়না?” স্নেহর মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে বলল মিনা। মিনার কথার উত্তরে লতা কিছু বলার আগেই সুমি ভিতরে ঢুকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল “এই ঔষধ টা খেলে ঠিক হয়ে যাবে ভাবি। খাওয়ানোর ব্যবস্থা কর।”লতা এক দৃষ্টিতে স্নেহর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। জ্ঞান শুন্য অবস্থায় হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে বিছানায়। তার চোখ ছল ছল করে উঠলো। সুমি বুঝতে পেরে লতার ঘাড়ে হাত রেখে বলল “কিছু হবেনা ভাবি। এই ঔষধটা খাইলে জর এমনিতেই নেমে যাবে।”
লতা কথা বলল না। মিনা উঠে গিয়ে স্নেহর মাথাটা একটু তুলে ধরল। সুহাকে উদ্দেশ্য করে বলল “পানি আন।” সুহা উঠে জগ থেকে পানি ঢেলে মিনার দিকে এগিয়ে দিলো। সে মিন মিনে সরে বলল “স্নেহ! মা স্নেহ! একটু হা কর। ঔষধ খা।”

মিন মিনে সর কানে যেতেই স্নেহ কিঞ্চিত ঠোঁট দুটো ফাকা করলো। “অইত জ্ঞান আছে। আপা শুনতে পাইছে।” সুহা চিৎকার করে উঠলো। মিনা সযত্নে তাকে ঔষধটা খাইয়ে দিলো। আবার বিছানায় মাথাটা রেখে কাথা দিয়ে মুড়ে দিলো।

——————–

চারিদিকে মোটা কুয়াশার চাদরে মোড়ানো। যতদূর চোখ যায় ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সামনের পুকুর তিনটা বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পুকুরের উপরে কুয়াশার বিচরন ধোঁয়ার মতো মনে হচ্ছে। মজুমদার বাড়ির সামনে পর পর তিনটা পুকুর। খুব কাছাকাছি সামনে একটা। কয়েক কদম গেলেই সেখানে উপস্থিত হওয়া যায়। পূর্ব পাশের টাও বাড়ির কোল ঘেঁষে। বাড়ির পিছনের দরজায় যেতে হলে একদম পাড়ের উপর দিয়েই চলতে হয়। পশ্চিম পাশের টা একটু দুরে। কিন্তু ততটাও না। পশ্চিম পাশে মসজিদ আছে আর সেখানেই পারিবারিক কবর স্থান। মসজিদের সাথেই শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। মসজিদের ব্যাবহারের জন্যই সেটা নুরুল মজুমদার শান বাধিয়ে দিয়েছে। মাথার উপরে কুয়াশার বিচরন হিম ধরিয়ে দিচ্ছে। তার সাথে এই নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝে টিনের চালে টুপ টুপ করে কুয়াশা পড়ার আওয়াজ শরীরে আরও বেশি কাপুনি ধরিয়ে দিতে সক্ষম। মাথায় একটা লম্বা ঘোমটা টেনে গায়ে চাদর জড়িয়ে যবুথবু হয়ে বাইরে দাড়িয়ে আছে সুহা। বরাবরি তার ঠাণ্ডাটা একটু বেশি। শীত তার একদম পছন্দ না। এতো ঠাণ্ডা যে কিভাবে সবাই সহ্য করে সেটা তার বোধগম্য নয়।

“শীত লাগছেনা?” আচমকাই গম্ভীর পুরুষশালী কণ্ঠ সুহাকে নাড়িয়ে দিলো। পিছন ফিরে দেখে একটা কাল হুডি দিয়ে মাথা পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে নাবিল। হাত গুঁজে শীত আটকাতে চেষ্টা করছে। ফর্সা মুখটা কাল হুডির মাঝে দেখতে বেশ লাগছে। অবাধ্য চুল গুলো হুডি পার করে কপালে বিচরন করছে। শীতের হিমেল হাওয়ায় তারাও কেঁপে কেঁপে উঠছে। সুহার দিকে উত্তরের অপেক্ষায় চাতকের মতো চেয়ে আছে।

“আপার জন্য অপেক্ষা করছি।” সুহা কিঞ্চিত হেসে উত্তর দিলো।
“কোথাও জাচ্ছ?” নাবিলের সরল প্রশ্নের উত্তরে উপর নিচে মাথা নাড়াল সুহা। তারপর হাসি মুখেই বলল “স্কুলে যাচ্ছি। আপা কলেজে যাবে।”

“ওহ আচ্ছা।” বলেই ঠোঁট কামড়ে নাবিল ভাবছে। আজ তিনদিন হয়ে গেলো অথচ স্নেহ নামের মেয়েটার চেহারাটা এখন অব্দি দর্শনের ভাগ্য হলনা। মায়ের কাছে শুনেছে মেয়েটা নাকি বেশ সুন্দর। তাদের মজুমদার পরিবারে ওরকম সুন্দরি মেয়ে আর নেই। তাই তার মাঝে দেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটা যে কোনভাবেই দেখা দেয়না। তবে আজ সে দেখেই ছাড়বে। তাই দাড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই স্নেহ হন্তদন্ত করে বের হয়ে এলো বাড়ি থেকে। কোনদিকে না তাকিয়েই সামনে হাটতে লাগলো। মাথায় অনেক দূর পর্যন্ত ঘোমটা টেনে দেয়া। “যা বাবা মুখটাই তো দেখতে পেলাম না।” আসতে করে বলেই নাবিল আবার গলা তুলে বলল “বড়দেরকে সালাম দিতে হয় জানোনা?”

নাবিলের এমন ধমকের রেশে বলা কথা কানে আসতেই দুজনি ঘুরে তাকায়। কিন্তু কাকে উদ্দেশ্য করে বলল সেটা বুঝতে পারছে না। দৃষ্টি তাক করে স্নেহ বুঝে গেলো তাকেই বলা হয়েছে কথাটা। দ্রুত পায়ে হেঁটে নাবিলের সামনে এলো। কিন্তু ওড়নাটা নাক অবধি টেনে দেয়া। এতে চোখ জোড়া ছাড়া আর কিছুই দেখার সুযোগ হল না।

“আস সালামু আলাইকুম!” স্নেহর নির্লিপ্ত কণ্ঠের কথায় নাবিলের ঘোর কাটে। কিন্তু উত্তর দেয়ার আগেই স্নেহর চোখ জোড়ায় তার চোখ আটকে যায়। পুরো মুখটা না দেখা গেলেও। ঘন কাল পাপড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা কুচকুচে কাল মনি দেখে সৌন্দর্য কিছুটা আন্দাজ করা সম্ভব। কিছুটা উপরে চোখ তুলতেই বাতাসে কয়েকটা চুল এলোমেলো হয়ে নড়াচড়া করা দেখার সৌভাগ্য হল। কয়েকটা চুল দেখেই আন্দাজ করে ফেলেছে কতটা কাল আর সিল্কি।

“কি হল? সালাম দিছি তো। উত্তর দিলেন না যে?” স্নেহর এমন চটপটে কণ্ঠের জেরে নাবিলের ঘোর কাটলেও সে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। “ওয়ালাই কুম আস সালাম!” হালকা সরে বলতেই স্নেহ ঘুরে চলে গেলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাড়া আছে। কিন্তু স্নেহর এমন কথার সর নাবিলের ঠোঁট জোড়া অনেক টা ফাকা করে দিলো। এই কয়দিনে সুহার সাথে কথা বলে যা ধারণা করেছিলো স্নেহ সম্পর্কে সে তার পুরো উলটা। সুহার কোন বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে নেই। দুই বোনের মধ্যে এতোটা পার্থক্য হতে পারে সেটাই নাবিল মানতে পারছে না।

“ভাইয়া কোথাও যাবে?” একটু চমকে মুবিনের দিকে ঘুরে তাকায় নাবিল। “ভাবছি সামনে থেকে একটু ঘুরে আসি। গ্রামের শীতের সকাল উপভোগ করি।” সামনে তাকিয়ে বলল নাবিল। তার কথা শুনে মুবিন আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। সামনে হাটতে হাটতে বলল “চল তোমারে স্কুলের দিকটায় ঘুরে আনি।” নাবিল তার পিছু পিছু হাটতে শুরু করলো।

কিছুদুর এগিয়েই দেখতে পেলো সুহা আর স্নেহ কে। দুজনেই মাথা নামিয়ে হাঁটছে। কুয়াশায় তেমন স্পষ্ট না দেখা গেলেও অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে। নাবিল একটু ভেবে মুবিন কে বলল “স্নেহ কি খুব চঞ্চল?”

“বাপ রে বাপ! আপার জন্য সুহা বেচারি সব সময় ভয়ে থাকে। কখন জানি বড় মায়ে মারে।” মুবিনের কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকাল নাবিল। আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। এমন কথায় আন্দাজ করতে পারছে বিষয়টা। তারপরেও আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললো “কেন?”

মুবিন এবার তার দিকে মুখ ফিরিয়ে স্নেহর এক এক করে ঘটানো সমস্ত ঘটনা বলতে শুরু করলো। স্নেহর যত অপকর্ম মুবিনের চোখে ধরা পড়েছে এই পর্যন্ত তার কিছুই বাদ রাখলনা। এক এক করে শুনছে আর নাবিলের চোখ কপালে উঠছে। যা ভেবেছিল তার থেকেও অনেক গুনে বেশি। আজ পর্যন্ত এসব কিছু সে একজন ছেলে হয়েই করেনি যা এই মেয়েটা করেছে। মুবিনের কথা অনেক সময় পর্যন্ত চলল। এর মাঝে তারা স্কুলে পৌঁছে গেলো। মুবিন স্কুলের গেটে দাড়িয়ে বলল “এই সময় মেয়েদের ক্লাস হয়। তাদের শেষ হলেই আমাদের শুরু।”

“এই নিয়ম কেন? এক সাথে ক্লাস হলে কি সমস্যা?” নাবিল কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করলো। “আসলে ছাত্র ছাত্রি অনেক বেশি। আর একটাই স্কুল। তাই এক সাথে ক্লাসে জায়গা হয়না।” মুবিন স্কুলের ভিতরে তাকিয়ে কথাটা বলল।

“ওহ আচ্ছা! তার মানে গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে হলে এই সময় ছাড়া উপায় নাই তাই তো।” নাবিল দুষ্টুমির সূরে মুবিনের দিকে তাকিয়ে বলল। মুবিন নাবিলের দিকে অবাক দৃষ্টি ফেরাতেই তার হাস্যজ্জল মুখ দেখে একটু লজ্জা পেলো। চোখ নামিয়ে হাসল। নাবিল জোরে হেসে বলল “লজ্জার কিছু নাই। এই বয়সে এসব স্বাভাবিক। তবে বেশি থাকা কিন্তু অস্বাভাবিক।” বলেই আবার শব্দ করে হাসল।

—————
গোছল সেরে চনমনে রোদে গা এলিয়ে দিয়ে একটা চেয়ারে বসে আছে রাজ্জাক। তার পাশেই নাবিল বসে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে নিচের ঠোঁট কামড়ে পা ঝাকাতে ঝাকাতে মোবাইলে খুব ব্যস্ততার সাথে কি যেন করছে। আশে পাশে দিয়ে সবাই যাওয়া আসা করছে তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।

“স্নেহ সকাল থেকে তোমাকে দেখলাম না যে।” রাজ্জাকের প্রশ্নে স্নেহ মাথা বাকিয়ে সহজ ভাবে বলল “কলেজে গেছিলাম ফুপাজি।” তাদের কথোপকথন কানে আসতেই নাবিল ফোন থেকে দৃষ্টি তুলে সামনে তাকাল। ততক্ষনে স্নেহ সামনে ঘুরে উঠান পেরিয়ে বারান্দায় পা তুলেছে। ব্যস্ততার মাঝে মাথায় পুরো ওড়নাটা টেনে দিতে বোধ হয় ভুলে গেছে। বড় খোপার উপরে আংশিক ওড়নাটা কোন রকমে আটকে আছে। সামনের পুরো অংশটাই ফাকা। “তাই বলি সকালে স্নেহময়ীর হাতের চা নাই কেন?” ঠাট্টা করে রাজ্জাক কথাটা বলতেই নাবিল চাপা সরে জিজ্ঞেস করলো “কি নাম?” রাজ্জাক নাবিলের দিকে ঘুরে হেসে একটু চড়া গলায় বলল “স্নেহময়ী মজুমদার!” কথাটা হালকা ভাবে স্নেহর কানেও আসলো। কিন্তু ফিরে তাকাতে চেয়েও পারল না। সামনে তার চাচির ডাকে দ্রুত পায়ে সেদিকে গেলো। নাবিল বিড়বিড় করে বার কয়েক নামটা আওড়াল “স্নেহময়ী!”

রোদের তেজটা বাড়তেই নাবিল গরমে শ্বাস ছাড়ল। সুমি এসে তার পাশে দাড়িয়ে বলল “গোছল করে নাও।”

“আমার কাপড় গুলা বের করে দাও।” নাবিলের কথা শেষ হতেই সুমি হতাশ হয়ে বলল “আর কতদিন আমাকে জালাবি? এবার তো বিয়ে কর। আমি দায়িত্ব থেকে মুক্তি চাই।” নাবিল একটু হেসে মোবাইলে চোখ রেখেই দুষ্টুমির সূরে বলল “তোমার ছেলের দায়িত্ব নিবে এমন মেয়ে খুঁজে বের কর। আমি তো না বলিনি।” নাবিলের কথা শুনে রাজ্জাক ফিক করে হেসে বলল “তোমার মা এখন পর্যন্ত জাদের দেখছে সেগুলার মধ্যে কাউকে বিয়ে করলে তোমার দায়িত্ব বাদ তাদের দায়িত্ব তোমাকে নিতে হতো।” বলেই বাপ ছেলে দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠলো। স্নেহ বারান্দায় দাড়িয়ে তাদের কথা শুনছিল। আচমকাই এভাবে দাঁত বের করে নাবিল কে হাসতে দেখে স্নেহর চোখ আটকে গেলো। মাথা নিচু করে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে গা দুলিয়ে হেসেই যাচ্ছে। অদ্ভুত সেই হাসি। সেও ঠোঁট এলিয়ে হাসল। স্নেহর কেমন এক অনুভুতি হল। আচ্ছা মানুষের হাসির মাঝে কি এমন কিছু থাকতে পারে যা সহজেই আর একটা মানুষকে আকর্ষণ করতে পারে। একেই কি সেই কবি সাহিত্যিকের ভাষায় ‘ভুবন ভুলান হাসি’ বলে। যা দেখে যে কেউ হারিয়ে যায় সেই হাসির মাঝে। বড্ড ভয়ংকর এই মায়া। যা একবার দেখার প্রয়াশে হাজারো লজ্জা সংকোচ বিসর্জন দেয়া যায়। ভেবেই দৃষ্টি ফিরে অন্যদিকে তাকালেও আনমনেই আবার সেই হাস্যজ্জল চেহারার দিকেই বেহায়া চোখ ফিরে গেলো। একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চমকে উঠলো। সেও কি এই মায়ায় জড়িয়ে গেলো নাকি? সেই ভুবন ভুলান হাসির ভয়ংকর মায়ায়?

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে