এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-১২

0
2612

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২

চট্টগ্রামে এসে সাদ লোক লাগিয়ে এবং নিজের চেষ্টায় তন্নতন্ন করে খুঁজে শোভাকে। দু’দিন কোনো খোঁজই পেলোনা। এভাবে তো কেউ হারিয়ে যেতে পারেনা, নিয়ন তো জানিয়েছে ওরা এখানেই কোথাও আছে। তাহলে কোথায়? সাদ তবুও হাল ছাড়লোনা। এবং সফলতা এসে ধরা দিলো চতুর্থদিন।

সাদ যখন গাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলো তখনই হঠাৎ নজরে আসে সাইফকে৷ ডাক্তার সাইফকে হঠাৎ চিনতে না পারলেও একসময় চিনে ফেলে। এর সাথেই তো সাদের মারামারি হয়ে গিয়েছিলো, এরপর থেকেই শোভা উধাও। নিশ্চয়ই এ সব জানে। সাইফ তার মাকে নিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছে। সাদ সন্দেহ করলো, সাইফ হয়তো সব জানে। এজন্য সাইফের পিছু নিলো।

সাইফের পাশের সিটে তাঁর মা বসা। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছেন। ওর মা বেশ কড়া হলেও খুবই ভালো। ছেলের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে? মুখটা এত শুকনো কেন?’

‘ ভাবছি!’

‘ কী?’

‘ মিলি যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয়।’

‘ দিলে দিবে।’

‘ আম্মু!’

‘ বিয়েটা ও করবে, তোর ইচ্ছাতে তো আর ওর জীবন চলবেনা৷ তাই না?’

‘ কিন্তু আমি মিলিকে পছন্দ করি।’

‘ তোর পছন্দ ধুয়ে তো ও পানি খাবেনা। ওর নিজস্ব পছন্দের কি দাম নেই?’

‘ অবশ্যই আছে।’

‘ তাহলে ওকে ওর মর্জিতে চলতে দে।’

‘ আমি জানি মিলি আমাকে ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু তুমিও ওর পক্ষেই চলে গেলে।’

‘ আমি একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের মনোভাব বুঝবোনা? এমনটা কি করে বলতে পারিস তুই?’

এমন সময় সাইফের বাবা কথা বলে উঠলেন। বললেন, ‘সাইফ! তুমি শুধু শুধু তোমার মাকে বুঝাচ্ছো৷ মেয়ে যদি না করে দেয়, তাহলে তোমার মাও স্ট্রেট না-ই করে দিবে!’

সাইফের মা চোখ গরম করে স্বামীর দিকে তাকালেন। বিরক্ত গলায় বললেন, ‘তোমার মতো হাঁদা ডাক্তার হলো কীভাবে বলোতো? ছেলেকেও হাঁদার পরামর্শ দিচ্ছো।’

‘ আমি কোথায় হাঁদা পরামর্শ দিচ্ছি?’

‘ শোনো, মিলি একটা মেয়ে। সে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বাজে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছে। শুধু পুরুষ মানুষের খারাপ রুপটাই ও দেখেছে। এখন ও যদি বিয়েতে না করে দেয়, সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে আমাদের ওকে জোর করার রাইট নেই।’

‘ তবুও মেয়েটাকে অন্তত বোঝানোর চেষ্টা তো করতে হবে।’

‘ আচ্ছা, গিয়ে দেখি সিচুয়েশন কেমন। তারপর সব ভাবা যাবে।’

তারপর সবাই চুপ করে বসলো। আর কোনো কথা হলোনা। শোভাদের বাসার দিকে গাড়ি এগুতে লাগলো। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রকৃতিতে। রাস্তাঘাটের কোণায় কোণায় সোডিয়াম বাতির ঝলকানি। পেছনে ফলো করতে করতে আসছে সাদের গাড়ি!
_____

এদিকে মিলিকে যে দেখতে আসছে সেটা শোভা আর ওর মা ছাড়া আর কেউ জানেনা। মিলি সন্ধ্যার নাস্তা বানিয়ে সবাইকে দিলো। রাফু, তুতুল টিভি দেখছে। শোভা এসে বললো, ‘কী করিস মিলি?’

‘ চা বানাই! খাবি?’

‘ না। আজ অন্যকিছু খেতে ইচ্ছে করছে।’

‘ কী?’

‘ একটু স্পাইসি খাবার।’

‘ হঠাৎ?’

‘ মন চাইলো আরকি।’

‘ আচ্ছা আমি বানিয়ে দিচ্ছি।’

‘ তোর বানাতে হবেনা, আমিই বানাবো।’

‘ কেন?’

‘ নিজের হাতে কতোদিন কিছু বানিয়ে খাইনা।’

‘ পাগল!’

শোভা ফ্রিজ থেকে স্লাইস করা মুরগীর মাংস, ডিম, মশলা বের করলো। পোলাওয়ের চাল, মাছ, সবজি বের করে রাখলো। মিলি অবাক হয়ে বললো, ‘স্পাইসি খাবার না বানিয়ে এসভ খাবার বানানোর মানে কি?’

শোভা পাত্তা না দিয়ে বললো, ‘জর্দা বানাতে পারিস?’

‘ না।’

‘ তুই যা এই বিচ্ছিরি ফতুয়া ছেড়ে একটা ভালো শাড়ি পরে আয়।’

মিলি তব্দা খেয়ে বললো, ‘হটাৎ শাড়ি কেন পরবো?’

‘ আহ! এতো প্রশ্ন করিস কেন? যা বলছি কর না।’

মিলি সন্দেহী গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘আজ কী হয়েছে তোর বলতো। এতসব কীসের আয়োজন করছিস?’

‘ তোর জানতে হবেনা।’

‘ না বললে আমিও এক পা নড়বোনা।’

‘ ওকে বলছি।’

‘ বল!’

‘ আজ খুব ইচ্ছে করছে ভালো করে সেজেগুজে ছবি তুলতে, ভালো খাবার খেতে। একটু পর গেস্টও আসবে।’

‘ কীসের গেস্ট? বাসায় কোনো অকেশন আছে বলে তো মনে পড়েনা।’

‘ আসলেই দেখতে পাবি। যা না প্লিজ!’

মিলি ভ্রু কুঁচকে বললো,

‘শাড়ি পরতেই হবে?’

‘ প্লিজ!’

‘ ওকে!’

মিলি না চাইতেও ঘরে যায়। ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পরে নেয়। শোভার মনে কি চলছে আর কোন গেস্ট আসবে বুঝতে পারলোনা। রাফু আর তুতুল মিওখ গম্ভীর করে বসে আছে। ঝগড়া হয়েছে দুজনের মধ্যে। মিলি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কী হয়েছে?’

‘ দাদাভাই আমার সাথে ঝগড়া করেছে।’

‘ কেন?’

‘ আব্বুর কাছে যাবে বলে। আমি বলেছি আমরা মায়ের সাথেই থাকবো। তাই ঝগড়া করেছে!’

মিলির মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। রাফুটা আজকাল বাবার জন্য কেমন জানি হয়ে গিয়েছে। সারাক্ষণ একটা গম্ভীর ভাব। আসলে স্কুলে সবারই তো বাবা আছে, সেজন্য ওর উপর মেন্টালি একটা চাপ পড়েছে।

মিলি রাফুকে বললো,

‘ তুমি কী সত্যিই যেতে চাও?’

‘ আম্মু গেলে, আমিও যাবো।’

‘ কিন্তু আম্মু তো যাবেনা।’

রাফু একটু রেগে বললো, ‘কেন যাবেনা? কী করেছে আব্বু?’

মিলি শান্ত হয়ে রাফুর পাশে বসলো। তারপর বলল,

‘ আচ্ছা, ধরো! তোমার আম্মুকে কেউ মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, সবার সামনে ছোট করেছে, তোমার আম্মুকে মরে যেতে বলেছে, আঘাত দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে, কাঁদিয়েছে, মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে, তোমাদেরকে বাজে কথা বলেছে। তুমি কী চাও সেই মানুষের কাছে তোমার আম্মু ফিরে যাক? যে লোকটা তোমাদের বাজে কথা বলেছে, ছুঁড়ে ফেলেছে তুমি কী ওর কাছে যেতে চাইবে?’

রাফু সাথে সাথেই বলে উঠলো,

‘কখনোই না।’

‘ তুমি জানতে চাওনা, তোমার আম্মুকে কে এতো কষ্ট দিয়েছে?’

‘ কে?’

‘ তোমার আব্বু! এখন তোমার আব্বু যদি তোমাদের নিতে আসে, তুমি কি চলে যাবে?’

রাফু এবং তুতুল দুজনেই মাথা নাড়িয়ে না জানালো। মিলি চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে নিয়ে ওদের গাল টেনে দিয়ে বলল, ‘গুড গার্ল। এভাবেই মায়ের পাশে থেকো। তোমার আম্মু তোমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছে। তোমরা চলে গেলে মা এবার মরে যাবে!’

‘ আমরা যাবো না!’

ওদের এই কথোপকথন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছিলো শোভা। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। সব সন্তানদের অধিকার আছে বাবাকে পাশে পাওয়ার। কিন্তু কোনো খারাপ বাবার এই অধিকার নেই! এমন সময় দরজায় বেল বাজলো। শোভা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সাইফ, ওর মা আর বাবাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। চোখেমুখে অস্বস্তি! ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও শোভা বেশ বুঝতে পারছে সাইফ চিন্তাগ্রস্ত! শোভা ওদেরকে বসতে দিলো।

‘ তুমি বুঝি শোভা?’

সাইফের মায়ের কথায় শোভা বললো,

‘ আসসালামু আলাইকুম, জ্বি আন্টি।’

‘ ওয়ালাইকুম সালাম, ভালো আছো মা?’

‘ জ্বি। আপনি ভালো?’

‘ খুব ভালো। তোমার আব্বু-আম্মু কোথায়?’

‘ বাসায়ই আছে। আমি ডেকে দিচ্ছি।’

শোভা ভেতরে গিয়ে রমজান সাহেব আর সালমা
বেগমকে ওখানে যেতে বললো। সাইফেরা সাথে করে অনেক ফলমূল,মিষ্টি নিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরে আরো মেহমান আসবে। শোভা রেস্তোরাঁতে খাবার অর্ডার দিলো। এতোজনের রান্না এই মুহূর্তে করা সম্ভব নয়।

মিলি বসার ঘরে মানুষের কথাবার্তা শুনতে পেয়ে রাফু, তুতুলকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। সাইফের পুরো ফ্যামিলিকে দেখে ওর চক্ষু ছানাবড়া। এরাই তাহলে গেস্ট? শোভার দিকে তাকাতেই ও মুচকি হাসি দিলো।

সাইফ মায়ের কানে কানে মিলির কথা বলতেই ওনি মিলর দিকে তাকালেন। মিষ্টি চেহারার সাথে সাদা রঙের জামদানি শাড়িটা বেশ ভালোই মানিয়েছে মিলিকে। ওনি বুদ্ধি করে শোভার কাছে শাড়িটা পাঠিয়ে দিয়েছেন আগেই৷ মিলিকে খুবই দারুণ দেখাচ্ছে। ওনি হাসিমুখে বললেন,

‘ তুমিই মিলি? আসো, আমার পাশে বসো। হবু শ্বাশুড়ির পাশে বসে মিষ্টিমুখ করে নাও মা!’

মিলি চমকে উঠলো। মানে কী? শ্বাশুড়ি? ও অবাক হয়ে শোভার দিকে তাকাতেই শোভা হেসে ফেললো। মিলি রাগী চোখে ওর দিকে তাকালো। সাইফের মা সবকিছুই লক্ষ্য করে মুচকি হাসছেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘ মিলি! আমি তোমার সঙ্গে একা একটু কথা বলতে চাই মা।’

শোভা বললো, ‘আসুন। আমি আপনাদেরকে ঘরে দিয়ে আসছি।’

সাইফের মা আর মিলিকে গেস্টরুমে দিয়ে এলো শোভা। মিলি রেগে আড়ালে শোভার হাতে কয়েকটা চিমটিও কেটেছে। শোভা পাত্তা দেয়নি।।মিলির ঋণ কোনোদিন শোধ করা শোভার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ওর জন্য মিলির জীবনটা নষ্ট হোক, শোভা তা চায়না। আর সাইফের ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। আর মিলি যতোই মুখে না বলুক, শোভা বুঝতে পারে মিলির মনেও সাইফের জন্য একটা অনুভূতি, শ্রদ্ধার জায়গা আছে। তাই শোভা সাইফের মা-বাবার সাথে যোগাযোগ করে খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ওদের দুজনের আজই বিয়ে দিবে। ধুমধামে বিয়ে মিলির কখনোই পছন্দ না। কিন্তু এই কথাটা সাইফ বা মিলি কেউই জানেনা। সবকিছু তৈরি করে রেখেছে শোভা। একটু হলেও যদি মিলির জীবনটা স্বাভাবিক করে দিতে পারে তাহলে শোভা খুব সুখী হবে। না হোক নিজের সংসার, মিলি’টারই হোক!

চলবে….ইনশাআল্লাহ!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে