এক টুকরো আলো পর্ব-২৩+২৪

0
225

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

সারাদিন ঘুরাঘুরি করে রাতের খাবার খেয়ে মাত্র হোটেল রুমে ঢুকলো ফাবিহা। দুই বান্ধবী ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফাবিহা খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গর্জন শুনলো। গত কয়েকদিন সে নিজেকে নিয়ে প্রচুর ভেবেছে। শাবাবের সাথে যেভাবে জীবনটা জড়িয়েছে তাতে সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পার্টনারের প্রতি মন থেকে শ্রদ্ধা থাকা লাগে। শাবাবের প্রতি তার ঘৃ*ণা ছাড়া কিছুই আসে না।
প্রথমদিকে শাবাবকে স্বাভাবিকভাবে না করলেও সে তার আচরণে মাত্রা ছাড়িয়েছে। বিরক্ত হয়ে যা-তা বলা শুরু করলো শাবাবকে। শাবাব থামলো না। তাকে বারবার হেনস্তা করেছে। সবকিছুর মাত্রা ছাড়িয়ে শেষে যা করেছে তাতে কোনোদিনই ফাবিহা তাকে ক্ষমা করতে পারবে না। তার সম্মান নষ্ট হয়েছে, বাবার মুখ ছোটো হয়েছে। এই শাবাবের কারণেই মানুষ তাকে বা*জে কথা বলার সাহস পেয়েছে।

শাবাবকে রিজেক্ট করার কারণ শক্ত। যখন তাকে প্রপোজ করেছিল শাবাব, তখন তাসিনকে সে মনেপ্রাণে জীবনে পেতে চায়। পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে ঠিক। শাবাব মেয়েদের সাথে চুটিয়ে প্রেম করে বেড়ায়। মাস দু-য়েকের মাঝে তার আগ্রহ হারিয়ে গেলে সে অন্য নারীর পেছনে পড়ে। এতগুলো শক্ত কারণ থাকার পরও কোনো মেয়ে কেনো নিজেকে একটা ছেলের দুই-তিন মাসের ব্যবহৃত পণ্য বানাতে চাইবে?

সুমি ডেকে উঠলো,“ফাবু ঘুমাবি না?”

“তোরা ঘুমিয়ে পড়। আমি একটু পর আসছি।”

শাবাব বন্ধুর বাসায় দুদিন থেকেই বাড়ি চলে এলো। ফাবিহা তিনদিন পর সময় মত বাড়ি ফিরলো। আতাউর রহমান মেয়েকে নিয়ে বসলেন। শান্ত হয়ে বললেন,“কী করতে চাস তুই?”

ফাবিহা ভ্রু কুঁচকে বলল,“কোন ব্যাপারে?”

“তোর শশুর যে তোকে নিতে এলো সেই ব্যাপারে।”

ফাবিহা বিরক্ত হয়ে বলল,“বাবা তুমি কি আমায় বোঝা মনে করছো? তাহলে বলে দাও আমি কোথাও চলে যাই।”

মাঝেমাঝে আদরের সন্তানের কাছে বাবা-মাকে কঠিন হতে হয়। আতাউর রহমান গম্ভীর মুখে বললেন,“কোথায় যাবে তুমি? কোথায় যাওয়ার জায়গা আছে তোমার?”

“জানি না।”

“তখন আর বাবা-মা লাগবে না?”

ফাবিহা চোখ বুজে বলল,“বাবা প্লিজ! আমাকে বলো আমি কী করবো?”
বাবার দিকে তাকাতেই তিনি লক্ষ করলেন ফাবিহার চোখজোড়া অসহায়। তিনি ফাবিহার মাথায় হাত রেখে বললেন,“বিয়ে হয়েছে। এটা কোনো সাধারণ পুতুল খেলা নয় মা। তোমার উচিত একবার সুযোগ দেওয়া। সবকিছু যতটা সহজ ভাবছো, ততটা সহজ নয়।”

ফাবিহা স্তব্ধ হয়ে গেল। বাবা কীভাবে তাকে এমন কথা বলতে পারে? কীসের সুযোগ দেবে শাবাবকে? কোনো অধিকার না থাকার পরও সে যা করেছে এখন তো সুযোগ পেয়ে স্বামীর অধিকার খাটিয়ে দ্বিগুণ অ*ত্যা*চা*র করবে। বাবার উপর অভিমান হলো তার। কঠিন গলায় বলে দিল,“তাঁদের আসতে বলো। আমি যাব তাঁদের সাথে।”

আতাউর রহমান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,“রাগ করে নয়, ঠাণ্ডা মাথায় করো সব। এখন তুমি চাইলেই সংসারটা যেনতেন করে ভাঙতে পারবে না। তাঁরা যদি স্টেপ নেয় তোমাকে ঘরে তোলার, তুমি যদি না যাও, তাহলে বিয়ে ভাঙার জন্য নিশ্চয়ই একটা বৈঠক হবে। আর সেখানে সবাই বলবে আগে দুজনে সময় নিয়ে সবটা ঠিক করার চেষ্টা করো। যেভাবেই হোক, তোমাকে শাবাবের ঘরে যেতেই হবে। এরপর যদি মনে হয় কিছুই ঠিক হচ্ছে না, তুমি যখন-তখন চলে আসতে পারো। তুমি বাবার উপর রাগ কোরো না। আমি না পাঠালেও বৈঠকে সবাই তোমাকে ওখানে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করবে।”

মানুষ যখন অতিরিক্ত রাগে থাকে, তখন কোনো ভালো কথাও তার মাথায় ঢুকে না। ফাবিহারও হলো তাই। আতাউর রহমান মেয়েকে শাবাবের দিকে জোর করে ঠেলে দিচ্ছেন না। যাতে অন্যরা মেয়েকে না বলতে পারে ‘তুমি আগে সংসার করে দেখেছো?’
শাবাবকে তিনি নিজেও পছন্দ করেন না। কেবল মেয়ের ভালোর কথা চিন্তা করে এই ঝুঁকিটা নিচ্ছেন। ফিরোজ আলমকে পরদিন আসতে বললেন আতাউর রহমান। তিনি শাবাব বা সুরাইয়া কাউকে নিয়ে আসেননি। ফাবিহা চুপচাপ ফিরোজ আলমের সাথে বেরিয়ে গেল। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলেও বাবার সাথে কথা বললো না।

ফাবিহার মা রাত থেকে স্বামীকে কচলে ফেলেছেন। মেয়েকে তিনি শাবাবের হাতে কিছুতেই তুলে দেবেন না। এখনও যা পারছেন বলে যাচ্ছেন। যে পুরুষ মুখ বন্ধ রাখতে পারে, সংসার জীবনে সে-ই বোধহয় সবচেয়ে সুখী। কেননা এখন মুখ খোলা মানেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যুদ্ধ সৃষ্টি হওয়া। তারচেয়ে বরং মুখ বন্ধ রেখে চুপচাপ সব সহ্য করে যাওয়া ভালো। ফাবিহা চলে যাওয়ার পর থেকে কিছুই খেলো না তার বাবা-মা। আতাউর রহমান ভেতরে ভেতরে চিন্তায় অস্থির। মুখে কিছুই প্রকাশ করছেন না।

ফাবিহাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই সুরাইয়া বউ ঘরে তোলার আগে হাঁকিয়ে গেলেন।
“তুমি নাকি আমার আব্বার মাথা ফাটিয়েছ?”

ফাবিহা অচেনা নারীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফিরোজ আলম স্ত্রীকে বললেন,“শাবাবের মা, আগে যা হয়েছে বাদ দাও এসব।”

“কেন বাদ দেব? আমার আব্বা, আমার একমাত্র ছেলে। আমার ছেলের কিছু হলে ওর মা কি আমাকে একটা ছেলে দেবে?”

“কী আবোলতাবোল কথা বলছো তুমি? ছেলের শাশুড়ি তোমাকে ছেলে দেবে কেন?”

“তুমি চুপ থাকো।”

ফাবিহা প্রচুর বিরক্ত। তবে উপরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। ফিরোজ আলম ফাবিহাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। তুলিকে ডাকতে হলো না। সে আগেই এসে হাজির। তাকে বললেন,“তুলি এটা হলো তোমার ভাইজানের বউ। তোমার ভাইজানের ঘরে নিয়ে যাও।”

তুলি চুপচাপ নতুন বউ নিয়ে শাবাবের ঘরে ঢুকলো। এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার গদগদ কণ্ঠে বলল,“ভাবি আপনে মেলা সুন্দরী। এইজন্যই ভাইজান আপনার জন্য পাগল হইছে।”

অল্প বয়সি একটি মেয়ে তুলি। ফাবিহার ভালো লাগলো মেয়েটিকে। মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,“তুমি পড়াশোনা করো?”

তুলি মাথা নেড়ে বলল,“না ভাবি। পড়ালেহা ভাল্লাগে না। আমার মাথায় ঢুকে না।”

ফাবিহা ঘর দেখতে দেখতে নাক সিটকালো। সব এলেমেলো হয়ে আছে। এর মাঝে জানতে চাইলো,“এই বাড়ির বাকি লোকজন কোথায়?”

“ভাইজান বাড়িত নাই।”

“বাকি ভাইবোন?”

“ভাইজান তো একলাই। আম্মার আর পোলাপান নাই। ভাইজান হেগো বিয়ার বারো বছর পর হইছে। আর কোনো পোলাপান নাই।”

ফাবিহা ভেবে বলল,“আচ্ছা তুমি যাও। তোমাকে ডেকে না পেলে হয়তো তোমার আম্মা তোমার উপরও রেগে যাবেন।”

তুলি ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,“ধূর, আম্মার রাগ। আম্মার রাগ এই আসে এই পানি হইয়া যায়। তা আপনে কন, আমার এত সুন্দর ভাইজানের মাথা ফাটাইলেন ক্যান?”

“এখন তোমার মাথাও ফাটিয়ে দেব।”

তুলি ভয় পেয়ে “ও মা গো” বলে দৌড়ে চলে গেল। ফাবিহা তুলিকে ভয় পেতে দেখে হেসে ফেললো। শাবাবের ছড়ানো ছিটানো সব জিনিস এক জায়গায় ঠেলে স্তূপ করে রাখলো। বাকি সব গুছিয়ে নিলো।

তুলি নিচে যেতেই সুরাইয়া থমথমে গলায় বললেন,“নবাবের বেটি, ডা*কা*তে*র সর্দারকে নাস্তা দিয়ে আয়।”

তুলি মুখ চেপে হাসলো। পুত্রবধূ আসার পর হামলে পড়লো আর এখন নাস্তা দিয়ে আসতে বলছে। শাবাব বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকতেই চমকে গেল। তার বিছানায় ঘুমিয়ে আছে ফাবিহা। ঘরের চেহারা পাল্টে গিয়েছে। তার জিনিসপত্র সব এক জায়গায় জড়ো করে রাখা। যেন ডাস্টবিনের ময়লা। ফাবিহাকে বাবা আনতে যাবেন এটা শাবাব জানলেও ফাবিহা যে এত সহজে আসতে রাজি হয়ে যাবে শাবাবের ভাবনার বাহিরে ছিল। সে নিজের জিনিসপত্রের হাল দেখে রাগ দমিয়ে রাখতে পারলো না। চেঁচিয়ে ডাকলো,“এ্যাই মেয়ে ওঠো।”

ধড়ফড়িয়ে উঠলো ফাবিহা। সামনে শাবাবকে দেখে তেতে উঠে বলল,“কী সমস্যা তোমার? এমন মাইক বাজাচ্ছো কেন?”

শাবাব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“আমার জামাকাপড়, জিনিসপত্রের এই অবস্থা কেন?”

ফাবিহা তাচ্ছিল্য করে বলল,
“এসব তোমার জিনিসপত্র? আমি ভাবলাম ডাস্টবিনে ফেলার জন্য ময়লা জমা রেখেছো।”

ফাবিহার কথা শুনে শাবাবের রাগ আরো বাড়লো। বলল,“তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো ফাবিহা।”

“কী বাড়াবাড়ি করছি? শোনো আমি শান্তি চাইছি। দয়া করে শান্তি দাও। তোমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”

শাবাব চোখ ছোটো করে তাকালো। কটমট করে বলল,“তোমার সাথে কথা বলার মনে হচ্ছে আমার খুব ইচ্ছে! আমারও তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই। এখন আমার বিছানা ছাড়ো।”

“বিছানা ছাড়বো কেন?”

“আমি ঘুমাবো।”

“তো আমি কি তোমার চোখের পাতা টেনে খুলে রেখেছি?”

শাবাব অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে বলল,“তুমি সামনে থাকলে আমার মাথাব্যথা বেড়ে যাবে। দয়া করে এখান থেকে যাও।”

“অন্যের লাইফে মাথা দিতে আসলে মাথা ব্যথা তো হবেই।”

ফাবিহার কটাক্ষ করে বলা কথার প্রত্যুত্তরে শাবাব বলল,“আমার রাগ ওঠাবে না ফাবিহা।”

“তোমার সাথে কথা বলতেই আমি বিরক্ত হচ্ছি।”

শাবাব একটাও কথা না বলে লম্বা কদম ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দরজায় শব্দ হলো সজোরে। ফাবিহা পাত্তা দিলো না শাবাবের রাগকে। সে আবারও শুয়ে পড়লো।

শাবাব রাতে এসে একপাশে শুয়ে পড়লো। ফাবিহা জেগেই ছিল। শাবাবের দিকে না ফিরেই বলল,“নিজের লিমিটের কথা ভুলে যেও না। ওপাশ ক্রস করে এপাশে আসার চেষ্টা করলে ফল ভালো হবে না।”

শাবাব উঠে বসলো। ফাবিহার হাত চেপে ধরে বলল,“এ্যাই তুমি নিজেকে কী ভাবো? আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করবো। এটা আমার বাড়ি। এখানে আমার আধিপত্য চলবে, তোমার নয়। সবাই মিলে তোমাকে আমার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে বলে তোমায় এতক্ষণ সহ্য করছি।”

ফাবিহা হাতে ব্যথা পেল। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তেজী গলায় বলল,“সেজন্যই বে*হা*য়া*র মত আমার পেছনে পড়ে রইলে? নিজের বাবাকে পাঠিয়ে আমাকে নিয়ে এলে? তুমি আমাকে কী সহ্য করবে? তুমি তো আমাকে ডিজার্ভই করো না। তুমি যেমন থার্ড ক্লাস? তেমনটাই ডিজার্ভ করো।”

হাতটা আবার মুচড়ে ধরলো শাবাব। রাগে কাঁপছে সে।
“আমি থার্ড ক্লাস? নিজেকে দেখেছো তুমি? বাবাকে আমি পাঠাইনি। বাবা নিজেই গিয়েছে। আর তুমিই নি*র্ল*জ্জ বলে বাবা বলার সাথে সাথেই চলে এসেছো। কী ভেবেছো, আমার উপর রাজত্ব করবে? একদম মে*রে ফ্যানের সাথে ঝু*লি*য়ে দেব।”

ফাবিহা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে শব্দ করলো,“আহ্!”

শাবাব ঝাড়ি দিয়ে হাতটা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। ফাবিহা হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মুহূর্তে শাবাবকে বালিশ চাপা দিয়ে মে*রে ফেলার শখ জেগেছে। তারই ভুল ছিল। বাবার উপর রাগ দেখিয়ে এখানে আসা উচিত হয়নি। নিজের ভুলের জন্য এতটুকু কথা হজম করেই নিলো।

পরদিন ফাবিহাকে দেখতে তার শশুর আর শাশুড়ির আত্মীয়স্বজন আসা শুরু করলেন। ফাবিহা নিজের নিয়ে আসা জামাকাপড় থেকে একটা কমলা রঙের জামা পরলো। শাবাব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছিল। সে ভ্রু কুঁচকে বলল,“এটা কী পরেছো তুমি?”

ফাবিহা যেন শুনতে পায়নি। সব কিছুতে কেন এই ছেলের কথায় পাত্তা দিতে হবে? সে ওড়না ঠিক করছে। শাবাবের রাগ উঠে গেল। প্রথমত এই রঙ তার অপছন্দ। দ্বিতীয়ত জামার গলা খুব বড়ো। সে কঠিন সুরে আদেশ দিল,“অন্য একটা জামা পরে আসো। নিচে আমার জেঠু, জেঠিমা, কাজিনরা আছে। বি*শ্রী লাগছে তোমায়।”

ফাবিহা কথার জবাব দিচ্ছে না। চুপচাপ ওড়না ঠিক করা হয়ে গেলে বের হতে নিলো। শাবাব ওর হাত ধরে ফেললো খপ করে। ফাবিহা কঠিন গলায় বলল,“হাত ছাড়ো শাবাব৷”

“তুমি জামা খোলো।”

ফাবিহার চোখে আগুন।
“আমি খুলবো না। দেখি তুমি কী করো।”

বলার দেরি শাবাবের হাত চলতে দেরি নেই। থ্রিপিসের পাশ থেকে ধরে টা*ন দিয়ে জামার নিচের দিকটা ছিঁড়ে ফেললো।

বিস্মিত হয়ে চোখ বড়ো করে তাকিয়ে রইলো ফাবিহা। তার চোখের পলক পড়ছে না।

শাবাবের কাজিন প্রিয়া চোখে হাত দিয়ে লজ্জা পাওয়ার ভান করে বলল,“সরি! সরি! এই ভুল সময়ে এসে তোমাদের রোমান্স দেখে ফেললাম। ভাইয়া এতো রোমান্টিক।”

সে চলে গেল দৌড়ে। শাবাবও বেরিয়ে গেল। ফাবিহা ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। এখনো তার মস্তিষ্ক সচল হয়নি।

★★★

সাজেদা হুরাইনকে দেখতে এলেন স্বামীর সাথে। হুরাইন শাশুড়ির সবকিছু আগ বাড়িয়ে করতে যাচ্ছে। সাজেদা তাকে সাবধান করে দিলেন।
“এত উড়াউড়ির দরকার নেই। তিন-চার মাস রেস্টে থাকো। আবার রেস্ট বলতে সারাদিন শুয়ে থাকা নয়, একটু হাঁটাচলা করবে।”

হুরাইন মুখ লুকিয়ে হাসলো। হুরাইনের ভাবি বললেন,“তোমার শাশুড়ি দেখছি খুব যত্নবান।”

হুরাইন মুচকি হেসে বলল,“আমার শাশুড়ির মন ভালো। শুধু মুখেই মায়ের মত বকাবকি করেন।”

সাজেদা কান খাড়া করে শুনলেন ওনার কথা কী বলছে দুজন মিলে। হুরাইনের কথা শুনে সন্তুষ্ট হলেও মুখ রেখেছেন ভার করে। বিকেলে চলে যাওয়ার সময় হলে হুরাইনের মা আবদার করলেন।
“আপা, মেয়ে আমার কাছে দুটো মাস থাকুক।”

সাজেদা বললেন,“আমি কি আপনার মেয়ের যত্ন নিতে পারবো না?”

“না না আপা। আমি সেটা বলিনি।”

সাজেদা আবারও থমথমে গলায় বললেন,“আচ্ছা এখন আরো কিছুদিন থাকুক। যখন ভালোলাগবে, তখন বললেই তাসিন এসে নিয়ে যাবে।”

হুরাইনের মা খুশি হলেন। হাসিমুখে বেয়ানকে বিদায় দিতে দরজা পর্যন্ত এলেন। সাজেদা আবারও পেছন ঘুরে হুরাইনকে বলল,“ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করবে, পানি খাবে। নয়তো শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে।”

হুরাইন মনোযোগ দিয়ে শাশুড়ির কথা শুনে নিচ্ছে।
ওদিকে তাসিন আর তার শশুরের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে।
“আমার মেয়ে কিছু না বললেও আমি কিন্তু সব খবর রাখি জামাই। যেহেতু আমি জেনে-বুঝে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, তাই এভাবে আড়ালে খোঁজখবরটা নিতেই হচ্ছে। আপনি নিজের কথা রাখতে পারেননি। আমি আপনার শর্তটাই মেনে নিয়েছি। এখন থেকে আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে। আপনার বাইরের দিকটা নাহয় আমি খোঁজ নেওয়ায় জানতে পেরেছি, বাড়ির ভেতর কী কী করছেন সেগুলো তো আমার অজানাই রয়ে গিয়েছে। আমি শুধু মেয়ের ধৈর্য দেখে এতদিন চুপ করে ছিলাম। আপনি এখনো বান্ধবীদের সঙ্গ ছাড়তে পারেননি। এসব কিছুতেই বন্ধুত্ব হতে পারে না। ফিতনা ছাড়া কিছুই নয়।”

তাসিন চমকে উঠলো জনাব আজাদের কথায়। হুরাইনকে সে ছাড়তে পারবে না। বান্ধবীদের সাথে সে ইচ্ছে করে দেখা করেনি। গতকাল পথেই একজনের সাথে দেখা। সে আগ বাড়িয়ে কথা বলল। তাসিন কেবল কোনোভাবে উত্তর দিয়ে দ্রুত পাশ কাটিয়ে এসেছিল। দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একসময় আর কথা বলাও হবে না। দূর থেকে দেখে তো আর সবকিছু শোনা বা বুঝা যায় না। যিনিই দেখেছেন, দূর থেকে দেখেই বিচার করে নিয়েছেন। তাসিন কিছুইতে শশুরের কথা মেনে নিতে পারছে না।

“অসম্ভব! আমি হুরাইনকে ছাড়তে পারবো না।”

“যদি হুরাইন নিজেই আপনার সাথে ফিরতে না চায়?”

স্তব্ধ চোখে ভীতি নামলো তাসিনের। হুরাইন এমনিতেই বলে দিয়েছে সে তার সাথে ফিরবে না। এখন যদি বাবার কথা শুনে সত্যি সত্যি ফিরতে না চায়?

#চলবে…..

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

“তাসিন ভাই বিয়ে করলেন আর দাওয়াত দিলেন না! ভাবি কেমন, সেটা তো দেখলাম না। দেখি ছবি দেখান।”

তাসিনের অজানা কারণে হুট করে রাগ হলো। চোয়াল শক্ত হতে লাগলো। তবুও কঠিন মুখে হাসি টে*নে বলল,“আমার স্ত্রীকে দেখার অধিকার তো শুধু আমারই ভাই।”

লোকটি রসিকতা করে বলল,“কী বলেন ভাই, ভাবি কি বেশি সুন্দরী? সেজন্যই দেখাতে চাচ্ছেন না?”

এবার আর ঠোঁটে হাসি টুকু রইলো না তাসিনের। তার স্ত্রী কেমন, বর্ণনা শুনে লোকটি কল্পনা করার চেষ্টা কেন করবে? শক্ত গলায় বলল,“আমার স্ত্রী পর্দা করে। সে পরপুরুষের সাথে দেখা দেয় না।”

লোকটি যেন বিদ্রুপ করে হাসল। হয়তো ভাবলো এ আবার কোথাকার কোন হুজুর এলো। মুখে বলল,“ভালো ভালো।”

তাসিন কথা শেষ দিয়ে বিদায় নিলো। দুদিন ধরে হুরাইনের সাথে কোনো কথা হচ্ছে না। হুরাইন ইচ্ছে করেই ফোন তুলছে না। এদিকে শশুর বাড়ি যাওয়াও তার নিষেধ। আজ আর কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সন্ধ্যার পর শশুর বাড়ি চলে গেল তাসিন। মেহমান খানায় না ঢুকে সোজা বাড়ির ভেতরে এসে দরজায় দাঁড়ালো। গলা খাঁকারি দিয়ে পুরুষ মানুষের উপস্থিতি জানান দিলো। সামনের ঘরে কোনো মহিলা থাকলে সরে যাবেন। দরজায় দাঁড়ানোর দুই মিনিট পর ভেতরে ঢুকলো তাসিন। পড়ে গেল শশুরের সামনে।
জনাব আজাদ হাতের কিতাব বন্ধ করে ভ্রু কুঁচকে চাইলেন। প্রশ্ন করলেন,“আপনি এখানে কেন?”

থতমত খেয়ে গেল তাসিন। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো। গম্ভীর স্বরে বলল,“আমি আপনার সন্তানের কাছে আসিনি। আমার সন্তানের কাছে এসেছি।”

জনাব আজাদ আগাগোড়া পরোখ করলেন তাসিনকে। পরিপাটি হয়েই শশুর বাড়িতে এসেছে। মুখ যথেষ্ট গম্ভীর করে রেখেছে। জামাতা যে একটু ধূর্ত আছে, সেটাও তিনি চট করে বুঝে গেলেন। তিনিও কম যান না। কিতাব খুলে তাতে চোখ রাখলেন। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন,“আপনার সন্তান এখনো দুনিয়াতে আসেনি। যখন আসবে, তখন এসে তাকে নিয়ে যাবেন।”

তাসিনের এবার রাগে দাঁত লেগে আসছে। শশুরের সাথে তো আর চেঁচামেচি, হাঙ্গামা করা যায় না। তাই ধপ করে বসে পড়লো। গমগমে আওয়াজ তুলে বলল,“আমার সন্তান দুনিয়ায় আসা পর্যন্ত তার দেখভাল করার অধিকার আমার আছে। আর সে ভূমিষ্ট হওয়ার পর তো অবশ্যই তাকে নিয়ে যাবো।”

“আমার মেয়ের কাছে যাওয়া ছাড়া আপনি যেভাবে পারেন আপনার সন্তানের যত্ন নিন।”

“কথা ছিল আমি শর্ত ভঙ্গ করলে আপনার মেয়ে আপনার কাছে থাকবে। আমার সাথে ফিরবে না। কিন্তু তাতে এটা উল্লেখ ছিল না যে আমি এখানে এসে তার সাথে দেখা করতে পারবো না। ঠিক আছে, তাকে যেতে হবে না আমার সাথে, আমি আসবো এখানে। যতদিন আমার সন্তান এখানে থাকবে, ততদিন আমিও এখানে আসা-যাওয়া করবো।”

জ্বলন্ত চোখে তাকালেন জনাব আজাদ। তাসিন শশুরকে জালে ফাঁসিয়ে দুর্বোধ্য হাসলো। জনাব আজাদ বললেন,“আপনি যতই ছলচাতুরী করেন না কেন, মেয়ে আমি আপনার সাথে যেতে দেব না।”

“ঠিক আছে। আপনার সন্তানের প্রতি আপনার যেমন অধিকার, আমার সন্তানের প্রতিও আমার ততটাই অধিকার। আরো একটা কথা বলে রাখছি। আজ আমাকে আমার সন্তানের কাছে আসার অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে, একসময় আমিও আপনাকে নাতি-নাতনির কাছে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবো।”

জনাব আজাদ বললেন,“এমন কিছু শর্তে উল্লেখ ছিল না।”

“আমি আমার সন্তানের কাছে আসতে পারবো না, এমনটাও শর্তে উল্লেখ ছিল না।”

তাসিন ফলমূলসহ কয়েক পদের খাবার জিনিস নিয়ে এসেছে। জনাব আজাদ এবার সেদিকে তাকালেন।
“এগুলো আপনার জিনিস আপনি নিয়ে যাবেন।”

তাসিন হেসে বলল,“এগুলো আমার সন্তান খাবে।”

“আপনার সন্তান এসব কীভাবে খাবে?”

তাসিন আবারও হাসলো।
“তার মা খেলে, তার খাওয়া হয়ে যাবে।”

“আমার মেয়ে যাঁর সাথে যাবে না, তাঁর কেনা খাবারও খাবে না।”

“তাহলে আমার সন্তানও কারো কেনা খাবার খাবে না। আলহামদুলিল্লাহ তার বাবার যথেষ্ট সামর্থ্য আছে।”

কথায় কুলিয়ে উঠতে পারছেন না জনাব আজাদ। গম্ভীর স্বরে বললেন,“তাঁর নানাকেও আল্লাহ সামর্থ্য দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।”

“সে যদি তার নানার টাকায় কেনা খাবার খেতে পারে, তাহলে তার মাও তার বাবার টাকায় কেনা খাবার খেতে পারবে।”

“আপনি আপনার সন্তানকে দেখতে আসতে পারবেন। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন না। দেখেই চলে যাবেন।”

তাসিন চওড়া হেসে বলল,“শুকরিয়া।”

হুরাইনের ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। জনাব আজাদ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইলেন তার যাওয়ার পানে। হুরাইন আজকাল বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করছে। দোয়া-দূরদ, বেশি বেশি আমল করার চেষ্টা করছে। এখনো বসে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছে। তাসিন ভেতরে ঢুকে চুপচাপ মুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছে তার মধুর স্বর। হুরাইন আয়াত শেষ করে বিছানায় তাকালো। তাসিনকে দেখে ভারি চমকালো। এখানে তাকে আশা করেনি। এসেছে কীভাবে? তারও ভেতরে ভেতরে মন পুড়ছিলো তাসিনের জন্য। তাসিন তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলল,“থামলে কেন?”

হুরাইন গম্ভীর হলো। শুধালো,“আপনি এখানে কেন এসেছেন? আপনার তো এখানে আসার অনুমতি নেই।”

“আমি তোমার কাছে আসিনি। আমার সন্তানের কাছে এসেছি। এখন আমার পাশে এসে তার সাথে আমাকে সময় কাটাতে দাও।”

হুরাইন সেই জায়গাতেই বসে থেকে তাসিনের গতিবিধি লক্ষ করছে। তাসিন নিজ থেকে উঠে এসে হুরাইনের পাশে পায়ের পাতায় ভর দিয়ে বসলো। হুরাইন আগের তুলনায় অনেকটাই শুকিয়ে গিয়েছে। তাসিন কোমল স্বরে শুধালো,“তুমি এমন শুকিয়ে যাচ্ছো কেন? ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো না, তাইনা?”

হুরাইন তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,“আপনি বলতে চাইছেন আমার বাবা আমাকে খাওয়াতে পারে না, তাইতো?”

তাসিন মিটিমিটি হেসে বলল,“এতো রাগ কীভাবে করতে পারো? আমি ভাবতাম আমার রাগের কাছে কারো রাগ কোনোদিন পাত্তা পাবে না। অথচ আমিই এখন তোমার রাগের কাছে পাত্তা পাই না।”

হুরাইন কুরআন মাজীদ নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দিয়ে বলল,“আমি মানুষের মত অকাজে রাগ দেখাই না।”

তাসিন হুট করে তাকে কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে দিল। পিটপিট চোখে তাকালো হুরাইন। মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ থাকতে বলল তাকে।
“হুসস! আমি এখন আমার আম্মাজানের সাথে কথা বলবো।”

“আপনি কীভাবে জানেন যে মেয়ে হবে?”

“আমি জানি না সে ছেলে না কি মেয়ে! তবে মন বলছে তোমার মতো একটা জান্নাত আসবে আমার ঘরে। তাকেও তোমার মতো মাদ্রাসায় পড়াবো।”

হুরাইন খোঁচা দিয়ে বলল,“বাবা পুরোপুরি দ্বীন পালন করে না। আর মেয়েকে মাদ্রাসায় পড়ানোর চিন্তাভাবনা করছে।”

হুরাইনের পেটে চুমু দিয়ে তাসিন বলল,“ইনশাল্লাহ আমি সবকিছু পেছনে ফেলে দ্বীনের পথে এগিয়ে যাব। আর ভুল করলে তখন আমার আম্মাজান আর তার আম্মাজান মিলে শাসন করে শুধরে দেবেন।”

হুরাইন তাসিনকে সরিয়ে দিয়ে বলল,“আমি তো যাবোই না।”

“কারো যদি মেয়ের প্রতি মায়া পড়ে যায়, তখন আমার কাছে ফিরতে পারবে। আমি কিছুই মনে করবো না।”

হুরাইন তাসিনের সুখ সুখ মুহূর্তে বলে উঠলো,“আপনার বাচ্চাকে আদর করা শেষ। এবার সরুন।”

হঠাৎ পেট গুলিয়ে উঠলো। হুরাইন ছুটে ওয়াশরুমে চলে গেল। বমি করার শব্দ শোনা যাচ্ছে। পিছুপিছু তাসিনও ছুটে গেল। সে অস্থির হলেও বুঝে উঠতে পারলো না কী করবে। ভাবলো হুরাইনের হাত চেপে ধরে রাখলে, তাকে সঙ্গ দিলে হয়তো তার ভালোলাগবে। তাই হুরাইনের একহাত চেপে ধরলো। বমি করতে গিয়ে অস্থির অবস্থা হুরাইনের। গলগল করে বমি করতে গিয়ে কথা বলতে পারছে না। বারবার হাত ঝাঁকিয়ে বোঝানো চেষ্টা করছে আমার হাত ছাড়ুন। তাসিন ভাবলো তার হাত শক্ত করে ধরতে বলছে। সে এবার দুই হাত চেপে ধরলো। তাসিন এমন কিছুর সাথে অভ্যস্ত নয়। গর্ভাবস্থায় মেয়েদের এমন বমি হয়ে থাকে এটা জানে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কী করতে হয় তা জানে না। হুরাইন ঝাড়ি দিয়ে হাত সরিয়ে নিলো। ভালো করে কুলি করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তাসিন বলল,“তুমি তো অসুস্থ। যেতে পারবে না। আমি কোলে তুলে নিয়ে যাচ্ছি।”

হুরাইন রাগি চোখে তাকিয়ে নিজেই হেঁটে চলে এলো। বমি করার সময় কোন পাগল রোগীর দুইহাত চেপে ধরে রাখে? বলদের মত কাজকর্ম। এ আবার বাবা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তাসিন বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। রাগ দেখানোর কারণ বুঝে উঠতে পারলো না।

★★★

ফাবিহা জামা পরিবর্তন করে নিচে নামলো। সবাই জানে শাবাব লুকিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। তাই ফিরোজ আলম গিয়ে বউ নিয়ে এসেছেন বাড়িতে। জেঠা শশুর আর জেঠী শাশুড়িকে সালাম দেওয়ার পর শাবাবের জেঠা হাতে টাকা গুঁজে দিলেন। ওর জেঠী একটা চেইন পরিয়ে দিলেন গলায়। যেহেতু শাবাবের বাবা-মাও ওনাদের পুত্রবধূ, মেয়ে জামাইদের এভাবেই উপহার দিয়েছেন। শাবাবতো ফিরোজ আলমের এক ছেলে। তার বউকে তো দিতেই হয়। পুরো দিন ওনাদের সাথেই কাটলো। তাঁরা বিকেলে বিদায় নিলেন।
সন্ধ্যায় সুরাইয়ার জন্য চা করে নিয়ে গেল ফাবিহা।
“আম্মা আপনার চা।”

সুরাইয়া বললেন,“যে আমার ছেলের মাথা ফাটিয়েছে, আমি তার হাতের চা খাবো না। নিয়ে যাও।”

ফাবিহা সোজাসাপটা বলল,“আপনার ছেলেও তো আমার গ*লা চেপে আমাকে মে*রে ফেলতে যাচ্ছিলো।”

খ্যাঁক করে উঠলেন সুরাইয়া।
“আমার ছেলেকে তো হাজতে দিয়েছো।”

“আমাকেও হাজতে রেখে আসুন আম্মা।”
বিড়বিড় করে বলল,“অন্তত আপনার ছেলের সংসার করা থেকে বেঁচে যাই।”

“সবাই তো আর তোমার মতো না।”

“চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে আম্মা।”

সুরাইয়া রাগ করে কাপ নিয়ে ফেলে দিলেন। ফাবিহা প্রতিক্রিয়াহীন দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর কাপের ভাঙা টুকরো তুলে বেরিয়ে গেল। তুলিকে পাঠিয়ে দিল ফ্লোর পরিষ্কার করতে।
মনে মনে চৌদ্দগৌষ্ঠী উদ্ধার করলো শাবাবের।
“মা- ছেলে দুজনই এক।”

ঘরে যেতেই সিগারেটের উৎকট গন্ধ নাকে লাগলো। নাক চেপে ধরলো ফাবিহা। শাবাব রুমে বসে আয়েশ করে সিগারেট টানছে। ধোঁয়া উড়ছে ঘরে। ফাবিহা খেয়াল করেনি শাবাব কখন এসেছে। তাকে এভাবে সিগারেট ফুঁকতে দেখে সকালের রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। তিরিক্ষি মেজাজে বলল,“সিগারেট খেতে হলে বাইরে গিয়ে খাও। এই ঘরে এসব চলবে না।”

শাবাব সিগারেটে আরো একটা টান দিয়ে ফাবিহার মুখে ধোঁয়া ছাড়লো। কেশে উঠলো ফাবিহা। শাবাব চোয়াল শক্ত করে বলল,“এটা আমার ঘর। গলা নামিয়ে কথা বলবে। এখানে আমি যা চাই, তাই হবে।”

ফাবিহা ধারালো চোখে তাকালো। শাবাবের আঙ্গুলর ফাঁক থেকে সিগারেটের শেষ অংশ টেনে নিলো। শাবাব হেসে বলল,“কয়টা সিগারেট ফেলবে তু….

কথা বন্ধ হয়ে গেল শাবাবের। হাতের মধ্যে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরেছে ফাবিহা। শাবাব দাঁতে দাঁত চেপে ফাবিহার হাত মুচড়ে ধরলো। ফাবিহা ব্যথা পেলেও টুঁশব্দ করলো না।
“দ্বিতীয়বার এমন সাহস করলে হাত ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো।”

ফাবিহার হাত ঝাড়ি দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো শাবাব। আদেশ করলো,“আমার জন্য চিনি ছাড়া এক কাপ চা বানাও।”

ফাবিহা নিজের ফোন হাতে করে চুপচাপ বেরিয়ে এলো। এবার আর সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে। রান্নাঘরে এসে দাগ হয়ে যাওয়া হাতের কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। তারপর মন দিলো চা বানানোতে।

শাবাব চা খেয়ে বেরিয়ে গেল। রাতে খাওয়ার সময় হলেও শাবাব এলো না। ফাবিহা শশুরের সাথে একসাথে খেয়ে উঠে গেল। শাবাব খাক বা না খাক, কারো জন্য সে অপেক্ষা করতে পারবে না। খেয়ে ঘুমিয়েও পড়লো। সুরাইয়া বকাবকি করলেও কান দেয়নি সে। ওনার ছেলের জন্য কি সে এখন না খেয়ে বসে থাকবে?

শাবাব ফিরলো এগারোটার পর। দরজা খুললেন সুরাইয়া। ছেলেকে বেড়ে খাওয়ালেন। সাথে ফাবিহার কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করলেন। ফাবিহা তার জন্য অপেক্ষা করেনি এতে শাবাবের ভাবান্তর হলো না। সেও চুপচাপ খেয়ে ঘরে গেল। ফাবিহার পাশে বিছানায় বসেই একটা সিগারেট ধরালো। সুখটান দিতে দিতে সরু চোখে ফাবিহাকে পর্যবেক্ষণ করলো। কম্বলের বাইরে হাত দুটো বেরিয়ে আছে। ডান হাত লাল হয়ে আছে। হাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজেও ঢুকে পড়লো কম্বলের নিচে। চোখে ঘুম ভীড় করেছে। একই বিছানায় এত কাছাকাছি থাকার পরও দুজনের মনে যোজন যোজন দূরত্ব।

ঘুমের ঘোরে ফাবিহার সেই ডানহাত শাবাবের পিঠের নিচে পড়লো। প্রথমে টের না পেলেও হাত যখন ঝিমঝিম করে উঠলো তখন হাত টান দিলো ফাবিহা। হাত বের করতে না পেরে ঘুম ভেঙে গেল তার। শাবাবের পিঠের নিচে হাত দেখে ওকে ধাক্কা দিল।
“আমার হাত ছাড়ো।”

শাবাব নড়েচড়ে উঠলো। হাত বের করে নিলো ফাবিহা। আবারও গভীর ঘুমে হারিয়ে গেল শাবাব। ফাবিহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু এখন আর ঘুম আসছে না। তার চিন্তা সে কীভাবে এখান থেকে বের হতে পারবে! শাবাবের সাথে সংসার করা কিছুতেই সম্ভব নয়।

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে