এক টুকরো আলো পর্ব-২১+২২

0
207

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২১
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

ফুফুর কাছে ফাবিহার দিন বেশ ভালো কেটেছে। আপাতত তার ফোনে সিম নেই। মা-বাবার সাথে ফুফুর ফোন দিয়েই কথা বলছে। দিন যতই ভালো কাটুক, বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। বাবাকে ফোন করলো তাকে এসে নিয়ে যেতে। আতাউর রহমান এসে গেলেন মেয়েকে নিতে। ফাবিহা বাবার সাথে বাড়ি চলে এলো। লোকজন জিজ্ঞেস করলো সে এতদিন কোথায় ছিল?
আতাউর রহমানের জবাব “বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।”

মানুষের ফুসুরফাসুর চললেও ফাবিহাকে আর কেউ সামনে এসে কটু কথা বললো না। ফোনে আবার সিম চালু করলো। বাড়ি বসে থেকে ভালোলাগছে না। একবার ভার্সিটি থেকে ঘুরে আসা দরকার। যেই ভাবা সেই কাজ। ফাবিহা বেরিয়ে গেল। অনেকদিন পর ভার্সিটি এসে যেমন খালিখালি লাগছে আবার ভালোও লাগছে।
শাবাবের গুপ্তচর ফরহাদ খবরটা জানিয়ে দিতেই শাবাব এসে উপস্থিত। ফাবিহাকে অনেকদিন পর দেখে শান্ত চোখে খানিক সময় তাকিয়ে রইলো। স্বাভাবিক গলায় ফাবিহা বলল,“পথ ছাড়ুন।”

শাবাবের রাগ হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“আমি তোমাকে আটকে রাখতে এখানে আসিনি। আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেই চলে যাব।”

“বলুন কী প্রশ্ন?”

“এতদিন কোথায় ছিলে?”

ফাবিহা শাবাবের চোখে চোখ রেখে বলল,“শশুর বাড়ি।”

শাবাবের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সে বিশ্বাস করে না ফাবিহার প্রতি তার সামান্য অনুভূতি আছে। তার ধারণা তার শরীর থেকে অ*প*মা*নে*র ঘা এখনো শুকায়নি। ফাবিহা কেন এত সহজে বিয়ে করে সুখে থাকবে? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,“তোমার হাজবেন্ড আমার চেয়ে অ্যাট্রাক্টিভ?”

“হ্যাঁ, তবে সেটা চরিত্রের দিক থেকে। সে ভালো মানুষ।”

উত্তেজিত হয়ে পড়লো শাবাব। ফোঁস করে উঠে বলল,“তুমি আবার আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলছ? তুমি জানো আর প্রেম করিনি?”

ফাবিহা তার অযৌক্তিক কথায় হাসলো। বলল,“তুমি একটা কেন, একশোটা প্রেম করলেও আমার কিছু যায় আসে না।”

শাবাব এদিকওদিক তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,“তুমি কেন বিয়ে করেছ?”

ভ্রু কুঁচকে গেল ফাবিহার।
“আমি বিয়ে করবো কি না সেটা তোমায় জিজ্ঞেস করবো?”

শাবাব আজ কথা খুঁজে পাচ্ছে না। বলল,“তুমি এখন আর রিয়েক্ট কর না কেন?”

“দেখছি তুমি কতদূর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারো।”

“তোমাকে আমি সুখে সংসার করতে দেব না। তোমার হাজবেন্ডের ঠ্যাং ভেঙে দেব। তখন ল্যাংড়া বর নিয়ে দুঃখী দুঃখী সংসার করবে।”

ফাবিহা পাত্তা দিল না শাবাবের কথায়। বলল,“পারলে ঠ্যাং ভেঙে দিও। এখন সরো।”

শাবাবকে ঠে*লে দিয়ে চলে গেল ফাবিহা। কটমট করে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো শাবাব। এবার তার কাজ ফাবিহার হাজবেন্ডকে খুঁজে বের করা। ঠ্যাং ভেঙেই ছাড়বে সে।
সে চোখ রাখলো ফাবিহার বাড়ির উপর। বউ যতদিন এখানে থাকবে, বর নিশ্চয়ই একদিন হলেও আসবে। এমন কাজ তাকে দিয়ে হচ্ছে অথচ সে এটাকে স্বাভাবিক জেদ ধরে বসে রইলো। দুদিন সে রাত জেগে পাহারা দিয়েছে। এভাবে না ঘুমিয়ে পাহারা দেয়া যায়? দিনে আবার অফিস যেতে হয়। এভাবে হবে না। তবে হাল ছাড়লো না। পরদিন ফাবিহা বাড়ি থেকে বেরিয়ে লোকসমাগম কম এমন স্থানে আসতেই শাবাব সামনে এসে দাঁড়ালো। ফাবিহা বিরক্ত হয়ে বলল,“সমস্যা কী তোমার? আর কী চাও? আমাকে বারবার হেনস্তা করেও কি তোমার শখ মেটেনি?”

শাবাব শক্ত মুখে জবাব দিলো,“তুমি আমাকে প্রথমবারের মতো থা*না পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছো। এই অপ*মানের শোধ কি অল্পতে তোলা হয়ে যায়? আর আমার চ*রি*ত্র নিয়েও তুমি বা*জে কথা বলেছ।”

“তুমি আমাকে গলা চে*পে মে*রে ফেলতে চেয়েছিলে। চাও নি? তাই থা*না*য় যাওয়া স্বাভাবিক। আর তোমার চরিত্র কি ফুলের মত পবিত্র? তোমায় কোলে নিয়ে মাইক ভাড়া করে “শাবাব ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র। প্রেম করে সর্বত্র।” বলে শ্লোগান দেব?”

শাবাব সরু চোখে তাকিয়ে বলল,“তোমার এখনো সেই ক্ষমতা হয়নি যে আমাকে কোলে তুলবে। এখন তোমার বরকে সামনে নিয়ে আসো।”
শেষ কথাখানা আদেশের সুরে বলল।

ফাবিহা নির্লিপ্ত থেকে বলল,“তোমার যেহেতু প্রয়োজন, তাই তুমি বের করো।”

“ভয় পাচ্ছো আমাকে?”

“না পাওয়ার তো কিছু নেই। তোমার বিশ্বাস নেই, যা কিছু করতে পারো তুমি।”

শাবাবের চোখ জ্বলে উঠলো। ভেবেছিল ইমেজ বাঁচাতে ফাবিহা বলবে -ভয় পাই না তোমাকে। বরকে সামনে নিয়ে এসে বলবে এই দেখো আমার বর। কিন্তু মেয়ে তার বিপরীত। শাবাব বলল,“এক কাজ করি। তোমাকে আটকে রাখি। তখন বউ খুঁজতে বর আপনা-আপনি বেরিয়ে আসবে। কান টানলে যেমন মাথা আসে? ঠিক তেমনই।”

ফাবিহা কিছু বলার আগেই তার নাকে কিছু স্প্রে করে দিল শাবাব। নাকে ওড়না চাপতে বেশ দেরি হয়ে গেল। কিন্তু ফাবিহা নিজের কোনো পরিবর্তন লক্ষ করতে পারলো না। চোখজোড়া ভীতসন্ত্রস্ত। এরা ওকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে যেকোনো কিছু করতে পারে। সম্পর্কটাই শ*ত্রু*তা*র।
ফাবিহার ভয়কাতুরে চেহারা দেখে শাবাব হো হো করে হেসে ফেললো। পানির বোতল সামনে এনে বলল,“পানি স্প্রে করেছি।”

ফাবিহা রেগে গিয়ে বলল,“কখনোই তুমি ভালো হবে না।”

শাবাব ধীর স্বরে বলল,“হবো। তবে তোমার বরের পা যে পর্যন্ত না ভাঙতে পারবো, ততক্ষণ বোধহয় ভালো হবো না।”
শাবাব দুঃখী দুঃখী একটা চাহনি দিল। ফাবিহা বিড়বিড় করল,“ফা*ল*তু।”

ফাবিহা পা বাড়াতে পারলো না। এবার সত্যি সত্যি তার নাকে ক্লোরোফর্ম স্প্রে করলো। ফাবিহা ভাবলো এবারো বুঝি পানি স্প্রে করেছে। তার ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে শাবাব তাকে গাড়িতে তুলে নিলো। বাবার গাড়ি এটা। মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিলো বাবার কাছে।
“দুঃখিত বাবা! তোমার গাড়ি নিয়ে একটা অপ*ক*র্ম করতে যাচ্ছি।”

শাবাবের দু’জন বান্ধবী আরও দুটো মেয়ের সাথে একটা ফ্ল্যাটে থাকে। সবাই বেশ অবস্থা সম্পন্ন ঘরের মেয়ে। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে এখানে থেকে। ফাবিহাকে তাদের কাছে রেখে শাবাব কল করতে নিলো আতাউর রহমানকে। ফোন হাতে নিয়ে টের পেলো তার কাছে তো নম্বরই নেই। এখন করবেটা কী? ফাবিহার ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ফোন লক করা। শাবাব ফাবিহার ফোন হাতে নিয়ে বাসায় চলে এলো। মেয়ের খোঁজ না পেয়ে আতাউর রহমান নিশ্চয়ই মেয়েকে ফোন করবেন। তখন সে কথা বলে নেবে। সে এখনো বুঝতে পারছে না সে কী করেছে। ফাবিহার হাজবেন্ডের পা ভাঙা নয়, বরং লোকটাকে দেখার ইচ্ছা প্রবল। তাকে রিজেক্ট করে কেমন ছেলেকে বিয়ে করেছে, কেবল এটাই দেখতে চায়। ফাবিহা সোজা কথার মেয়ে নয়। সে তো তার বরের ছবি দেখাচ্ছে না। গত দুদিন রাত জেগে ফাবিহার বাড়ির সামনে পাহারা দেওয়ায় ঘুম হয়নি। আজ বাড়ি এসে গোসল করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সন্ধ্যা হয়ে গেল। শাবাবের কক্ষে দুটো ফোন বেজে যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে ফোন দুটো বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রেখে ঘুমালো সে। একটা ফোন ফাবিহার। আরেকটা ফোন শাবাবের নিজের।

★★

ফাবিহা চেঁচামেচি করছে মেয়েগুলোর সাথে। যা পারছে বলে যাচ্ছে। তার জ্ঞান ফেরার পর থেকেই মেয়েগুলো শাবাবকে কল দিচ্ছে। সে ফোন তুলছে না। ফাবিহার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে খুব। পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন এক্ষুনি এসে পড়বে।

“আপনারা কেমন অ*স*ভ্য মেয়ে? একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে এলো আর আপনারাও জায়গা দিয়ে দিলেন? আমার জায়গা যদি আপনারা চারজনের মধ্যে কেউ থাকতেন? তখন কেমন লাগতো?”

একজন সিনিয়র মেয়ে মিলি। মেয়েটা একটু ভীতু ধরনের। ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো,“দেখো, তুমি এমন চেঁচামেচি কোরো না। শাবাবের সাথে যেহেতু প্রেম করেছো, তাহলে বিয়ে করতে অসুবিধা কোথায়?”

ফাবিহার আশ্চর্য হয়ে বলল,“মাথা খা*রা*প আপনাদের? কে প্রেম করেছে ওই ল*ম্প*টে*র সাথে?”
বলতে বলতে উগ্রভাবে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটি পিছিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ফাবিহা মেয়েটা এক্ষুনি তার মাথা ফাটিয়ে দেবে। বলল,“শাবাব বলেছে। সেজন্যই তো এখানে জায়গা দিয়েছি।”

“না জেনেই জায়গা দিয়ে দেবেন?”

আরেকটি মেয়ে ফাবিহার মতো তেজ নিয়ে বলল,“চুপচাপ বসে থাকো। প্রেম করে আবার মিথ্যা বলছো?”

ফাবিহা চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। খানিকটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,“আমার ফোনটা দিন। আমি বাসায় কল করে বলছি আমাকে নিয়ে যেতে।”

ফাবিহা জায়গাটা চিনে না। সেজন্য যেতে অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে। মিলি বলল,“তোমার ফোন তো শাবাব নিয়ে গিয়েছে।”

ফাবিহা মেয়েটিকে ঠাণ্ডা মাথায় আদেশ দিল যেন।
“ওকে ফোন করুন।”

“ফোন করছি সেই কখন থেকে। ধরছে না।”

এভাবে আরো তর্কাতর্কি চললো।

শাবাবের ঘুম ভাঙলো মাগরিবের পর মায়ের ডাকে। ফোন চেক করে তার চোখ কপালে উঠে গেল। ফাবিহার ফোনে ‘বাবা’ নামে সেইভ করা নম্বর থেকে ৫০ টির মতো কল এসেছে। তার ফোনেও অনেকগুলো কল। সে মিলিকে কল ব্যাক করতেই রিসিভ হয়ে গেল। শাবাবের কিছু বলার প্রয়োজন পড়লো না। মেয়েটা হড়বড়িয়ে বলল,“দোহাই লাগে তাড়াতাড়ি আয়। মেয়েটা এক্ষুনি আমাদের মে*রে-টেরে কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলবে। এর চোখে ভয় দেখছি না। মনে হচ্ছে খু*ন চেপেছে মাথায়!”

শাবাব ফোন কানে নিয়ে একটা শার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে গেল। কাউকে কিছু জানালো না।

মিলিদের ফ্ল্যাটে পাশের ফ্ল্যাট থেকে লোকজন চলে এসেছে। তাঁরা আবার অন্যান্য ফ্ল্যাট থেকে লোক ডেকে এনেছেন। মিলি সবাইকে বলে দিল তাদের বন্ধু প্রেমিকা নিয়ে এখানে উঠেছে। মেয়েটি এখন ছেলেটিকে বিয়ে করতে চাইছে না।

শাবাব তাদের কাছে ফাবিহার ব্যাপারে যা বলেছে সেটাই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরলো মিলি। শাবাবও পৌঁছে গেল। ঝামেলাটা বেড়ে গেল। শাবাব তো স্তব্ধ হয়ে গেল। এতকিছু হয়ে যাবে সে ভাবেনি। সব জায়গাতেই কিছু টাকা খাওয়া পাব্লিক থাকে। এখানেও আছে। তাঁরা শাবাব আর ফাবিহাকে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাথে শাবাবের জরিমানা করা হবে। অবস্থা বেগতিক দেখে শাবাব সত্যিটাই বলল। মেয়েটা বিবাহিত।

এবার সবাই আরো খারাপভাবে নিলো ব্যাপারটাকে। ঘরে স্বামী রেখে এই ছেলের সাথে বেরিয়ে এসেছে। ফাবিহা চিৎকার করে বলছে“ আমি আসিনি। আমাকে তুলে নিয়ে এসেছে।”

তার চোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। শাবাব নিজেও বলল ফাবিহাকে সে তুলে এনেছে। পাব্লিক যা বুঝলো সেটাই সত্য। এদের কথা আর বিশ্বাস করছেন না তাঁরা। কারণ এরা একবার এক কথা বলছে। প্রথমে বলল প্রেমিক-প্রেমিকা। মেয়েটা বিয়ে করতে চায় না বলে তুলে এনেছে। তারপর বলল মেয়েটা বিবাহিত। এখন আবার বলছে প্রেম-টেম কিছু না। তুলে নিয়ে এসেছে। বাঁচার জন্য যে এরা বারবার মিথ্যা বলছে না তার প্রমাণ কী? তাই এবার আর কেউ শুনতে চাইলো না শাবাব ফাবিহার কথা। তাদের সাথে বিপদে পড়লো ফ্ল্যাটের চারজন মেয়ে। শাবাবের চোখজোড়া ফাবিহার কান্নারত মুখের দিকে। তার খা*রা*প লাগছে মেয়েটার জন্য। সে বারবার বলছে সব দোষ আমার।
ফাবিহা বলল,“আপনারা কিছু করার আগে আমার বাবা-মাকে কল দিন। তাঁরা জানে আমি কী করতে পারি আর না পারি।”

একজন বলল,“মেয়েটার বাবাকে কল দিন। ছেলের বাবাকেও কল দেয়া হোক। ছেলে-মেয়ের কীর্তিকলাপ তাঁরা এসে দেখে যাক।”

বাবাকে কল দিতে বলেই ফাবিহার মনে পড়লো বাবা তো হার্টের রোগী। যদি এসব শুনে টেনশনে কিছু হয়ে যায়? ভয় ঢুকলো মনে। আবার ভাবলো বাবা ছাড়া তো কেউ তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। সব রকম চিন্তা, না খাওয়া মিলিয়ে শরীর কেঁপে অসাড় হয়ে এলো। চোখে সব ঝাপসা দেখছে। খাবার না খাওয়ার চেয়ে বেশি ভয়টাই কাবু করে নিলো ফাবিহাকে। সে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। শাবাব দৌড়ে তার কাছে যেতে গিয়েও পারলো না। কয়েকজন মিলে ফাবিহাকে ঘিরে ধরে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। কেউ বা বলছে ঢং করছে মেয়েটি।

এতদিনের অপরাধের কোনো অনুশোচনা না হলেও আজ অপরাধবোধ হলো শাবাবের। তার একটা অন্যায় মেয়েটার জীবন শেষ করে দিচ্ছে। ফাবিহার শশুর বাড়ির লোকজন শুনলে কী হবে? স্বামী রাখতে চাইবে তো তাকে? সংসার টিকবে? ফাবিহার ভালো-মন্দের চিন্তায় ডুবে গেল শাবাব। তার কাছ থেকে ফোন নিয়ে তার আর ফাবিহার বাবাকে কল দেওয়া শেষ।
দু’জনই বোধহয় জান হাতে নিয়ে ছুটে আসছেন। ফাবিহার বাবার চিন্তাটাই যে বেশি।

পরিবেশ আপাতত ঠাণ্ডা। আতাউর রহমান আর ফিরোজ আলম এসে পৌঁছেছেন। ফিরোজ আলমের শাবাবকে মা*র*ধ*র করা শেষ। বৈঠক বসেছে। আতাউর রহমান যেভাবে বললেন তাতে ওনার মেয়ে নির্দোষ। ফাবিহার জ্ঞান ফিরেছে। সে বাবার সাথে লেপ্টে আছে। এখন একটু একটু সাহস এসেছে। ফিরোজ আলমও যা বললেন তাতে ওনার ছেলে দোষী। শাবাব মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

আক্ষেপ করলেন আতাউর রহমান।
“আমার মেয়ের এখন কী হবে? ভালো ঘরে মেয়ে বিয়ে দিতে পারবো আমি? আমার মেয়ের দোষ না থাকলেও লোকে তাকে নিচু চোখে দেখবে।”

শাবাবের ভ্রু কুঁচকে গেল। ভালো ঘরে বিয়ে হবে মানে কী? ফাবিহার না বিয়ে হয়ে গেল?

শাবাবের প্রশ্নটি একজন বৃদ্ধ করে ফেললেন।
“আপনার মেয়ে না বিবাহিত?”

“ওটা এই ছেলের হাত থেকে বাঁচতে বলেছিলাম।”

শাবাব বড়ো সড়ো এক ধাক্কা খেল। কী ভুলটাই না সে করে ফেললো। সেই বৃদ্ধ লোকটি প্রস্তাব করলেন।
“এই ছেলের কারণে যেহেতু এতকিছু। তাহলে সব দায়ভার তাকেই নিতে দিন। দুজনের বিয়ে পড়িয়ে দিন।”

“অসম্ভব!”
আতাউর রহমান তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলেন।

ফিরোজ আলম নিজেও বললেন,“আমি নিজেই নিজের ছেলের উপর ভরসা করতে পারছি না। আর উনি কীভাবে করবেন? অন্য ফয়সালা করুন।”

“অন্য কি ফয়সালা করবো? আপনার ছেলেকে তো পু*লি*শে দেব। কিন্তু মেয়েটার কী হবে?”

ফাবিহা শক্ত মুখে বলল,“জীবনে বিয়ে না হলেও আমি ওকে বিয়ে করবো না।”

তাকে ধমকে উঠলেন বৃদ্ধ লোকটি।
“জীবনের বুঝো কী মেয়ে? তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তোমার বাবা আছেন। কথা বলছো কেন তুমি?”

আতাউর রহমান একরোখা ভাবে বললেন,“আমি তো এই ছেলের হাতে আমার মেয়ে তুলে দেব না।”

রাত বাড়ছে, অথচ কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। বৃদ্ধ লোকটি শাবাবের দিকে তাকালেন। খ্যাঁক করে উঠে বললেন,
“কী শাস্তি নেবে তুমি?”

শাবাব দৃষ্টি নিচের দিকে রেখেছে তো আর তুলছে না। সে নিজেও বুঝতে পারছে না তার জন্য কেমন শাস্তি উপযুক্ত। ফিরোজ আলম আর আতাউর রহমানের উপর সবটা ছেড়ে দেয়া হলো। ফিরোজ আলম নিজের ছেলের উপর ভরসা করতে পারছেন না। আতাউর রহমান মেয়েই বিয়ে দেবেন না। এদিকে কিছু একটা সিদ্ধান্ত না নিয়ে লোকজন তাঁদের উঠতে দিচ্ছে না। বৃদ্ধ লোকটি আতাউর রহমান আর ফিরোজ আলমকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন।
“দেখুন বাবারা। এখন বিয়ে না দিলে পরে ঝামেলা আরো বাড়বে। অনেকেই ভিডিও ধারণ করে রেখেছে। এসব ইন্টারনেটে ছাড়লে ছেলে তো বুক ফুলিয়ে হাঁটবে। মেয়েকেই মুখ লুকিয়ে বাঁচতে হবে। তারচেয়ে বরং ছেলে যেহেতু মেয়েটিকে বিয়ের জন্য এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে তাই উচিত হবে বিয়ে পড়িয়ে দেয়া। যদি ছেলের সুমতি হয়।”

আতাউর রহমান বললেন,“ওনার ছেলের সুমতির জন্য কেন আমার মেয়েকে বলির পাঠা হতে হবে?”

বৃদ্ধ উঠতে উঠতে বললেন,“আমি যাচ্ছি বাপু। তোমরা দেখো এদের থেকে ছাড় পাও কি না। এমন জায়গায় এসে পড়েছো, সব দা*লা*ল। একটাও এখন কিছু একটা না ঘটিয়ে তোমাদের উঠতে দেবে না। সাথে পয়সা উসুল। এক জায়গা দুটো ছেলেমেয়েকে ধরতে পারলেই এদের কাজ ধরে বেঁধে বিয়ে পড়িয়ে দেয়া, সাথে মোটা অঙ্ক দাবি করা।”

বৃদ্ধ লোকটি উঠে গেলেন। এতক্ষণ একজনের উপর সব ছেড়ে দিলেও সবাই এবার মাতব্বর হতে এসেছে। যাঁর ঘরে অবিচার, সেও রাজা সেজে বিচার করতে এসেছে।

একজন এগিয়ে এসে বলল,“এতক্ষণ অনেক দেখেছি। ছেলে-মেয়ে যেমন? বাবারাও তেমন। ছেলেমেয়ের পা*প ঢাকতে তাঁরাও মিথ্যা জুড়ে দিয়েছে। আজ বিয়ে দিয়ে পবিত্র হয়ে এখান থেকে বের হবে। নয়তো ছেলে-মেয়ে দুটোকেই পু*লি*শে দেব। সাথে তাদের বাপদেরও মুখে কালি মাখাবো।”

শাবাব এবার ক্ষে*পে গেল।
“বারবার এক কথা কেন বলছেন? বললাম তো সব দোষ আমার। সবাইকে যেতে দিয়ে যা শাস্তি দেয়ার আমাকে দিন।”

লোকজন এসে শাবাবকে চ*ড়, থা*প্প*ড় বসালো। অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেই বৃদ্ধ লোকটি এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আবারও এগিয়ে এসে আতাউর রহমান আর ফিরোজ আলমকে বললেন,“বাবারা আরো বা*জে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আপনাদের আজ বাড়ি যেতে দেবে না এরা। পরে কী হবে সেটা না ভেবে এখান থেকে বের হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।”
ফাবিহাকে বললেন,“তোমার বুঝার বয়স হয়েছে। ভেবে দেখো এখান থেকে মানসম্মান নিয়ে বের হবে না-কি এখানেই পড়ে থাকবে।”

কোনো হাল হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত আতাউর রহমান আর ফিরোজ আলম রাজি হলেন। ফাবিহার সব দায়িত্ব ফিরোজ আলম নিজের ঘাড়ে তুলে নিলেন। শাবাব আর ফাবিহা বাঁধ সাধলো। বিনিময়ে ফাবিহাকে বাবা বুঝিয়ে গেলেও শাবাবের কপালে চ*ড় ছাড়া কিছুই জুটলো না। মানুষ এতটাই এগিয়ে গিয়েছে যে, তাঁরা হুজুর নিয়ে হাজির। ফাবিহা আর বাড়াবাড়ি করলো না। এতকিছু যখন তার সাথে ঘটে গিয়েছে, তাহলে সামান্য একটা বিয়ে আর কী করবে তাকে? কোনো অনুভূতি ছাড়াই কবুল বলে দিল। শাবাব স্থির হয়ে গেল। সে কবুল বলতে দেরি করছে। অথচ দেরি করার কথা ছিল ফাবিহার। ধাক্কা খেয়ে শাবাবও কবুল বলে দিল। কয়েকজন ফিরোজ আলম আর আতাউর রহমানকে চেপে ধরলেন তাঁদের চা-নাস্তার টাকা দিতে। এতক্ষণ এখানে সময় দিয়েছেন তারা। আর চা-নাস্তার টাকা খুবই সামান্য। দুজন মিলে চল্লিশ হাজার দিলেই হবে। ফ্ল্যাটের মেয়ে চারজনকে ওয়ার্নিং দিয়ে সকলে বেরিয়ে যাচ্ছিলো এক এক করে।

এর মাঝে এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে গেল। ফাবিহা কাঁচের জগ তুলে শাবাবের মাথা ফাটিয়ে দিল। তার চোখে তীব্র রাগ। শাবাব ব্যথা স্থানে হাত দিয়ে র*ক্ত দেখে র*ক্তের দিকেই তাকিয়ে রইলো। সকলেই স্তব্ধ। ফাবিহার ভাবগতি খুব খা*রা*প। সে আরো কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। আতাউর রহমান ছুটে গিয়ে মেয়েকে আটকালেন। ফিরোজ আলম শাবাবকে নিয়ে হাসপাতাল যাবেন। শাবাব জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। হাসপাতাল গেল না।

#চলবে….

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

সাজেদা কাশিতে ভুগছেন। নিজে উঠে সব কাজ করছেন। নিশিকে ডেকে বললেন,“একটু গরম পানি করে দে তো।”

“যাচ্ছি।” বলে ফোনে ব্যস্ত রইল নিশি। সময় গড়ালো। কাশতে কাশতে বুক ব্যথা হয়ে গিয়েছে। নিশিকে কয়েকবার বলার পরও “যাচ্ছি” বলে বসে থাকা দেখে সাজেদা মেয়েকে বকতে বকতে মনের কষ্টে নিজেই উঠে গেলেন পানি গরম করতে। এবার নিশির টনক নড়লো। ফোন রেখে সে পানি গরম করতে গেল। সাজেদা মেয়ের হাত থেকে পাতিল টে*নে নিয়ে বললেন,“যা এখান থেকে। আমার কাজ আমিই করতে পারবো। একজন খাটের উপর গিয়ে বসে থাক আরেকজন তো আগেই বাপের বাড়ি গিয়ে উঠেছে।”

সাজেদার মুখ থমথমে। অবসর সময়ে একা একা বসে থাকতে এখন আর ভালোলাগে না। হুরাইন থাকলে ইচ্ছে করেই এসে বসে থাকতো ওনার পাশে। এটা-ওটা বলে গল্প করার চেষ্টা করতো। মেয়ে তো সারাদিন ফোন নিয়েই পড়ে থাকে। মায়ের সাথে কথা বলার সময় কোথায়? নিশি গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সাজেদা নিজের জন্য পানি গরম করে ঘরে যেতেই শুনতে পেলেন ফোন বেজে চলেছে।
গলা পরিষ্কার করে ফোন ধরলেন। ওপাশ থেকে সালাম দিল হুরাইন।
“আসসালামু আলাইকুম আম্মা। কেমন আছেন?”

সাজেদা থমথমে গলায় জবাব দিলেন,“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আমার ভালোর খবর কে নেয়? তুমি কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ। আপনার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন আম্মা? আপনি কি অসুস্থ?”

“আমার অসুখ হলেই বা কী?”
বলতে বলতে আবারও কেশে উঠলেন সাজেদা।

হুরাইন বলল,“ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন? আমি কি চলে আসবো আম্মা?”

“গিয়েছি। আসতে হবে না তোমার। আরো কিছুদিন থাকো। আরো বড়ো অসুখ নিয়েও সংসার সামলিয়েছি।”

হুরাইন বলল,“বাড়ির সবাই কেমন আছে?”

“আছে ভালোই। তোমার বাবা-মা কেমন আছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছেন দু’জনেই। আপনার পানি ধরা উচিত হবে না। আরো অসুস্থ হয়ে যাবেন। আমি আব্বুকে বলবো আমাকে ও বাড়ি পৌঁছে দিতে।”

সাজেদা সন্তুষ্ট হলেও মুখে বললেন,“তুমি অনেকদিন পর বেড়াতে গিয়েছো। নিশি আছে, ও পানির কাজকর্ম করে দিলে বাকিটা আমি করতে পারবো।”

হুরাইন শাশুড়ির কথা শুনে হাসলো। নিশি তো কোনো কাজকর্মই পারে না। সাজেদা একবার যেতে বললেই সে চলে যাবে। যদি তাসিনের সাথে সম্পর্ক আগের মত সহজ হত, তবে হুরাইন এখনই চলে যেত। সাজেদা বারবার বলছেন যাওয়ার দরকার নেই। এমন কাশি ঠান্ডা পড়লেই হয়ে থাকে ওনার। ঔষধ নিলেই সেরে যায়। হুরাইন কথা শেষ করলো।

সে বাবার বাড়ি এসেছে চার দিন হলো। এখনো তাসিন সম্পর্কে কাউকে কিছু জানায়নি। তাসিন প্রতিদিন ফোন দিয়ে খোঁজখবর জেনে কল কেটে দেয়। তাদের মধ্যে বাড়তি কোনো আলাপ হয় না।

তাসিন সারাদিনের কাজকর্ম শেষে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিতেই হাজারো চিন্তাভাবনা তার মাথায় এসে ভীড় জমালো। এখন মন থেকেই একটু একটু করে নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে। ধর্ম সম্পর্কে তার অল্পস্বল্প যা ধারণা আছে, তাতে স্পষ্ট হুরাইন তার খারাপ চায় না। বরং তাকে আলোর পথে টে*নে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এতদিন মনকে স্থির করতে না পারলেও এখন মনকে স্থির করে ফেলেছে। সে নিজেকে পরিবর্তন করবেই। তবে এবার বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাইরের মানুষ। যাদের সাথে মেলামেশা করে এসেছে এতদিন। তারা যেন নানারকম কথা দিয়ে পেছন থেকে টে*নে ধরে তাকে। বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এ নিয়ে সবার মধ্যে চলছে মনোমালিন্য।
হুরাইনের সাথে বাড়তি কোনো কথাও সে বলছে না। বলতে পারছে না। হুরাইন কীভাবে রিয়েক্ট করে বসবে সেই ভয় থেকেই কথা বাড়াচ্ছে না সে। তার মনে আরো একটি ভয় ঢুকেছে। সেটি হলো হুরাইন যদি আর না ফেরে তার কাছে? ঠিকঠাক ঘুম হয় না তার। সব সময় মনের ভেতর একটা অশান্তি কাজ করে। হুরাইনকে সে ভালোবাসে এটা যেমন সত্য, দুই যুগের বেশি সময় ধরে অভ্যস্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আসাটাই কষ্টসাধ্য এটাও তেমনই সত্য। আমি জীবনে সফল হতে চাই। এই চাওয়া তো সবারই থাকে, সফলতা ক’জনে পায়? আর সফল হওয়াটাও কি দুই-একদিনের ব্যাপার? কারো চার বছর, পাঁচ বছর কারো আবার সারাজীবন লেগে যায়।

শশুর তাকে স্মরণ করলো। জনাব আজাদের কল পেয়ে বুক ধ্বক করে উঠলো। এই বুঝি তিনি নিজের শর্তের কথা মনে করিয়ে মেয়েকে নিজের কাছে রেখে দেবেন! শীতের মাঝেও ঘামছে তাসিন। নিজেকে ধাতস্থ করে কল রিসিভ করে সালাম দেয়ার পূর্বেই জনাব আজাদ সালাম দিলেন। তিনি কখনো কারো সালামের অপেক্ষায় থাকেন না। বরং আগে আগে নিজেই সালাম দেন।
সমাজে অহরহ মুরব্বি দেখা যায়, যাঁরা বয়সে ছোটোদের সালামের অপেক্ষায় থাকেন। আগে সালাম না দিলে বে*য়া*দ*ব বলে আখ্যায়িত করেন। অথচ আগে সালাম দেয়া ব্যক্তি আল্লাহর কাছে উত্তম।

তাসিন সালামের জবাব দিল। দু’জনের মধ্যে ভালো-মন্দ কথা হলো। এবার জনাব আজাদ বললেন,“আপনার সাথে কথা আছে। আগামীকাল আমাদের বাসায় আসবেন জামাই।”

জনাব আজাদের গলা সব সময়ের মতোই শান্ত। তাসিনের ভেতরে ভয় ঢুকলো। সে বুঝতে পারছে না জনাব আজাদের তাকে ডাকার কারণ। কোনোভাবে হুরাইন আর তাকে আলাদা করার প্রস্তুতি না নেয়া হচ্ছে। রাতে ছটফট করতে করতে ভোরের আগে ঘুম হলো তাসিনের। তবে মস্তিষ্ক সজাগ। ফজরের আজান পড়ার পরপরই উঠে পড়লো। আজ আর তাকে কারো ডেকে তুলতে হয়নি। গত দুদিন এভাবেই চলছে। ফজরের নামাজ পড়ে হুরাইনের কুরআন মাজীদ হাতে তুলে নিলো। ভেতরের কিছুই সে পড়তে পারছে না। ছোটবেলায় পড়েছিল। কিন্তু চর্চা না থাকায় কিছুই মনে নেই। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো প্রতিটি হরফ। মনে মনে আওড়ালো হরকতের নাম। অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছে সে। তারপর কুরআন মাজীদ আবার রেখে দিল। নাস্তার টেবিলে বাবা-মা দুজনকেই হাসিখুশি দেখালো। কিন্তু খুশির কারণ তার অজানা। নিশি নির্লিপ্ত। তামিম আবার ফিরে গিয়েছে। তাসিন নাস্তা করে চলে গেল অফিসে। মা-বাবাকে বলে গেল সে আজ শশুর বাড়ি যাবে।

শশুর বাড়ি এসে সে আগের মত সবার সাথে আচরণ করতে পারছে না জড়তার কারণে। হুরাইন নিশ্চয়ই সব বলেছে সবাইকে। জনাব আজাদের আচরণ স্বাভাবিক। হুসাইন আর তার শাশুড়িও আগের মতোই তাকে আপ্যায়ন করছে। হুরাইনকে একবারও দেখলো না। সে সামনে এলো না। রাতের খাবরের পর সে ছাড় পেল। অথচ জনাব আজাদ কোনো কথাই তুললেন না। তাসিন দুরুদুরু মন নিয়ে হুরাইনের ঘরে প্রবেশ করলো।

মাথার কাপড় সরিয়ে রেশমি কালো চুলে মাত্র হাত দিয়েছে হুরাইন। তার একহাতে চিরুনি। তাসিন দরজায় দাঁড়িয়ে পড়লো। হালকা শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকালো হুরাইন। তাসিন চোখ নামিয়ে নিলো। হুরাইন সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে তাসিন ভেতরে ঢুকে বিছানায় বসে পড়লো। হুরাইন চুল বেঁধে এগিয়ে এলো। তার দিকে তাকালো তাসিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হুরাইনের হাত দুটো চেপে ধরলো হাতের মুঠোয়। চোখজোড়া অশান্ত তার। অস্থির গলায় বলল,“আমার সময় লাগবে হুরাইন। আমি চেষ্টা করছি নিজের পরিবর্তনের। তুমি প্লিজ ফিরে চলো!”

তাসিনের চোখে ভয়। হুরাইন মনোযোগ দিয়ে পরোখ করলো। তারপর বলল,“আপনি আগে বলুন কাকে ভয় পাচ্ছেন?”

তাসিন থমকে গেল হুরাইনের প্রশ্নে। অতঃপর সময় নিয়ে বলল,“আমি দুটোতেই ভয় পাচ্ছি। আল্লাহকে ভয় পাচ্ছি সাথে তোমাকে হারানোর ভয়টাও পাচ্ছি।”

হুরাইন বলল,“যদি আপনার কথা সত্য না হয়?”

“কী করলে বিশ্বাস করবে?”

“আমি আপনার পুরো পরিবর্তন চাই। একজন দ্বীনদার মানুষ হিসেবে দেখতে চাই। তাহলে আমি আর আপনার সন্তান দুজনই আপনার কাছে ফিরবো।”

ভোঁ ভোঁ করে মাথা ঘুরতে থাকলো তাসিনের। হুরাইনের কথা মাথার উপর দিয়ে গেল। তাদের সন্তান আসলো কোথা থেকে? মাথায় আরেকটু চাপ দিতেই সবটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। তার চোখ জোড়া ঝলমল করে উঠলো সাথে ভিজে উঠলো পানিতে। হুরাইনের হাত ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে হুরাইনকে আগলে নিলো। শক্ত করলো বাঁধন। যেন ছেড়ে দিলেই সে পালিয়ে যাবে। হুরাইন নিজেও বাঁধন ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না। অনুভূতি প্রকাশ করতে দিল তাসিনকে। মিনিট পাঁচেক যেতেই তাসিনের হাত ছাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বলল,“ছাড়ুন আমাকে।”

তাসিন বাঁধন আরো শক্ত করলো।
“এবার আর ছাড়বো না তোমায়।”

হুরাইন বলল,“আমি আপনার সাথে ফিরবো না। যেদিন আমার মনে হবে আপনি পরিপূর্ণ সঠিক পথে চলছেন, কোনো গাফিলতি হচ্ছে না সেদিনই আমি আপনার সাথে ফিরবো।”

“এবার কিন্তু আমার প্রতি জুলুম হয়ে যাচ্ছে হুরাইন।”

“আমি জুলুম করছি না। আপনি নিজেই নিজের উপর জুলুম করছেন। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন।”

তাসিন আহত চোখে তাকালো। লাভ হলো না। হুরাইনের মন নরম হলো না। এখন তার কথাই শুনতে হবে তাসিনকে। শুয়ে পড়লো। আজ তাড়াতাড়ি ঘুম এসে পড়লো। হুরাইন এপাশ-ওপাশ করছে। তাসিনের ঘুম এসেছে বুঝতে পেরে তার দিকে ফিরলো। চুলের ভাঁজে হাত চালিয়ে বলল,“আমি চাই আপনার সাথে থাকতে। তারজন্য আপনাকে পরিপূর্ণ দ্বীন পালনে অভ্যস্ত হতে হবে। আমার ভয় হয়, যদি আবারও নিজের দেয়া কথা আপনি ভুলে যান? তাই যে পর্যন্ত না আপনি নিজের ভালো বুঝতে পারবেন, নিজেকে পরিবর্তন করতে পারবেন ততদিন আমি ফিরবো না।”

হাত নিয়ে তাসিনের গলা জড়িয়ে ধরলো। আস্তে করে একটা পা তুলে দিল তার শরীরে। তারপর ঠোঁট টিপে হাসলো। নড়েচড়ে উঠলো তাসিন। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরলো হুরাইন। যেন সে ঘুমের ঘোরে তাসিনের গায়ে হাত-পা তুলে দিয়েছে। তাসিনও ঘুমের ঘোরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে।

ফজরে আজ তাসিনকে ডাকতে হলো না। সে নিজ থেকে জেগে ওজু করতে গিয়েছে দেখে হুরাইন অবাক হলো সাথে খুশি হলো বেশ। সাজেদা বেগম খবরটা শোনার পর খুশি হয়েছেন বুঝা গেল। কিন্তু তিনি নিজের খুশিটা পুরোপুরি প্রকাশ করতে নারাজ। হুরাইনকে বলে সাবধান করে দিলেন। এভাবে চলবে, ওভাবে চলবে, ঠিকমতো খাবে। তারপর হুরাইনের মায়ের সাথে কথা বলেও সবটা বুঝিয়ে দিলেন বেয়ানকে। হুরাইন আশার আলো দেখছে। সে পারেনি, তাদের সন্তানের আগমন যদি ওই পরিবারের মানুষগুলোর একটু একটু করে হিদায়াত আনতে পারে! সুসংবাদ পেয়ে সকলের মাঝেই সে অল্পস্বল্প পরিবর্তন লক্ষ করেছে। কেবল নিশি ছাড়া।

★★★

শাবাবকে জোর করে হাসপাতাল নিয়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিলেন ফিরোজ আলম। ফাবিহাকে আতাউর রহমান বাড়ি নিয়ে গিয়েছেন। শাবাবকে নিয়ে ফিরোজ আলম বাড়ি ফিরতেই সুরাইয়া তুলকালাম বাঁধালেন। তিনি তো কিছুই জানেন না। কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। ভেবেছেন শাবাব মা*রা*মা*রি করে এসেছে।
“আব্বা, কেনো গেলে মা*রা*মা*রি করতে?”

ফিরোজ আলম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,“মা*রা*মা*রি*র চেয়ে বেশিকিছু করেছে তোমার ছেলে। বউ ধরে মাথা ফা*টি*য়ে দিয়েছে।”

সুরাইয়া কান্নার মাঝেই খেঁকিয়ে উঠলেন,“এই তুমি আবোলতাবোল কথা বলবে না। আমার ছেলের বউ আসবে কোথা থেকে?”

“তোমার ছেলে আজ বিয়ে করেছে।”

সুরাইয়া বিশ্বাস করলেন না। শাবাবকে জিজ্ঞেস করলেন,“তোর বাবা কী বলছে আব্বা? এই লোকেরে কি জ্বীন-ভূত আছর করেছে না কি?”

শাবাব দৃষ্টিনিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সুরাইয়া রেগে গিয়ে বললেন,“বাপ-বেটা দুটোকেই আজ ঘরে জায়গা দেব না। বের হ। আমার প্রশ্নের উত্তর দে।”

শাবাব আড়চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে মায়ের উদ্দেশ্য বলল,“বাবা সত্যি বলছে।”

সুরাইয়া আবারো হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। একমাত্র ছেলে বিয়ে করলো তাদের না জানিয়ে? আবার বলে কি-না বউ তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। কী ডা*কা*ত মেয়ে বিয়ে করলোরে। সুরাইয়ার প্রেশার বেড়ে গেল। তুলি এসে বলল,“ভাইজান আপনে ঘরে যান। আমি আর খালু আম্মারে দেখতাছি।”

সুরাইয়া বিলাপ করছেন। শাবাবের মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। সে ঘরে চলে গেল। আজকের ঘটনা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। ব্যান্ডেজে হাত ছুঁইয়ে ফাবিহার রাগান্বিত চেহারা মনে করলো। ব্যথায় টনটন করে উঠলো মাথা। মনে হচ্ছে এখনই মাথাটা ফাটিয়েছে। দিনে ঘুমিয়েছে বলে এখন আর ঘুমও আসছে না। তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায় ডুবে গেল।

ফিরোজ আলম সুরাইয়াকে শান্ত করে সব খুলে বললেন। ছেলের দ্বারা এসব ঘটেছে শুনে তিনি বিস্মিত। আবার ছেলের মাথা ফাটানোর কথা শুনে একবার ফাবিহাকে দেখতে চাইলেন। কতবড়ো কলিজা হলে তাঁর ছেলেকে মে*রে মাথা ফাটিয়ে ফেলতে পারে। তিনি ফাবিহার উপর ক্ষেপে আছেন।

ফাবিহা, শাবাব দুজনই কিছুদিন বাড়ি থেকে বের হলো না। দুজনের অবস্থার কিছুটা উন্নতি দেখে ফিরোজ আলম ফাবিহাকে নিয়ে যাওয়ার কথা তুললেন। বিয়ে যেহেতু হয়ে গিয়েছে তখন একটা সমাধানে আসা উচিত। ফাবিহা বেঁকে বসলো। সে যাবে না। একরোখা সিদ্ধান্তের সাথে তার মাও একমত। মেয়েকে তিনি কিছুতেই দেবেন না। বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? কেউ তো আর জানে না। আতাউর রহমান আর ফিরোজ আলম কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলেন আরো কিছুদিন ওদের সময় দেয়া যাক। তারপর নাহয় আবার নেয়ার কথা তোলা যাবে। এই সময়ে ফাবিহা ফ্রেন্ড’দের সাথে ঘুরতে চলে গেল তিনদিনের জন্য। তার মাইন্ড ফ্রেশ করা জরুরি। আতাউর রহমান তাই বাঁধা দিলেন না। শাবাবও ব্যাগপত্র নিয়ে কোথাও চলে গেল ফাটা মাথা নিয়ে। এখন অবশ্য অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে