এক টুকরো আলো পর্ব-১৯+২০

0
199

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_১৯
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

আজ ঘরের পরিবেশ গুমোট। বাড়ি ফেরার পর থেকে একবারও কথা বলেনি হুরাইন। তাসিন দুশ্চিন্তায় পড়লো। আজ আবার কী নিয়ে রেগে আছে? সকালের ব্যাপার নিয়ে? রাতের খাবারেও কথা হয়নি। ঘরে এসে দেখলো চুপচাপ বিছানা করছে হুরাইন। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,“রেগে আছ কেন? সকালের জন্য সরি।”

হুরাইন কিছু বলল না। ছাড়ানোর চেষ্টাও করলো না। চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। তাসিন বুঝলো মান ভাঙেনি। তাই তার ভালোবাসার গভীরতা আরেকটু বাড়লো। পুরো প্রতিক্রিয়াহীন হুরাইন। যেন কোনো রোবট দাঁড়িয়ে আছে। বাঁধাও দিচ্ছে না। সরে গেল তাসিন। নিভু নিভু স্বরে শুধালো,
“তোমার কি আমার স্পর্শ খা*রা*প লাগছে?”

হুরাইন বিছানা গোছানো শেষ করে দম ফেললো। এবার স্বাভাবিক গলায় বলল,“বসুন। আপনার সাথে কিছু কথা আছে।”

তাসিন বসলো।
“বলো।”

তাসিনের চোখে চোখ রাখলো হুরাইন। গভীরভাবে তার চোখজোড়া পড়তে চেষ্টা করলো। বলল,“আমি যা যা জিজ্ঞেস করবো, সত্য জবাব দেবেন।”

তাসিন বুঝতে পারলো না হুরাইন কোন প্রসঙ্গে কথা বলতে চায়। তবুও সে আশ্বস্ত করলো সত্য বলবে। হুরাইন বলল,“আপনার কি বিয়ের আগে কোনো সম্পর্ক ছিল?”

এবার শব্দ করে হেসে ফেললো তাসিন। রগঢ় করে বলল,“তুমি দেখি খুব জেলাস।”

হুরাইন উত্তেজিত হয়ে বলল,“জেলাস কেন হবো? সে কি আপনার স্ত্রী? যদি হালাল হতো, তাহলে জেলাস শব্দটা মানা তো। আমার বরং ঘৃ*ণা হচ্ছে।”

তাসিন বিস্মিত হয়ে হুরাইনের রাগ দেখলো। চোখের সাদা অংশ লাল। ফর্সা ত্বক লাল হয়ে আছে। তাসিন তাকে শান্ত করার জন্য দু’হাতে তাকে আগলে নিলো।
“শান্ত হও। আমার বিয়ের আগে কোনো সম্পর্ক ছিল না।”

হুরাইন বাঁধন থেকে সরে এসে বলল,“আমি আবারও বলছি, মিথ্যা বলবেন না।”

“সত্য বলছি। আচ্ছা তোমার মাথায় বাচ্চা মেয়েদের মত এসব কে ঢুকিয়েছে?”

হুরাইন তেজী গলায় বলল,“আমার বিবেক, আমার বয়স কোনো দিক থেকে আমি ছোটো নই। আমি যা জানতে চাইছি তার জবাব দেবেন।”

তাসিন অপলক তেজী হুরাইনকে দেখে নিয়ে মৃদু হেসে বলল,“স্বামীর কাছে কৈফিয়ত চাইছো?”

হুরাইন আরও কঠিন হয়ে বলল,“আপনি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি আমি আপনার স্ত্রী। তাই আপনার সম্পর্কে সব জানার অধিকার আমার আছে। আমি ভালোবেসে যেমন আগলে নিতে জানি, তেমনি কঠিনও হতে জানি।”

তাসিনের ভাবমূর্তি পরিবর্তন হয়ে গেল। এখন আর তার ঠোঁটে বিন্দুমাত্র হাসি নেই। হুরাইনের এমন রূপের সাথে সে খুব একটা পরিচিত নয়। সে প্রায়ই রাগ করে থাকে। তবে এবারের মতো কঠিন কখনো তাকে দেখা যায়নি। তাসিন বলল,“আচ্ছা আর কী জানতে চাও?”

“ফাবিহা আপুর সাথে আপনার কী সম্পর্ক ছিল?”

“ফাবিহার সাথে আমার কোনোকালেই সম্পর্ক ছিল না। তবে ওর সাথে পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। সেটা আমার সম্মতিতে। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার কৌতুহল মাত্র। ফাবিহার সাথে বিয়ে হয়ে গেলে আর তোমার চিন্তা মাথায় আসবে না। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। যত দিন যাচ্ছিলো, আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি তোমার প্রতি। ফাবিহার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র মনের টা*ন ছিলো না।”

“আপনি নিজের সমস্যার সমাধান করতে একটা মেয়েকে কেন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবেন? এই সাহস, এই অধিকার কে দিল আপনাকে? ফাবিহা আপু দিয়েছিলেন?”

তাসিন দৃষ্টি নামিয়ে বলল,“আমি অনুতপ্ত হুরাইন। মাও এই ব্যাপারে আমার সাথে রেগে ছিলেন। তুমি প্লিজ আমাদের বর্তমান, ভবিষ্যতে ওসব কথা টে*নে এনো না!”

হুরাইন মলিন হেসে বলল,“এখন সবটা স্পষ্ট যে কেন আপনার মা আর বোন আমাকে পছন্দ করেন না। আমি তাঁদের সাথে যতোই মিশতে চেষ্টা করি, তাঁরা আমাকে আ*ঘা*ত করতে চান। ঠিক আছে, ওটা আপনার অতীত ছিল। বিয়ের পূর্বের বিষয় নিয়ে কথা বললেও সেটা এখন সমাধান হবে না। তবে আপনার দ্বারা এমন কিছু হয়েছে, আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। বাদ দিলাম ওসব।”

একটু থেমে বলল,“কিন্তু বিয়ের পরবর্তী জীবন নিয়ে আমি আপনাকে একবিন্দু ছাড় দেব না।”

ভ্রু কুঁচকে গেল তাসিনের।
“আশ্চর্য! আর কী করলাম আমি?”

“আপনার মেয়ে বান্ধবী আছে নিশ্চয়ই! তাঁদের সাথে চলাফেরাও হচ্ছে নিয়মিত।”

তাসিন এবার চুপ করে গেল।
“কী হলো? জবাব দিন।”

তাসিন অস্বস্তি নিয়ে বলল,“বন্ধুবান্ধবের সাথে একসাথে চলাফেরা করেছি। এখন চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারছি না। একটু বুঝার চেষ্টা করো। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”

“পরিবর্তন আজ হোক, আগামীকাল নয়। এভাবে চলতে থাকলে মৃ*ত্যু এসে দরজায় কড়া নাড়বে অথচ আগামীকাল আর আসবে না।”

“আচ্ছা আমি কীভাবে এড়িয়ে চলবো বলো?”

হাসলো হুরাইন। তার ঠোঁটের কোনে লুকিয়ে আছে স্পষ্ট উপহাস।
“আপনি নিশ্চয়ই ছোটো বাচ্চা নন! আপনি বিয়ে করেছেন। সবাইকে বলবেন ‘আমি বিবাহিত, দ্বীনের পথে চলতে চাই‘।
তাঁরা যদি আপনাকে দ্বীন পালনে বাঁধা দেয় তবে ওসব বন্ধু পরিহার করুন।”

তাসিন চাপা রাগ দেখিয়ে বলল,“তুমি কী বলছো বুঝতে পারছো? বন্ধু মানে বুঝো তুমি? তাদের আমি ছেড়ে দেব?”

হুরাইন দ্বিগুণ রেগে বলল,“আপনি কি ভেবেছেন? আপনার বিয়ের পূর্বে সকল অন্যায়, হা*রা*ম কাজ মেনে নিয়েছি বলে এখনো সবটা মেনে নেব? তখন আপনার সাথে আমার জীবন জড়িত ছিল না। তাই আমার করার কিছুই ছিল না। কিন্তু আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি এখনো সকল বেহা*য়া*পনা, অশ্লী*লতা সহ্য করবো তবে ভুল ভাবছেন। ইসলাম স্বামীকে মান্য করতে বলেছে, স্বামীর বে*হা*য়া*প*না নয়। যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতি ভালোবাসা আসে না, ভীতি আসে না। কয়েক বছর চলা বন্ধুত্বের প্রতি এত টা*ন? যারা আপনাকে ইসলামের পথে নয়, হারামের দিকে টে*নে নিয়ে যায়, তাঁরা আপনার বন্ধু নয়, শ*ত্রু।”

“হুরাইন। নিজের মুখ সংযত করো।”
ঘরে দুজনের চাপা স্বরে রাগারাগি, ঝগড়াঝাটি চলছে। বাকি সব ঘুমে বিভোর।
হুরাইন বলল,“স্ত্রী ঘরে রেখে বাইরে পরনারীর সাথে মেলামেশাকে কী বলবো? পুণ্যের কাজ?”

তাসিন চোখ বুজে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে বলল,“আমার রাগ আর বাড়িয়ে দিও না হুরাইন।”

হুরাইন আর কথা বললো না। চুপচাপ শুয়ে পড়লো। তার অনেকক্ষণ ধরে কোমর, তলপেটে ব্যথা হচ্ছে।
তাসিন ওখানেই বসে রইলো। জীবনকে যতটা সহজ ভেবেছিল, তা ততটা সহজ নয়। তার মাথার ভেতর হাজারও টেনশন। সে কোনোদিকই ছাড়তে পারছে না। স্ত্রীর কথামতো চলতে চাইছে, নিজেকে পরিবর্তন করতে চাইছে, বাইরে গেলে মানুষের কটাক্ষ, বিদ্রুপ এড়িয়ে এগিয়ে যেতে পারছে না। কিছু মানুষের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে, তাদের কাছ থেকে ছুটে আসা যাচ্ছে না। হুরাইনের কথাগুলো তীক্ষ্ণ তীরের মতো গেঁথেছে মনে। একটা স্বাভাবিক চলাফেরাকে কীভাবে সে বেহা*য়া*পনা বলতে পারলো! মেয়ে বন্ধুতো তার একার নয়। সে তো তাঁদের সাথে সম্পর্কে জড়াচ্ছে না। তাহলে কীসের এতো ভয় হুরাইনের?

হুরাইন জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। তার চোখে ঘুম নেই। পেট ব্যথা তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করার চেষ্টা করছে। তাসিন গভীর ঘুমে। তার দিকে ফিরলো হুরাইন। পলকহীন তাকিয়ে রইলো। সে মনেপ্রাণে চাইলো আল্লাহ তাসিনকে আর এই পরিবারের মানুষগুলোকে হিদায়াত দিক। চোখমুখ কুঁচকে ব্যথায় কুঁকড়ে গেল সে। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট আর্তনাদ বেরিয়ে এলো।

আজ আর তাহাজ্জুদ পড়তে ওঠেনি হুরাইন। ঘুম এসেছিল শেষ রাতে। তাই টের পায়নি। জেগে গেল আজানের শব্দে। আজান হলেই তার আর ঘুম হয় না। তাসিনকে ডাকলো নামাজ পড়ার জন্য।
তাসিন উঠলো না। হুরাইনের ডাকাডাকিতে সে সাড়া দেয়নি। পেটে ব্যথা এখনো আছে। তবুও জায়নামাজ গুছিয়ে উঠে গেল। বেরিয়ে দেখলো সাজেদা রান্নাঘরে। সে বলল,“আমি করে নিচ্ছি আম্মা। আপনি যান।”

সাজেদা ভারী গলায় বললেন,“তুমি যখন ছিলে না, তখন আমি এই সংসারটা একা হাতে চালিয়েছি।”

“তখন করেছেন। এখন আপনার রেস্ট করার সময়।”

“যাও এখন থেকে।”

হুরাইন বুঝতে পারলো না সে কী কাজ করবে! হাতের কাছে করার মত কোনো কাজও নেই। এদিকে সাজেদাও গম্ভীর হয়ে কথা বলছেন।
সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ না যেতেই সাজেদার বকাবকি শুরু হয়ে গেল। এই বয়সে এসে ওনাকে কাজ করতে হচ্ছে। হুরাইন এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সে তো কাজ করতেই চেয়েছিল। তখনও রেগে গেলেন আর কাজ না করে ওনার কথা মান্য করছে বলেও রাগ দেখাচ্ছেন।
তাসিনের অফিসের সময় হয়ে এলেও হুরাইন ডাকলো না। ঘড়িতে যখন আর দশমিনিট বাকি। তখন ঘুম ভাঙলো তার। বিয়ের আগে মা বা নিশি ডেকে দিতো। বিয়েরপর হুরাইন ডেকে দিতো। আজ তাকে ডাকা হলো না। সময় দেখে সে কয়েকবার চেঁচিয়ে হুরাইনকে ডাকলো। তারপরই ওয়াশরুমে ছুটলো। হুরাইন ঘরে এলো ধীরেসুস্থে।
তাসিন বেরিয়ে নিজের কোনোকিছুই আজ গোছানো পেল না। জামাকাপড় বের করা নেই, আয়রন করা নেই। অন্যদিন সবকিছু তৈরি রাখে হুরাইন। তাকে দেখে রাগী স্বরে বলল,“আমার অফিসের সময় হয়েছে, ডাকোনি কেন? আমার কিছুই গোছানো নেই কেন?”

হুরাইন শান্ত স্বরে বলল,“আমি আপনাকে ফজরে ডেকেছিলাম। আপনি ওঠেননি। সেটা আমার দোষ নয়।
আর বাকি রইলো আপনার সব গুছিয়ে রাখা। যে ব্যক্তি ফজর পড়া জরুরি মনে করে না, আমিও তাঁর সব গুছিয়ে রাখা জরুরি মনে করিনি।”

সময় চলে যাচ্ছে। তীব্র রাগ হলেও দ্রুত একটা শার্ট নিয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল তাসিন। কথা বাড়ানোর সময় নেই। এমনিতেই দেরি হয়ে গেল। বসকে হাজারটা জবাবদিহি করতে হবে। কথা শোনাতে কার্পণ্য করেন না বস। আজ আর আয়রন করা শার্ট পরা হয়নি। এলোমেলো হয়ে বেরিয়ে গেল। হুরাইন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। শরীর বারবার ভেঙে আসতে চায়। বারবার মনে হয় এটা কিছুতেই তার জীবন হতে পারে না। সে এমন জীবনের স্বপ্ন দেখেনি।

★★★

ফুফাতো ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে শাবাব নিজেও এলো। মেয়ে দেখার পূর্বেই মেয়ের বাবা শাবাবকে দেখে ফিরোজ আলমকে জিজ্ঞেস করলেন,“ও পাত্রের কী হয়?”

ফিরোজ আলম হেসে বলল,“পাত্রের মামাতো ভাই। আমার একমাত্র ছেলে।”

আতাউর রহমান সাথে সাথে বলে দিলেন।
“দুঃখিত আমি মেয়ে বিয়ে দেব না!”

শাবাব দুর্বোধ্য হাসলো। ফিরোজ আলম সহ সকলে অবাক হয়ে তাকালেন। কারণ জানতে চাইলে শাবাবের কীর্তিকলাপের বিবরণ দিলেন আতাউর রহমান। ফিরোজ আলম যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছেন না। শাবাবের দিকে তাকাতেই শাবাব বলল,“ওনার মেয়ে আমার সাথে প্রেম করেছে। কিন্তু বিয়ে করবে না।”

“মিথ্যা কথা। তুমি আমার মেয়েকে উত্যক্ত করেছো। যার জন্য আমরা থা*না*য় যেতে বাধ্য হয়েছিলাম।”
প্রতিবাদ করলেন আতাউর রহমান। ফিরোজ আলমের বোন তো কিছুতেই আর মেয়ে দেখবেন না। তিনি এই মেয়েকে আর বউ বানাবেন না। ভাইকে রেখেই তিনি ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ফিরোজ আলম মাথানিচু করে বেরিয়ে এলেন। শাবাব বেরিয়ে আসতেই তাকে রাস্তায় রেখে চ*ড় মা*র*লে*ন দুটো। আজ তিনি খুব আ*ঘা*ত পেয়েছেন। মুখটা ছোটো হয়ে গিয়েছে।
শাবাবের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন।

আজ আবার দেখতে এসে ফিরে গিয়েছে ছেলেপক্ষ। এটাও জানাজানি হয়ে গেল। ফাবিহা হয়ে উঠলো উপহাসের পাত্রী। সকলের ধারণা মেয়েটার আর বিয়ে হবে না।

#চলবে……

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_২০
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

ফাবিহা এসে বাবার পাশে বসলো। ছোটো করে বলল,“আমাকে ফুফুর বাসায় দিয়ে আসো বাবা। ক’দিন থেকে আসি।”

আতাউর রহমানও ভাবলেন মেয়ে ঘুরে আসলে হয়তো মনটা ভালো হবে। তাই মেয়েকে বললেন,“জামাকাপড় গুছিয়ে নে।”

ফাবিহা উঠে গেল। জামাকাপড় গুছিয়ে নিলো। তিক্ত স্মৃতিগুলোকে এখানেই মাটিচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করলো। চাইলেই কি আর স্মৃতি ভোলা যায়? তবুও মানুষের কত চেষ্টা।
ফাবিহাকে নিয়ে পরদিনই চট্টগ্রামের গাড়ি ধরলেন তার বাবা-মা। একেবারে বোনের বাসায় পৌঁছে দিয়ে সেদিন তাঁরাও ওখানে রইলেন। পরদিন আবার চলে আসলেন দু’জন। বাড়িতে তালা ছিল। প্রতিবেশীদের অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন কোথায় গিয়েছেন। আতাউর রহমান স্ত্রীকে চুপ থাকতে বলে দিলেন। এই মানুষগুলো তাঁর মেয়ের শান্তি নষ্ট করেছে, ক*টু কথা বলেছে। এখন আবার নতুন কোনো কথা তুলবে। ফাবিহার মাও শক্ত রইলেন। সন্তানের বেলায় সব বাবা-মা-ই কেমন শক্ত হয়ে যান। ফাবিহা যে ফুফুর বাড়ি গিয়েছে এই সংবাদ কেউ জানে না।

এক সপ্তাহ কেটে গেল। ফাবিহার কোনো খোঁজ নেই। ফরহাদকে ফোন দিলেই সে জানায় “আসেনি ক্যাম্পাসে।”

শাবাব চিন্তিত হলো। কিছু হয়েছে নাকি? আশঙ্কা থেকে ফরহাদকে বলল,“একটু ওর বাসায় খোঁজ নিয়ে দেখ। কোনো সমস্যা হয়েছে কি না জানা আমাকে।”

“ঠিক আছে ভাই।”

কল কেটে ভাবনায় বসলো শাবাব। ফাবিহা এখন একেবারে প্রতিক্রিয়াহীন। কোনো প্রতিবাদ করছে না। এখন কেন যেন মেয়েটাকে শা*স্তি দিয়ে মজা পায় না।
আসলেই কি প্রতিবাদ করছে না? তার নিরবতাই যে সবচেয়ে বড়ো প্রতিবাদ। এটা শাবাব বুঝে উঠতে পারেনি।
বাবার কাছে গিয়ে অফিসের একটা ব্যাপার নিয়ে কথা তুললো। ফিরোজ আলম কাঠকাঠ গলায় বলে দিলেন,“আমার ব্যবসায় আর কারো বসার দরকার নেই। আমি আগে সামলাতে পেরেছি, এখনো পারবো।”

“বাবা।”
শাবাবকে থামিয়ে দিলেন ফিরোজ আলম। রুষ্ট কন্ঠে বললেন,“ভেবেছিলাম ভালো হয়ে গিয়েছিস। আমি ভুল ছিলাম। যতটা খা*রা*প তোকে ভেবেছিলাম, তারচেয়ে বেশি খা*রা*প তুই। তোর মায়ের জন্য পারছি না। নয়তো বাড়ি থেকেই বের করে দিতাম।”

শাবাব মাথা নিচু করে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বাবা না করলেও ব্যাবসা নিয়ে সে মাথা ঘামালো। এভাবে আরো একটি সপ্তাহ পার হলো। ফরহাদ খবর জানালো ফাবিহা বাড়িতে নেই। কোথায় আছে কেউ বলতে পারছে না। কারো কাছেই মুখ খুলছেন না ফাবিহার বাবা-মা। শাবাবের ভালো লাগছে না। অস্থিরতা তাকে তাড়া করছে। অপরাধবোধ না কি এত সহজে ফাবিহা হেরে গিয়েও জিতে যাওয়া শাবাবকে শান্তি দিচ্ছে না, তা বুঝা গেল না।

ফাবিহার ফুফু কল দিলেন। ভাইয়ের বউ আর ভাইয়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বললেন। ফাবিহাও মা-বাবার সাথে কথা বলেছে। এবার ফোন নিয়ে সরে গেলেন ফাবিহার ফুফু। আতাউর রহমানরা স্বামী-স্ত্রী এখনো কলে আছেন। ফাবিহার ফুফু বললেন,“তোদের সাথে একটু আলাপ করার ছিল।”

আতাউর রহমান বললেন,“বল।”

“আমাদের এখানে তো কেউ কিছু জানে না ফাবিহার কথা। আমার ননাস এসেছিলেন। ফাবিহাকে পছন্দ হয়েছে ওনার। এ নিয়ে কথাও তুলেছিলেন। আমি বলেছি আমার ভাই-ভাবির সাথে কথা বলে দেখি।”

ফাবিহার মা-বাবা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। তারপর আতাউর রহমান গলা ঝেড়ে বললেন,“তোর ননাস। তাহলে তো সব খবর তোর জানা।”

“জি ভাইয়া। আমার ননাসের কথা বলে লাভ নেই। বউদের সাথে খ্যাটখ্যাট করা স্বভাব আছে। তবে ছেলে ভালো। তাছাড়া ছেলে চাকরি করে যেখানে, সেটা বাসা থেকে দূরে আছে। সপ্তাহে বাড়ি আসে। খাওয়াদাওয়ার কষ্ট। তাই বিয়ে হলে ফাবিহাকে সাথেই রাখবে মনে হয়। সমস্যা একটা আছে।”

“কী?”

“ছেলের বয়স একটু বেশি আর খাটো।”

ফাবিহার মা নাকচ করলেন। তিনি বলেই দিলেন,“আমার মেয়ে তো ঘর ভেঙে যাচ্ছে না। সবকিছু বাদ দিলেও বয়সের কথা বলি। ছেলের সাথে ছেলের বয়সে খাপ খাবে এমন মেয়ে দেখা উচিত। আমার মেয়ের মাত্র অনার্স করছে। আরো কয়েক বছর পরও ফাবিহাকে লাগবে যুবতী আর ছেলেকে মধ্যবয়স্ক ধরা হবে। তখন মেয়ের মন উঠে যাবে। সংসারে মন দেবে না। আমরা যদি এখন এসব না আটকাই পরে দোষ মেয়ের হবে না, আমাদের হবে।”

“ভাবি সবদিক তো পাওয়া যায় না। এতকিছু বিবেচনা করলে বিয়ে দেবে কীভাবে? এলাকায় যা বদনাম ছড়িয়েছে মেয়ে এত সহজে বিয়ে দিতে পারবে? পারলেও ভালো ঘর পাবে? তাছাড়া ছেলের বয়স বেশি হলে সেই ছেলেরা বুঝদার হয় বেশি।”

“আমিও বলছি না সবদিক পাবো। আর ছেলে বুঝদার হবে এটা আমরা জানি, আমরা মানি। মেয়ে তো মানবে না। মন থেকে মানিয়ে নিতে না পারলে ভবিষ্যতে কিছু একটা ঘটালে তার দায়ভার কে নেবে? মেয়ের মন যে অন্যদিকে যাবে না তার নিশ্চয়তা কী?”

“তোমরা আগে এখানে এসে দেখে যাও। ফাবিহার সাথে কথা বলে দেখো সে কী বলে। তারপর নাহয় সিদ্ধান্ত নিও। ফাবিহা না চাইলে তো আর কিছু করার নেই।”

আতাউর রহমানও সায় দিলেন। বললেন,“আগে আমরা ফাবিহার সাথে কথা বলে দেখি।”

ফাবিহার মা মানতে চাইছেন না। আতাউর রহমান বোনের সাথে কথা শেষ করে স্ত্রীকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। বললেন,“তুমিই তো বললে মন থেকে মানতে না পারলে ভবিষ্যতে অঘটন ঘটবে। আগে আমরা কথা বলে দেখি। দেখো, সুযোগ কিন্তু বারবার আসে না। বিয়ে না দিলে কিছুদিন পর ফাবিহা আবার আসবে এখানে। মানুষ ওকে খোঁ*চা*বে। ভালো সম্বন্ধ আসলেও কিছু মানুষ তাঁদের কানভারী করে রাস্তা থেকে বিদায় দেবে।
মেয়ে এবার শক্ত থেকেছে বলে কি সবসময় শক্ত থাকতে পারবে? আ*ঘা*ত আ*ঘা*তে সবাই শক্ত হয় না। বেশিরভাগই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আমি বলছি না এখনেই বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। আগে যাচাই-বাছাই করো। মেয়ের মন বুঝার চেষ্টা করো। চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?”

ফাবিহার মা থমথমে গলায় বললেন,“যেখানে আমার মন বলছে আমার মেয়ে মানিয়ে নিতে পারবে না, সেখানে আমি যাচাই-বাছাই করতে যাওয়ার প্রয়োজন দেখি না।”

“তুমি বেশি অবুঝ হচ্ছো। আমরা আগে দেখে আসি।”

ফাবিহার মা আর কথা বাড়ালেন না। তবে তিনি মনে মনে ঠিক করে ফেললেন মেয়েকে তিনি কিছুতেই বিয়ে দেবেন না।
দুদিন পর আবার স্বামী-স্ত্রী চট্রগ্রাম গেলেন।
ফাবিহার ছোটো ছোটো ফুফাতো ভাইরা দোকান দিয়েছে। দুজন মিলে পাঁচশো টাকার জিনিসপত্র তুলেছে। জোরজবরদস্তি করে প্রথম ক্রেতা বানালো ফাবিহাকে। ফাবিহা বলল,“আমি কিছুই কিনবো না।”

জোর করে তার মুখে একটা চকলেট ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,“দাও, টাকা দাও।”

হতভম্ব হয়ে গেল ফাবিহা। চকলেট খেয়ে এবার বলল,“তাহলে আরেকটা চকলেট দাও।”

আরেকটা চকলেট নিলো ফাবিহা। দশ টাকা বাড়িয়ে দিতেই ছোটো ফুফাতো ভাই বলল,“আরো দুই টাকা।”

ফাবিহা ভ্রু কুঁচকে বলল,“কীসের দুই টাকা? দুইটা চকলেট দশ টাকা।”

“না, আমরা একটা চকলেট ছয় টাকা বিক্রি করি। নয়তো লাভ হবে কীভাবে?”

ফাবিহা চোখ বড়ো করে বলল,“প্রথমত জবরদস্তি করে ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি করেছো। আবার দু’নম্বরি শুরু করেছো?”

“এতকিছু বুঝি না। দুই টাকা দাও।”

ফাবিহার ফুফা মুখ টিপে হাসছেন। ফাবিহা ফুফার দিকে তাকাতেই ফুফা বললেন,“দুই টাকা মাফ করে দাও।”

“না, যদি বলা হয় এক পয়সা মাফ করো। মাফ করতে পারবো না। প্রয়োজনে একবেলা ভাত খাওয়াবো। ব্যাবসার সাথে কোনো আপোষ করা হচ্ছে না।”

ফাবিহা ভেংচি কেটে বলল,“আমিও দুই টাকা দিচ্ছি না।”

ফুফা পকেট থেকে দশ টাকার নোট দিলেন ছেলেদের দিকে। ফাবিহা মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,“এটা কিন্তু দু’নম্বর ব্যাবসায়িদের প্রমোট করা হলো ফুফা।”

ফুফাতো ভাই বলল,“যাও দুই টাকা মাফ করে দিলাম।”

“আম্মাজান।”
ডাক শুনে পেছন ঘুরলো ফাবিহা। বাবা মাকে দেখে ছুটে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। তাঁদের অপেক্ষাতেই এখানে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাঁরা আসবে ফাবিহা জানে। কিন্তু কেন আসবে তা জানে না।

রাতে ফাবিহার কাছে এসে বসলেন বাবা-মা। প্রথমে ভিন্নভাবে কথা শুরু করলেও কথার মোড় ঘুরলো ধীরে ধীরে। আতাউর রহমান সবকিছু বলে ফাবিহার দিকে তাকালেন। মাথানিচু করে রইল ফাবিহা। ফাবিহার মা আগ বাড়িয়ে বললেন,“আমি জানি তোর পছন্দ হয়নি। না হলে বল আমরা বিয়ে দেব না।”

আতাউর রহমান বিরক্ত চোখে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। ফাবিহাকে বললেন,“তোর মতামত জানতে চাইছি।”

কেন বিয়ে দিতে চাচ্ছেন, কী সুবিধা-অসুবিধা সব বললেন আতাউর রহমান। ফাবিহা নিচু গলায় উদাস হয়ে বলল,“তোমরা যা ভালো মনে করো। আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস কোরো না। সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো মানসিকতা এখন আমার নেই।”

আতাউর রহমান মেয়ের কথা শুনে খুশি হলেন। স্বামী-স্ত্রী উঠে গেলেও দুজনের মাঝে ঠোকাঠুকি লেগে গেল। পরদিন ফাবিহার ফুফুর ননাসের পরিবার আসলো। তাঁরাও বিকেলে চলে গেলেন আর ফাবিহার বাবা-মাও বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। ফাবিহা আরো কিছুদিন থাকুক।

বাড়ি আসার দুদিন পরই চমকিত হলেন ফাবিহার বাবা-মা। শাবাব তাঁদের বাড়িতে। এসেই ফাবিহার খবর জানতে চাইল। সে কোথায়?
আতাউর রহমান সোজাসাপটা জবাব দিলেন,“বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।”

শাবাব কপাল কুঁচকে পরক্ষণেই মৃদু হেসে বলল,“বিয়ে দিলেন আর কেউ জানলো না?”

“কেউ যাতে না জানে, আমার মেয়ের বিয়ে ভাঙতে না পারে সেজন্যই লুকিয়ে বিয়ে দিয়েছি।”

আপনা-আপনি শাবাবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। চাপা রাগ দেখিয়ে বলল,“ওর শশুর বাড়ি কোথায়?”

“তোমাকে কেন বলবো?”

“বলতে হবে না।” বলে শাবাব বেরিয়ে গেল। রাস্তায় নামতেই এক টুকরো ইটের সাথে হোঁচট খেল। রাগ চেপে গেল আরো। লা*ত্থি মা*র*লো ইটের টুকরোয়।

★★★

হুরাইন আর তাসিনের সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। তাসিন সব ঠিক করতে চাইলেও হুরাইন ঠিক করার চেষ্টা করছে না। সেদিন তাসিন নরম হয়ে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলো, বুঝানোর চেষ্টা করলো। হুরাইন ভাবলো তাসিন তার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। সে নিজের কাপড়ে হাত দিয়ে আঁচল ফেলতে গিয়ে বলল,“আপনাকে বাঁধা দেয়ার শক্তি বা অধিকার কোনোটাই আল্লাহ আমাকে দেননি। আপনি আপনার অধিকার নিতে পারেন।
তবে সত্যি বলছি আমি আপনাকে এখন আর মন থেকে গ্রহণ করতে পারছি না।”

থমকে গেল তাসিন। তার প্রচণ্ড রাগ হলো সাথে কষ্ট পেল। প্রথমত ঘনিষ্ঠ হওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল না। যা তার রাগ বাড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত তাকে মন থেকে মানতে না পারার ব্যাপারটা পীড়া দিচ্ছে তাকে। রাগ আর কষ্ট থেকেই হুরাইনকে আর বুঝানোর চেষ্টা করেনি সে। যেভাবে চলছে চলুক। দুজনের মাঝে প্রয়োজন ছাড়া কথাও হচ্ছে না।

আজ তাসিনের ভাই বাড়ি ফিরেছে। ভাইয়ের বিয়ের সময় তার পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার পর বন্ধুদের সাথে ট্যুর দিয়েছে। তারপর আবার ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই আর বাড়ি আসা হয়নি। এখন বাড়ি এসেছে।

তামিম বাড়ি আসায় হুরাইন এখন ঘর ছেড়ে বের হয় না। ভালোভাবে দেখেশুনে রান্নার কাজকর্ম সারতে আসে। তাও যত জলদি করা যায় সে ঘরে চলে আসে। হুরাইনের মাঝে এই পরিবর্তন দেখে সাজেদা খ্যাঁক করে উঠেছেন। দুদিন যাবত কাজ নিয়ে চো*রা*চু*রি দেখছেন তিনি। ঘরে বসে থাকে সারাদিন। তামিম তো গতরাতে বলে ফেললো,“ভাবি কি আমার বাড়ি আসা পছন্দ করছে না? দেখাও করলো না কথাও বললো না।”

বউ অসুস্থ বলে সাজেদা সব ধামাচাপা দিলেন। আজ রান্না করতে এসে কথা দিয়ে হুরাইনের টুঁটি চেপে ধরলেন। হুরাইন বলল,“আম্মা তিনি আমার দেবর। আমি কীভাবে তাঁর সামনে যাই? সেজন্যই দ্রুত কাজকর্ম সেরে ঘরে ঢুকে যাই।”

“দেবর তো কী হয়েছে? সে তোমার স্বামীর ছোটো ভাই। তোমারও ছোটো ভাই। একটু কথা বললে তো আর জাত যাবে না। নাকি তুমি আমার ছেলের বাড়ি আসা পছন্দ করছো না।”

“এটা ওনার বাবার বাড়ি। আমি কেন ওনার আসা নিয়ে ঝা*মে*লা করবো আম্মা? আমরা ছোটো ভাই বলে সামনে গেলেও ইসলামে তা জায়েজ নেই।”

সাজেদা যেন অবুঝ নারী হয়ে গেলেন। তিনি একরোখা ভাবে বললেন,“আজ ঘরে যাওয়া চলবে না। সবাইকে দাঁড়িয়ে খাবার দেবে তুমি।”

হুরাইন কথা বলল না। সে চুপচাপ কাজ করে গেল। দুপুরে সকলে খাবার টেবিলে। তাসিন অফিসে আছে। হুরাইন নিচে নামছে না। সাজেদা কয়েকবার গলা ছেড়ে ডাকলেন। হুরাইন সাড়া দিচ্ছে না। তার দরজা বন্ধ। সে জায়নামাজে পড়ে আছে। সকল ফিতনা থেকে সে মুক্তি চাইলো। নামাজ বন্ধ দিচ্ছে না। সাজেদা কতক্ষণ চিল্লাফাল্লা করে দরজা বন্ধ দেখে গজগজ করতে করতে নিজেই খাবার বেড়ে দিলেন সবাইকে। তামিম তো আর এতদিন বাড়ি ছিল না। সে কিছুই জানে না। ভাবলো ঘরে হয়তো ভাবির সাথে সবার ঝামেলা চলছে। সে বিরক্ত হয়ে বলল,“এসব কী হচ্ছে ঘরে?”

তাসিনের বাবা এতক্ষণ চুপচাপ স্ত্রীর কাণ্ডকারখানা দেখে গেলেও এবার মুখ খুললেন।
“তোমরা তো কিছুই মানো না। মেয়েটাকে কেন তার দ্বীন পালনে বাঁধা দিচ্ছো? সে সঠিক কাজই করছে।”

সাজেদা এবার হুরাইনকে ছেড়ে স্বামীর উপর চড়াও হলেন। তাসিনের বাবা চুপ করে শুনে গেলেন। কথা বলে তর্কে জড়ানোর মত বোকামি তিনি করলেন না।

তাসিন বাড়িতে ঢুকার পরই তাকে আগলে ধরলেন সাজেদা। হুরাইন কী কী করেছে সব জানালেন। তাসিন কাউকে কিছু না বলে দরজার সামনে এসে নক করলো।
“দরজা খুলে দাও।”

তাসিনের গলা শুনে হুরাইন দরজা খুলে দিল। অফিসের পোশাক পরিবর্তন করে ফ্রেশ হয়ে শান্ত হয়ে বসলো তাসিন। ক্লান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,“বাসায় কী হয়েছে?”

হুরাইন স্বাভাবিক গলায় বলল,“আপনার ভাইয়ের সামনে যাইনি কেন, সেটা নিয়েই আম্মা রেগে আছেন।”

তাসিন ওভাবেই বলল,“গিয়ে ওকে খাবারটা দিয়ে চলে আসলেই পারতে। ও তোমার ছোটো ভাইয়ের মত।”

হুরাইন রেগে গিয়ে বলল,“আপনি কোন ব্যাপারে সিরিয়াস বলতে পারেন? নিজে পরিবর্তন হবেন না, আমাকেও বহাল থাকতে দিচ্ছেন না। ছোটো ভাই মনে করলেই তো হলো না। তাঁর সাথে আমার দেখা দেয়া জায়েজ নেই। তিনি নন-মাহরাম পুরুষ আমার জন্য। দেবর মৃ*ত্যু সমতুল্য।”

তাসিন বলল,“আচ্ছা আমরা যেটার ভয় পাচ্ছি, ও কিন্তু তেমন না। তোমার দিকে নজর দেওয়ার মতো কাজ ও করবে না৷ তাছাড়া সেই সাহস ওর নেই। ও জানে আমি ওকে কী করতে পারি।”

হুরাইনের আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবুও বলল,“ফিতনার জন্য স্বাভাবিক একটা চোখের দৃষ্টিই যথেষ্ট। দ্বিতীয়বার তাকানোর কুমন্ত্রণা শ*য়*তা*ন দিয়ে দেবে। সামান্য আমার স্বর যদি আপনার মনে অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে, আমাকে নিয়ে ভাবতে আপনাকে বাধ্য করতে পারে তাহলে দৃষ্টি কেন নয়?”

তাসিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এতো ধরাবাঁধা নিয়মে তো তারা বড়ো হয়নি। সে নিজের ভুল অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে। কেবল নামাজ পড়লেই যে তাকে প্রকৃত মুসলিম, প্রকৃত দ্বীনদার বলে না। প্রতিনিয়ত সে চেষ্টা করেও নিজের কাছে প্রতারিত হয়। শ*য়*তা*ন বলে ওঠে,“আল্লাহ ক্ষমাশীল। তুই পা*প করে ক্ষমা চাইলে তিনি মাফ করে দেবেন। আবার পা*প করবি আবার মাফ চাইবি। আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমা করবেন।”
তখন সে নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আপনা-আপনি কেউ যেন তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। একজন মা*তা*ল যেমন ম*দ খেয়ে বেহুশ হয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারায়, সেও তেমনি নিয়ন্ত্রণ হারায়। পরে অনুতপ্ত হয়। আমি কেন করলাম এটা? আবারও সে নিয়ন্ত্রণ হারায়। হুঁশ আসতে আবারও অনুতপ্ত হয়। এরজন্য দরকার শক্ত ইমান।

রাতে হুরাইন ঘুমিয়ে গেলেও তাসিনের ঘুম আসছে না। সে অপলক তাকিয়ে আছে হুরাইনের দিকে। কতশত চিন্তা তার মাথায় ভর করছে। দশটার আগেই তার শশুর ফোন করে মেয়েকে নিতে আসতে চান বলে দিল। তাসিন প্রথমে না করলেও পরে হার মানলো। হুরাইন অনেকদিন হলো বেড়াতে যায় না। তাই শশুরকে আর না করলো না। হুরাইন কাল যাবে। অথচ তাসিনের এখন থেকেই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। হুরাইনের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে সে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো।

কথা অনুযায়ী জনাব আজাদ মেয়ের শশুর বাড়ি আসলেন মেয়েকে নিতে। তাসিন আগেই মা-বাবাকে বলে রেখেছে হুরাইনকে যেতে দিতে।
তাসিন অফিসে, হুরাইন চলে গেল তার বাবার সাথে। যাওয়ার আগে একবার কল দিয়ে বলল,“আমি বাবার সাথে যাচ্ছি।”

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে