এক জীবনের গল্প

0
977

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০
“এক জীবনের গল্প”
– আর্নিসা ইসলাম রিদ্দি

পাগলের মতো কান্না করে চলেছে আছিয়া।আজ যেন আছিয়ার চোখের জল কিছুতেই বাধা মানছে না। মনে হচ্ছে পৃথিবী থমকে গেছে। বুকের ভেতরে কেউ হয়ত আগুন লাগিয়ে দিয়েছে আর সেই আগুনে জ্বলে- পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। বাবা- মা’কে হারানোর পৃথিবীর সবথেকে কষ্টকর বিষয়,আছিয়ার জন্মের আগেই তার বাবা এক দুর্ঘটনায় মারা গেছে তাই এই কষ্টের সাথে সে পরিচিত ছিল না।আজ আছিয়া তার মাকেও হারিয়ে ফেলেছে।তার মা আজ চলে গেছে না ফেরার দেশে।
আছিয়ার বয়স আর কত? এইতো বারো কিংবা তেরো হবে। এইটুকু বয়সে তার মা-বাবা দুজনকেই হারানোর শোকটা সে ঠিক মেনে নিতে পারছে না। ধীরে ধীরে আছিয়ার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে।কাঁদতে কাঁদতে এক সময় আছিয়া জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

জ্ঞান ফেরার পর সে নিজেকে ঠিক আগের জায়গাতেই আবিষ্কার করল। চারপাশ কেমন জানো স্তব্দ।তার মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে যারা এসেছিল তারা হয়ত সবাই নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেছে।আর তার মা? মায়ের কথা মনে পরতেই আছিয়ার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। আছিয়া ছুটে গিয়ে তার মাকে খুঁজতে শুরু করল কিন্তু কোথাও মাকে খুঁজে না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরের এক কোণে বসে পড়ল।

বাবার আদর স্নেহের সাথে আছিয়া পরিচিত না।ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছেই বড় হয়েছে সে। মাকে ঘিরেই ছিল আছিয়ার পৃথিবী আজ সেই মাও তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।জীবনে এই প্রথমবার আছিয়ার মনে হচ্ছে তার মা তাকে ভালোবাসে না, মা যদি তাকে ভালোবাসত তাহলে এভাবে তাকে না বলে চলে যেত না।

আছিয়ারা দুই ভাই-বোন। আছিয়ার বড় ভাই আজিজ, পড়ালেখায় খুব মেধাবী কিন্তু এসএসসি পাশ করার পর অর্থের অভাবে আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাকে সে রাজমিস্ত্রীর কাজ করে।পরিবারে শত দারিদ্রতা থাকলেও খুব কষ্টে আছিয়াকে পড়াশোনা করাচ্ছিল আছিয়ার মা।এ নিয়ে আজিজের খুব ঝগড়া হতো তার মায়ের সাথে।মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে আজিজের মা তার হাত ধরে বলে গেছে যাতে সে আছিয়াকে পড়াশোনা করায়।

সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না। আছিয়ার মা মারা গেছে আজ তিনমাস হলো।আছিয়া মায়ের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠলেও মাঝে মাঝে মায়ের কথা মনে করে অশ্রুজল বিসর্জন দেয়।

দেখতে দেখতে দেড় বছর পেরিয়ে গেল আছিয়া এখন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আজিজ বিয়ে করে বউ এনেছে ঘরে। মাকে দেয়া কথা রাখতে আছিয়ার পড়াশোনা বন্ধ করেনি আজিজ।সব মিলিয়ে সুখেই আছে তারা। কিন্তু এসবের মাঝে নিত্যনতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আছিয়াকে। স্কুলে যাওয়ার সময় কিছু ছেলে তাকে দেখে অশ্লীল কথা বলে, সিটি বজায়, মাঝে মাঝে আবার তারা আছিয়ার পিছু নেয়। দিনদিন এই বদমাশ ছেলেগুলোর অসভ্যতা বেড়েই চলছে।
এই বিষয় নিয়ে আছিয়া খুব চিন্তায় আছে কাকে বলবে সে তার সমস্যার কথা, কে এই সমস্যার সমাধান দিবে তাকে।তাছাড়া যে ছেলেগুলো আছিয়াকে বিরক্ত করে তারা সমাজের খুব প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তান তাদের কিছু বলার সাহস গ্রামের কারোর নেই।

একদিন আছিয়া স্কুল থেকে ফিরছিল।হঠাৎ সেই অসভ্য ছেলেগুলোর মধ্যে একটা ছেলে এসে আছিয়ার ওড়না টেনে ধরল।আছিয়া কি করবে বুঝতে না পেরে ওড়না ফেলে রেখেই বাড়ির দিকে দৌড় দিল।
বাড়িতে পৌঁছে আছিয়া তার ভাবিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করল। কিছুতেই আছিয়ার কান্না থাকতে চাইছে না। অনেকক্ষন পর আছিয়া শান্ত হয়ে তার ভাবিকে সব খুলে বলল তার ভাবি তাকে ভরসা দিল।

রাতে আজিজ বাসায় ফেরার পর আছিয়ার ভাবি তাকে আছিয়ার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বলল।আজিজ পরের দিন সকালবেলা উঠে এই নিয়ে গ্রাম প্রধানের কাছে বিচার চাইতে গেলে গ্রামপ্রধান আজিজকে বলল,
-বুঝলা আজিজ মিয়া এক হাতে কখনো তালি বাজে না,তোমার বোনের অবশ্যই কোনো দোষ আছে। তাছাড়া আমি বুঝি না মেয়ে মানুষের এত লেখাপড়া করা লাগব কেন?
– আপনি একটু বিষয়টা দেখেন এভাবে তো চলতে দেয়া যায় না!
-হুনো মিয়া এই বিষয় আমার কিছুই করার নাই।

একদিকে সামনে এসএসসি পরীক্ষা অপরদিকে গ্রামের অসভ্য ছেলেদের জ্বালাতন সবকিছু নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে আছিয়া। দিন দিন তাদের অত্যাচার বেড়েই চলেছে। তাই আজিজ সীদ্ধান্ত নিল আছিয়াকে আর পড়াশোনা করাবে না।তার মাকে দেয়া কথা রাখা আজিজের পক্ষে আর সম্ভব না। আছিয়ার আর এসএসসি পরীক্ষা দেয়া হলো না। আছিয়া আজিজের পা ধরে খুব কেঁদেছিল যাতে আজিজ তার পড়াশোনা বন্ধ করে না দেয় কিন্তু এতে তেমন কোনো লাভ হয়নি। আজিজের মতে সে আর ঝুঁকি নিতে পারবে না ওসব ছেলেদের কোনো বিশ্বাস নেই আর একটা মেয়ে কলংকিনী হলে সমাজ আর কখনো সেই মেয়েকে সহজ ভাবে গ্রহণ করে না।

কিছুদিনের মধ্যেই আজিজ আছিয়ার বিয়ে ঠিক করল।ছেলে বয়সে কম হলেও আছিয়ার থেকে ষোল বছরের বড়।বিয়েতে ছেলে পক্ষের চাওয়াও অনেক। তবুও আজিজ সবকিছু মেনে নিয়ে আছিয়ার বিয়ে দিচ্ছে কারণ আছিয়ার সাথে কোনো খারাপ কিছু ঘটলে তার দায় নিতে আজিজ নারাজ। এদিকে আছিয়া নানা উপায় তার ভাবিকে বোঝানোর চেষ্টা করছে তারা যাতে তার বিয়ে না দেয়।
-ভাবি আমারে বিয়া দিয়া দিও না, আমি আরও লেখাপড়া করমু।
-দেখো বোইন এই বিষয় আমার কিছুই বলার নাই তোমার ভাই তোমার জন্য যেটা ভালো মনে করবে সেটাই করবে।
শত চেষ্টা করেও আছিয়া নিজের বিয়েটা আটকাতে পারল না। আজিজ খুব কষ্টে যৌতুকের টাকা জোগাড় করেছে এমন কি বাবা রেখে যাওয়া একমাত্র সম্ভল বাড়িটাও বন্ধক রেখেছে তবুও আজিজ যৌতুকের সম্পূর্ণ টাকা জোগাড় করতে পারিনি কিন্তু আজিজ তাদের ভরসা দিয়েছে সে তাদের সব টাকা শোধ করে দেবে।
এতদিনের চেনা পরিচিত পরিবেশ কাছের মানুষগুলো সবাইকে বিদায় জানিয়ে অচেনা এক মানুষের সাথে জীবন শুরু করল আছিয়া। এইতো জীবন! আছিয়া ভাবল এবার হয়ত জীবন বদলাবে হয়ত সুখের দেখা মিলবে, হয়ত আবার সে পড়াশোনা করতে পারবে। কিন্তু আছিয়ার ভাবনাগুলো নিত্যান্তই ভুল। বিয়ের কয়েকদিন যেতে না যেতেই আছিয়ার উপর অমানবিক অত্যাচার।
আছিয়ার শশুড় বাড়ি খুব প্রভাবশালী।এলাকায় তাদের ভালোই নাম ডাক। এত বড় বাড়ির সব কাজ আছিয়া নিজ হাতে সামলায় তার উপর উঠতে বসতে শাশুড়ীর কথা শুনতে হয়। যৌতুকের টাকার জন্য আছিয়ার স্বামি প্রতিনিয়ত তার গায়ে হাত তোলে। এত অত্যাচার সহ্য হচ্ছিল না আছিয়ার তাই কোনো উপায় না পেয়ে বাপের বাড়ি চলে আসল আছিয়া।
আছিয়ার এ বাড়িতে আসায় তার ভাই-ভাবি সবাই তার উপর অসুখী। আসার পর থেকে কেউ আছিয়ার সাথে ভালো করে কথাও বলেনি।
-ভাবি আমার লগে কতা কবা না? বুঝছি আমি যে ঐ বাড়ি থে চইলা আইছি তাই আমার উপর রাগ কইরা আছো।
-দেখো তুমি তো জানো তোমার ভাই যা আয় করে তাতে আমাগোই খাইয়া-পইরা থাকতে কষ্ট হয় তার উপর তোমারে বিয়া দিতে গিয়া তোমার ভাই নিঃস্ব হইয়া গেছে।এবার আমাগো একটু মুক্তি দাও, আমরা শান্তি চাই।
-আমি এমনি এমনি ঐ বাড়ি থে চইলা আহি নায়, জানো ভাবি ওরা আমারে খুব মারে, সারাদিন কত কাম করি তবুও আমারে ঠিক মতো খাইতে দেয় না আমি সব সহ্য করছি ভাবি কিন্তু ওরা আমার মরা বাপ মা নিয়া গালি দেয় এইডা আমার সহ্য হয় না। তবুও তোমরা যদি চাও আমি চইলা যামু এহানে আর থাকুম না।
আছিয়া আবার তার শশুড় বাড়ি ফিরে গেল। সহ্য অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে শুরু করল।আছিয়া খেয়াল করেছে সে যদি প্রতিবাদ করে তবে তার উপর অত্যাচার আরও বেড়ে যায়।তাই সে কোনো প্রতিবাদ করে না।
আছিয়া মা হতে চলেছে এই খবর শোনার পর আছিয়ার শাশুড়ী আছিয়াকে বলে দিয়েছে তাদের ছেলে চাই। আছিয়া ভেবে পায় না ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে এই বিষয় তো আর তার হাতে নেই।তাহলে তাকে কেন সবাই এই কথা বলছে। ইদানীং আছিয়ার উপর তার স্বামী কিংবা শাশুড়ি তেমন কোনো অত্যাচার করে না তবুও এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বাড়ির সব কাজ আছিয়াকেই করতে হয়।

পাগলের মতো কাঁদছে আজিজ,তার বাবার মৃত্যুও আজিজ এতটা কাঁদেনি।আছিয়ার ভাবি অজ্ঞান হয়ে এক পাশে পরে আছে। সারা বাড়ি জুড়ে বিরাজমান এক স্তব্দতা ভেঙে শুধু এক শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আছিয়ার মেয়ে হয়েছে সেই সাথে আছিয়াও চলে গেছে তার মা-বাবার কাছে। ডাক্তারের মতো বাচ্চা জন্ম দেয়ার মতো উপযুক্ত বয়স আছিয়ার হয়নি মাত্র ষোলো বছরের একটা মেয়ের পক্ষে এত কিছু সহ্য করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি তাই…….

হারিয়ে গেল আছিয়া হাজার দুঃখ কষ্ট সহ্য করে অবশেষে পারি জমালো না ফেরার দেশে। আছিয়ার স্বামী আবার বিয়ে করেছে নতুন বউ নিয়ে সে সুখেই আছে।আছিয়ার শুশুড় বাড়ির লোকজন আছিয়ার মেয়েকে গ্রহণ করতে নারাজ তাই আছিয়ার সন্তান এখন বড় হচ্ছে আছিয়ার ভাবীর কাছে।আছিয়ার মৃত্যুর পর আজিজ জানো কেমন হয়ে গেছে। এখন আজিজ সময় পেলেই আছিয়ার মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে থাকে আর আপনমনে বিড়বিড় করে।আজিজের মতে আছিয়ার মৃত্যুর জন্য সে নিজে দায়ী। সে ভুল করেছিল এত কম বয়সে আছিয়াকে বিয়ে দিয়ে। কিন্তু কিছু ভুলের সংশোধন করার সুযোগ জীবন মানুষকে দেয় না আর সেই ভুলের মাশুল সারা জীবন ধরে দিতে হয়। আজিজও হয়ত প্রতিনিয়ত সেই ভুলের মাশুল দিয়ে চলেছে ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে