একাকী বিকেল পর্ব-০১

0
1856

#একাকী_বিকেল
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১

কাজিনের বিয়েতে গিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে বর’বেশে দেখতে পাবো তা কখনোই ভাবিনি আমি। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক ওর সামনেই, হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে। ওকে বরের সাজে দেখে আমার পুরো পৃথিবীটা থমকে গিয়েছিলো যেন। তৌহিদকে দেখে আমি যতটা না অবাক হয়েছি, তার থেকে বেশি অবাক বোধহয় ও হয়েছে। আমাকে দেখে ওর চেহারায় একটা চোরা ভাব ফুটে ওঠলো। আমার চোখ তখন জলে টলমল করছিলো, কিন্তু নিজেকে যথাসম্ভব সামলানোর চেষ্টা করছিলাম। তৌহিদ নিজের চেহারার অস্বস্তি ভাবটা গোপন করার ব্যর্থ চেষ্টা করে আমার বাড়িয়ে দেওয়া শরবতের গ্লাসটি নিলো। আমি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী দুলাভাই? ভালো আছেন তো?’

আচমকা এমন একটা প্রশ্ন করায় তৌহিদ চমকে গেলো। ‘দুলাভাই’ ডাকটা হয়তো সে আশা করেনি আমার কাছ থেকে। শরবতের গ্লাসটাতে মাত্র চুমুক বসিয়েছিলো৷ এই প্রশ্ন শুনে ওর কাশি উঠে গেল। আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, ‘সাবধানে কাজ করবেন না? এতো কেয়ারলেস হলে সবকিছুতে আটকে আটকে যাবেন।’

তৌহিদের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বলল, ‘মানে?’

আমি হেসে বললাম, ‘বিয়ে করতে এসেছেন, এতো ঘাবড়াচ্ছেন কেন?’

‘ক কই ঘাবড়াচ্ছি না ত তো…’

‘তাহলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না যে?’

তৌহিদ থমথমে গলায় বলল, ‘ক কোন প্রশ্ন?’

‘আপনি ভালো আছেন কি-না?’

আশেপাশে আমার অন্যান্য কাজিনরা বরকে ঘিরে বসে ছিলো। ওরাও অধীর আগ্রহে বসে আছে বর কী বলে তা শোনার জন্য। তৌহিদ কোনোমতে উত্তর দিল, ‘ভালো আছি।’

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ‘সুন্দরী বউ বিয়ে করছেন বলে কথা, ভালো তো থাকতেই হবে। তবে আপনি আমার পরিচয় জানেন কী, আমি কনেপক্ষের লোক?’

তৌহিদ ঢোক গিলে বলল, ‘হ্যাঁ, তা বুঝতে পেরেছি।’

আমি মাথা ঝুঁকিয়ে একটু নিচু হয়ে কানে কানে বললাম, ‘মিস্টার তৌহিদ! এখন যদি আপনার আসল চেহারাটা সবার সামনে তুলে ধরি, তখন কী করবেন?’

তৌহিদ ফ্যাকাসে মুখে তাকালো। মিনমিন করে বলল, ‘তুমি এখানে কেন? আর কী হও মিথিলার?’

‘আমি মিথিলা আপুর কাজিন। দূরের নয়, বেশ কাছের। ঘরের মানুষ বলতে পারেন।’

তৌহিদ বিস্মিত হয়ে বলল, ‘যেমন?’

‘ও আমার বড়চাচার মেয়ে। আপনি আমার সাথে প্রতারণা করেছেন, আমি সবাইকে সবটা জানিয়ে দিলে আপনার ভালোমানুষি ব্যবহারটা থাকবে তো মিস্টার তৌহিদ?’

কথাটা বলে আমি সেখান থেকে সরে এলাম। পেছনে ফিরে দেখি তৌহিদ শেরওয়ানির পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছছে, খুব নার্ভাস দেখাচ্ছে। ওর পরণে খয়েরি রঙের শেরওয়ানি। ফর্সা চামড়ায় মানিয়েছে ভালো। তবে ওর বাহ্যিক গড়ন যতটাই চমৎকার, ততোটাই কুৎসিত ওর ভেতরটা। আর এই কথাটা আজ বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। আমার ভেতরটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে, তবুও মুখে কৃত্রিম হাসি বজায় রাখলাম। এই বিশ্বাসঘাতকটার জন্য একফোঁটা চোখের জল ফেলতেও রাজি নই আমি। কিন্তু মন মানতে চাইছে না। তৌহিদের সাথে দীর্ঘ চার বছরের সম্পর্ক আমার। কলেজের ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানে আমাকে দেখে নাকি ওর ভালো লেগে যায়। তারপর থেকেই আমাকে বিরক্ত করা শুরু করে। ও নিজেই প্রপোজ করেছিল আমাকে। প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে ওর পাগলামির কাছে হার মানতে বাধ্য হলাম। রাজি হয়ে গেলাম একসময়। আমার ইচ্ছে ছিলো অনার্স শেষ করে বাসায় ওর কথা জানাবো, কিন্তু তার আগেই ও সব শেষ করে দিলো, ঠকালো আমায়। অবশ্য সম্পর্কের প্রথমদিকে তৌহিদ আমার খুব কেয়ার করতো। কিন্তু আজ প্রায় দুই মাস ধরে ওর মাঝে পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলাম আমি। ফোন দিলে কথা বলতো না, দেখা করতে চাইতো না, এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতো। এমনকি আজ সকালেও ফোনে আমাকে বলেছে ওর শরীর নাকি খুব অসুস্থ। ভাবলাম সারাদিন অফিসে খাটাখাটুনি করে তাই হয়তো অসুস্থ। কিন্তু ও যে আমাকে এভাবে ঠকাবে তা ঘূর্ণাক্ষরেও কল্পনা করি নি আমি।

তবে তৌহিদের সত্যিটা চাইলেও কাউকে বলতে পারবো না আমি। কারণ মিথিলা আপু এই বিয়েটা নিয়ে খুব এক্সাইটেড। আপুর বয়স ঊনত্রিশ। বড়চাচার বেশ টাকাপয়সা আছে, মিথিলা আপুও সুন্দরী। তবুও মেয়ের বয়স বেশি বলে আপুর প্রায় অনেকগুলো বিয়ে ভেঙেছে। তা নিয়ে ইদানীংকালে বড়চাচা বেশ চিন্তিত ছিলেন। যদিও ঊনত্রিশ বছর বয়সটা মোটেও বেশি নয়। তবে আমাদের সমাজে এ বয়সটাকে একটু বেশি বলেই ধরা হয়। বেশ কয়েকদিন যাবৎ মিথিলা আপুও বিয়ের চিন্তায় ডিপ্রেশড হয়ে পড়েছিলো। আর পাড়া-পড়শীর মুখ থেকে সমালোচনা যেন সরছিলোই না। বড় চাচা তো চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন। তার মধ্যে ডিফেন্সে চাকুরী করা একটা ছেলে মিথিলা আপুকে বিয়ে কর‍তে রাজি হয়েছে তা শুনে আমরা খুব খুশিই হয়েছিলাম। তবে বিয়েতে বরপক্ষকে মোটা অঙ্কের টাকা, খাট, আলমিরা, সোফাসেটসহ ঘর সাজানোর সামগ্রী উপহার দেওয়া হয়েছে। আর এই সমস্ত ঘটনাটা ফোনে জেনেছিলাম মাহাদ ভাইয়ার কাছ থেকে৷ এই লোভেই হয়তো তৌহিদ আমাকে ছেড়ে আপুকে বেছে নিয়েছে। কারণ আমি বলেছিলাম আমাদের বিয়েতে এসব যৌতুক দেওয়া-নেওয়া হবে না। আমি এই প্রথাটাকে ভীষণ ঘৃণা করি।

বড়চাচার কথা মাথায় রেখে বিয়ে বাড়ির আনন্দদায়ক মুহূর্তটাকে নষ্ট করতে চাই না বলেই সবার কাছে তৌহিদের সত্যটা লুকিয়ে গেলাম৷ জানি না কতোটা ঠিক করেছি। তবে এ মুহূর্তে ঠিক-ভুলের বিচারে আমি গেলাম না। ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে হাউমাউ করে কাঁদলাম। আমার সাথে এই জঘন্য কাজটা না করলে কি চলতো না তৌহিদের? সে একটাবার বলতে তো পারতো আমাকে আর চায় না। কিন্তু দিনের পর দিন মিথ্যে আশা দিয়ে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে আমায়। কতশত স্বপ্ন দেখিয়েছে, এমনকি আজ সকালেও আমি জানতাম না তৌহিদ আমাকে ঠকিয়ে বিয়ের পিড়িতে বসতে যাচ্ছে৷ আহ, কী বোকা, নির্বোধ আমি!

অনেকক্ষণ পর ঘরের বাইরে থেকে মায়ের ডাক শুনতে পেলাম। দরজা খুলতে বলছেন আমাকে। ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও চোখমুখ মুছে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। মা আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘বিয়ে খেতে এসে দরজা আটকে বসে আছিস কেন? কী হয়েছে?’

আমি বললাম, ‘কই কিছু না। শাড়ির পিনটা খুলে গিয়েছিল তাই।’

মা ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললেন, ‘ওহ। তাড়াতাড়ি বাইরে আয়, মিথিলা তোকে খুঁজছে। কাজি চলে এসেছে, এবার বিয়ে পড়ানো হবে।’

মায়ের কথায় আমি খুব বেশি অবাক হলাম না। কিন্তু মনের ভেতরটায় কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো। ইচ্ছে করছিলো সবাইকে গিয়ে বলি তৌহিদ শুধু আমার। কিন্তু ওর প্রতারণার কথা মনে হতেই ঘৃণা হলো আমার। ছিঃ, তৌহিদ আমার চাচাতো বোনের হবু স্বামী। তাকে নিয়ে এসব কী ভেবে চলেছি আমি! আমি হাসিমুখে বিয়ে এ্যাটেন্ড করবো। দেখি, তৌহিদ কীভাবে আমার সামনে চোখ তুলে তাকায়। জানি, আর কোনোদিনও সে আমার চোখের দিকে তাকাতে পারবে না। আমাকে শক্ত থাকতে হবে। তারপর নাক টেনে মায়ের সঙ্গে গেলাম শামিয়ানা টাঙানো বিয়ের আসরে। বর-কনে’কে একসাথে বসানো হয়েছে। মাঝখানে পাতলা পর্দা দিয়ে আড়াল করা হয়েছে দুজন-কে৷ মিথিলা আপুকে কনের সাজে অপূর্ব লাগছিলো, তাঁর মুখে সুখের হাসি। অথচ তৌহিদের পাশের সেই জায়গাটা আমার ছিলো। তৌহিদ আমাকে দেখে অস্বস্তি নিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো, হয়তো ভাবছে আমি সবাইকে সব জানিয়ে দিয়েছি। আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। গিয়ে দাঁড়ালাম মিথিলা আপুর পাশে। কাজি বিয়ে পড়াচ্ছেন। প্রচুর হৈ-হল্লা হচ্ছিলো। সবাই খুব খুশি, আনন্দ ঠিকরে পড়ছিলো বড় চাচার চেহারায়। শুধু আমি ঠকে যাওয়া মন নিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য কারোর হয়ে যেতে দেখলাম। তখন কিছুই করার ছিল না আমার। কখনো ভাবি নি আমার সাথে এমন হবে, এমনভাবে ঠকে যাবো আমি! বিয়ের কার্যক্রম শেষ হতেই আমি দৌড়ে চলে গেলাম ছাদে। মরে যেতে ইচ্ছা করছে কেন জানি না। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিলো!

[চলবে…ইনশাআল্লাহ!]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে