একরাশ দুঃখ

0
650

মজিদের বসার ঘরে জনা পঞ্চাশেক লোক বসা; সবাই তাকে দেখে দাড়িয়ে যায়; আগে ব্যাপারটা মজিদ খুব উপভোগ করতো; এখন বিশেষ কিছু মনে হয় না; বরং মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে। মজিদ জানে এরা কেউই তাকে মন থেকে ভালোবাসে না; ঘর থেকে বের হয়েই গালি দেয়; দুনিয়াটা শক্তের ভক্ত নরমের যম। মজিদ শক্ত মানুষ। রাজনীতিতে বরাবর সফল; সফলতার জন্য মজিদ পারে না এমন কিছুই নেই; লোকে তাকে পিশাচ মজিদ বলেই ডাকে; মজিদের ভালো লাগে; মানুষ ভয় না পেলে তার আজকের এই অবস্থান থাকতো না; এখন কিছুই করতে হয় না; তার নামেই কাজ হয়;

মজিদের পি এস শামীম বলে;

ভাই শিকদার মিয়ার ভাইরে গতকাল ফারুকরা মারছে; বাজার থেকে বাড়ি ফেরার সময়; সাথে আরেকটা ছেলে ছিল সে দৌড় দিয়া পালাইছে;

মজিদ গাল দিয়া উঠে; কিরে ফারুক দুইজন ছিল একজন পালাইলো কেমনে? তোর চর্বি হয়ে গেছে; দত্তপাড়াতে আমার নতুন লোক নিতে হবে; তোরে দিয়া হবে না;

ভাই এইটা আপনি কি কইলেন; এই ফারুক আপনারে যেই পরিমান ভালোবাসে নিজের বাপ মারেও এতো ভালোবাসে না; ভাই ঐ শালা জন্মের কাইল্লা; অন্ধকারে দেখা যায় না। শালা যে শিকদার মিয়ার ভাইয়ের সাথে ছিলো এইটাইতো আমরা প্রথমে বুঝতে পারি নাই। দৌড় দেয়ার পর বুঝতে পারছি। কিন্তু ভাই ও পালাইয়া ভালো হইছে; পুরা এলাকায় খবর হয়ে গেছে। মানুষ ভয়ে ঘর থেকে বাহির হচ্ছে না;

আরেকজন বলে ভাই শিকদার মিয়ার ভাইরে মাইরা কি হবে। আপনি আদেশ দেন শিকদার মিয়ারেই মারি;

মজিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; তার চাটুকারের অভাব নাই; একেকজন একেকজন থেকে উপরে; সবাই নিজেকে জাহির করতে চায়; মজিদ পোড় খাওয়া মানুষ; জানে ক্ষমতা জোয়ার ভাটার মতো; যখন আসতে থাকে আসতেই থাকে কিন্তু যখন যায় তখন সব কিছু নিয়ে যায়; কিন্তু কিছু করার নাই; জীবন মানেই খেলা;

হুম। শিকদাররেও মারতে হবে; এই অঞ্চলে শুধু আমি থাকবো; পিশাচ মজিদ;

এই সময় ভেতর থেকে খবর আসে

ভাই ভাবী আপনারে ডাকে;

মজিদ খুব বিরক্ত হয়; তার বউ ছিঁচকাঁদুনে টাইপের; কেউ তারে গিয়ে কোন অনুরোধ করলেই সে অস্থির হয়ে উঠে; যখন তখন মজিদকে ডাকে। মজিদ গালমন্দ করে তাতেও রেহানার আক্কেল হয় না; সেদিন মজিদকে বলে

শুনো শিকদার ভাইয়ের ভাতিজিরে কারা যেনো উঠাই নিয়ে গেছে; শিকদার ভাইয়ের ভাবী আসছে; তুমি লোক পাঠাও; সেই মেয়ের যেন বিন্দুমাত্র ক্ষতি না হয়; ভাবী অনেক কাদতেছে; আমার সহ্য হচ্ছে না;

মজিদ মনে মনে গালি দেয়। বউয়ের এই সকল ঢঙের কথা শুনলে গা জ্বলে। মজিদের সবচাইতে খাস চামচা কাল্লু শিকদারের ভাতিজিরে পছন্দ করে। মজিদের অনুমুতি নিয়েই তুলে নিয়ে আসছে;

এইসব ব্যাপারে তুমি মাথা ঘামাবা না রেহানা; কে কারে তুলে নিয়ে গেছে আমি কি করবো?

আমানের বাপ; আমানের কসম লাগে; ঐ মেয়ের যেন কিছু না হয়; তুমি কি ভাবছো আমি জানি না; আমি পিশাচ মজিদের বউ; তোমারে আমি পুরা না চিনলেও কিছুটা হলেও চিনি; এই অঞ্চলে তোমার হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না;

মজিদের অন্তর নরম হয়ে যায়। মজিদের দুর্বলতা তার ছেলে; বিয়ের আট বচ্ছর পর তাদের ছেলে হয়। তখন সবাই বলতো মজিদ তুই জীবনে সব কিছু পাইলি কিন্তু বাপ ডাক শুনতে পারলি না। মজিদ তাদের গালমন্দ করতো; শালা বাপ ডাক শুনার মধ্যে এমন কি আছে; আমি আমার বাপরে এমন কি করে উল্টাই ফেলছি; সন্তান, সন্ততি মায়া ছাড়া কিছু না; তার জন্য এতো উতলা হওয়ার মানে নাই;

সেই মজিদের ঘরে যখন ফুটফুটে ছেলে হয় তখন মজিদ প্রথম বুঝতে পারে বাপ হওয়ার মর্মটা কি। মজিদ তার ছেলের প্রস্রাব, পায়খানা নিজের হাতে পরিষ্কার করতো; বাসায় এসে বাচ্চারে কোলে না নিয়ে, খেলাধূলা না করে মজিদ রাতের খাবার খেতো না; একবার বাচ্চা অসুস্থ হয়; ডাক্তার বলে এটা কোন ব্যাপার না; মজিদ সেই ডাক্তারকে মারধর পর্যন্ত করেছে;

মজিদ তার ছেলেকে অস্ট্রেলিয়া পাঠাচ্ছে পড়াশুনার জন্য। মজিদ জানে তার জন্য বেশ কষ্টকর হবে। এখনো প্রতিরাতে ছেলের মুখ না দেখে মজিদ রাতের খাবার খায় না।

ছেলে বলে

বাবা আমি এখন অনেক বড় হয়েছি না?

মজিদ হাসে; ছেলের থেকে ভালোবাসা লুকাতে চেষ্টা করে;

সবাই জানে পিশাচ মজিদের একটাই দুর্বলতা; তার ছেলে;

ভাই ভাবী ডাকতেছে; খুব জরুরী দরকার; আমানকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না;

মজিদের বুক কেপে উঠে; পাওয়া যাচ্ছে না মানে কি? মজিদ চেয়ার ছেড়ে উঠে ভেতরের দিকে ছুটে; ছেলের মোবাইলে ফোন দিতে থাকে; ফোন সুইচ অফ;

ও কই গেছে? তুমি কোন খবর রাখো না; মজিদ চিল্লিয়ে উঠে; খালেদ কই? খালেদ ওর সাথে ছিলো না?

ও খালেদকে নিয়ে রেলস্টেশনের দিকে গিয়েছিল; খালেদ গিয়েছিল টয়লেট করার জন্য; এসে আমানকে পাচ্ছে না;

মজিদের মাথায় রক্ত চড়ে গেছে;

শামীম এই ঘটনার সাথে শিকদার জড়িত; ও আমার ছেলেরে তুলে নিয়ে গেছে; তুই ওসিরে এখনি জানা; শিকদার, ওর বউ, ওর ছেলে মেয়ে সবাইরে যেনো লকআপে ঢুকায়;

ভাই আমরা তুলে নিয়ে আসি?

আমি আমার ছেলেরে ফেরত চাই শামীম; তুই পুলিশ নিয়ে ওর বাড়ি তল্লাশি চালা; ওদের তুলে নিয়ে আয়;

মজিদ গাড়ি নিয়ে রেলস্টেশনে যায়; তার সাথে শ খানেক লোক; চারপাশে খবর রটে গেছে; মজিদের ছেলেকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না; রেহানা মাতম তুলছে; মজিদের বুক ফেটে কান্না আসছে; তার ছেলে। মজিদের মনে পরে ষোল বচ্ছর আগের কথা সেই ছোট ছোট দুই খানা হাত; মজিদ যখন সেই ছোট হাতগুলো ধরতো তার ছেলে হাতগুলো আঁকড়ে ধরতো; আর ছাড়তো না;

মজিদ ঢুকরে উঠে

বাবা তুই আজ কোথায়? মজিদের কাছে তার ছেলে বড় হয়নি; এখনি সেই ছোট দুইহাত মজিদের চোখে ভাসছে;

মজিদ থানায় যায়; ওসি থানায় চলে আসছে; ওসির শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত ছিলো; সেই দাওয়াত থেকে উঠে আসতে হয়েছে; ওসির মেজাজ খারাপ। শ্বশুর বাড়িতে চিতল মাছের কোপ্তা রান্না হয়েছিল; সাথে টার্কিশ মুরগী নতুন আইটেম; সরিষা ইলিশ। সেই খাবার রেখে তড়িঘড়ি করে আসতে হয়েছে; মজিদ মিয়ার ছেলেকে পাওয়া না গেলে ওসির ট্র্যান্সফার নিশ্চিত টেকনাফে। মজিদ খুব প্রভাবশালী;

মজিদ থানায় শিকদারের সামনে বসে;

শিকদার আমার ছেলে কই?

মজিদ তোমার ছেলে কই আমি জানি না; আমি পিশাচ মজিদ না; কারো ছেলে, কারো মেয়ে, কারো বউরে তুলে আনার মতো লোক আমি না;

কথা কম ক শিকদার; যা জিজ্ঞেস করছি শুধু তার উত্তর দে; তুইতো জানোস তোর বড় ভাইরে আমি কি করছি।

জানি মজিদ; তুমিতো মানুষ না। মানুষরুপী পিশাচ; আমার বড় ভাইরে প্রানে মেরে ফেলেছো। তার ছোট ছোট দুইটা ছেলে; আজও দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে বাবার অপেক্ষায়; ভাবে বাবা কোনদিন তাদের জন্য চকলেট নিয়ে আসবে;

শিকদার; তোর ছেলে মেয়েরাও দরজার দিকে তাকিয়ে থাকবে তোর জন্য;

মজিদ আমার ভয় মরে গেছে। ভয় পেতে পেতে এখন আর ভয় পাই না; প্রতিদিনই আমাদের কাউকে না কাউকে তোমার লোক মারধোর করছে; তুলে নিয়ে যাচ্ছে; সয়ে গেছে মজিদ;

শিকদার তুই বলবি না; আমার ছেলে কই?

সত্যি আমি জানি না মজিদ; জানলেও বলতাম কিনা তাও জানি না। পিশাচ মজিদ অত্যাচার করতে করতে ভুলে গেছে প্রকৃতি কোন কিছু ছেড়ে দেয় না; তুমি আজ যা করবা একদিন তা ফেরত পাবা;

মজিদ চেয়ার থেকে উঠে চেয়ার ছুড়ে ফেলে দেয়;

ঐ ওসির বাচ্চা আমার ছেলেরে আমি ফেরত চাই; শিকদাররে আজ সারারাত মারবি; ওর বউ, ছেলে, মেয়ে কেউ যেন বাদ না যায়;

মজিদ তার বাহিনীর দিকে ঘুরে

ঐ সব শালার ব্যাটা আমার ছেলেরে খুইজা আন; আমার ছেলেরে ছাড়া আমি বাচুম না; আমার একটা ছেলে, একটা কলিজার ধন;

রাত চলে যায়; মজিদ উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকে; কিন্তু কোথাও আমানের কোন খোঁজ নাই; মনে হচ্ছে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে; ফজরের আজান হচ্ছে; মজিদ থানায় ফোন করে ওসিকে সবাইকে ছেড়ে দিতে বলে;

মজিদ তার ছেলের রুমে বসে ঢুকরে ঢুকরে কাঁদতে থাকে;

বারবার তার চোখে ভেসে আসছে সেই ছোট দুইখানা হাত; মজিদ যখন ধরতো; ঠিক প্রতিবার আঁকড়ে ধরতো; কি পরম নির্ভরতা্য়; জানতো এই সেই হাত যা সবসময় তাকে আগলে রাখবে;

ওরে মানুষ
দুই দিনের দুনিয়া
কেন করিস বড়াই
কিসের এতো লড়াই
কেন বাড়াস পাপ
পাপ ছাড়ে না বাপ
জন্ম থেকে মৃত্যু
ছড়িয়ে দে ভালোবাসা
হৃদয় গভীরে থাকবি
এই হউক আশা;

বাইরে তখন ফিসফিস হচ্ছে; একটা লাশ পাওয়া গিয়েছে রেললাইনে; একজন প্রত্যক্ষদর্শীও পাওয়া গেছে; আমান ফোনে কথা বলতে বলতে রেল লাইনের উপর দিয়ে হাঁটছিলো ট্রেন আসছিলো সে টের পায়নি;

একদিন এই পৃথিবীতে মানুষ পাপের কথা চিন্তা করবে; সকল হানাহানি বন্ধ হবে; ভালোবাসায় এবং শান্তিতে থাকবে সকল মানুষ; পৃথিবীতে বইবে লিলুয়া বাতাস;

#আমিনুলের_গল্প_সমগ্র

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে