একটু ভালোবাসা পর্ব-০৩

0
1327

#একটু_ভালোবাসা
#পর্ব_৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________

আমিনের চারপাশটা ঘুরছে। মাথা চক্কর দিচ্ছে। চোখের সামনে সবকিছুই ঝাপসা লাগছে আর একটা জিনিসকে দুটো করে দেখছে। এই তো ওর সামনে চারটে মানুষ দাঁড়িয়ে। মাথা ঝাঁকি দিলে আবার দুজন দেখা যাচ্ছে। কী অদ্ভুত! নেশাটা বোধ হয় বেশিই হয়ে গেছে। প্রিয়ু বুঝতে পারে আমিনের নেশা বেশি হয়ে গেছে। বিয়ে বাড়িতে এসেও নেশা ছাড়া থাকতে পারে না। দুচোখেও সহ্য হয় না। কিন্তু উপায় নেই। এখন তো প্রিয়ুকেই সাহায্য করতে হবে। প্রিয়ু রিশাদকে পাশ কাটিয়ে আমিনের কাছে যায়। আমিন মাতলামি করে বলে,
“আচ্ছা এইখানে কয়টা মানুষ?”
প্রিয়ু কিছু বলে না। নিচে কীভাবে নিয়ে যাবে আর মানুষজনই বা কী ভাববে সেটাই ভাবছে প্রিয়ু। রিশাদ নিজেকে সামলে নিয়ে ওদের কাছে এগিয়ে যায়। প্রিয়ুর দিকে তাকিয়ে বলে,
“এটাই আপনার ভাই?”
“সৎ ভাই!”
“ঐ হলো। দেখে তো মনে হচ্ছে নেশা করেছে।”
“হুম।”
“এখন তো নিচে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনি চাইলে সাহায্য করতে পারি।”
“কী সাহায্য?”
“উনাকে চিলেকোঠার ঘরে রেখে আসতে পারি। যাওয়ার সময় না হয় নিয়ে যাবেন।”
প্রিয়ু কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
“হুম! সেটাই ভালো।”

রিশাদ এবং প্রিয়ু দুজনে মিলে আমিনকে ধরে চিলেকোঠার রুমে রেখে নিচে নামে। দুজনকে একসাথে নামতে দেখে অনিক। প্রিয়ু কনের কাছে চলে যায়। ওখানে আশা আর মিনাও ছিল। অনিক রিশাদের কাছে এসে বলে,
“ঘটনা কী?”
“কীসের ঘটনা?”
“দুজনে একসাথে ছাদ থেকে নামলি যে?”
“একসাথে নামলাম নাকি?”
“হ্যাঁ, তাই তো দেখলাম। তুই আর প্রিয়ু একসাথে নামলি।”
“তাহলে হতে পারে।”
“আচ্ছা বাদ দে। একটা কথা আছে।”
“বলে ফেল।”
“মুহিতের ছোট শালীকাকে দেখেছিস? কী সুন্দর! একদম পরী।”
“তোর এই ভালো লাগার বাতিক কবে যাবে?”
“এমন করিস কেন? তুই একটু মুহিতকে বলবি? যেন আমাদের লাইনটা করিয়ে দেয়।”
“তোর ভাই তুই গিয়ে বল। তাছাড়া কাল না প্রিয়ুর কথা বললি?”
অনিক মন খারাপ করে বলে,
“প্রিয়ু আমায় পাত্তা দেয় না। আমার কথা না শুনেই তোর কাছে ফুড়ুৎ করে চলে গেল।”
“আমার কাছে কেন যাবে আজব! ছাদে গেছিল। আর তোর কোনো লাইন টাইন সেট করার মধ্যে আমি নাই।”

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলে বরযাত্রীরা বউ নিয়ে বাড়িতে ফেরে। আশা আর প্রিয়ু আলাদা সিএনজিতে করে আমিনকে নিয়ে যায়। বাড়ি থেকে গাড়ি পর্যন্ত আমিনকে আনতে সাহায্য করে রিশাদ আর অনিক। পরেরদিন বৌভাতের অনুষ্ঠানে রিশাদের সাথে শেষ দেখা হয় প্রিয়ুর। সেদিন রাতেই রিশাদ আর অনিক নিজেদের বাড়ি চলে যায়। মিনাদের বাড়ি থেকে আশা আর প্রিয়ু দুপুরে খেয়েই চলে আসে। বিকেলে মনসুর আলী আর আলেয়া বেগম আজ বাড়িতে ফিরবেন। তাদের জন্য রান্নাবান্না করতে হবে। দু’বোন মিলে রান্নাবান্নার সব জোগার করে। আশা রান্না করে আর আগুনের পাশে বসে থাকে প্রিয়ু। মুহিতের বিয়ের গল্প করছে দুজন। প্রিয়ু বলে,
“আপু তোমার বিয়ে হয়ে গেলে তখন আমি কীভাবে থাকব? যদি দুলাভাইর মতো তোমার স্বামীও আমার সাথে কথা বলতে না দেয়?”
“ওমন ছেলেকে বিয়েই করব না আমি।”
“তুমি জানবে কী করে কে কেমন?”
“সময় হোক তো আগে! আমি তো চাই আমার আগে তোর বিয়ে হোক।”
“যাহ্! কী বলো! বড় বোনের আগে ছোট বোনের বিয়ে হয় নাকি?”
“হয় তো! আর না হলে আমার সাথে তোকে নিয়ে যাব।”

প্রিয়ু হাসে। কারণ প্রিয়ু জানে জীবন এত সহজ নয়। এখন যত সুন্দর করে কল্পনায় সব সাজানো হচ্ছে বিয়ে হলে সব পাল্টে যাবে। কল্পনাগুলো ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। কিন্তু আশা আপু সুখী হোক। খুব সুখী। ভালো মানুষের সুখী হওয়ার অধিকার আছে। শুধু কষ্ট একটাই। আমার বড় আপা সুখে নেই!
.
.
পরেরদিন আশা আর প্রিয়ু একসাথে ভার্সিটিতে যায়। বাজারে গেলেই ফার্মেসীর এক ছেলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে। আশার ধারণা ছেলেটা প্রিয়ুর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু প্রিয়ু লক্ষ করে দেখেছে তার দৃষ্টি আশার দিকে নিবদ্ধ। খারাপ দৃষ্টি নয়। ঐ দৃষ্টিতে আশা আপুর জন্য অনেক ভালোবাসা রয়েছে। কিন্তু আশা আপু দেখেও যেন দেখেনা! তার একটা কারণ অবশ্য আছে। এটা একান্তই প্রিয়ুর ধারণা। ছেলেটা ওদের থেকে অনেক বড়লোক। দেখতেও মাশআল্লাহ্। আর আশাদের অবস্থা এত ভালো নয়। তারমধ্যে মায়ের দুই বিয়ে। এমন পরিবারের মেয়েকে এত বড় পরিবার মেনে নেবে না। ভার্সিটির ক্লাশ শেষ হলে আশা বাড়িতে চলে যায়। প্রিয়ু যায় টিউশনি করতে। আশার পড়ার খরচ আব্বা দিলেও প্রিয়ুর পড়ার খরচ দেয় না। এর কারণ অবশ্য আলেয়া বেগম। সংসারের সবকিছু তো তার কথামতোই চলে।
টিউশনিতে যাওয়ার সময় দেখা হয়ে যায় অরণ্য ভাইয়ার সাথে। প্রায় দু’মাস পর তো হবেই। কোথায় যে উধাও হয়ে যায়! প্রিয়ুকে দেখে অরণ্য এগিয়ে এসে বলে,
“আরে টুনটুনি, কেমন আছিস?”
প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করে প্রিয়ু।
“এতদিন কোথায় ছিলে?”
“ছিলাম এক কাজে। কোথায় যাচ্ছিস?”
“টিউশনি করাতে।”
“এই রোদে পুড়ে?”
“আগুনে পুড়লেও যে সহ্য করতে পারে তার কাছে রোদ তো কিছুই না।”

উত্তরে অরণ্য কিছু বলে না। চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শুধু। বলে,
“আচ্ছা তাহলে যা। আমি এখানেই আছি। তুই ফিরলে একসাথে বাড়ি যাব।”
“আমার ফিরতে সন্ধ্যা হবে।”
“সমস্যা নেই। যা।”
প্রিয়ু টিউশনি করতে চলে যায়। মোট চারটা টিউশনি করায় প্রিয়ু। যা টাকা আসে তাতে মোটামুটি পড়াশোনার খরচ তো চলে যায়। শুধু এক্সামের সময়ই ঝামেলায় পড়তে হয়। আর তখন ঝামেলার মুশকিল আহসান হয়ে আসে মিনার আব্বা আর অরণ্য ভাইয়া। কলেজে ভর্তি হওয়ার টাকা দিয়েছিল মিনার আব্বা। এরপর বইখাতা এগুলো সব কিনে দিয়েছে অরণ্য ভাইয়া। উনাদের সহযোগিতার জন্যই হয়তো এতদূর আসতে পেরেছে। না হলে যাদের সাথে রক্তের কোনো সম্পর্কই নেই তারা এত সাহায্য করে? অথচ যার সাথে রক্তের সম্পর্ক সেই আব্বা-ই প্রিয়ুর প্রতি দায়িত্বহীন। এসব এখন আর গায়ে লাগে না। অভ্যেস হয়ে গেছে তো।
.
টিউশনি সব শেষ করতে করতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায়। ভার্সিটির সামনে চায়ের দোকানে অরণ্য ভাইয়াকে দেখতে পায়। সিগারেট খাচ্ছিল। প্রিয়ুকে দেখে সিগারেট ফেলে দেয়। প্রিয়ু এগিয়ে যেতেই অরণ্য বলে,
“বাসায় যাওয়ার তাড়া আছে?”
“না।”
“তাহলে চল হাঁটি।”
“আচ্ছা।”
দুজনই চুপচাপ হাঁটছে। এর আগেও দু ভাই-বোন এই রাস্তায় অনেক হেঁটেছে। রাতের তারা গুণেছে একসাথে। হাসি-ঠাট্টা করেছে। নিজেদের সুঃখ-দুঃখ শেয়ার করেছে। কিছু সম্পর্ক আসলে রক্তের নয়। আত্মার হয়! যেমন অরণ্য ভাইয়ার সঙ্গে প্রিয়ুর আত্মার সম্পর্ক। মৌনতা কাটিয়ে প্রিয়ু বলে,
“তুমি সিগারেট খাও?”
“আগে খেতাম না। কয়েকদিন ধরে খাচ্ছি।”
“খুবই বাজে স্বভাব।”
“সবই টেনশন দূর করার চেষ্টা।”

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে মেইন রোডের দিকে যায়। ওখানে একটা ধাবা আছে। গরম গরম ডিম পরোটা, আলু কাবলী, আলুর দম আর চা বিক্রি করে। প্রিয়ুর যে খিদে পেয়েছে এটা অরণ্য জানে। সকালের পর পেটে আর কিছু যায়নি সেটাও জানে।
“তোর খিদে পেয়েছে প্রিয়ু?”
“পেয়েছে।”
“চল আজ আলুর দম দিয়ে ডিম পরোটা খাব।”
“আচ্ছা।”
“আমার সাথে ছাড়া আর এখানে এসেছিলি?”
“না। আসার মতো আমার কেউ নেই।”
“শোন, আমি মারা যাওয়ার আগে এই দায়িত্বটা তোর স্বামীকে দিয়ে যাব। আমি মরার আগে না কিন্তু!”
“আমি বিয়ে করব না।”
“হয়েছে! দু’দিন পরই বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যাবি।”
“এমন কেউ নেই যার জন্য পাগল হব।”
“নেই, হয়ে যাবে।”

ধাবায় এসে খাবার অর্ডার দিয়ে দুজনে চেয়ারে বসে। প্রিয়ু বলে,
“এবার বলো কী এত টেনশন?”
“তিতলির কথা তো জানিসই।”
“কী হয়েছে দিদির?”
“ওর কিছু হয়নি। ওর বাড়িতে আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গেছে।”
“তারপর?”
“আর তারপর! খুব রাগারাগি করেছে ওর সাথে ওর মা। ওর মাকে তো তুই ভালো করে চিনিস। তারমধ্যে আমরা দুজন দু’ধর্মের।”
“সম্পর্কে জড়ানোর আগে এসব নিয়ে ভাবা উচিত ছিল।”
“ভালোবাসা কি এতকিছু ভেবে হয়? আল্লাহ্ জানেন এখন কী যে হবে!”
“কথা হয় না?”
“খুব কম। লুকিয়ে ফোন দেয়।”
“আচ্ছা আমি কাল তিতলি দি’র বাসায় যাব।”
“সত্যিই যাবি?”
“হ্যাঁ। তুমি বরং একটা চিঠি লিখে দাও। আমি দি’কে দিয়ে দেবো।”
“তাই ভালো। দে একটা কাগজ আর কলম দে।”
খাবার চলে আসে। প্রিয়ু কাগজ আর কলম এগিয়ে দেয়। চিঠি লেখা শেষ হলে দুজনে খেয়ে নেয়। কিছু টাকা প্রিয়ুকে দিয়ে বলে,
“যাওয়ার আগে ওর জন্য কাঁচের চুরি কিনে নিয়ে যাবি। তোর হাতের মাপেই নিবি। দুজনই তো একই রকম শুকনা!”
“ইশ! তুমি কত মোটা।”
“তোর জামাই মোটা হবে।”
“হু! ঘেচু হবে।”

—————————–
রাত থেকে আশার ঠান্ডা-জ্বর। শীতে ঠান্ডা বসিয়ে ফেলছে। একটু পরপরই নাক টানছে। আব্বার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ডাক্তারের দোকানে নিয়ে গেছে প্রিয়ু। ফার্মেসীর ছেলেটা অস্থির হয়ে জানতে চায়,
“কী হয়েছে উনার?”
প্রিয়ু মুচকি মুচকি হাসে। বলে,
“আমি কী করে জানব? ডাক্তার আমি নাকি আপনি?”
প্রিয়ুর কথায় বোকা বনে চলে যায় ডাক্তার সিয়াম। আসলেই তো! ডাক্তার তো প্রিয়ু নয়। ঠান্ডা, জ্বর সব মেপে ওষুধ দেয় সিয়াম। সঙ্গে বলে দেয় নিয়মমতো খাওয়াতে। প্রিয়ু টাকা এগিয়ে দেয়। সিয়ামের নেওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও নেয়। নয়তো পরে সন্দেহ করবে। যাওয়ার আগে প্রিয়ু বলে,
“সবসময় আমার আপুকে এমন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেন কেন? চোখ তুলে ফেলব একদম।”
সিয়াম হতবিহ্বহল হয়ে যায়। মুখটা কাচুমুচু করে ফেলে।

পরেরদিন সকালে প্রিয়ু একাই ভার্সিটিতে যায়। তিনটা ক্লাস করে চলে যায় শপিংমলে। তিতলির জন্য কাঁচের চুরি কিনতে হবে। বৃহস্পতিবারেও মার্কেটে এত্ত ভীড়! বাব্বাহ্! পা ফেলারও যেন জায়গা নেই। ধাক্কাধাক্কি করেই চুরির দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ-ই কিছুর সাথে চুলে টান লাগে। প্রিয়ু থেমে যায়। বিরক্ত নিয়ে পেছনে ফিরে দেখে রিশাদকে। রিশাদ দু’হাত সামান্য উঁচু করে বলে,
“আমি কিছু করিনি।”
প্রিয়ু তাকিয়ে দেখে রিশাদের শার্টের সাথে প্রিয়ুর চুল আটকে গেছে। রিশাদের ভাবমূর্তি দেখে হেসে ফেলে প্রিয়ু। কী কিউট করে ইনোসেন্টের মতো কথা বলে! এদিকে লোকজন ধাক্কাধাক্কি করে যাচ্ছে। শার্ট থেকে চুল ছাড়ানোর সুযোগটুকুও নেই। বিষয়টা খেয়াল করে কাপড়ের দোকানের এক কর্মচারী। প্রিয়ুকে বলে,
“আপা দোকানের এইখানে আইসা দাঁড়ান।”
প্রিয়ু চুল ধরেই দোকানের কাছে এগিয়ে যায়। পেছনে পেছনে আসে রিশাদ। ঐ দোকানেই টি-শার্ট দেখছিল অনিক। প্রিয়ু শার্টের বোতাম থেকে চুল ছাড়াচ্ছে তখন অনিক তাকায়। ঠোঁট দুটো চোখা করে বলে,
“বাব্বাহ্! সেটিং হয়ে গেছে? মামা! তুমি না চাইলে কী হবে? আল্লাহ্ আছে তো।”
রিশাদ চোখ গরম করে তাকায় অনিকের দিকে। অনিক যেন তাতে ভয় না পেয়ে আরো উৎসাহ পেল। বলে,
“খাড়া। দুইডা ছবি তুইলা লই। ফ্রেমে বাইন্ধা রাখমু।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে