একটি অনাকাঙ্খিত মৃত্যু

0
559

তীব্র একটা মাথাব্যথা ছড়িয়ে পরেছে পুরো মাথা জুড়ে। ব্যথার তীব্রতায় ঘুম ভেঙে যায় আসলাম সাহেবের। উঠে বসতে যেয়ে দেখেন ওনার শরীরের ডানপাশ নাড়াতে পারছেননা। সাথে মনে হচ্ছে কে যেন বুকের ওপর চেপে বসে আছে। নিশ্চিত কোন দুঃস্বপ্ন দেখছেন ভেবে ভীষণ ভাবে চাইলেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে। হঠাৎ করেই শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। একটু বাতাসের জন্য কি যে আকুলতা যেন পুরো পৃথিবীর কোথাও একটু বাতাস নেই। বামহাতে হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলটা তুলে নেন তিনি। শেষ নাম্বার ডায়াল করা ছেলের নাম্বারে কল ও দেন। কিন্তু ওপার থেকে ছেলের কন্ঠে হ্যালো শোনার মত সময় তার হয়না। তার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন তিনি।

গভীর রাতে বাবার ফোন থেকে কল পেয়ে আবরার উঠে বসে সাথে সাথেই। একটানা হ্যালো হ্যালো করে যায় কিন্তু অপর পাশে তখন নিশ্ছিদ্র নীরবতা। নিশ্চিত কোন বিপদ হয়েছে বুঝতে পেরে সাথে সাথে গাড়ি বের করে। পথেই ফোন দেয় ইমার্জেন্সী নাম্বারে। পুলিশের গাড়ি আর আবরার একই সময়ে এসে পৌঁছায়। ভেতর থেকে বন্ধ বাসায় তালা খুলে ঢুকতে ঢুকতে লেগে যায় অনেকটা সময়। ততক্ষণে সব শেষ। আবরার যখন বিছানায় অচেতন তার বাবার হাত ধরে তখনো গা টা কেমন উষ্ণ হয়ে ছিল। প্যারামেডিক এসে মৃত্যু নিশ্চিত করে মৃতদেহ সৎকারের আয়োজন করতে বলে। আবরারের স্ত্রী সানজিদা, কমিউনিটির পরিচিত লোকজন ততক্ষণে ভীড় করে আসলাম সাহেবের এক বেডরুমের এপার্টমেন্টে। কথায় কথায় আসলাম সাহেব বলেছিলেন তার মৃত্যু হলে যেন এই বিদেশ ভূমেই কবর দেয়, দেশে যেন লাশ নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া না করে।

নিজের মনের ভেতর জমে থাকা গুমোট কান্নাটুকু বেডরুমের বদ্ধ বাতাসে ছড়িয়ে দেয় আবরার একাকী অনেকটা সময় পরে। ততক্ষণে ফিউনেরাল হোম বাবার মৃতদেহ নিয়ে গেছে। চলে গেছে কমিউনিটির লোকজন। সানজিদাকেও জোর করেই ঘরে পাঠিয়ে দেয় আবরার। বারবার মনে হয় আরেকটু সময় কি দেয়া দরকার ছিল তার বাবাকে?
বড্ড খেয়ালী কিন্তু কাজপাগল ছিলেন আসলাম সাহেব। আবরারের মা যতদিন বেঁচে ছিল তিনিই স্বামীর সব খোঁজ রাখতেন। আবরার অনেকবার চেয়েছিল বাবা তাদের সাথে থাকুক। কিন্তু ভীষণ আত্মগরিমাসম্পন্ন আসলাম সাহেবের তা পছন্দ ছিলনা। স্ত্রী ছাড়া আর কারো ওপর নির্ভরশীল হওয়া তার ধাঁচে ছিলনা। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার কারণে নিজেই নিজের সব কাজ করতেন। শুধু অমনোযোগী ছিলেন নিজের শরীরের ব্যাপারে। অনেক অল্প বয়সে হয়ে যাওয়া উচ্চরক্তচাপের ঔষধ ডাক্তার দিয়েছিল অনেক বছর আগেই। ওনার ধারনা ছিল উনি সিগারেট খাননা, স্বাস্থ্যকর খাবার খান, নিয়মিত হাঁটাহাটি করেন কাজেই ঔষধ কেন খেতে হবে? যতবার বাবার সাথে ডাক্তারের কাছে গিয়েছে আবরার প্রতিবারই শুনেছে ব্লাড প্রেসার বেশী আর প্রতিবারই ডাক্তার বলেছে যেন ঔষধটা নিয়মিত খায়।

আসলাম সাহেবের মৃত্যুর ছয়মাস পর আবরার বাংলাদেশে আসে তার বাবার স্বপ্নপূরণে। পরিবারের পরিচিত একজন কার্ডিওলজিস্টের সাহায্যে গ্রামে স্থাপন করে একটি স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক যেখানে প্রতিমাসে বিনামূল্যে একবার চল্লিশোর্ধ পুরুষ নারীদের ব্লাডপ্রেসার মাপা হবে চেক করা হবে ব্লাডসুগার আর কোলেস্টেরলসহ আনুষঙ্গিক রক্ত পরীক্ষা।

গত কয়েক মাসের সাফল্যের পর আজ ক্লিনিক থেকে গ্রামের মানুষদের উপস্থিতিতে আয়োজন করা হয়েছে উচ্চরক্তচাপ বিষয়ক সচেতনতা সভা। আবরারকে কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করে তার এরকম উদ্যোগ সম্পর্কে জনসম্মূখে কথা বলার জন্য। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে মানুষের জন্য করে বাবার স্বপ্নপূরণ করবে এমন ইচ্ছে থাকলেও আবরারের মনে হয় ওর বাবার করা অবহেলার কথাটুকুই মানুষকে বোধহয় জানানো উচিত যদি একজন মানুষ ও তাতে শুধরায়! তাহলে হয়তো আরেকটা অনাকাঙ্খিত মৃত্যু ঠেকানো যাবে। সবাইকে সালাম দিয়ে আবরার বক্তৃতা শুরু করে।

‘আমার বাবা আসলাম সাহেব ছিলেন ভীষণ কর্মঠ একজন মানুষ। ওনার খুব ইচ্ছে ছিল একবারে দেশে চলে আসবেন। ওনার গ্রামের মানুষগুলোর জন্য কিছু করবেন। টাকা জমাচ্ছিলেন নিজে কাজ করে করে। আমি সাহায্য করতে চেয়েছিলাম কিন্তু ঐ যে বললাম আমিই করবো, ওরকম মানসিকতার জন্যই এতোগুলো দিন অপেক্ষা। অথচ পারলোনা বেঁচে থেকে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে। কি কারণ জানেন? শুধুমাত্র নিজের প্রতি অবহেলা। উচ্চরক্তচাপে ভুগছিলেন অনেকদিন ধরেই। কিন্তু ঔষধ খেতে ছিল তার যত আপত্তি। একা একা সব কাজ করতে পছন্দ করতেন। আর তাই মৃত্যুটাকেও একা একাই বরণ করে নিলেন। আমি এক হতভাগা সন্তান মৃত্যুর সময় পারিনি তার পাশে উপস্থিত থাকতে।আমি চাইনা আর একজন সন্তানও আমার মত হাহাকার নিয়ে বাঁচুক। মৃত্যু সবার জীবনে এক অমোঘ সত্য। কিন্তু আমি চাইনা আর কারো বাবা কারো মা কেউবা নিজে একটা ঔষধ রোজদিন খাবার মতো অবহেলা করে নিজের মৃত্যুকে তরান্বিত করুক। ছোট্ট একটা ঔষধ রোজ খেয়ে আর নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে যদি একটা দিনও ভালো থাকা যায় তবে এরকম অবহেলা করার কি কোন মানে হয়? আপনারা আজ প্রতিজ্ঞা করুন উপস্থিত যে যার নিজের এবং তাদের বাবা মায়ের উচ্চ রক্তচাপের যত্ন নেবেন।’

চোখের জলে বুক ভিজিয়ে শেষ করা আবরারের বক্তব্য জল আনে উপস্থিত কম বেশী সবার চোখে। আর রুলটানা খাতায় উপস্থিত রোগীদের নাম্বার আর সচেতনতা আবরারকে আশা দেখায় তার বাবার স্বপ্নকে পুরো দেশে ছড়িয়ে দেবার।

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে