একটা পরীর গল্প পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0
1958

#একটা_পরীর_গল্প
#সাদিয়া_আহমেদ_রোজ
#শেষ_পর্ব

সকালে ঘুম ভাঙতেই সর্বপ্রথম আমি পাশে শুয়ে থাকা অভীকের দিকে তাকাই। আর যেটা দেখি সেটা দেখার জন্য আমার চোখ কিংবা মন কোনোটাই প্রস্তুত ছিলো না। কোথাও কেউ নেই! ভয়ে হুরমুরিয়ে উঠে পড়ি আমি। ডানে, বামে, ঘরের আনাচে কানাচে শতখুজেও কোনো মানুষের হদিশ মিললো না। এবার নিজের দিকে তাকালাম। না জামাকাপড় তো ঠিকই আছে, তবে গায়ে একটু ব্যাথা আছে। হয়তো জ্বরের কারনে। কিন্তু এতো বড় এবং বাজে একটা স্বপ্ন দেখলাম আমি? আমি বাইরে বেড়িয়ে আসি, ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। উঠানে একটা কুকুর ঘুমিয়ে আছে তার দুটো বাচ্চা নিয়ে। আমি ওযু করে দ্রুত নামায পড়ে নিলাম।হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে। আমি চমকে ফোনের দিকে তাকাই, ফোন চালু করা? তাহলে আমি রাতে ফোন চালু করেছিলাম। যদি ফোন চালু করে থাকি! আর এটা সত্য হয় তাহলে অভীকের আসাটা কি?

কার সাথে ঘুমিয়েছি রাতে? অভীক ছাড়া! অন্য কারোর তো ঘরে আসার কথা না, আর থাকারও কথা না কারন চাচারা সারা রাত জেগেই পুকুরে মাছ ধরেছেন, কেউ আসলে ওনারা নিশ্চই জানবেন। আমি বাইরে গিয়ে চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম।

– ” চাচা তোমাদের জামাই..”

চাচা দ্রুততার সঙ্গে উত্তর দিলেন।
– ” হ আইছে তো। তুই ওঠনের আগেই দ্যাখলাম ও উইঠ্যা রাস্তার ওইপারে যাইতাছে। আমি জিগাইলাম কই যাও বাবা, কয় কাজ আছে বিলের ওইহানে তাই যায়। ”

আমি এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। যাক এটা তো সত্য যে উনি এসেছেন। কিন্তু বিলের ওখানে কেন গিয়েছেন? এমন যে আজ প্রথম হয়েছে তা না, প্রতিবারই দেখেছি ওনাকে ঘুরতে এসে ওখানে যেতে। কি করতে যান ওখানে? আমি নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে ধীর পায়ে অগ্রসর হলাম সেই দিকে। হিম শীতল ঠান্ডা হাওয়ায় গা শিরশির করে উঠছে, বোধ হয় জ্বরটা আবার এসেছে। বিলের পাশেই একটা ছোট ব্রিজ। আমি ব্রিজের ওপর দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ আমার চোখ যায় ব্রিজের নিচে, অভীক একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ওর মাথার হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ক্ষনিকের জন্য পাথরের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে আসলো চোখের পানিতে। মেয়েটা অভীককে ছেড়ে পাশে দাড়াতেই দেখলাম লিজাকে। অভীকের বন্ধু লিজা যে এই গ্রামেই থাকে, আমাদের বাড়িতেও আসতো আগে আমার বড় আপুর সাথে। আমার পা টলে আসে। অভীক তখনই উপরে তাকায় আর আমাকে দেখতে পেয়ে চমকে যায়। আমি কিছু না বলে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। অভীক পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলো আমাকে, কিন্তু সে ডাক আমার কানে এসে পৌঁছালো না। ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। মিষ্টি তখন আমার ঘরেই ছিলো।আমাকে খুজতে এসেছিলো, আমি না থাকায় ও আমার ফোনে গেইম খেলছিলো।

– ” মিষ্টি, দীপ্তির কাছে যাও তো সোনা। ”

আমার কথা শুনে মিষ্টি অবাক হয়ে তাকালো। স্বাভাবিক! এই প্রথম ওকে আমি নিজের ঘর থেকে বাইরে যেতে বলেছি তার ওপর নিজের গলার স্বরের এরূপ পরিবর্তন, কান্নায় ভেজা রুদ্ধস্বর। মিষ্টি একনজর আমার দিকে তাকিয়ে বাইরে চলে গেলো। আমিও খিল দিয়ে দিলাম ঘরে। অভীক এসে দরজায় কড়া নাড়লো।

– ” পরী দরজা খোল। ”

আমি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। আমার চেহারা একদম স্বাভাবিক। অভীক ক্রোধান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

– ” ওখানে গিয়েছিলি কেন? ”

– ” আপনি আসুন আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করছি। কি খাবেন আপনি? ”

– ” আমি তোকে জিজ্ঞেস করেছি এই জ্বর নিয়ে কেন গিয়েছিলি ওখানে? কিসের জন্য? ”

– ” আপনাকে দেখতে। চাচা বললো আপনি ওখানে গিয়েছেন তাই। আমি আসছি। ”

– ” আমাকে দেখতে গিয়েছিলি, তো চলে আসলি কেন?তোকে ডাকলাম তখন উত্তর দিসনি কেন? ”

– ” ইচ্ছে করেনি তাই। তাছাড়া আপনারা তখন কথা বলছিলেন সেজন্য বিরক্ত করিনি। আচ্ছা আপনাদের কথা বলা শেষ হয়েছে? নাকি আরও কিছু বাকি আছে? বাকি থাকলে আজ রাতে যেতে পারেন। আমি সব ব্যবস্থা করে দিবো। ”

কথাটা অভীকের কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই অভীক সজোরে চর মারলেন আমার গালে। আমি গালে হাত দিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। মুচকি হেসে বললাম।
– ” খেতে আসুন। ”
– ” খাটের ওপর গিয়ে বস। তোর পা দিয়ে রক্ত পড়ছে।”
– ” আমার অভ্যাস আছে। ”
– ” পরী আমার কথার অবাধ্য হোস না। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে। তোর কপালে কিন্তু বহুত দুর্ভগ আছে। ”
– ” আগে কি ছিলো না? ছিলো তো!”

অভীক আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি হাতের ইশরায় ওনাকে বাঁধা দিলাম।
– ” আমার কাছে আসবেন না দয়া করে। এখন আমার নিজেরও একটু সময়ের প্রয়োজন এই ঘটনা মেনে নেওয়ার জন্য। ”

অভীক তবুও আমার কথা শুনলেন না। হাতের কব্জি চেপে ধরলেন খুব জোরে। আমি ব্যাথায় কুকড়ে উঠলাম তবুও ছাড়লেন না। আমায় খাটে বসিয়ে উনি পায়ের ধারে বসলেন। পা উঁচু করে দেখলেন কি হয়েছে। এরপর নিজের ব্যাগ এনে সেখান থেকে তুলো আর স্যাভলোন বের করলেন, বড়ইগাছের কাটা ফুটে আছে।অভীক প্রথমে হাত দিয়ে চেষ্টা করলো কাটা বের করার কিন্তু যখন ব্যর্থ হলো তখন সরাসরি মুখ দিয়ে বসলো পায়ে, ময়লা লেগে থাকা পায়ে এভাবে মুখ দেওয়ার আমি বিব্রত হয়ে পা সড়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু উনি দু-হাতে শক্ত করে চেপে ধরে আছেন পা। কাটা বের করে, ছিলে যাওয়া অংশ টুকু তুলো দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে বললেন।

– ” পরী একটা সত্য কথা বলবি? ভেবেচিন্তে উত্তর দিবি। তোর এই একটা উত্তর আমার জীবনের অনেক অগোছালো অধ্যায় গুছিয়ে দিবে, অনেক প্রশ্নের উত্তর দেবে, অনেক সমস্যান সমাধান করবে। ”

আমি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালাম অভীকের দিকে। অভীক আমার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,

– ” ভালোবাসিস আমাকে? ”

আমি অভীকের কথা তাচ্ছিল্যে ভরা হাসি দিয়ে মাথা নত করলাম। ওনার জীবনের সমস্যা আর কি হতে পারে? আমি ছাড়া! ওনার জীবনটা হুট করে অগোছালো কে করেছে? আমি ছাড়া! ওনার অনেক প্রশ্নের মাঝে একটা প্রশ্ন তো এটাও ” আমার জীবন কেন নষ্ট করলি? ” তাছাড়া এটাও তো ঠিক যে উনি আমার থেকে ভালো কাউকে আশা করেছিলেন। আর আমার জীবনের কালো অধ্যায়টাও না জেনে আমাকে নিজের জীবনে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও এনেছিলেন। সব ভেবে আমি স্মিত হেসে উত্তর দিলাম।

– ” না। ”
উত্তর শুনে অভীক সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন।
– ” ভেবে বলছিস? ”
– ” হ্যাঁ। ”
– ” আরেকটু ভাব, ভাবার জন্য পাঁচ মিনিট সময় দিলাম তোকে। ”
– ” ভেবেই বলেছি। আর ভাবার প্রয়োজন নেই। ”
– ” বিয়েটা ভেঙে দিতে চাস? ”
– ” সবাই যা বলবে সেটা করবো।”
– ” নিজস্ব মতামত? ”
– ” নেই। ”
– ” তো এমন গম্ভির মুখে বসে আছিস কেন? ”
– ” তো কি ষোলো পাটি দাঁত বের করে হে হে করবো? ”
– ” মাঝে মাঝে তো তাও করতে পারিস! তোর কালো মুখ দেখলেই সেইদিনটা খারাপ যায় আমার।”
– ” তাহলে না দেখার ব্যবস্থা করে ফেলুন। ”
– ” খুব বাড় বেড়েছে তোর। আমার মুখে মুখে তর্ক করা শিখেছিস। ”
– ” আমি বরাবরই এমন। আগে নিভৃতে ছিলাম ”
– ” তো হঠাৎ প্রকাশিত হলো কোন আমোদে? ”
– ” আপনার রাসলীলা দেখার আমোদে।”
– ” বাহ। অতি উত্তম উত্তর। ”
– ” হুম। ”
– ” লিজা আমার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড। ”
– ” তো? ”
– ” এবার ঠাটিয়ে দিবো এক চর। মনোযোগ দিয়ে শোন কি বলেছি। ”

ওনার ধমক শুনে আমি এবার খেয়াল করলাম ওনার কথা। এতক্ষণ শুধু হু হা বলে উত্তর দিয়েছি, কোনো প্রশ্নই সেভাবে শুনিনি, সব প্রশ্নই আংশিক শুনেছি। উনি আবারও বললেন,

– ” লিজা আমার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড। আমার বোনের মতো। ওদের সম্পর্ক বাড়ি থেকে কেউ মেনে নিচ্ছে না।তাই কাঁদছিলো তাছাড়া আমার বন্ধুও ছিলো ওখানে, লিজাকে আমায় দেখে রাখতে বলে ও পালিয়েছে।”

– ” কোন বন্ধু? ”

– ” তোর বড়ফুফুর ছেলে রিয়াদ। ”

ওনার কথা শুনে আমি থমথমে গলায় বললাম।
– “মিথ্যা কথা। আমার ভাই’য়ের কথা আমি জানি না। আপনি জানেন? এসব বানোয়াট।”

– ” কি বললি? ”
– ” যেটা শুনলেন সেটাই বলেছি। আপনি যে সত্য বলছেন তার প্রমাণ কি? ”

অভীক আমার সামনে ভাইয়াকে ফোন করলো।
– ” হ্যালো রিয়াদ? ”
– ” হ্যাঁ বল। লিজা কি খুব কাঁদছিলো? ওকে শান্ত হতে বল। আমি সবটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি। আর তোকে বলেছিলাম না? মামাকে বলতে।”
– ” আব্বু রাজি হয়েছে ফুফুকে বোঝানোর জন্য। চিন্তা করিস না তুই। আর লিজা এখন স্বাভাবিক আছে।”
– ” যাক বাঁচালি। তুই না থাকলে আমাদের সম্পর্কটা টিকতো না এভাবে, কবেই ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। ”

অভীক ফোনটা কেটে দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি বসে বসে নখে নখ ঘসছি।
– ” শুনলি? ”
– ” তো এসব আমাকে শুনিয়ে কি লাভ? আমি কে হই আপনার? যে আমাকে এসব বলছেন।”
– ” এখন কি কাবিননামা বের করে দেখাতে হবে সম্পর্কের হিসাব? ”
– ” এসব করে কি বোঝাচ্ছেন? ভালোবাসেন আমাকে? আমার সম্পর্কে সবটা জানেন? যদি ভালোবাসতেন তাহলে এই তিনবছর দূরে ছিলেন কেন? যোগাযোগ করেননি কেন? ওদেশে যে আর কোনো বউ নেই তার গ্যারান্টি কি? ”
– ” গ্যারান্টি তোর বাপ। তোর বাপের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। যা। ”

আমি থতমত খেয়ে প্রশ্ন করি,
– ” মানে? ”
– ” মানে তোর বাপই তো ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়েছিলো। তাই তোর সব উত্তর উনি দিবেন। আমি তোর এই ফালতু মগজে বুদ্ধির চাষ করতে পারবো না।”
– “করার প্রয়োজনও নেই।”
– ” শোন আজ বিকালে তোদের “একটা পরীর গল্প ” শোনাবো। তুই সশরীরে ওখানে উপস্থিত থাকবি নাহলে কিন্তু মার একটাও নিচে পড়বে না। ”
– ” আমি শুনবো না। ”
– ” শোনার প্রয়োজন নেই। শুধু আমার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে থাকবি। নো মোর ওয়ার্ড। ”

বিকালে আসর বসানো হলো বাড়ির পেছনের বাগানে। অনা, দীপ্তি কিছু ফল এবং মিষ্টি এনে রেখেছে মাদুরের ওপর। মিষ্টি তেতুল মাখা, আর বড়ই মাখা আনছে। আমি গিয়ে চুপচাপ দেখতে লাগলাম সবটা। বেশ ভালোই আয়োজন করেছে। হঠাৎ অভীক এবং রিয়াদ কয়েকডজন খাবার প্যাকেট নিয়ে হাজির। অর্ধেকটা রিয়াদ এখানে আনছে, বাকিটা অভীক আম্মুর কাছে দিয়ে আসলো। কি এমন গল্প শোনাবে যে এমন এলাহি কান্ড করা হয়েছে।সবাই গোল হয়ে বসলো মাদুরে। অভীক মৃদু হেসে বলতে শুরু করলো,

– “একটা পরীর গল্প ” বলতে আসলে তেমন কিছু নেই। শুধু কিছু বোকা মানুষের মনোযোগ পাওয়ার জন্য এই চতুরতা। তবে যেটুকু বলা যায় সেটুকুই বলি, ”

আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন উনি। ওনার হেয়ালি দেখে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। অভীক আমার দিকে তাকিয়েই বলতে শুরু করলো।

– ” সে ছিলো আনন্দপরী।
উল্লাসই যেন তার সর্বক্ষণের সঙ্গী
সে গান গাইতো নিভৃতে,
আড়ালে, সবার অগোচারে।
সারাদিন ব্যস্ত থাকতো নিজের দুষ্টুমিতে।
দিন যায়, দিন আসে!
পরীর গানের কথা রটে।
ঘরে, বাহিরে সব খানে পরীর নাম ডাক,
পরী শুধু গানকে বলে, তুই আমার সঙ্গে থাক।
পরী, অবুঝ মনের অধিকারী!
বিশ্বাস, শব্দের সঙ্গে তার অতি বাড়াবাড়ি!
দিবালোকে পরীকে দেখে মুগ্ধ হয়! এক শয়তান
কিন্তু পরীর রক্ষাকবচ দেখে!
সে হয়ে গেলো সাবধান
সুরবিদ্যার তরে সে আসে পরীর পানে
তিমিরে সে পরীর দিকে! হাত বাড়ালো সন্তর্পণে
কালো হাতের অন্তরালে পরী ছটফটায়
এই বু্ঝি ছোট্ট পরী ভয়ে জ্ঞান হারায়।

এপর্যন্ত শুনেই আমি ঘামতে শুরু করি।হুবহু আমার মিল রেখে কিভাবে ছন্দ বাঁধছেন উনি? তবে কি উনি সবটা জানেন? সেই নরপশুটার কথাও? যে আমাকে!

– ” পরী থাকে সুরক্ষিত নিজ প্রাসাদে,
কয় না কথা, একলা থাকে অতি নিরবে।
দূর থেকে এক রাজপুত্র!
এলো পরী দেখার ছলে
পরীর রূপে মুগ্ধ হলো,
পরীকে বাঁধলো নিজের জালে।
পরীর অন্তরালে সে ভালোবাসে তাকে
পরীই থাকে অগোচরে, এই কথার উন্মেষে
নিভৃতে যতনে সে পরীকে রাখে দূরে
পরী যেন এই কথা টের না পায় ঘুনাকখরে
অবশেষে সে বাঁধা পড়লো পরীর অভিমানে
ফিরতে হলো সুদূর থেকে! তাকে পরীর টানে।
বিচ্ছেদের এই মিলনতিথির সময় ক্ষণকাল
পরী নিজেই জানে না যে, তার মনের হাল চাল

এটুকু বলেই থেমে গেলেন উনি। সবাই গল্প শোনায় এতোটাই মগ্ন যে গল্প থামার সাথে সাথে ওরা চিৎকার দিয়ে উঠলো।

– ” তারপর? ”

অভীক স্মিত হেসে উত্তর দিলো।
– ” পরী জানে। কাহিনি এখানেই শেষ। এবার সবাই গিয়ে খেয়ে নে। খাবারগুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

আমি ঘরে চলে আসি। অভীকও পিছু পিছু আসে। অভীক ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো।আজ ও ওর পরীর সব প্রশ্নের উত্তর দেবে । আমি খাটের ওপর বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার পানে।অভীক এসে আমার কোলে মাথা গুজে শুয়ে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায়, আমি বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

– ” আজ তোর সব প্রশ্নের উত্তর পাবি তুই। ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে বেড়াতে গিয়ে, অশান্ত হয়েছি তোর থেকে দূরে থেকে থেকে। আমি চাই তোকে কাছে পেতে, তোর কাছে থাকতে, তোকে আগলে রাখতে।”

আমি সরু চোখে তাকালাম অভিকের মুখের পানে। ব্যাপারটা ‘ভুতের মুখে রাম নাম ‘ এর মতো। এটাও অভীকের বিশেষ কোনো চাল আমাকে জব্দ করার সুতরাং আমি ওর কথার জালে আর ফাঁসবো না।কিছুতেই না। অভিক নিজ থেকেই বলে উঠলো,

– ” তোকে যেদিন প্রথম দেখি! কয়লার কালির আবরণে ঢেকে থাকা শুভ্র মুখশ্রী! তখন থেকেই আমার প্রিয় হয়ে উঠেছিলো। আমি তখন জানতাম তোর গানের স্যার তোর সাথে খারাপ আচরণ করেছে, তোকে গান শেখানোর নাম করে, তোর এবং বাকি সবার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এক বর্ষনের বিকালে এসে ধর্ষণ করতে চেয়েছিলো তোকে। ”

আমি চমকে তাকালাম অভীকের দিকে। অভীক স্বাভাবিক কন্ঠেই বলতে থাকে।

– ” মূলত তোকে দেখার জন্যই এসেছিলাম আমরা। সেই দূর্ঘটনার পর থেকে তুই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলি, তোর গান তোর থেকে দূরে চলে গিয়েছিলো, একা থাকতিস, দীপ্তি ছাড়া তেমন কারোর সাথে মিশতিস না, এমনকি তখন বুঝতিসও না যে তোর সাথে ঠিক কি হয়েছিলো, তোর শুধু মনে ছিলো সেই বিশ্রি স্পর্শ আর হাসিটুকু। আমি তোকে কথা বলানোর অনেক চেষ্টা করি, কিন্তু তুই তোর মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতিস না। তাই তোকে জ্বালাতন করতাম। আর তুই ভেবে বসেছিস আমি তোকে অপছন্দ করি! তাতে আমার কোনো আফসোস নেই। কিন্তু যেদিন তোর বিয়ের কথা শুনলাম সেদিন আমার অবস্থা কেমন হয়েছিলো তোকে বোঝাতে পারবো না আমি। আমার মনে হতে লাগলো আমার আমিটা আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, পাগলের মতে কেঁদেছি সেদিন রাতে। মিষ্টির পরে তোর জন্য কেঁদেছি দেখে আব্বুও রাজি হয়ে যায় আমার সাথে তোর বিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু শর্ত দিয়েছিলো যতদিন না তুই ঠিক হবি, বড় হবি ততদিন তোর সাথে জোরাজুরি করতে কিংবা তোর কাছে যেতে পারবো না আমি। আমি তখন তোকে পাওয়ার জন্য সবকিছুতে হ্যাঁ বলে দেই। পরেরদিন সবার আগে আমি আর রিয়াদ তোর বর চুরি করার প্লানিং করি, কারন তোর বরকে সামনে রাখলে আমি কখনই তোকে বিয়ে করতে পারতাম না। যে পাওয়ারফুল চেয়ারম্যান তোদের, মোটা,কালো, ভুড়িওয়ালা ”

আমি রাগি চোখে তাকাতেই অভিক মূল কথায় আসে,

– ” যদি রহমতকে না সড়াতাম তাহলে তোর আব্বুর সব জমি ওদের দখলে চলে যেতো। বহুকাল আগে তোর মূর্খ দাদা কোন কাগজে টিপসই দিয়েছিলো তার ফল এটা। যাই হোক তো নির্বিঘ্নে বিয়েটা কাটাতেই আব্বু সেই শর্তের কথা মনে করিয়ে দিলো। এখন তুই বল বিয়ে করেছি কি আলাদা থাকার জন্য? একই বাড়িতে একই ছাদের নিচে বিবাহিত হয়েও সিঙ্গেল থাকবো? যখন এগুলো নিয়ে কথা হচ্ছিলো তখন ইন্ডিয়া থেকে আমাকে একটা রেকর্ডিং কম্পানি লেটার পাঠায়, আমি ওদের আমার কিছু গানের রেকর্ডিং দিয়েছিলাম সেটা সিলেক্ট হয়েছিলো। তাই চলে গিয়েছিলাম। এবার আসি তোর হামযার কথায়, হামযা তোকে না আমার মিষ্টিকে ভালোবাসে, বলা যায় আমি ওকে একপ্রকার ভাড়া করেছিলাম তোর মন পরীক্ষা করার জন্য। ওই যে আজকাল কার লোকের ধারনা আছে না ‘ স্বামী বিদেশ ‘ বউ দেশে কি করে না করে ”

আমি রাগে ওনার মাথা কোল থেকে নামিয়ে সড়ে বসলাম। খচ্চর এবার উঠে বসলো, আমার দিকে তাকিয়ে আমতা সুরে বললো,

– ” আরে ভাই এতো রাগ করার কি আছে? আমি তো একটু খানি, যাস্ট চেক করছিলাম। তোর তো প্রাউড ফিল করা উচিত আমার মতো এমন একটা জামাই পেয়ে। নাহলে তো ওই রহমত ব্যাটার ঘরেই গিয়ে পড়তে হতো, সতীনের সাথে চুলাচুলি করতে হতো, আমি তোকে বাঁচিয়ে। একপ্রকার তোকে উদ্ধার করেছি, সেই হিসাবে আমার প্রতি তোর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত পরী। এমনে মুখ ভেঙচাস না। ”

আমি মাথা নত করে বসে আছি। তার মানে উনি সেই নরপশুটার কথা জানে যে আমাকে.. এজন্যই গতকাল রাতে জিজ্ঞেস করেছেন, ওনার স্পর্শে আমার খারাপ লাগছে কিনা। কিন্তু উনি দূরে থেকে আমার সাথে এতোগুলো অন্যায় করলো! আমি যে ওনার অনুপস্থিতিতে এতো কষ্ট পেয়েছি তার কি হবে? অভীক নিজের দু’হাতে আমার গালে চেপে ধরলো।

– ” তাছাড়া আরও একটা কারন ছিলো আমার ওদেশে যাওয়ার, আমি প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলাম। আমার মিষ্টির মতো যে শিশুগুলো অবুঝ, সরল, তাদের নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলাম। আমার এক বন্ধু এদের নিয়েই কাজ করে তাই এইসুযোগে ওর সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করে ফেললাম। ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে গতবছর। আর কয়েকদিনের মধ্যেই শেষ হবে কাজগুলো। ”

– ” ভালো। ”

– ” শুধু ভালো? আর কিছু বলবি না? তোর জন্য এতোকিছু করে ফেললাম কি শুধু ‘ভালো’ শব্দ শোনার জন্য? ”

আমি এবার ভীষন চটে গেলাম। মনের সব রাগ মেটানোর সময় এসেছে। আমাকে সবার সামনে যে হারে উনি অপমান করেছেন, মেরেছেন তার শোধ তোলার সময় এসেছে। তাছাড়া উনি আমার অতিত জেনে আমাকে আপন করেছেন সুতরাং আজ, এই মুহূর্ত থেকে আমার আর কোনো দায় নেই। আমি মুখে গাম্ভীর্য ভাব এনে কঠোর গলায় বললাম।

– ” তাহলে কি চাচ্ছেন? ”

– ” গতকাল রাতে যেটা হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু হয়নি সেটার জন্য অনুমতি চাচ্ছি। তোর অনুমতি ছাড়া অভীক তার মনোরথে ব্যর্থ।”

– ” আমাকে এতোদিন মেরেছেন, চুল ধরে টেনেছেন,কটু কথা বলেছেন, কাইল্যা-গাইয়্যা বলেছেন, খোঁটা দিয়েছেন ইভেন বিয়ের পর সদ্যবিবাহিত বউকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলেন, আপনার কারনে রহমতের মুখ থেকে আজেবাজে কথা শুনতে হয়েছে আমায়। ”

অভীক ভ্রু কুচকে তাকালেন আমার দিকে।
– ” তো? ”

আমি ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম।
– ” সুতরাং নতুন জীবন শুরু করার আগে, পেছনের সবকিছু ভুলে যাওয়া উচিত।”

অভীক খুশিমনে মাথা নাড়লো। আমি এবার ওনার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললাম।
– ” কিন্তু আমি এগুলো তখনই ভুলবো যখন আপনি সবার সামনে আমার সেই ‘ চৌদ্দগুষ্টি ‘ যাদের নিয়েও খোঁটা দিয়েছেন। সেই চৌদ্দগুষ্টির সামনে আমায় প্রণয়ের কথা বলবেন। প্রস্তাব দিবেন আমার হাত সারাজীবন ধরে রাখার। তারপর যা হবার হবে। ”

আমার কথাগুলো শুনে অভীকের প্রতিক্রিয়া কেমন সেটা বোঝা গেলো না। আমি খুব ভালো করেই জানি আব্বু আম্মুর সামনে উনি কখনই আমাকে প্রপোজ করবেন না। কারন উনি সবার সামনে খুবই নম্র, ভদ্র, এবং অবুঝ যুবক সেজে থাকেন। আমি উঠানে গিয়ে সবাইকে একত্রিত করে গল্পের আসর জুড়ে দিলাম। অনেক বছর পর নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। সবার সাথে মন খুলে কথা বলতে পারছি। অভীকের গিটার নিয়ে খেলছে মিষ্টি। অভীকও এসে আমার পাশে বসলেন। আমি ভাবলেশহীন হয়ে বললাম,

– ” রাত হতে কিন্তু বেশি দেরি নেই। সুতরাং প্রপোজ’টা দ্রুত করে ফেললেই আপনার জন্য ভালো। নাহলে আমাকে কেন? আমার নখের ছোঁয়াও যাতে আপনি না পান সেই ব্যবস্থা আমি নিজদায়িত্বে করিবো। ”

– ” তোকে সব জানিয়েই ভুল করেছি আমি। না জানালে তুই আগের পরী হয়েই থাকতি, তবে তোর মগজে বোধ হয় এবার সত্যিই বুদ্ধির চাষ করতে হবে। এমন হাম্বা মার্কা বউ কোনো কাজের না। তবে আমারও একটা শর্ত আছে। আমি যদি তোকে প্রপোজ করতে পারি তাহলে, তুই’ও যে আমাকে ভালোবাসিস সেটা তোকে, আমায় গানে গানে জানাতে হবে। ”

– ” গাইবো। এবং বুদ্ধি নিয়ে যা ইচ্ছা বলুন কিন্তু প্রপোজ আপনাকে করতেই হবে। ”

– ” আমি কি বলেছি করবো না? এই মিষ্টি গিটারটা দে তো। ”

অভীক গিটার নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলেন। আমি সরু চোখে তাকিয়ে ওনার উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছি।

– ” একটা পরীর গল্প,লেখা অল্প অল্প
তার পাখনাতে ভর করে
খেলে মেঘ আর রোদ্দুরে
তার রংধনু বাসায় রঙিন স্বপ্ন সাজায়
মনের চিলেকোঠায়
দুটো শালিক ঝগড়া বাঁধায়
ও যে ঝগড়া নয় শালিকের!
গোপন ভালোবাসা
মুখ ফুটে বলবি কবে!
বুক বেঁধেছি আশায়।( ২ )

শুনছে না মন তবলায়
অস্ফুট থাকা এই মন
ভালোবাসায় এই সজ্জায়
তবু শুনছে না, কিছু বলছে না,
কেন বুঝছে না,
আমি ভালোবাসি তাকে ”

ওনার গান শুনে আমি পুরো ‘থ’। ব্যাটা কত্তবড় খাঁটাশ। গান দিয়ে প্রপোজ করছে! কেউ টেরও পাচ্ছে না। সবাই আরামসে গান শুনছে আর উপভোগ করছে। আমি ওনার দিকে তাকাতেই উনি সন্তর্পণে সবার আড়ালে চোখ মারলেন আমাকে। এই খচ্চরের সাথে কখনো বুদ্ধিতে কিংবা তর্কে জিততে পারিনি আর কোনো দিন পারবও না, ব্যাটা ধূর্ত শয়তান। যাক উনি যখন প্রপোজ করেছেন তখন ওনার শর্ত মোতাবেক আমাকেও গাইতে হবে। কতদিন পর গাইবো, কি জানি কেমন হবে। ওদিকে অভীক গিটার বাজাতে বাজাতে আমার দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ভাবলাম গেয়েই ফেলি যা আছে কপালে,

– “দুচোখ জুড়ে বৃষ্টি, একি অনাসৃষ্টি
ঝরছে প্রেম টুপটাপ,
তবু ঠোট দুটো এই চুপচাপ
তবু শুনছে না, কিছু বলছে না,
কেন বুঝছে না,
আমি ভালোবাসি তাকে
ও যে ঝগড়া নয় শালিকের!
গোপন ভালোবাসা
মুখ ফুটে বলবি কবে!
বুক বেঁধেছি আশায় ”

আমাকে ১১বছর পর গান গাইতে দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে অভীকের দিকে তাকায়, অদ্ভুত আমি গেয়েছি তার ক্রেডিটও কি এই খাঁটাশটা পাবে? ওদিকে খাঁটাশ ব্যাটা আমার দিকে অদ্ভুতভাবে আড়চোখে তাকাচ্ছে।আমি উঠে আসতে চাইলে উনি আমার হাত চেপে ধরেন।

– ” পরী! ”

ওনার ডাকের উত্তরে আমি মৃদু হাসলাম। ওনার মুখের পানে চেয়ে দেখলাম খুশিতে ওনার চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। হারিকেনের আলোতেই অস্ফুট যেটুকু দেখা সম্ভব। আমাকে পাশে বসিয়ে উনি আমার কোমর চেপে ওনার সাথে মিশিয়ে নিলেন। ওনার এহানো কান্ডে আমি বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বাড়ির সবাই আছে এখানে সবার মধ্যে ওনার এমন কাজ! কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে। আমি ওনার হাত সরানোর চেষ্টা করতেই উনি আমার হাতও চেপে ধরলেন। এরপর আমার কানের কাছে ঠোট এনে কোমলকন্ঠে বললেন

– ” উফ এতো নড়িস কেন? দেখ রাতে কিন্তু একদম নড়বি না। যদি আমি আমার কাজে ডিস্টার্ব ফিল করি তো আগামী তিনদিন তুই কারোর সামনে যাওয়ার মতো চেহারায় থাকবি না। অভীকের স্পর্শের প্রকাশ সারা শরীরে গাঢ়ভাবে সিল করে দিবো।”

সবার অগোচারে ওনার এমন বাক্য আমার কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আমার সারা শরীর শিহরিত হতে শুরু করে।কান গরম হয়ে উঠেছে, সেই সঙ্গে লজ্জায় চেহারায় ফুটে উঠেছে রক্তিম আভা।

সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে