একজন সৃজনশীল মানুষ

0
835

আবিদের সাথে আমার বিয়েটা একদমই হুট করে হওয়া। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম টাইপ ব্যাপার যেন। তবে তফাতটা শুধু এলাম দেখলাম জয় করলামের কাজটা করেছেন আমার শ্বশুর। অনার্স শেষ করে রেজাল্টের অপেক্ষায় বাড়িতে থাকাকালীন অচেনা এক লোক এলো বাড়িতে। কথাবার্তায় দেখা গেলো বাবার পরিচিত। তার তিনদিনের মাথায় তার ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো।

আমার বাবা মাস্টার্স শেষ করার আগে বিয়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেননা। কিন্তু আমার নাছোড়বান্দা শ্বশুর ওনাকে রাজী করিয়ে ছাড়েন। আত্মীয়স্বজন ও বলছিল এতো করে যখন ছেলেপক্ষ চাইছে খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত। একদিনের ভেতর খোঁজ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন খুঁত পাওয়া যায়না। বাবা ছেলের সংসার। শাশুড়ি গত হয়েছেন আবিদ যখন কলেজে পড়ে তখন। সেই থেকে শ্বশুরসাহেব ঘর বাহির একা হাতে সামলে চলেছেন।

বিয়ের পর আবিদদের বাসায় উঠে এসে দেখা গেলো ঘরে সারাদিন আমার কোন কাজ নেই। সবকিছু আমার শ্বশুর বাবা এমনভাবে সামলান যে কোন ভীষণ সংসারী নারীও ওনার কাছে হার মানবেন। রান্নাঘরের লবন থেকে টয়লেট ক্লিনার পর্যন্ত কোথায় কি আছে বা কি লাগবে সব তার নখদর্পনে। ওনার কাছ থেকেই একটু একটু করে আমার রান্না শেখার হাতেখড়ি শুরু হয়।

সামনের সপ্তাহ থেকে মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হবে। জীবন ব্যস্ত হয়ে যাবে। আমার শ্বশুর আব্বার কি একটু মন খারাপ? আমার সাথে সারাদিন গল্প করে আমাদের দুজনের সময় তো ভালোই কাটতো। গত কয়েকদিন দেখছি সকাল বেলা দেরী করে ঘর থেকে বের হন। ওনার রুম গোছাতে দিতে চাননা। কি হয়েছে কে জানে?

আজ সকাল থেকে অবশ্য ঘরে সাজ সাজ রব। আজ আমার জন্মদিন বলে উনি মোরগ পোলাও রাঁধবেন। সকাল থেকে আমাকে কোন কাজে হাত দিতে দেয়া হয়নি। আমার নিজের বাবার বাড়িতেও এতো ঘটা করে কখনো আমার জন্মদিন করা হয়নি। আবিদ অফিস থেকে চলে আসে দুপুরের খাবারের আগে আগেই। দুপুরের খাওয়া শেষে আমার হাতে তুলে দেয়া হয় জন্মদিনের উপহার। প্যাকেট খুলে আমার হতভম্ব হবার যোগাড়। একটা হাল্কা নীল রঙের শাড়ি যার পুরোটা জুড়ে সাদা সাদা মেঘের ছোপ। যেন বারো হাতের এক টুকরো শরতের আকাশ। দৌড়ে রুমে যেয়ে শাড়ি পরে এসে বাবাকে সালাম করি।

– এতো সুন্দর শাড়ি কোথায় পেয়েছেন?

তোমার পছন্দ হয়েছে?

– ভীষণ।

আবিদ আর আমি মিলে করেছি। ও সব যোগাড়যন্ত করে দিয়েছে আর কি। তোমাকে এজন্যই আমার রুম গোছাতে দেইনি গত কয়েকদিন।

– এতো সুন্দর আঁকার হাত আপনার!

তোমাকে যেদিন দেখতে যাই তোমাদের বাসায় বসার ঘরে তোমার আঁকা দুটো ছবি দেখে আমার চোখ আটকে যায়। তোমার বাসায় সবাই ভেবেছে আমি একা হাতে সংসার টেনে ক্লান্ত, ছেলের বৌ হলে আমার দায়িত্ব কমে এসব ভেবে তোমায় এতো তড়িঘড়ি করে বিয়ে করিয়ে এনেছি। আসল ঘটনা হচ্ছে আমি তোমার ছবিগুলো দেখে ওমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু তুমি দেখি কোন আগ্রহই দেখাওনা আঁকাআকির ব্যাপারে।

– বাবা ওগুলো শখের বশে আঁকা। আমার তো কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই ।

নেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। জানো মা, সৃজনশীলতার লালন সবাই করতে পারেনা। আর যথাযথ চর্চার অভাবে কত হাজারও সৃষ্টিশীল মেধা ঝরে যায় প্রতিদিন তা আমরা নিজেরাও জানিনা।

– আপনি কোথায় শিখেছেন?

আমারও তোমার মতই অবস্থা। খুব ধর্মভীরু মুসলিম পরিবারে আমার বেড়ে ওঠা। আমার পুরো পরিবারে আমিই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র পড়ার সুযোগ পাই। এক ঢাকায় থাকা ছেলের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়। ও খুব ভালো আঁকিয়ে ছিল। ওর কাছেই হাতেখড়ি। আমার মায়ের জন্য একটা শাড়ি এঁকেছিলাম খুব শখ করে। আমার বাবা সেই শাড়ি মায়ের পরনে দেখে এমন ক্ষেপে গিয়েছিলেন যে ঐ শাড়ি মা কোথায় লুকিয়েছিল তার হদিশ আমি আর পাইনি। ছোট্ট দুটো পাখি ছিল শাড়ির আঁচলটাতে আঁকা। তোমার শাশুড়িকে বিয়ের প্রথম বছর শেষে একটা শাড়ি এঁকে দিয়েছিলাম। ওর বোধহয় তেমন একটা ভালো লাগেনি। একবার নামকাওয়াস্তে পরেছিল। তারপর কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই শাড়ি। আমি একটু মন খারাপ করলেও ওকে কিছু বলিনি। বুঝে গিয়েছিলাম ততদিনে সৃজনশীলতা শব্দটা সব মানুষকে লালন করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা দেননা। তুমি যদি আবার রংতুলি হাতে তুলে নাও আমি খুব খুশী হবো। আমার খুব শখ ছিল আমার একটা শাড়ির দোকান হবে। সব শাড়ি হবে হাতে আঁকা। একেকটা শাড়ি একেকটা জীবনের গল্প বলবে। আমার সাহায্যকারী হবে তুমি?

……………

এ বছর বাংলাদেশের দেশীয় শাড়ি শিল্পে অবদান রাখা নবীন উদ্যোক্তাদের সমাবেশে সাজঘর বুটিক প্রথম পুরস্কার পেয়েছে। নবীন উদ্যোক্তা হিসেবে সাজঘরের কর্ণধার নাদিয়া হাসানকে পুরস্কার বুঝে নিতে ও কিছু বলতে মঞ্চে আসতে অনুরোধ করছি।

নাদিয়া আপনার সাজঘর সম্পর্কে কিছু বলুন সবার উদ্দেশ্যে।

– আমার মতান্তরে আমার সাজঘরের আজকের এই অবদানের পেছনের মানুষটা হচ্ছেন আমার বাবা আমজাদ হোসেন। সম্পর্কে আমরা বৌ শ্বশুর হলেও উনি আমাকে সবখানে ওনার মেয়ে বলেই পরিচয় দিন। আমিও ওনাকে আমার বাবার মতোই ভালবাসি ও সম্মান করি। আজ থেকে সাত বছর আগে বিয়ের পর প্রথম জন্মদিনে উনি আমাকে আমার আজকের পরনের শাড়িটা নিজ হাতে উপহার দিয়ে বলেন, সৃজনশীলতার লালন সবাই করতে পারেনা। এই বলে শাড়ির সাথে আমার হাতে এক বাক্স রংতুলি তুলে দেন। ওনার স্বপ্ন ছিল সাজঘরের প্রতিটা শাড়ির আলাদা একটা নাম থাকবে। যে নামে কোন একটা জীবনের গল্প ফুঁটে উঠবে। আজকের এই পুরস্কার তাই আমি ওনার জন্য উৎসর্গ করলাম। নতুন কিছু গড়ার স্বপ্ন অনেকেই দেখতে পারে তবে তাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে ওনার মতো হাতে গোনা কয়েকজন।

পেছনে দর্শক সারিতে বসা আমজাদ হোসেন তখন চোখের পানি মুছতে ব্যস্ত। স্বপ্ন যদি পূর্ণতা পায় আনন্দে চোখে দুফোঁটা জল যে আসতেই পারে।

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে