উড়বে হওয়ায় বিষন্ন চিরকুট পর্ব-০১

0
1581

উড়বে হওয়ায় বিষন্ন চিরকুট
পর্ব-০১
জিনাত আফরোজ

আজ কাজিন মহলে একটা ঘটনা ঘটছে যা আমরা কখনো কল্পনাও করিনি। আমাদের খালাতো
ভাইবোনদের মধ্যে মেঝ খালাতো ভাই একটা পুতুলের মতো মেয়ে নিয়ে বাড়িতে এসে বড়ো খালামুনিকে বলে,
– আম্মু এ তোমার মেঝবউমা, আমাদেরকে দোয়া করে দাও। আমরা আজকে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করছি।
খালামুনি ভাইয়ার কথা শুনে ভাইয়ার দিকে বোয়াল মাছের মতো হা করে তাকিয়ে থাকে। খালামুনি হইতো ভাবতে পারেনি উনার ভোলা ভালা, সবাইর থেকে শান্ত ছেলে কোন মেয়েকে ভাগিয়ে বিয়ে করতে পারে। যে এখনো অফিসে যাওয়ার সময় মায়ের থেকে অনুমতি নিয়ে অফিসে যায়। সে ছেলে কি-না মাকে ছাড়া একা একা বিয়ে করে চলে আসছে!!!
খালামুনি মিনমিন করে খালুকে বলে,
– ও সহেবের বাপ আমারে একটা চিমটি দেন তো আমি মনে হয় স্বপ্ন দেখছি।
খালু খালামুনির থেকে একটু দূরে, আমি খালামুনির পাশে ছিলাম, দিলাম একটা চিমটি খালামুনি উুঁপ করে মুখ কুচকে বলে,
– এই মাইয়া তোরে কইছি চিমটি দিতে? দিলি তো দিলি এতো জোরে কেনো দিয়েছিস? মরার উপর খাঁড়ার ঘাঁ দিতে এক একটা উস্তাদ।

আর কী শুরু হলো দুমদাম কিল সব সোহাইল ভাইয়ের পিঠে। আহারে বেচারা বিয়ে করে নতুন বউয়ের সামনে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেলো। খালু জোর করে খালামুনিকে সরিয়ে আনে। খালামুনি রাগে ফোসফাস করতে থাকে। আমার আম্মু নতুন বউকে ভেতরের রুমে নিয়ে যায়। সোহাইল ভাইও পিছনে পিছনে যেতে গেলে ছোট মামা আটকে দেয়। আর আমাদের সব কাজিনদের আড্ডা ঘরে সোহাইল ভাইকে বসতে বলে।

” ডিসেম্বরে মোটামুটি সবাইর স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকে। তাই সব খালা,মামারা একত্রে হইছে নানার বাড়িতে। অবশ্য আমার নানার বাড়ির পাশে আমাদের বাড়ি, তারপর আরেকটা গ্রামের পর বড়ো খালামুনির বাড়ি। অন্য খালামুনিরা অনেকটা দূরে আছে। আমি ইলিয়ানা হক (ইলমা) আমরা দু’ভাইবোন আমি এবার অর্নাস ফাস্ট ইয়ারে। বেড়াতে এসে এর মধ্যে সোহাইল ভাই এ কান্ড ঘটিয়ে ফেলছে।

সোহাইল ভাই আমাদের সব কাজিনদের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালে দেখে আমরা সবাই দুঃখ পাওয়ার বদলে মিটিমিটি হাসতেছি।
জামির ভাই অতি দুঃখ পাওয়ার ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– সোহাইল ভাই এতো ভোলা ভালা, শান্ত মানুষটা এ কাজ করলো বিশ্বাস হয় না। এটা তো আমার করার কথা ছিলো। আহ যুগ পাল্টানোর সাথে সাথে মানুষ গুলোও পাল্টে যাচ্ছে। একজনের কাজ অন্য জনে করছে, মানবতা আজ কোথায়।

জামির ভাইর কথা শুনে আমরা সবাই কপালে হাত দিয়ে মাথা নাড়ি। এ মানুষটা কখনো সিরিয়াস হবে না। যতোই হাসি এখন ভাই-বোন হিসেবে সোহাইল ভাইয়ে পাশে থাকা দরকার আমাদের। জামির ভাইয়ের কথাটা ঠিক মিথ্যাও না। আমার মায়ের দিকে সব কাজিনদের মধ্যে জামির ভাই দুষ্ট। উনার কাছে যত আজগুবি কাহিনী, আর মেয়ে পটানোর ধান্দায় থাকে। কিন্তু সোহাইল ভাই একেবারে বিপরীত উনি সারাক্ষণ পড়াশোনা, চাকরি নিয়ে থাকতো। বড়ো খালামুনির ছেলে মেয়ে চারোটা একেবারে সিরিয়াস।
বড়োটাকে আমরা সবাই ভয় পায়, উনি যেমন গম্ভীর, তেমনি ইগোস্টিক, কারোর সাথে সহজে কথা বলেন না। কথা বললেও বড়োদের সাথে টুকটাক। যেদিন যেদিন আমাদের সব ভাই-বোনদের পড়াশোনার খোঁজ খবর নেন তখন আমাদের অবস্থা হয় “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি “।

সবাই ভয়ে ভয়ে আছি, না জানি সারাফাত সহেব মিয়াজি, ঘটনাটা কীভাবে নেয়। সোহাইল ভাই কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
– না জানি ভাই কি বলবে, আমি কী করতাম ডালিয়াকে আমি ভালো করে চিনিও না। মেয়েটা বিয়ের সাজে পালিয়ে আসে আমার কাছে। আমার একটা বন্ধুর ভাইয়ের বিয়েতে ওকে দেখছি। টুকটাক কথা হয়েছে, সে থেকে ওর ধারণা আমি ওকে সাহায্য করতে পারি। তাই ওর বাবা জোর করে বিয়ে দিচ্ছে দেখে আমার কাছে চলে আসে, আর বিয়ের প্রপোজাল দেয়। আমিও আর না করেনি। লাস্ট কথা গুলো বলতে গিয়ে সোহাইল ভাই লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

জামির ভাই মুখ বাঁকা করে বলে
– ইশ দেখো কী লজ্জা পাচ্ছে, এই মেয়েদের মতো লজ্জা পাওয়ার নাটক করো না তো। বিয়ে তো ঠিকেই করে নিয়েছো, বিয়ের আগে লজ্জা পেলে এক কথা ছিলো।

আমি এবার জামির ভাইকে থামিয়ে দিয়ে বলি
– চুপ করো তো ভাইয়া, ডালিয়া ভাবিকে সে কখন ভিতরে রুমে নিয়ে গেছে, সবাই ওর সাথে কী করছে কে জানে?
সোহাইল ভাই আর্তনাত করে উঠে বলে,
– আরে তাই তো মা,খালামুনিরা না জানি ওর সাথে কী আচরণ করছে?
তুলি বিরক্ত হয়ে বলে,
– চুপ করবে তোমরা, আমাদের মা-খালারা কী অত্যাচারী শ্বাশুড়ি যে ছেলের বউকে অত্যাচার করবে? এখন ভাবো সব কিছু যেনো ঠিক ঠিক হয়।

জায়িন বিরশ মুখে বলে,
– এর জন্য না আবার আমরা বাশ খায়,
মামাতো বোন তনয়া বলে
– তুশি আপা,আর জেমি আপাও কেমন বিয়ে হয়ে যাওয়া বড়োদের সাথে সাথে থাকে, একবার এসে বলেও যাচ্ছে না ওইখানে কি হচ্ছে?

অনেকটা সময়ের পর,,,,

গাড়ীর আওয়াজ শুনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, গম্ভীর, দাম্ভিক সারাফাত সহেব নামছে। এই তো আমার বে*ঈ*মা*ন মন আমার সায় না দিয়ে ওই রাগী মানুষটাকে দেখে লাফ দিয়ে বাহিরে চলে আসছে। হা*রা*মী আমার মধ্যে থেকেও আমার সাথে বে*ঈ*মা*নী করে। এ মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলছে। আমি জোর করে ঢোক গিলে সব অনুভূতিকে পেটে চালান করে দিই।
জীবনেও আমি আমার অনুভূতি, ভালোবাসার কথা কখনো বলতে পারবো না। এক তো বাবা পছন্দ করে না রিলেটিভদের সাথে কুটুমতা করা, তারচেয়েও বড়ো কথা সহেব ভাইর সাথে আমার যায়ও না। উনি জীবনে সব কিছুতে সাকসেস আর আমি টেনেটুনে যাচ্ছি।
উনি কতো ফর্সা, হ্যান্ডসাম, আর আমি শ্যামলা অনেকেই কালোও বলে। তারপরেও এই যে বললাম না আমার মনটা আমার মাঝে থেকেও প্রতিনিয়তো বে*ঈ*মা*নী করে যাচ্ছে।

সহেব ভাই বাড়িতে আসার পর বড়োরা সবাই ওকে যার যার মতো বলে। খালামুনি বড়ো ছেলেকে ধরে ফ্যাচ ফ্যাচ করে এক দফা কেঁদে বাসিয়েছে।
সব কিছু কেমন নিরিবিলি, যেনো ঝড় আসার আগের পূর্বাবাস।
আমরা সবাই এখনো আড্ডা ঘরে বসে আছি।

সহেব ভাই আড্ডা ঘরে এসে সবাইর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সোহাইল ভাইকে ডেকে নিয়ে যায়। আল্লাহ জানে কি হয়, কিন্তু আমাদের ভাবনাকে ভুল করে, সহেব ভাই সবাইর উদ্দেশে বলে,
– আমি সোহাইল আর ডালিয়ার কথায় বুঝতে পারছি। ওরা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে, আর ডালিয়া যেহেতু বাড়ি থেকে পালিয়ে আসছে সেখানে সোহাইলের তো আর কিছু করার থাকে না। অসহায় মেয়েটাকে তো আর ফেলে চলে আসতেও পারে না। যেহেতু ও নিজেও ডালিয়াকে পছন্দ করে। তবে ডালিয়া এখানে যেমন তোমার ভুল ছিল, তেমন বোকামিও ছিলো। এভাবে বাড়ি থেকে আসা উচিৎ হয়নি, তোমার বাবাকে আগে সোহাইলের কথা বলা উচিৎ ছিলো। তারচেয়েও বড়ো কথা হলো সোহাইল যদি তোমাকে বিয়ে না করতো তুমি তখন কী করতে? কারোর মনে কথা না যেনে তাকে কিছু বলা বোকামি। যায় হোক যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন কয়েক জনকে বলে আবার নতুন করে কাজি ডেকে বিয়েটা করিয়ে দেন।
তারপর আমাদের কাজিনদের সবাইর দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বলে,
– সবাইকে একটা কথা বলে দিচ্ছি, সোহাইল যে ভুলটা করছে সে ভুল যেনো দ্বিতীয় বার আর না হয়, এটা যেনো সবাইর মাথায় থাকে।
সহেব ভাইর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি তুলির অলরেডি কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে। আমি মনে করছিলাম শুধু আমার একারি হাত পা কাঁপছে।
ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ইচ্ছে নেই, নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিয়ে কুল পাচ্ছি না।

খালামুনি ঈশারায় খালুকে কি জেনো বলতে বলে,
খালু হাত উঠিয়ে বলে,
– বাবু আমার একটা কথা আছে, সবাইও উপস্থিত আছে। আমি আর তোমার মা চাচ্ছি, শুধু আমরা না সবাই চাচ্ছে এ ছুটিতে সবাই যখন এক হইছে। সোহাইলও যখন বিয়ে করছে তুমিও সোহাইলদের সাথে বিয়েটা করে নাও। এমন নয় যে তোমার বিয়ের বয়স হয়নি।

সহেব ভাইর বিয়ের কথা শুনে আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। কে জেনো কলিজার ভেতর খামঁচি দিয়ে ধরছে। আমি দম বন্ধ করে সহেব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি, সহেব ভাই কি বলে!!
সবাই সহেব ভাইরের মতামতের জন্য উনার দিকে তাকিয়ে থাকে। উনি সবাইর দিকে তাকিয়ে সবাইর রিয়েকশন দেখে খালুকে বলে,
– আমাকে একটা দিন সময় দাও বাবা,
এ কথা বলে সহেব ভাই নানার রুমে চলে যায়। নানার বাড়িতে আসলে সহেব ভাই নানার রুমে থাকে।
আমি সহেব ভাইর কথা শুনে দম ছাড়ি, সাথে কান্নাটাও ধলা পাকিয়ে গলা অব্ধি চলে আসে। ঢুক গিলে কান্না দমন করতেই গলা জ্বলে উঠে। যেনো কেউ গলায় ছু*রি দিয়ে ফালা ফালা করে দিয়েছে।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে