উজান ঘাটের মাঝি পর্ব-০১

0
592

#উজান_ঘাটের_মাঝি
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
#পর্ব_০১

ফুচকা খাওয়ার সময় থু থু’র শব্দে তিতির নাকমুখ কুঁচকে নেয়।ভ্রু কুঁচকে সামনে দাঁত কেলিয়ে হাস্যময় ছেলেটার দিকে তাকায়।ছেলেটা হেসে বললো,
“থু থু!ফুচকার সাথে মিশিয়ে খেতে মজা না?”

তিতিরের চোখে পানি ঝমে যায়,রাগে শরীর কেঁপে উঠে।চিল্লিয়ে ডাকে,
“বড়োমা,অ বড়োমা।”

“বড়োমা কি হ্যাঁ? খেয়ে বল কেমন।”

“আপনি খেয়ে দেখেন মজা কিনা।”

ছেলেটা গা কাঁপিয়ে হাসে।হাতের আঙ্গুল নেড়ে বললো,
“নো নো।আমি এসব খাই না।তুই চিকনি তুই’ই খা,অনেক ভিটামিন আছে, দেখবি কালকের মাঝেই মোটা হয়ে যাবি।”

তিতির শব্দ করে কেঁদে উঠে।সালমা বেগম ছুটে আসে।মেয়েটা মাত্রই তো প্লেট ভরে ফুসকা নিয়ে গেলো এখনি আবার কি হলো!সোফার কাছে নিজের ছেলেকে দেখে উনি বুঝলেন কেন চিৎকার করছে।তিতির তখনো রাগে ফুসফুস করছে।বড়োমাকে দেখে বললো,
“তোমার ছেলে আমার ফুচকায় থু থু দিয়েছে।কেমন খারাপ ভাবো একবার ?”

সালমা হতভম্ব চোখে উনার ছেলের দিকে তাকায়।এতোবড়ো ছেলের এমন পাগলামি মানা যায় না।আর খাবারের সময় কেউ এমন করে নাকি?বিশ্রী অবস্থা।উনি রাগী গলায় বললো,
“আরফান তিতিরের কথা সত্যি?”

আরফান তার মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখের হাসি প্রসারিত করে।তিতির মুখে হাত চেপে বাথরুমের দিকে দৌড়ে যায়।সালমা বেগম সেদিকে তাকিয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে বললো,
“এতোবড়ো ছেলে এই বাচ্চা মেয়ের সাথে এমন করতে লজ্জা লাগে না?”

আরফান হতবাক হয়ে বললো,
“তোমরা যেমন ওকে বাচ্চা মনে করো ও কিন্তু তা না,আস্ত একটা পাকনা বুড়ি।”

“যাইহোক।তুই এমন কাজ করলি কেনো?”

“দুষ্টুমি করেছি মা।”

“নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ তো,দুষ্টুমির বয়স আছে?”

আরফান হেসে বললো,
“আমি বড়ো হইনি মা।”

“হ্যাঁ বড়ো হসনি কিন্তু কিছুদিন পরে ডাক্তার হবি।”

আরফান মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“সে তো তোমার জন্য হচ্ছি,তুমি এতো অসুস্থ হও তাই ভাবলাম ডাক্তার হয়ে আমিই যত্ন করবো।”

“ভালো সিদ্ধান্ত কিন্তু তিতিরের সাথে আর এমন করবি না।কতোবড়ো হয়েগেছিস তুই!সারাটাক্ষন সময় পেলেই মেয়েটাকে জালাতন করিস।”

“আচ্ছা।”

সালমা বেগম আবার নিজের কাজে ফিরে যায়।তানিয়া আক্তার রান্নাঘরে কাজ করছে,মেয়ের কান্নায় উনার কাজ একটুও থামেনি বরং মনযোগ দিয়ে কাজ করেই যাচ্ছে।চিল্লানো তিতিরের কাজ আর এই চিল্লানোতে আশকারা দেয়া তার বড়ো জা সালমা বেগমের কাজ।উনি ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ফিরে আসলে তানিয়া আক্তার বললো,
“কি নিয়ে ঝামেলা বাধালো ভাবি?”

সালমা বেগম বললো,
“ও কিছু করেনি,আরফান’ই দুষ্টুমি করছিলো।আমার ছেলেটারও না আক্কেল জ্ঞান নেই।”

তানিয়া ঘোর প্রতিবাদ করে বললো,
“আরফান খুব ভালো ছেলে,আমার মেয়েই দুষ্টু।”

তিতির রান্নাঘরে আসতে নিয়েও মায়ের কথা শুনে আর রান্নাঘরে আসলো না।নুপুরের ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দ ফেলে নিজের রুমে চলে গেলো।আরফান সোফায় বসে ছিলো,তিতিরের হেলেদুলে যাওয়া দেখে বললো,
“এতোটুকুন মেয়ের আবার কতো ঢং!”

মানুষের মন যেমন হঠাৎ খারাপ হয়ে যায় গুমরে উঠে বুকের ভেতরটা,চিৎকার করতে ইচ্ছে করে তেমনি বুঝি আকাশেরও এমন লাগে তাইতো তিতিরের সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশ শো শো করে কেঁদে উঠে।মনের গোমট ভাব দূরে ঠেলে পানির মাঝে নিজেকে উজার করে দিতে চায়।তিতির জানালার বিরাট পাল্লা খুলে দেয়,জানালার সাথে লাগোয়া
প্রাচীন আমলের লোহার বড়ো দোলনায় বসে হাটুতে মুখ গুজে উদাস চোখে বাহিরে তাকিয়ে আছে।আরফান সবসময়ই তার সাথে এমন করে।দুষ্টুমি একটু আধটু হলে না হয় মানা যায় কিন্তু উনি একটু বেশীই বাড়াবাড়ি করেন।ঢাকা থেকে প্রতি সাপ্তাহে বাড়ি আসবে আর তিতিরের সাথে সব আজব কান্ডকারখানা করবে।আরফানের জ্বালায় তিতির অতিষ্ঠ।তার মাঝে মাঝে মনে হয় শুধুমাত্র তাকে জ্বালানোর জন্যই আরফান ঢাকা থেকে ছুটে আসে।সে মনে মনে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বললো,
“আরফান আর কখনো ঢাকা থেকে না আসুক,ও ঢাকাই থাকুক।”

আরফান আসলেই তিতিরের সব শান্তি হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিশে যায়।এইতো কিছুদিন আগে তার ক্রাশ মেহমুদ তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিলো তাও কতো মিষ্টি করে কিন্তু কি হলো?কিছু হওয়ার আগেই আরফানের চামচে মানে তিতিরের ছোট ভাই তুহিন সব তার হুজুরকে বলে দিয়েছে।আরফান তাকে আর এক পা ও আগাতে দেয়নি,বকামন্দ করে সেখানেই থামিয়ে দিয়েছে।শুধু বকা দিয়ে উনি ক্ষান্ত হয়নি সাথে বোনাস হিসাবে সাদা ফকফকে গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে গালটা লাল বানিয়ে ছেড়েছে।এতোকিছুর পরে তিতির আর আগানোর সাহস পায়নি।সেখানেই পা থামিয়ে দিয়েছে।যদি পা না থামাতো তাহলে এতোদিনে নিশ্চয়ই তার প্রেম হয়ে যেতো।একটাই প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছিলো তাও ওই অহংকারী লম্বুর জন্য তা হলো না।তিতির কষ্টে ভরা মুখে মেঘের আনাগোনা দেখে,ইশ,এই মেঘের মতো যদি আরফানকে সরিয়ে ফেলা যেতো।কতোইনা ভালো হতো!

শাহাবুদ্দিন খান এই গ্রামের সর্দার।তার পরদাদারা নাকি এককালে এই এলাকার নামি-দামি লোক ছিলো,বংশ পরম্পরায় আগের সেই জৌলুস না থাকলেও প্রাচীন বাড়িটা যেনো কিছুটা আঁকড়ে ধরে রেখেছে।বাড়িটার মতো শাহাবুদ্দিন খান তার আব্বার বড়ো ছেলে হিসেবে বাড়ির মান বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেন।উনার ছোটভাই মহিবুল্লাহ খান আর একমাত্র বোন সুফিয়া খানম।উনাদের বাড়ির নিয়ম অনুসারে সবাই এখনো যৌথ পরিবারেই আছে।তাছাড়া যৌথ পরিবারে থাকার আরেকটা কারণ হলো উনার আম্মা জয়তুন খানমের ইচ্ছে।উনার বয়স হলেও যেনো গলার জোড় কমেনি,নব্বই বছরের শক্ত সামর্থ্য শরীর নিয়ে বেশ হুংকারের সহিত কথা বলতে পারে।তাদের আব্বা মা,রা যাওয়ার পরে জয়তুন বেগমকে সবাই বেশ মান্য করে চলে।শাহাবুদ্দিন খানের এক ছেলে দুই মেয়ে।ছেলের নাম আরফান খান,পড়ালেখায় বেশ তুখোড় ছাত্র,আর কিছুদিন পরে ডাক্তার হয়ে বেরোবে,মেয়েটা এবার কলেজে উঠেছে,খুবই শান্ত আর ভাইয়ের মতো পড়ায় বেশ মনোযোগ,ছোট মেয়েটার সবে পাঁচ বছর।মহিবুল্লাহ’র এক মেয়ে দুই ছেলে।বড়ো ছেলের নাম মাহামুদ খান,সে ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে, মেয়ের নাম তিতির মেহবীন সে কলেজে পড়ে,সবচেয়ে ছোট ছেলের নাম তুহিন খান ।বড়ো বোন
সুফিয়া খানমের স্বামী প্রবাসী।উনিও এই বাড়িতেই থাকে।এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে বাবার প্রাসাদের মতো বাড়িতে দিনকাল বেশ আরামেই চলে যাচ্ছে।ছেলের নাম আরশ আর মেয়ের নাম নিনিয়া।ছেলে সিঙ্গাপুর থাকে।মেয়ে স্কুলে পড়ে।

তিতির দোলনায় শুয়ে আছে তখন তার ফুফুর মেয়ে নিনিয়া এসে বললো,
“আপু চলো।”

তিতির ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
“কোথায়?”

“ফুচকার আয়োজন করা হয়েছে।নিচে বসার ঘরে সবাই অপেক্ষা করছে।”

নিনিয়ার কথায় তিতির মাথা তুলে বললো,
“ফুচকার আয়োজন কে করলো? ”

“আরফান ভাই।”

আরফানের নাম শুনতেই তিতিরের মুখ কালোবর্ণ ধারন করে।আগের মতো দোলনায় শুয়ে বললো,
“আমি খাবো না।”

নিনিয়া ভাবুক হয়ে বললো,
“ভাইয়া তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে।”

“যাবো না।”

নিনিয়া হেসে বললো,
“এতো সুন্দর একটা ছেলে তোমাকে যেতে বলেছে তুমি গায়ে মাখছো না!”

“না।”

“আরে চলো।”

“তুই যা নিনি।আমাকে জ্বালাস না।কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি আমার শরীর ভালো না।”

নিনিয়া চলে গেলে তিতির আগের মতো সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে।তার জন্যই যে এই ফুচকার আয়োজন তা আর কেউ না বুঝলেও তিতির বেশ বুঝতে পারছে।তখন এমন করার কি দরকার ছিলো আর এখনই বা এমন গুষ্ঠিশুদ্ধ মানুষকে খাওয়ানোর কি আছে।আরফান আসলেই আজব মানুষ, উনাকে তিতির একটুও বুঝতে পারে না।
বৃষ্টির মাঝে ঝাল ঝাল ফুচকা সবাই বেশ উপভোগ করেই খেলো।হাবিবা বেগম তিতিরের রুমে ফুচকা রেখে গিয়েছে।তিতির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে।ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু আরফানের উপর রাগ হচ্ছে বিধায় খাচ্ছে না।উনি পরে যদি আবার খোচা দিয়ে কথা বলে।

আরফান কালো গেঞ্জি পরে ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে,খালি পায়ে ঘাস লেগে পায়ে সুড়সুড়ি লাগছে,পুরুষ মানুষ হয়েও তার প্রচন্ড সুড়সুড়ি।অঝোড় ধারার বৃষ্টি তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।তার চোখের দৃষ্টি দোতালার কোনার রুমের দিকে স্থির।মেয়েটার এতো অভিমান!তার উপর এতো অভিমান করা মানায়?সে কি একটুও বুঝে না?নাকি আরফান বুঝাতে অক্ষম।যদি কখনোই কিছু না বুঝাতে পারে তো!
আরফানের বুকে ব্যাথারা লুটোপুটি খায়।

নিচের দিকে তাকিয়ে তিতির চমকে যায়।আরফান বৃষ্টিতে ভিজছে!তাও ক্ষনে ক্ষনে তার রুমের দিকে তাকাচ্ছে।সে উঠে বসে।ইশারায় আরফানকে বুঝায় কি সমস্যা?আরফান হাসে,সুন্দরতম হাসি দিয়ে অবুজ বালিকাকে ঘায়েল করতে চায়,কিন্তু মেয়েটা কিচ্ছু বুঝেনা,সে কি আসলেই অবুজ নাকি অবুজ হওয়ার নাটক করে!তিতির আরফানের নাম্বারে ফোন দেয় আর আরফানকে হাত দিয়ে মোবাইলের ইশারা করে।আরফান বুঝতে পেরে সিড়িতে রাখা মোবাইলের দিকে এগিয়ে যায়।
“হ্যালো।”

তিতির বললো,
“আপনি ভিজতেছেন কেনো?”

“ইচ্ছে হলো।”

“জ্বর আসবে।”

আরফান হেসে বললো,
“ডাক্তারদের জ্বর আসে না।”

“কোথায় লেখা আছে?”

“লেখা থাকতে হবে না,আমি বললেই গিনেসরেকর্ড হয়ে যাবে।”

“কচু।”

“ফুচকা খাসনি কেনো?”

তিতির মিহিয়ে যায়।আরফানের জন্যই যে ফুচকা খায়নি তা না বলে সে বললো,
“ভালো লাগেনি।”

অবুজ বালিকা না বললেও আরফান ঠিকই বাকিকার মনের সুপ্ত অভিমান বুঝে।
“তাহলে আমার জ্বর আসুক,জ্বরে পুড়ে আমি ম,রে যাই,তাহলেই তোর শান্তি।”

“আমার ফুচকা খাওয়ার সাথে আপনার ম,রা বাঁচার কি সম্পর্ক? ”

“তুই একটা বলদ,এতোসব বুঝবি না।”

তিতির আস্তে করে বললো,
“হুহ।”

“তাহলে আমার ম,রা কনফার্ম।”

“আমিতো এমন কিছু বলিনি।”

“বলা লাগবে না।”

তিতির সত্যিই আরফানের এমন পাগলামোর আগামাথা কিছুই খুঁজে পায় না।কিন্তু এভাবে ভিজলে আসলেই জ্বর আসবে।সে বললো,
“খাচ্ছি।”

আরফান কাপড়ে মোবাইল পেচিয়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়।তিতির ফুচকা খাচ্ছে।আরফান এক দৃষ্টিতে তিতিরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুই কতো মিষ্টি তা কি জানিন তিতির ?”

তিতির বৃষ্টির শব্দে কথাটা পুরোপুরি না শুনেই বললো,
“মিষ্টি না ভাইয়া ফুচকা অনেক ঝাল হয়েছে।”

তিতিরের কথায় আরফান হেসে বললো,
“আমি জানিনা আমার কি হবে,আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাবো তিতিরসোনা।”

বৃষ্টিতে তিতির কথাগুলো স্পষ্ট শুনলো না কিন্তু জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি উপহার দেয়।আরফান সেদিকে বিবস চোখে তাকিয়ে থাকে,বুকের ভেতর অনুভূতিরা হুড়োহুড়ি খায়।ইশ অনুভূতি এতো ভয়ংকর হতে পারে!বুকের যন্ত্রণা কি স্ট্রোকের সমস্যা নাকি প্রেমের যন্ত্রনা।ইশ!এই ব্যাথার অবশান কোথায়!

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে