উজানের ঢেউ পর্ব-০১

0
574

#উজানের_ঢেউ ( ১)
#কলমে ✍️ #রেহানা_পুতুল
” আমার কেনো জানি আজকাল তোমার উপর মন বসেনা।”
হঠাৎ তার মুখে নির্দয় বাক্যটি শুনে আশ্চর্য হওয়ার চেয়ে অধিক লজ্জাই পেলাম। ঘোর অপমানিত বোধ করলাম। কোনো স্বামী যখন স্ত্রীকে মুখের সামনে এমন কথা বলেই ফেলে। সে স্ত্রীর জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কিছুই হতে পারেনা। নিতান্তই সহজ সরল কয়েকটি শব্দ মাত্র। তবুও শব্দগুলোর ধার ক্ষুরের চেয়েও শাণিত ঠেকলো আমার কাছে। আমি লজ্জা পেয়েও ওর চোখের সামনে থেকে পালানোর চেষ্টা করলামনা। বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। কেউ কেউ বলে বেহায়া না হলে নাকি ভালোবাসা পাওয়া যায়না। ওকে যে প্রচন্ড ভালোবাসি আমি।
দৃষ্টি নামিয়ে নিচুগলায় জানতে চাইলাম,

” আমি কিভাবে চললে মন বসবে আপনার? বলেন? ”

সে চঞ্চল সুরে বলল,

” জানিনা। এসব বলে কয়ে হয়? তোমার চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। গায়ের রঙ তামাটে হয়ে গিয়েছে। দৈহিক গঠন ও অনাকর্ষণীয়। তোমাকে আজকাল কেমন ভাঙ্গাচোরা বেড়ার ঘরের মতো লাগে দেখতে। ”

” তাহলে আর কেনো জানি বললেন কেনো? কারণতো আপনার রেড়িই আছে দেখছি।”

” যা ভাবো তুমি।”

” তবে কি আমি বাবার বাড়ি চলে যাবো?”

” কি করবে তা তুমিই ভালো জানো।”

” আমি জানলে, বুঝলেতো আপনার মতন করেই চলার চেষ্টা করতাম। আমিতো জানি আমরা স্বামী স্ত্রী। যেমনই হইনা কেনো দুজনের দুজনকে সবসময় ভালোলাগবে।”

” তুমি আসলেই একটা ক্ষ্যাত গাইঁয়া মেয়েলোক। কেবল গাধার মতন সংসারের সবকাজ করতে পারলেই হয়না। পুরুষের রূচি বুঝে তাকে নিজের করে ধরে রাখার কৌশলটুকুও জানতে হয়। যেটা তুমি জানইনা।”
দারুণ তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলল সে।

” তাহলে আমি আজ থেকে চেষ্টা করে দেখবো।” ধীর গলায় বললাম।

সে কিছু বললনা আর। আমার উপর প্রগাঢ় বিরক্তি প্রকাশ করে বাড়ির সামনের দিকে চলে গেলো।

#রেহানাপুতুল পেইজে like ও Follow দিয়ে প্রেরণা দিবেন কলম চলমান রাখার জন্য। প্লিজ।

আমি তৎক্ষনাৎ ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তীক্ষ্ণ চাহনিতে নিজের পেলব অঙ্গখানির দিকে তাকালাম। নাহ আশরাফুল একদন্ডও মিথ্যে বা ভুল কিছু বলেনিতো। আমার নজরকাড়া আঁখিতলে কালি জমে গিয়েছে। ফর্সা গায়ের রঙ পাংশুটে আকার ধারণ করেছে। দিঘলকেশী চুল উসকোখুসকো হয়ে গিয়েছে। মা হওয়ার জন্য তলপেটে বুকে মাতৃত্বের উজ্জ্বল দাগ পড়ে গিয়েছে। কলুর বলদের মতো খেটে খেটে রূপ লাবন্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এমনতো হয়েছে তাদের সংসারে খেটে খেটেই।

আশরাফুল এটা কেনো একবারও ভাবলোনা। বিয়ের সময়তো আমি তার পছন্দই ছিলাম। দেখেশুনেইতো সে বিয়ে করলো আমাকে। সুডৌল বুকের দিকেও একবার চাইলাম। হেলে গেলো নাকি আশরাফুলের ভাষ্যমতে?
আশরাফুলের কথাগুলো কি আমার জীবনে আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস? ভেবেই হতাশ মনে ঘরের বাইরে পা রাখলাম। শাশুড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি পিছনের উঠানে বেতের মোড়া তৈরি করছেন। আমার চোখমুখে দুঃখী দুঃখী ছাপ দেখে নিজ থেকেই জানতে চাইলেন,

” ঝগড়া করে এলে নাকি জামাইয়ের লগে?”

“নাহ আম্মা।”

” তাহলে মুখ অমন ছাঁইরঙা হইয়া আছে ক্যান? তোমাগো বাড়ির থেইকা মোবাইল আইছেনি? কারো অসুখ বিসুখ নাকি?”

” নাহ আম্মা। বাড়ির জন্য মন পুড়তেছে। কয়দিনের জন্য যেতে চাই।”

প্রসংগ পাল্টিয়ে ফেললাম, হুট করে শাশুড়ীকে বিষয়টা জানানো ঠিক হবেনা ভেবেই।
আম্মা বললেন,

” আমি না হয় যেতে দিবো। কিন্তু আশরাফুল বিদেশ থেইকা আইলো মাসখানেক হইলো কেবল। সে যাইতে দিবো তোমারে? তারে জিগাও আগে।”

” আম্মা উনি মনে হয় যেতে দিবে। তেমন কিছুই মনে হলো।”

” যার বউ তার আপত্তি না থাকলে আমাদেরও কোনো আপত্তি নেই।”

সরস হেসে বললেন আম্মা।
বিয়ের আগে চাচাতো, খালাতো,মামাতো বোনদের কাছে শুনতাম, বেশিরভাগ বিবাহিত মেয়েদের জীবনে এক আতংকের নাম হলো শাশুড়ী।
আমিও বিশ্বাস করতাম তখন ওদের মুখের অভিব্যক্তি দেখে। কিন্তু বিয়ের পরে আমার এই বিশ্বাস ও ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হলো। বরং প্রমাণ হতে যাচ্ছে কারো কারো জীবনে স্বামীও হতে পারে এক আতংকের নাম। যদি তাই না হতো, তাহলে কোনকালে কে শুনেছে,চেহারা ভেঙ্গে গেলে,গায়ের রঙ নষ্ট হলে, দৈহিক সৌন্দর্য কমে গেলে স্ত্রীর উপর মায়া কমে যায় স্বামীর। ভালোবাসা মিলিয়ে যায় বাতাসার ন্যায়।

সেদিন বেলা না ফুরোতেই কাপড়চোপড় গুছিয়ে আমার একমাত্র দুই বছরের ছেলে রাজনকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেলাম একাই। যাবার আগে সলাজ নয়নে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনি কি চান আমি আর ফিরে আসি আপনার জীবনে?”

” আমার জীবনের কথা ভুলে যাও। কিন্তু এই সংসারের জন্য ফিরে এসো।”

ও এতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাক্যটা উচ্চারণ করলো। শুনে মনে হলো ও নিজেই যেনো একশো শাবল দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে আমার বুকের ভিতরে একটা বিষাদের গভীর কূয়ো খনন করে দিয়েছে। আর মনে মনে উল্লাস করে বলছে,
” রত্না যত ইচ্ছে তোমার দুঃখ,বেদনাকে এই কুয়োর মাঝে স্তুপাকারে সঞ্চিত রাখতে পারবে। কোন সমস্যা হবেনা। উগরে বের হবেনা। কেউ জানবেনা।”

” কোন পরিচয়ে ফিরে আসবো এ সংসারে? ”

” উদ্ভূত! তোমার আদিখ্যেতা দেখলে বাঁচিনা। কোন পরিচয়ে আসবে মানে? যে পরিচয়ে এতদিন ছিলে সেই পরিচয়ে আসবে। তোমাকে কি আমি তাড়িয়ে দিচ্ছি নাকি?”

পাষাণের মতো ও যখন কথাগুলো বলল,
ওই মুহূর্তে আমি ওর চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করেছি। দেখলাম সেখানে জমা রয়েছে আমার জন্য রাশি রাশি উপেক্ষা,অনাদর,অসম্মান। কথা বাড়ালাম না আর। পা বাড়িয়ে হাঁটা ধরলাম। ও রাজনকে কোলে নিয়ে আমার পায়ে পায়ে হেঁটে এলো বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত। রিকসায় তুলে দিলো। করুণার মত হাত বাড়িয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিলো কিছু টাকা। আমি নিরুপায়। নিতে হলো আমার একমাত্র ছেলের কথা ভেবেই।

বাবা, মা, ভাইবোনেরা আমাকে দেখে কিছুটা চমকে গেলো। তবে ভড়কে গেলনা। শাশুড়িকে বলা কথাটাই ওদেরও বলতে হলো। নয়তো কথার মিল না থাকলে ঝামেলা হতে পারে। আশরাফুলকেও তাই শিখিয়ে দিলাম। পরিস্থিতি নিজেই সামলে নেয়ার উপায় খুঁজতে লাগলাম।

রাজনকে ঘুম পাড়িয়ে ভাইবোনের পড়ার রুমে ঢুকলাম। বুক সেলফ থেকে বুদ্ধদেব বসুর প্রথম নাট্যগ্রন্থ ‘ তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বইটা নিলাম। কলেজে পড়ার সময় এই বইটা কিনেছি। বইয়ের পাতা উল্টিয়ে চলে গেলাম কাঙ্ক্ষিত পাতায়। যেখানে বর্ণিত আছে অসাধারণ সুন্দরী বারবনিতা ‘তরঙ্গিণী’ র কথা। যাকে পুরুষবধের প্রেম,ছলা,কলা,ভক্তির সবক শেখানো হয়। যে হয় ছলা কলায় শীর্ষে। যার অঙ্গুলী হেলনে যে কোনো পুরুষোত্তমের হৃদয় হেলতে সময় নেয় না অনুক্ষণের।

আশরাফুলের মতো পুরুষদের অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো নারীর রূপের স্তুতি গাওয়া। এরা জীবনের সুখ আহরণ করে নারীর বাহ্যিক রূপসুধা থেকে। এদেরকে তুলনা করা যায় উড়ে উড়ে মধু খাওয়া ভ্রমরের সাথে। এরা হীরের কদর বোঝেনা। ঠুনকো আঘাতে গুঁড়িয়ে যাওয়া চকচকে কাঁচকে খুব গুরুত্ব দেয়। অতি মূল্যবান মনে করে যত্ন করে।

পড়া শেষে বই রেখে দিলাম। ইউটিউবে রূপচর্চা, শরির চর্চা,স্কিন কেয়ার,মেনিকিউর,পেডিকিউর,ত্বকের যত্ন,বডি ফিটনেস যা আছে একেএকে সবগুলো ভিডিও দেখলাম। বড় মার্কেটে গেলাম ছোটবোন রাবুকে সঙ্গে করে। সব ধরনের ক্রিম এবং প্রয়োজনীয় সব উপাদানগুলো কিনে নিলাম। নিয়ম করে সকাল, বিকাল, রাতে রূপচর্চা করতে লাগলাম। দুদিন না যেতেই মায়ের নজরে পড়ল বিষয়টা। মা কিঞ্চিৎ অবাক হলো।

কৌতুহল নিয়েই জিজ্ঞেস করল,
” কিরে রত্মা। আচম্বিতে নিজের যত্ন নিচ্ছিস? জামাই কিছু বলছে নাকি তোর চেহারাসুরত নিয়ে?”

আমার ভিতরটা নড়ে উঠলো মায়ের কথা শুনে। এইতো হলো শ্রেষ্ঠ মা। সন্তানকে নিয়ে যার অনুধাবন ক্ষমতা সবার চেয়ে বেশী। দোনোমোনো শুরু করলাম ইতিউতি চেয়ে।

” প্রবাসী জামাই দেশে। তুই চলে এলি একা বাবার বাড়ি। আমার দিলে খচখচানিটা তখনই শুরু হয়েছে। তোকে চোখে চোখে রাখছি। মনে মনে দেখছি। নিশ্চিত হওয়ার জন্য।”

উদ্বেগ নিয়ে বলল আমার মা। আমি নরম গলায় মাকে বললাম,

” মা ওর নাকি এখন আমার প্রতি কোনো টান কাজ করেনা। আমার জন্য ওর দু’চোখভরা অবজ্ঞা দেখেছি। তাই তার আড়ালে চলে এলাম। আগের মতো কিছুটা হলেও নিজের রূপ-মাধুর্য ফিরিয়ে আনার ঐকান্তিক চেষ্টায়।”

শুনে মা নিদারুণ কন্ঠে বলল,

” একদম বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছিস। কারো সামনে খড়কুটো হয়ে থাকার চেয়ে আড়ালে এসে জীবের মতো থাকা উত্তম।”

আশরাফুলের কিছু নিষ্ঠুর কথা আমার মৌনাকাশে রাশি রাশি মেঘপুঞ্জ হয়ে ভাসতে লাগলো অবাধ আধিপত্য নিয়ে। এর শেষ পরিণতি কি আমি জানিনা।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে