আলো আঁধার পর্ব-১১

0
916

#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা: সালসাবিল সারা

১১.
সকালে উঠে রাণী মাটি নিয়ে বসে পড়েছে।আজকের কিছু অর্ডারের জিনিস বানানোর চেষ্টা করছে সে।আজ তার প্রধান কাজ হল, মাটি দিয়ে জিনিস গুলোর আকৃতি দেওয়া।বাকি কাজ অন্যরা করবে।তার উপর আজ থেকে রাণী যাবে তূর্যয়ের অফিসে।রাণী সেই অফিসে কি পদে নিয়োজিত সেটা রাণী নিজেও জানে না।গতকাল রাতে হ্যারি ফোন করেছিল রাণীদের মোবাইলে।তখন হ্যারি রাণীকে বলেছিল, দুপুর বারোটার দিকে অফিসে হাজির হতে। অফিসের সময় শুনে রাণী যেনো আকাশ থেকে পড়লো।এই সময়ে শুধুমাত্র রাণীই মনে হয় একমাত্র মানুষ, যে সেই অফিসে যাবে।কারণ,সাধারণত অফিসের সময় শুরু হয় সকাল নয়টা বা আটটা থেকে। এই খবর রাণী অন্যদের জানালে তারা নিজেরাই সমান অবাক হয়।সিমি আর রিয়া তো হাসতে হাসতে কুপোকাত হয়েছিল।রাণীর প্রতি অন্য মেয়েরা এখনো অনেক নিচু চোখে তাকাচ্ছে।সুযোগ পেলে রাণীকে দুই চারটা কথাও শুনিয়ে দিচ্ছে।রাণীও কম না।রাণী তার কথার ঠিকই প্রতিবাদ করেছে।রাণীর এইসব কথা এতিম খানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে।বাহিরের কেউ এইসব কথা জানেনা।তবে, এতিম খানার ভেতরের মানসম্মানকে রাণীর মুখ্য মনে হয়। আজকে দুই জায়গা থেকে অর্ডার এসেছে মাটির জিনিসের।সকালের নাস্তা শেষ করেই রাণী মাটির সাথে মেতে উঠেছে।তার সাথে হাত লাগিয়ে কাজ করছে রিয়া আর কলি।রাণী মূলত মাটি দিয়ে কাঠামো তৈরি করছে।রাণীর তৈরি এই কাঠামো বেশ শক্তপোক্ত হয়।তাই এই প্রধান কাজটা রাণী করে।রিয়া আর কলি এই মাটির জিনিস আগুনে পোড়াবে ও পরে রং করবে।সবটা বানানো শেষ করে রাণী উঠে পড়লো বসা থেকে।হাত ধুয়ে নিজের ওড়নায় হাতের পানি মুছতে মুছতে রাণী অন্যদের বললো,”কাজ শেষ করে জিনিসগুলো জায়গা মতো পাঠিয়ে দিস।আর টাকা হাতে পেলে তোরা ভাগ করে নিয়ে এরপর আমারটা আমাকে দিস।” রিয়া উঠে পড়ল রাণীর এমন কথায়। সে রাণীর হাত ধরে বললো,”আগে যেমন তুই ভাগ করে দিতি টাকা,ঠিক তেমনই হবে এখন।” রিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে কলিও বলে উঠলো,”হ্যাঁ,একদম।তুই এইসব নিয়ে ভাবিস না।আমরা সবাই তোর সাথে আছি আর তোর সাথেই থাকবো সারাজীবন।” রাণী হাসলো বাকিদের কথায়।রাণী একটু কান্না কান্না ভাব নিলে তখন আবারও রিয়ে বলে উঠলো,”এই কান্না করবি না একদম! আমি জানি আমাদের মতো বন্ধুবী পাওয়া এতো সহজ না।এখন যা তুই তূর্যয়ের অফিসে।এই লোকের অফিস টাইম শুনে আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।” রাণী হেসে উঠলো রিয়ার কথা শুনে। রাণী হেসে তাদেরকে বললো,”এই লোকের কাজ কর্মের আগা মাথা যেমন নেই,তেমন এই লোকের কাজের কোনো সময় নেই।আচ্ছা আমি যায়।এগারোটা বাজতে চললো।” রাণী কথাগুলো বলে নিচে নেমে এলো ছাদ থেকে। রাণীর মাথায় ঘুরছে,”অফিসে যেতে বললো দুপুর বারোটায়।কিন্তু অফিসের ছুটি কয়টায় হবে এটাই তো বললো না!এই ভিনদেশী ভাইটাও কেমন?সব কিছুতেই তাড়াহুড়ো করে।ভালো করে কথায় বললো না কাল রাতে। ঐ তূর্যয় যেমন চালু, ভিনদেশী ভাইয়টাও তেমন চালু।তবে আমার মতে, ভিনদেশী ভাই তূর্যয়ের মতো এতো হিংস্র না!” রাণী নিজ মনে কথা বলে হাঁটতে লাগলো।রুমে যাওয়ার আগেই তার দেখা হলো চেরির সাথে। চেরি কোমরে হাত দিয়ে রাণীকে বললো,”শুনলাম তোর নাকি চাকরি হয়েছে তূর্যয় বড় সাহেবের অফিসে?” রাণী চেরির কথায় বললো,” চাকরি আর কি? উনার কাছে সাহায্য চেয়েছি বিনিময়ে উনি আমাকে কাজে রেখে দিলেন।উনার মতো বড় মাপের মানুষ তো আর আমাকে সহজে সাহায্য করবেন না।” চেরি হাত বুলালো রাণীর কাঁধে।আর মুচকি হেসে বললো,” চিন্তা করিস না।করবে উনি হেল্প।আর হ্যাঁ,ঠিক বলেছিস।লোকটা স্বার্থপর হতে পারে,তবে খারাপ না।আমি রাত কাটাতে গিয়েছিলাম না উনার কাছে?কিছুই করেননি উনি বরং কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন আমাকে রুমের বাহিরে।হাহা।” চেরি হাসছে কথাগুলো বলে।সাথে রাণী হেসে উঠলো।রাণী হেসে বললো,”হ্যাঁ, মনে আছে আমার কথাগুলো।কিজানি বাবা কেমন উনি!আমার কাছে তো উনাকে একটা দৈত্যের মতো লাগে।আর অনেক হিংস্র মনে হয়।” রাণীর কথায় চেরি কিছু বলতে পারলো না।এর আগেই সালেহার কথায় চেরি দৌড় দিল।সালেহা রাণীর কাছে এসে বলতে লাগলো,”এর আগেও বলেছি তূর্যয়ের ব্যাপারে উল্টো পাল্টা কিছু না বলতে। যেটা জানিস না সেটা নিয়ে কথা তো একদমই বলবি না। মানুষ সব সময় খারাপ হয় না। সময় তাকে খারাপ হতে বাধ্য করে।হতে পারে তূর্যয়ের সাথে এমনটা হয়েছিল। যাক, এতো কথা না বলে নিজের কাজে লেগে পড়।” সালেহা চলে যেতে নিলে রাণী আবারও তাকে বললো,”যতবারই আমি তূর্যয়ের ব্যাপারে খারাপ কিছু বলি, ততোবারই আপনি আমাকে চুপ করিয়ে রাখেন। আপনি কি কিছু জানেন তূর্যয়ের সম্পর্কে?” রাণীর প্রশ্নে সালেহা যেনো ঘাবড়ে গেলো।সে আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,” জলদি ফিরে আসবি।আর বেশি দেরী হলে নাজিমকে ফোন দিবি।সে নিতে আসবে তোকে।” সালেহা কথাগুলো বলে চলে গেলো।রাণী অবাক হয়ে সালেহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।তবে রাণীর মাথায় বেশি কিছু আসছে না এখন।তারপরও রাণীর মনে হচ্ছে,”সালেহা ম্যাডাম নিশ্চয় তূর্যয়ের ব্যাপারে কিছু জানেন।কিন্তু এদের মধ্যে আসল কাহিনী কি?উফ,সব জানা হয়ে যাবে রাণী তোর।আগে তুই অফিসে যা।সেখান থেকেই এই তূর্যয়ের সকল রহস্য সম্পর্কে জানতে পারবি।” রাণী দ্রুত ছুটলো নিজেদের রুমের দিকে।রুমে ঢুকতেই সে দেখলো সিমি ফোন নিয়ে বসে আছে। রাণী সেদিকে তাকিয়ে রুমে থাকা আলমারি থেকে একজোড়া কামিজ সেট বের করলো।সেটি কাঁধে নিয়ে রাণী একটু ঢং করে সিমিকে রাণী বললো,”কি!আজকাল দেখছি মোবাইলটা নিয়ে বেশি বসে থাকা হয়? প্রেম ট্রেম হচ্ছে বুঝি?” রাণীর কথায় সিমি মুখে লজ্জা এনে বললো,”আরে না।এমনিই সময় পার করছিলাম। যা তুই।অনেক দেরী হয়ে গেলো।” রাণী সিমির কথায় এক নজর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে “আল্লাহ্ রে!” বলে চলে গেলো বাথরুমে।গোসল সেরে রাণী তার গলায় একটা মলম লাগিয়ে নিল।এটা কাল তূর্যয়ের অফিস থেকে ফেরার সময় হ্যারি কিনে দিয়েছিল। ভেজা চুল খোঁপা করে নিয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে বেরিয়ে গেলো রাণী।ব্যাগের মধ্যে পানির বোতলটা নিয়ে নিল সে।তার আবার পানির প্রয়োজন হয় বেশি।সিমির কাছেই রেখে গেলো রাণী,তাদের মোবাইলটা।টেম্পুতে বসে রাণী দোয়া করছে,তাড়াতাড়ি যেনো সে অফিসে পৌঁছিয়ে যায়।দেখা গেলো ঠিকই জলদি চলে আসলো সে অফিসে।তবে তার সামান্য দেরী হলো।এর জন্যেই রাণী ভয়ে শেষ।সে মনে মনে বলতে লাগলো,”ঐ শয়তান যেনো অফিসে না থাকে,আল্লাহ্।আমার এই অল্প দেরী যেনো কারো চোখেই না লাগে।” গেইটে যেতেই রাণীকে দারোয়ান একটা কার্ড ধরিয়ে দিল।দারোয়ান শক্ত মুখে রাণীকে বললো,”এই কার্ড দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে।” রাণী মাথা নাড়ালো।চারদিকে চোখ বুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাণী অফিসের বড় কাঁচের দরজার সামনে চলে এলো। তার হাতে থাকা কার্ডটি কাঁচের দরজার পাশে লাগানো একটা মেশিনে লাগালো।আর সাথে সাথেই দরজা খুলে গেলো।গতকাল এই সিস্টেমে রাণী হ্যারিকে অফিসে ঢুকতে দেখেছিল।তাই রাণী খুব সহজে এই অফিসের নিয়ম বুঝে গেলো।অফিসের ভেতর ঢুকতেই রাণীর বুক ধুকধুক করতে লাগলো।সব কালো পোশাক পড়নে স্বাস্থ্যবান লোকের মধ্যে রাণী একটা মেয়ে।রাণীর হাত ঘামাতে শুরু করলো চিন্তায়।রাণী কোনদিকে যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না।এর মধ্যেই রাণী একটা ঝাড়ুদার মহিলাকে দেখতে পেলো।রাণী আর পথ খুঁজে না পেয়ে সেই মহিলার দিকে এগিয়ে যেতেই তার কানে ভেসে এলো হ্যারির শব্দ,”কুইন?” রাণীর পা থেমে গেলো।পেছনে ফিরতেই সে দেখলো তূর্যয়,হ্যারি সাথে আরো কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে।তূর্যয় এবং বাকি লোক সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো আর হ্যারি রাণীর দিকে এগিয়ে আসছে।রাণী তাকিয়ে আছে তূর্যয়ের দিকে।তূর্যয় ঢং করে দাঁড়িয়ে আছে পকেটে হাত দিয়ে।তূর্যয়ের চোখে কালো চশমা থাকায় রাণী বুঝতে পারছে না তূর্যয় কার দিকে তাকিয়ে আছে! তূর্যয়কে দেখে রাণী মনে মনে বলতে লাগলো,”গুন্ডা মানুষের ঢং কতো?সন্ত্রাসী মানুষের কি এতো দামী আর সুন্দর কাপড় পড়া লাগে?এরা ছেড়া জামা পড়লেও সন্ত্রাসী থাকে আবার দামী কাপড় পড়লেও সন্ত্রাসী থাকে। ইস,ভাব দেখলেই গা জ্বলে উঠে।” হ্যারি রাণীর সামনে আসতেই রাণী হ্যারির দিকে তাকালো।হ্যারি রাণীর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,” তুমি এসেছো!” রাণী হ্যারির কথায় বলে উঠলো,” কই না তো?” হ্যারি নিজের হাসিমুখ বন্ধ করে রাণীকে বললো,”আর ইউ অ্যাংরি উইথ মি?” রাণী বাঁকা চোখে তাকালো আবারও তূর্যয়ের দিকে।সে তূর্যয়ের দিকে চোখ রেখেই হ্যারিকে বললো,”আমার রাগ হওয়া আর না হওয়াতে কিছু যায় আসে না কারোই।এখন বলুন কি কাজ করতে হবে?” হ্যারি অসহায় কণ্ঠে রাণীকে বললো,”সরি সরি। আই অ্যাম সো সরি।প্লিজ তোমার এই ভাইকে ফর্গিভ করো।আর কখনো এমন কাজ করবো না।” হ্যারির মুখে ভাই শুনে রাণীর মনে মোচড় দিয়ে উঠলো।ভাই,মা,বাবা,বোন এইসব রাণীর ভাগ্যে আসেনি কখনোই।এখন হ্যারির মুখে “তোমার এই ভাই” কথাটি শুনতেই রাণীর মন একদম গলে গেলো।সে ধীর কণ্ঠে হ্যারিকে বললো,”ঠিক আছে।ক্ষমা করেছি।” হ্যারির মুখ চিকচিক করে উঠলো খুশিতে।সে রাণীর হাত ধরে বললো,”থ্যাঙ্কস আ লট, সিস।আর তোমার কাজ একটু পরেই জানতে পারবে।আপাতত তুমি তূর্যয় ব্রো এর কেবিনে বসো।আমরা মিটিং রুমে যাচ্ছি এখন।ততক্ষণ সেখানেই অপেক্ষা করো।এইখানের অন্যসব রুমে সব বয়।ইউ উইল ফিল আনকম্ফোর্টেবল দেয়ার। সো,ওয়েট করো ঐ কেবিনে।” রাণী মাথা নাড়লো।কালকে রাণী যে পথে এসেছিল সেই পথেই হেঁটে যাচ্ছে সে,তূর্যয়ের কেবিনের দিকে। হ্যারি তূর্যয়ের কাছে গিয়ে তূর্যয়কে ডেকে উঠলো,”ব্রো?” তূর্যয়ের কোনো হেলদুল নেই। সে তাকিয়ে আছে রাণীর যাওয়ার দিকে।এতক্ষণ যাবত রাণীর চোখের দিকেই তাকিয়ে ছিল তূর্যয়।কেমন চোখ ছোট করে কথা বলে মেয়েটা।এমন চোখজোড়া তূর্যয় আগেও দেখেছিল।কিন্তু কোথায়? বরাবরের মতোই তূর্যয়ের মনে আসে না রাণীকে সে কোথায় দেখেছিল! হ্যারি আবারও তূর্যয়কে ডেকে উঠলে, তূর্যয় ভারী গলায় হ্যারিকে বললো,”সমস্যা কি?” হ্যারি তূর্যয়কে বলে উঠলো,” কোথায় লস্ট গেলে তুমি?কাকে দেখছিলে এতক্ষণ?কুইনকে বুঝি?” তূর্যয় এখনো সেদিকে তাকিয়ে হ্যারিকে বললো,”হুঁ”।হ্যারি খুশি হয়ে আবারও তূর্যয়কে প্রশ্নে করলো,”ইজ ইট ট্রু? তুমি কুইন এর দিকে তাকিয়ে ছিলে?” হ্যারি তূর্যয়ের হাতে নাড়া দিলো।তখনই তূর্যয়ের হুঁশ ফিরে এলো। সে ভ্রু কুঁচকে হ্যারিকে বললো,”নাহ!আমি কেনো মেয়েটার দিকে তাকাবো? বাই দা ওয়ে,মেয়েটা গেলো কই?” কথাটা বলে তূর্যয় হাঁটতে লাগলো।
তূর্যয়ের সাথে বাকি সবাই তাল মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করল।হ্যারি তূর্যয়ের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“তোমার কেবিনে ওয়েট করতে বলেছি কুইনকে।মিটিং শেষে আমরা যে মিশনে বের হবো তাকে সেখানে নিয়ে যাবো।” হ্যারির এমন কথায় তূর্যয় রাগী কণ্ঠে বলল,”কি?আমার কেবিনে?মাথা ঠিক আছে তোমার?অফিসে কি জায়গা কম আছে অপেক্ষা করার?আর আমাদের মিশন কত ভয়াবহ হয় সেটা তুমি ভালোই জানো।সেখানে এই মেয়ের কাজ কি?”
তূর্যয় লিফটে উঠে পড়লো।সাথে হ্যারি আর বাকি সবাই উঠলো লিফটে।হ্যারি তূর্যয়কে উত্তর দিল,”আমাদের সাথে যারা ওয়ার্ক করে তারা মোটেও গুড পার্সন না। এন্ড ওরা রাণীর মতো বিউটিফুল মেয়ে পেলে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু করতে চাইবে। যদিও তুমি অপরাধী কে পরে কিল করে ফেলবে,কিন্তু তুমি কি পারবে কুইন এর গায়ে লেগে থাকা আঘাতের মার্কটা মুছতে?” হ্যারির কথায় তূর্যয়ের গায়ে যেনো কেউ কাঁটা বিঁধে দিলো।তূর্যয়ের মাথায় কেনো এইসব কথা আসেনি,এটা ভাবতেই অবাক হচ্ছে তূর্যয়।তার মাঝে এতটাই হিংস্রতা চলে এসেছে,সে এখন সাধারণ চিন্তাটা করতে পারে না।তার মাথায় সব সময় হিংস্র চিন্তায় ঘুরে।তূর্যয় চুপ করে গেল।তার মাথায় রাণীর বলা নানান কথা ঘুরছে।তূর্যয়ের মনে আছে রাণী কালকে তূর্যয়কে বলেছিল,
“সন্ত্রাসীদের দরদ দেখানো শোভা দেয় না।” আসলেই তো,তূর্যয় কখনোই কাউকে দয়া করেনি।সবসময় হিংস্রতা দিয়ে সব করেছে।একসময় তার দিন ছিলো অন্যরকম।আর এখন!তার দিন হিংস্রতায় ঘেরা।চেয়েও সে স্বাভাবিক চিন্তা করতে পারে না।তূর্যয় মনে মনে ভাবছে,”এইযে আজও,হ্যারি কি সুন্দর রাণীর জন্যে চিন্তা করে তাকে আমার অফিসে বসিয়ে দিলো!আর আমি?আমি কি?আমি ঠিক আছি।আমি এমনই ভালো আছি।আমি গ্যাংস্টার।আমার তো আর নরম হলে চলবে না!হ্যারি আছে নরম চিন্তা করার জন্যে।আমি পাথর।আমি হিংস্র।আমি হিংস্রই থাকতে চাই।” তূর্যয় তার মনে নানা কথা বলছে।মিটিং রুমে বসতেই দুইটা বড় গ্যাংস্টার গ্রুপ তাদের বিশাল আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

রাণী আজ তূর্যয়ের কেবিনের চারদিকে হেঁটে দেখছে।গতকাল তো সে এই অফিসের কেউ ছিল না। তাই সোফা থেকেই উঠেনি।কিন্তু আজ,সে এই অফিসেরই একজন।তাই তার বসের রুম দেখার তার অধিকার আছে।এই ভাবনা নিয়ে সে তূর্যয়ের কেবিন রুম দেখছে।তূর্যয়ের টেবিলে নেইম প্লেট বেশ সুন্দর করে লিখা আছে “তাশরীফ তূর্যয়।” রাণী হাত ছোঁয়ালো সেই নেইম প্লেটে। টেবিলের উপর রাখা আছে এক সুন্দর মেয়ের ছবি।রাণী বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো।মেয়েটির চোখ আর তূর্যয়ের চোখ একদম একই লাগছে রাণীর কাছে।রাণী আরেকটু কাছ থেকে ছবিটি দেখতে গেলে,
রাণীর হাতের সাথে লেগে কিছু ফাইল পড়ে যায় ফ্লোরে।রাণী দ্রুত সেই ফাইল আর সেখানে থাকা কাগজ এক করার চেষ্টা করছে।ভেজা চুলে খোঁপা করায় রাণীর মাথাটা যেনো ভার লাগছে।যার কারণে রাণী মন দিয়ে কাগজ মেলাতে পারছে না।তাই রাণী মাথা থেকে ওড়না খুলে চুলগুলো মেলে দিলো। ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে নাড়িয়ে ঠিক করার চেষ্টা করছে সে।

মিটিং শেষ করে তূর্যয় নিজের কেবিনে এসেছে।ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে দরজা খুলতেই সে দেখলো, রাণী তার নিজের চুলগুলো নিয়ে কিছু করছে।তূর্যয়ের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলেও তূর্যয় অবাক চোখে রাণীর দিকে তাকিয়ে রইলো।না চাওয়া সত্বেও তূর্যয়ের মনে ধুকধুক করতে লাগলো।এইসব কেনো হচ্ছে কিছুই মাথায় আসছে না তূর্যয়ের। সে আপাতত রাণীর মুখ কুঁচকানো আর চুল থেকে পানি ঝাড়ার দৃশ্য দেখছে। রাণী তার চুল সেট করে নিচে বসে ফাইল ঠিক করতে গেলেই তার চোখ গেলো তূর্যয়ের দিকে।তূর্যয় সেই আগের মতো প্যান্ট এর পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে রাণী ভয়ে উঠে পড়লো।রাণী আমতা আমতা করে বললো,”সরি।আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।” রাণীর কথায় তূর্যয়ের ধ্যান ভাঙলো।নিচে পড়ে থাকা ফাইল দেখে মুহূর্তেই
তূর্যয়ের মাথায় ভর করলো এক বিশ্রী রাগ।সে দ্রুত পায়ে হেঁটে রাণীর হাত চেপে ধরে তাকে চিল্লিয়ে বললো,”হাউ ডেয়ার ইউ?আমার জিনিসে হাত লাগানোর সাহস কি করে হয়?কেনো যে হ্যারি এইসব মেয়েকে কাজে রেখেছে?এই মেয়ে?আমার জিনিস ধরার সাহস আসে কোথা থেকে তোর?” রাণীর অন্তর কাঁপছে ভয়ে।তূর্যয়ের গর্জনে যেনো রাণী এখনই বিস্ফোরিত হবে।তাও রাণী সাহস জুগিয়ে বললো,”স..সরি,ঠিক করে দিচ্ছি।আর আপনি না জেনে শুনে আমার উপর এইভাবে চিল্লাতে পারেন না।” তূর্যয় আরো জোরে চেপে ধরলো রাণীর হাত।তূর্যয় দাতে দাঁত চেপে রাণীকে বললো,”আমি তাশরীফ তূর্যয়।আমি কারো থেকে জ্ঞান নিই না।আমার কি করতে হবে না হবে সেটা আমি জানি।তুই এখনি বেরিয়ে যা এইখান থেকে।” রাণীর চোখে পানি চলে আসলো। সাধারণত এইসব ধমকে কান্না আসে না তার।তবে আজ এই ভয়ংকর লোকের গর্জনে রাণীর চোখে পানি এসে গেলো।রাণী নরম কণ্ঠে বললো,”আপ..আপ..
আপনি তো বললেন আমাকে এইখানে কাজ করতে।” রাণীর কণ্ঠ শুনে তূর্যয়ের নজর শান্ত হয়ে এলো।রাণীর কান্নামাখা চোখের দিকে তাকিয়ে তূর্যয় হাত ছেড়ে দিলো রাণীর।তারপরও তূর্যয় থামলো না। সে তার গলার স্বর উচুঁ করে বললো,”বেরিয়ে যা, এইখান থেকে এক্ষুনি।”
রাণী আর দাঁড়ালো না।ছলছল চোখে তার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো এই কেবিন থেকে। তূর্যয়ের রাগ যেনো কমছে না।রাণীর সাথে খারাপ ব্যবহার করে তার মেজাজ আরো খারাপ লাগছে।পরক্ষণে সে চিল্লিয়ে বললো,”আমি যেমন খারাপ,আমার ব্যবহারও তেমন খারাপ হবে।আমার মনে দয়ার জন্যে কোনো জায়গা নেই।”

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে